বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
শরীর ও স্বাস্থ্য
 

সভ্যতার নতুন সংকট
 জু নো সি স

লিখেছেন  বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ  ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

 শুরুর কথা: জার্মানির ওবেরক্যাসেল-এর সমাধিস্থল
জার্মানির ওবেরক্যাসেল শহরে একটি সমাধিস্থল পাওয়া গিয়েছে, যেখানে একই সমাধিতে একাধিক মানুষ ও কুকুরের দেহাবশেষ রাখা রয়েছে। এই প্রত্নসমাধিস্থলটি প্রায় ১৪ হাজার বছরের পুরনো। এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে মানুষ এবং পশুর ব্যবহারিক এবং মানসিক সংযোগের ইতিহাস বহু পুরনো। পশুরা মানুষের রক্ষী, বন্ধু, খাদ্য উৎপাদনের সহায় এবং দেহাচ্ছাদনের উৎস হিসেবে অপরিহার্য স্থান অধিকার করে রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। তবে এইসব উপকারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভয়ঙ্কর সংক্রামক অসুখও পশু-পাখি থেকে মানুষে প্রবেশ করেছে। এইসব অসুখকেই বলা হয় জুনোসিস। বাংলায় বলা হয় পশুমারী।  
 জুনোসিস বা পশুমারী: আমরা জানি যে সংক্রামক অসুখ নানা জীবাণু থেকে হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া বা ফাঙ্গাস হল এইসব অদৃশ্য শত্রুর নানা প্রজাতি। বাতাস, জল বা খাবারের মাধ্যমে বা অন্য মানুষ থেকে এক বা একাধিক জীবাণু আমাদের আক্রমণ করে। ঠিক সেইরকম অনেক পশু থেকেও এইসব অদৃশ্য জীবাণু নিঃশব্দে প্রবেশ করে মানবদেহে। প্রবেশ করার পথ অনেক। পশুর মাংস থেকে, পশম থেকে বা শুধুমাত্র পশু-পাখির নৈকট্য থেকেই জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। যেমন পোষা পাখি ঘরে থাকলে তার থেকে হতে পারে সিটাকোসিস নামে এক ধরনের নিউমোনিয়া। অনেক সময়ে একটি পশু থেকে একটি মানুষে জীবাণু প্রবেশ করেই থেমে যায়। সেই রোগী আক্রান্ত হলেও তাঁর থেকে দ্বিতীয় কারও সংক্রমণের আশঙ্কা প্রায় শূন্য। ফলে সেই রোগীর প্রাণসংশয় হলেও মহামারীর আশঙ্কা খুব কম। যেমন র‌্যাবিস। আবার অনেক সময়ে একবার মানুষের শরীরে প্রবেশের পর সেই জীবাণু খুব দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে সৃষ্টি করে মহামারী। এর চরম উদাহরণ আজকের করোনা বা এইচআইভি।
  ফিরে দেখা—প্লেগ: শুধুমাত্র যদি গত একশো বছরের ইতিহাস দেখা যায়, তাহলেই দেখব যে বার বার নানা জুনোসিস আমাদের জন্য বিপদের সঙ্কেত নিয়ে এসেছে। প্রথমেই যার কথা বলা উচিত, সেটি হল প্লেগ। বার বার পৃথিবীর ইতিহাসে বিপর্যয়ের দূত হয়ে এসেছে এই রোগ। মূষিক জাতীয় প্রাণী থেকে এই রোগ ছড়ায় মানুষের মধ্যে। সাধারণভাবে শুধু ইঁদুরকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হলেও, ইঁদুর ছাড়া কিছু গোত্রের কাঠবিড়ালি বা খরগোশের মধ্যেও এই জীবাণু থাকতে পারে। প্লেগ বহু নগর-জনপদ ধ্বংস করেছে ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে। লাটভিয়াতে ৫ হাজার বছর আগের এক নরকঙ্কালের মধ্যে প্লেগের জীবাণুর ডিএনএ পাওয়া গিয়েছে। অনেকে মনে করেন যে প্লেগের কারণেই একসময়ে এই পূর্ব ইউরোপে নিওলিথিক যুগ শেষ হয়েছিল। আবার আজকের কিরগিজস্থানে, ১৩৩৮ সালের এক সমাধি থেকে সম্প্রতি নরকঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেও পাওয়া গিয়েছে প্লেগের জীবাণু। সেই প্রথম যুগের খ্রিস্টান সমাধির উপর লেখা রয়েছে, এই মানুষদের মৃত্যু হয়েছিল মহামারীতে। সেই মধ্য এশিয়ার তৃণভূমিতে হাহাকার ফেলে এই জুনোসিস এরপর পাড়ি দিয়েছিল ইউরোপে। তারপরের তিন শতাব্দী ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথের যুগ। আর স্মরণকালের মধ্যে ১৮৯৬ সালে শুরু হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার প্লেগের মহামারী তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের সেই সমাজে ভালমতো ছাপ রেখে গিয়েছে। 
