বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
শরীর ও স্বাস্থ্য
 

সিজারিয়ান বনাম নর্মাল ডেলিভারি

তুমুল বিতর্ক চলছে সিজারিয়ান বনাম নর্মাল ডেলিভারি নিয়ে। উত্তরোত্তর সিজারিয়ান প্রসব বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি অডিটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। কোন পদ্ধতি সেরা, স্বাস্থ্যকর বিতর্কে অংশ নিলেন দুই প্রতিথযশা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।

নর্মাল ডেলিভারিই সেরা উপায়
বিনা অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম দেওয়াই উন্নত পদ্ধতি। জানালেন টালিগঞ্জের রামকৃষ্ণ সারদা মিশন মাতৃভবনের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ প্রসেনজিৎ সরকার।
 
ছুরি-কাঁচির দুনিয়ায় না গিয়েও সুষ্ঠুভাবে সুন্দরভাবে শিশুর জন্ম দেওয়াই যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান একেই ‘নর্মাল ডেলিভারি’ বলে। বিদেশে কিন্তু এই পদ্ধতিই জনপ্রিয়। বরং খুব প্রয়োজন না পড়লে সেখানে অস্ত্রোপচার করা হয় না। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। এর জন্য প্রসূতির পরিবার, প্রসূতি নিজে ও কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকও দায়ী। প্রসূতি ও তাঁর পরিবার এই পদ্ধতিতে হওয়া বেদনা ও ব্যথাকে ভয় পান। মনের জোরের অভাবে নর্মাল পদ্ধতিতে শিশু জন্ম দেওয়ার ধকল সইতে পারবেন না বলে ভেবে বসেন। এক শ্রেণির চিকিৎসকও কিন্তু তাঁকে সেই মনস্তত্ত্ব থেকে বেরতে খুব একটা সাহায্য করেন না। ‘পেশেন্ট এডুকেশন’ তাই আমাদের দেশে খুব দরকারি। সকলে কি ইচ্ছে করলেই নর্মালভাবে শিশুর জন্ম দিতে পারেন? তা কিন্তু নয়। সিজার করতেই হবে, এমন কিছু ক্ষেত্রও থেকে যায়। তখন নর্মাল উপায়ে শিশুর জন্ম দেওয়ানোর ঝুঁকি আমরা নিই না।

কেন বাছবেন নর্মাল ডেলিভারি?
এই ধরনের প্রসবের কয়েকটি মারাত্মক সুবিধা আছে। 
১. অপারেশনের ঝুঁকি থাকে না। ২.অ্যানেসথেসিয়াজনিত ভয় থাকে না। ৩. অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে নানা আনুষঙ্গিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। যেমন, সেলাইয়ের নানা সমস্যা, সেপটিক হয়ে যাওয়া, সংক্রমণের ভয় ইত্যাদি। এসব পোহাতে হয় না। ৪. শিশুর জন্ম দেওয়ার পর থেকেই মা অনেক বেশি সক্রিয় থাকেন। সদ্যোজাতকে স্তন্যপান ও তার বেশিরভাগ যত্ন নিজেই নিতে পারেন। ৫. নর্মাল ডেলিভারিতে শিশুকে যথেষ্ট লড়াই করে বেরতে হয়। মা ও শিশু উভয়ের যৌথ প্রয়াস থাকে। বার্থ প্যাসেজ দিয়ে বেরনোর সময় শিশুর চেস্ট এক্সপ্যানশন হয়। অর্থাৎ তার লাং ও হার্ট প্রসারিত হয়ে তাকে বেরনোর দমটুকু জোগায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সিজারিয়ান শিশুর তুলনায় নর্মাল ডেলিভারির শিশুর শ্বসনযন্ত্রের ক্রিয়া অনেক উন্নত হয়। ৬. সিজারিয়ান বেবির ক্ষেত্রে মায়ের স্পাইনাল অ্যানাস্থেশিয়া হলে শিরদাঁড়ায় ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এই ইঞ্জেকশন কিন্তু মায়ের কোমরে একটি চিরকালীন ব্যথার জন্ম দেয়। আজীবন জ্বালায়। ফুল অ্যানেস্থেশিয়া হলে অবশ্য এই ইঞ্জেকশন লাগে না। 
চিকিৎসকের উচিত কাউকে স্পাইনাল অ্যানাস্থেশিয়া করার আগে এই বিষয়গুলি প্রসূতিকে বলে, বুঝিয়ে অনুমতি নিয়ে তবেই এই পথে যাওয়া। অনেক মা-ই শিশুর জন্মের সাক্ষী থাকবেন বলে, তাকে প্রথম দেখবেন, ধরবেন ও দ্রুত স্তন্যপান করাবেন বলে স্পাইনাল অ্যানাস্থেশিয়া বাছেন। অনেকে পুরোপুরি অজ্ঞান হতে ভয়ও পান। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রসূতিকে এই কোমরের ব্যথার বিষয়টি না জানিয়েই স্পাইনাল অ্যানাসথেসিয়া করা হয়। নর্মাল ডেলিভারিতে এইসব জটিলতা থাকে না। 
পাশাপাশি সাধারণ উপায়ে জন্ম দেওয়ার সময় প্রসূতির পরিজন ও চিকিৎসকদের কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। যেমন—
• বিনা অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম দেওয়ার চেষ্টার সময় নানা অসুবিধা আসতে পারে। প্রসূতি ও শিশুর প্রয়োজন অনুসারে যাতে জরুরিভিত্তিক অপারেশন থিয়েটারে স্থানান্তরিত করা যায়, এমন পরিবেশে নর্মাল ডেলিভারি করা উচিত। 
• নর্মাল পদ্ধতিতে শিশুর জন্ম দিতে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত শিশুর স্বাস্থ্য ও শরীরের খেয়াল রাখতে হয়। এই মনিটরিং খুব দরকার। শিশুর হৃদস্পন্দনের হার ঠিক আছে কি না, অন্য কোনও সমস্যা আছে কি না, এগুলি খতিয়ে দেখতে হবে। দরকারে সিপিটি মেশিন দিয়ে বাচ্চার ইসিজি করতে হবে। 

