পরামর্শে এনআরএস মেকিড্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ তুফানকান্তি দলুই।
প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ শরীরে উল্কি আঁকাতো। কিছু কিছু উপজাতি আপন গোষ্ঠীকে আলাদা করে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে শরীরে উল্কি খোদাই করাতো। এছাড়া শরীরে আরাধ্য দেবী ও দেবতার আদল খোদাই করাও ছিল নানা উপজাতির প্রথা। মনে করা হয়, পৃথিবীর প্রাচীনতম উল্কিটি খোদাই করা হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩ হাজার ৭০০ বছর আগে!
আধুনিক যুগে বলিউড, টলিউড, হলিউড, সঙ্গীত জগতের শিল্পী কিংবা ক্রীড়া জগতের তারকাদের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে শরীরে ট্যাটু করাতে তাঁরাও কতটা আগ্রহী। তারকাদের প্রভাব তো বটেই, সঙ্গে শখের বশেও অনেকে শরীরে ট্যাটু করাতে আগ্রহী হন। এখন যে প্রশ্নটা বারবার উঠে আসে, তা হল— ট্যাটু করানো কি আদৌ নিরাপদ? ট্যাটু করালে কি শারীরিক সমস্যা হতে পারে? ট্যাটু করলে কি রক্ত দেওয়া যায় না? ইত্যাদি।
গতমাসের প্রথম দিকের একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে সস্তায় ট্যাটু করাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন প্রায় ১৪ জন। এঁদের মধ্যে দু’জন এইডস-এ আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর মিলেছে!
অতএব বোঝাই যাচ্ছে, ট্যাটু করানোর সময় শুধুই আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিলে হবে না। বিপদ সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। কারণ ট্যাটু করানোর মতো নিরীহ কাজ থেকে আপনিও আক্রান্ত হতে পারেন জটিল সংক্রামক অসুখে। বিশেষ করে দেখা গিয়েছে, ট্যাটু করানোর নিডলটি দামি হওয়ার কারণে অনেক স্টুডিওতে সুচ পরিবর্তন করা হয় না। একই সুচ দিয়ে একাধিক ব্যক্তির দেহে ট্যাটু আঁকা হলে রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে জটিল রোগ।
কী কী অসুখ?
রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অসুখের মধ্যে প্রধান তিনটি রোগ হল হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং এইচআইভি।
হেপাটাইটিস বি: এক বিশেষ ধরনের ভাইরাস হল হেপাটাইটিস বি। ক্ষতিকর এই ভাইরাস একবার শরীরে ঢুকলে আক্রমণ করে বসে সরাসরি লিভারকে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগের কারণে হতে পারে লিভার ফেলিওরের সমস্যা। সংক্রামিত ব্যক্তি লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারেন। সমস্যা হল, হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণে প্রাথমিক দিকে কোনও শারীরিক লক্ষণ দেখা যায় না। যখন উপসর্গ দেখা যায়, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে রক্ত, লালা, অসুরক্ষিত শারীরিক সংসর্গ থেকে। এমনকী সন্তানসম্ভবা মায়ের দেহ থেকে ভ্রূণেও ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে।
রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত ব্লেড, টুথব্রাশ, ইঞ্জেকশন কিংবা নিডল ব্যবহার করলেও হতে পারে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ। আবার হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত কোনও সুস্থ ব্যক্তিকে দান করলেও, ওই ব্যক্তির দেহে হেপাটাইটিসের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
উপসর্গ
• অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা।
• বমি বমি ভাব ও পেটে ব্যথা।
• ত্বক ও চোখ হলদে হয়ে যাওয়া ।
• লাল ও গাঢ় হলুদ রঙের প্রস্রাব ।
• জ্বর
• মাথা ব্যথা।
• শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুলকানি।
হেপাটাইটিস সি: এই অসুখও হেপাটাইটিস বি-এর মতোই ছড়ায়। ভাইরাস আক্রমণ করে লিভার। লিভার ফেলিওর, সিরোসিস ও ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। উপসর্গও হেপাটাইটিস বি-এর মতো।
এইচআইভি: হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস এমন এক জীবাণু যা শরীরের প্রবেশ করার পর দেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতার জন্য দায়ী কোষগুলিকে ধ্বংস করতে থারে। এইচআইভি ভাইরাসের প্রভাবে হতে পারে হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস ইনফেকশন অ্যান্ড অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস)। অর্থাৎ একবার এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত হলে ওই ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অসুখ দ্বারা উৎপীড়িত হতে থাকেন। রোগ সারতে চায় না।