 ইরাকের সেই সমৃদ্ধ শহরের কথা: প্রথম পরিচ্ছেদ যে ঘটনা নিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই মানুষ-কুকুরের নৈকট্যের কথায় এবার আসি। কুকুরের কামড়ে হতে পারে র‌্যাবিস অসুখ। এই ব্যাপারটি কিন্তু সভ্যতার একদম প্রথম যুগ থেকেই মানুষের নজরে এসেছিল। যেমন খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দু’হাজার শতাব্দীতে আজকের ইরাকে ছিল এক সমৃদ্ধ শহর, এশনুনা। সেই শহরের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত কিউনিফরম লিপিতে লেখা আছে যে কারও পোষা কুকুরের যদি অসুখ হয়, তাঁর মালিককেই কুকুরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যদি কুকুরের কামড়ে কোনও নাগরিক মারা যায়, তাহলে সেই কুকুরের মালিককে জরিমানা দিতে হবে, জরিমানার পরিমাণ ৪০ শেকেল! তার মানে, পশু থেকে যে মানুষে অসুখ ছড়ায়, সেই জ্ঞান চার হাজার বছর আগেও ছিল। হিন্দুদের মৃত্যুদেবতা, যমের বাহন যেমন কুকুর, তেমন প্রাচীন ব্যাবিলনের মৃত্যুদেবী গুলার সঙ্গীও ছিল কুকুর। কুকুর থেকে যে প্রাণঘাতী অসুখ হয়, সেই বোধ থেকেই হয়তো মৃত্যুর দেবদেবীর সঙ্গী করা হয়েছিল কুকুরকে। এখন আমরা জানি যে শুধু কুকুর নয়, যে কোনও প্রাণীর কামড় বা আঁচড়েই ছড়াতে পারে র‌্যাবিস বা জলাতঙ্ক। 
 এক সংক্রামক প্রোটিনের কথা: এবার একটু আধুনিক যুগের কথায় আসি। নয়ের দশকের শুরুতেই ব্রিটেনে শুরু হয় এক গণহিস্টিরিয়া। ম্যাড কাউ ডিজিজ। হঠাৎ করেই রটে যায়, ব্রিটিশ গবাদি পশুর মাংসে নাকি আছে এক সংক্রামক প্রোটিন। আর সেটি পেটে গেলেই আস্তে আস্তে মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়ে মৃত্যু অনিবার্য। এই গুজবের ৯৯ শতাংশই ছিল ভিত্তিহীন। কিন্তু এই ‘প্রায়ন ডিজিজ’ যে একটি জুনোসিস সেটি অনস্বীকার্য। এর আগে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির কথা বললাম। প্রায়ন সেরকম আরেকটি জীবাণুর নাম। এটি হল সংক্রামক প্রোটিন। তবে এই অসুখ অত্যন্ত বিরল। দশ লাখে একটা হয় কিনা সন্দেহ। 
ইউরোপিয়ান কলোনাইজেশান পৃথিবীর বহু ক্ষতি করেছে। এশিয়া, আফ্রিকা জুড়ে পরিবেশ ধ্বংস করেছে। দেশ বা জাতি ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু এই উপনিবেশের অর্থনীতির অন্যতম সুদূরপ্রসারী ফল হল নানা অসুখের উৎপত্তি। এবং এর মধ্যে অনেক অসুখই জুনোসিস। 
 প্রাণীশিকার ও জুনোসিস: এইচআইভি এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের যে প্রতিযোগিতা, তার ফলশ্রুতিতেই শুরু হয় জঙ্গল ধ্বংস। 
আফ্রিকার হাজার হাজার বছরের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থা ধ্বংস করে চালু হয় রবার চাষ। ফলে পেটের তাড়নায় আফ্রিকার মানুষ বাধ্য হন জঙ্গলের প্রাণী শিকার করতে। একে বলা হতো বুশমিট। সেই বুশমিট শিকারের সময়েই কোন একটি আহত শিম্পাঞ্জি থেকে একটি ভাইরাস কোনও একজন মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। তারপর বেলজিয়ামের নারকীয় শাসনের হাত ধরে সেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে কঙ্গোয়। আর তারপর আটের দশকে আমেরিকায় হঠাৎ এইডস এর বিস্ফোরণ। এর মানে হল, জুনোসিস যতটা বিজ্ঞানের চর্চার বিষয়, ততটাই উপনিবেশের ইতিহাসের চর্চার বিষয়।
 ৬ জুলাইয়ের তাৎপর্য: তবে জুনোসিসের সবটাই নিরাশার ইতিহাস নয়। বরং যত নতুন অসুখ এসেছে, মানুষ ততই তার মোকাবিলা করেছে সফলভাবে। 
র‌্যাবিস অসুখটির কথা জানা ছিল চার হাজার বছর ধরে। অবশেষে ১৮৮৫ সালে ফ্রান্সের লুই পাস্তুরের টিকা আবিষ্কার এবং সফল প্রয়োগ একসঙ্গে শুরু করেন। সেই দিনটি ছিল ৬ জুলাই। তাই এখন সারা পৃথিবীতে ৬ জুলাই ‘বিশ্ব জুনোসিস দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। যতই আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে, ততই কিন্তু লাসা ফিভার বা নিপা ভাইরাসের মত নতুন জুনোসিস আবিষ্কার হচ্ছে। অতএব নতুন অসুখে আক্রান্ত হতে না চাইলে প্রকৃতিকে রক্ষা করা দিকে আশু নজর দিতেই হবে।
 কোভিডও কি জুনোসিস? 
ধারণা করা হয় চীনের উহানের ‘ওয়েট মার্কেট’ (যে বাজারে তাজা মাংস, মাছ বিক্রি করা হয়)-এ বিক্রি হওয়া কোনও বন্য প্রাণী বা বাদুড়জাতীয় প্রাণী থেকেই এই করোনা ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করেছে। অবশ্য এই বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি।

7th     July,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