ফরসেপের ভয় কতটা
নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ লোকজনই ভয় পান, পাছে ফরসেপ করতে হয়। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, অভিজ্ঞ নার্স, চিকিৎসক ও স্বাস্থকর্মী থাকলে ফরসেপের ভয় থাকে না। শিশুর মাথা যখন যোনিপথ দিয়ে পুরোটা বেরতে পারে না, কিছুটা বেরিয়ে আটকে থাকে, তখন এই ফরসেপ ব্যবহার করে তার মাথাটা টেনে এনে তাকে বাইরে বেরতে সাহায্য করা হয়। প্রাথমিকভাবে ইউটেরাস শক্ত হয়ে গিয়ে শিশুকে ঠেলে নীচের দিকে নামায়। তারপর কিন্তু মাকেই চাপ দিয়ে শিশুকে বের করে আনতে হয়। শিশুকেও সেই চাপের প্রাবল্য সহ্য করতে হয়। মা বা শিশু কেউ একজন দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়লেই, এই পদ্ধতির ব্যাঘাত ঘটে। অনেক সময় বার্থ প্যাসেজের আকার ছোট বা বাঁকা থাকলে শিশু বেরতে পারে না। ফলে ফরসেপ ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে আমাদের রাজ্যে হাই-ফরসেপ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ অনেক ভিতর থেকে শিশুকে টেনে বের করা যাবে না। খুব কাছাকাছি এলে তবেই লো ফরসেপ করা হয়। এতে ঝুঁকি একেবারেই নেই।

শেষ কথা
জরুরি কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, গর্ভাবস্থায় কিছু শরীরচর্চা ও নিজের প্রেশার-সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখলে এবং শিশুর জটিলতা না থাকলে নর্মাল ডেলিভারির দিকেই এগনো উচিত। এটাই সর্বোত্তম পদ্ধতি। ও হ্যাঁ, পাশাপাশি দরকার হবু মায়ের মনের জোরও। 
লিখেছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়
আজকের বাস্তবতায় সিজারই ‘বেস্ট’
 
পরামর্শে বেঙ্গল ইনফার্টিলিটি অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ থেরাপি হসপিটালের কর্ণধার ডাঃ গৌতম খাস্তগীর।