এইচআইভি ছড়াতে পারে অসুরক্ষিত শারীরিক সংসর্গ, এইচআইভি ব্যক্তির ব্যবহার করা ইঞ্জেকশন, ট্যাটুর নিডল থেকে। এক্ষেত্রেও সংক্রামিত সন্তানসম্ভবা মা এর দেহ থেকে ভ্রূণেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
মনে রাখবেন—
এইচআইভি ব্যক্তির সঙ্গে বসলে, তাঁকে স্পর্শ করলে, একই টেবিলে খেলে রোগ ছড়ায় না।
উপসর্গ
প্রাথমিকভাবে কোনও লক্ষণ থেকে না। কখনও কখনও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ পরে কিছু অনির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন জ্বর, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা, লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠা ইত্যাদি। মুশকিল হল, এইসব উপসর্গ কোনও চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যেতে পারে। ফলে রোগী এইচআইভি সম্পর্কে সময়ে সচেতন হন না।
রক্তবাহিত অন্যান্য সংক্রমণ
এইচটিএলভি ১ ভাইরাস, সাইটোমেগালো ভাইরাস, ওয়েস্টনাইল ভাইরাস, সার্স, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, সিফিলিস, ক্রুজফিল্ড জ্যাকব, ইত্যাদি রোগ ছড়াতে পারে রক্তের মাধ্যমে।
ট্যাটু করার পরে সাধারণ নিয়ম
শরীরে উল্কি আঁকানোর দিন থেকে পরবর্তী ছ’মাস কোনওভাবেই রক্তদান করা যাবে না। কারণ, এইচআইভি-এর সংক্রমণ হওয়ার পরে মানব দেহে ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ৬০ থেকে ৭০ দিন অবধিও হতে পারে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড হল ৬ সপ্তাহ। অন্যদিকে হেপাটাইটিস সি-এর মতো মারাত্মক ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ডই হল প্রায় ছ’মাস।
ইনকিউবেশন পিরিয়ড কী?
সংক্রমণের পর ভাইরাস যে সময়ের মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে সেই সময়কে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড। সুতরাং ছয় মাসের মধ্যে কোনওভাবে একজন ব্যক্তি এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, কিংবা হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এবং ওই সময়ের মধ্যে রক্তপরীক্ষা করালেও রিপোর্ট নেগেটিভ আসতে পারে। ফলে ট্যাটু করানোর ছয় মাসের মধ্যে কোনও ব্যক্তি রক্তদান করলে তাঁর রক্ত দ্বারা অন্য সুস্থ ব্যক্তি কঠিন অসুখে সংক্রামিত হওয়ার ভয়ও থেকে যায়! তাই এমন নিয়ম।
ট্যাটু এবং অন্যান্য জটিলতা—
• ট্যাটু সেন্টারে কোনও ব্যক্তি কবে ট্যাটু করিয়েছেন সেই বিষয়ে কোনও শংসাপত্র সাধারণত দেওয়া হয় না। ফলে একজন ট্যাটুধারী রক্তদানে ইচ্ছুক ব্যক্তি কবে ট্যাটু করিয়েছেন, সেই বিষয়ে বিভ্রান্তি থেকেই যায়। এই জন্যই ট্যাটু থাকলে বহু রক্তদান শিবিরে ওই ব্যক্তির রক্ত নেওয়া হয় না। অবশ্য অনেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ট্যাটু করানোর ছবি তুলে রাখেন। ওই ছবি থেকে জানা সম্ভব যে ওই ব্যক্তি কবে ট্যাটু করিয়েছেন। সমস্যা হল ট্যাটুধারী কোনও ব্যক্তির কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন না থাকলে তিনি বাকিদের কীভাবে বোঝাবেন যে শরীরে আঁকা ট্যাটুর বয়স আসলে ছ’মাস পেরিয়ে গিয়েছে!
• অনেকেই প্রশ্ন করেন কোনও যুবক যা যুবতী ত্বকে ট্যাটু করানোর পরে কি বাবা-মা বা ভাইবোনকে রক্ত দিতে পারে? এক্ষেত্রে প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার, অতি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বাধ্য না হলে কোনও ব্যক্তি তাঁর বাবা, মা, ভাই, দাদা, বোন ও সন্তানকে রক্ত দিতে পারবেন না। তাঁদের কাছে রক্ত নিতেও পারেন না। এই ধরনের আত্মীয়দের বলে ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ। এমন নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ করলে শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই ট্যাটু করানো থাক বা নাই থাক, ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেশনে রক্ত দান বা গ্রহণ এড়িয়ে চলুন।
শেষ কথা—
ট্যাটু থাকলেও রক্ত দেওয়া যায়। তবে ট্যাটু করানোর পর প্রথম ছ’মাস রক্ত না দেওয়াই উচিত। আরও ভালো হয়, যদি ট্যাটু করানোর ছ’মাস পরে রক্তে কোনও সংক্রমণ ঘটেছে কি না তা নির্ণয় করিয়ে তারপর একজন ব্যক্তি রক্তদান করেন।
লিখেছেন: সুপ্রিয় নায়েক