পার্থক্য 
ক. সিজারিয়ান ডেলিভারি সাধারণত পরিকল্পনা করেই করা হয়। অথবা গর্ভাবস্থা চলাকালীন সময়ে হঠাৎ করে কোনও বিপদ ঘটে গেলে করা হয় সিজারিয়ান ডেলিভারি।
নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে প্রসূতির প্রসব বেদনা উঠলে তাকে লেবার রুমে রাখা হয়। সেখানে উপস্থিত থাকেন গাইনিকোলজিস্ট, নার্স। 
সি সেকশন বা সিজারিয়ান ডেলিভারিতে পেট কেটে শিশুর প্রসব হয়। নর্মাল ডেলিভারি হয় সন্তানসম্ভবার লেবার পেইন উঠলে। 
খ. সিজারিয়ান ডেলিভারি পরিকল্পনা করে করা হয়। বাচ্চার জন্মের সময় নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় না। 
নর্মাল ডেলিভারিতে একধরনের অনিশ্চয়তা থাকে। বাচ্চা কখন ভূমিষ্ঠ হবে সেই সম্পর্কে চিকিৎসক আগে থেকে কিছুই জানাতে পারেন না। ব্যথা ওঠার ১০ ঘণ্টা পরেও জন্ম হতে পারে, আবার ১২ ঘণ্টা পরও জন্ম হতে পারে। এমনকী ২৪ ঘণ্টা পরেও বাচ্চার জন্ম অসম্ভব নয়। এককথায়, নর্মাল ডেলিভারিতে সন্তানের জন্মের সময়টি চিকিৎসকের হাতে নেই।
গ. সিজারিয়ান করা হয় শিরদাঁড়ায় অ্যানাস্থেশিয়া প্রয়োগ করে। ফলে সি সেকশন করার সময় সন্তানসম্ভবার সেভাবে ব্যথা-যন্ত্রণার অনুভূতি থাকে না। নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবাকে ব্যথা সহ্য করতে হয়।

নিরাপদ কোনটি?
অনেকে প্রশ্ন করেন, সিজারিয়ান নাকি নর্মাল ডেলিভারি— কোন পদ্ধতিটি বেশি নিরাপদ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, উন্নত প্রযুক্তির হাত ধরে নিরাপদ দু’টি পদ্ধতিই। তবু সিজারিয়ান নিয়ে অনেকের মনে দ্বিধা কাজ করে। একটা উদাহরণ দিলেই দ্বন্দ্ব কেটে যাবে। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে চিকিৎসকদের মধ্যে একটা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। স্টাডি অনুসারে— প্রতি ১০০ পুরুষ চিকিৎসককে যদি প্রশ্ন করা হয় যে তাঁর স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর কীভাবে তাঁর বেবির ডেলিভারি হয়েছিল, তাহলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই উত্তর দেবেন ‘সিজারিয়ান পদ্ধতিতে’। অতএব চিকিৎসকরা নিশ্চয় বোকা নন যে পরিজনকে বিপদসঙ্কুল কোনও চিকিৎসা পরিষেবার হাতে সঁপে দেবেন! 
একটা কথা বুঝতে হবে, আগে চিকিৎসা পরিষেবা এত উন্নত ছিল না। ফলে আগে সিজার করালে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা এড়ানো যেত না। এছাড়া ক্ষতস্থানে সেলাই দেওয়ার জন্য যে সুতো ব্যবহার করা হতো তাও ছিল অনুন্নত। সুতো থেকেও নানা বিপত্তি হতো। সন্তানসম্ভবার মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাতের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যেত না। তবে এখন চিকিৎসকদের হাতে রয়েছে উন্নত অ্যান্টিবায়োটিক। যে সুতো ব্যবহার করা হচ্ছে তাও সর্বাধুনিক। সেলাই জুড়েও যাচ্ছে চমৎকার। এছাড়া উন্নততর রক্তসঞ্চালনের ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে প্রাণহানি বা অন্য বিপদের আশঙ্কা যথাসম্ভব কমে গিয়েছে। এই কারণে গত ৩০ থেকে ৪০ বছরে বেশিরভাগ মানুষ ঝুঁকছেন সিজারিয়ান ডেলিভারির দিকে।

নিশ্চয়তা এবং সিজার
আধুনিক যুগে সময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। পরিকল্পনা করে সিজার করা যায়। ফলে প্রসূতির আত্মীয়রা আগে থেকেই জানতে পারেন, আগামী অমুক তারিখে সকাল ৮টা থেকে ৯টা নাগাদ সন্তানের জন্ম হবে। তাঁরা মানসিকভাবে তৈরি থাকেন। এছাড়া পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হওয়ায় সেই সময়ে চিকিৎসক, নার্স ওটি স্টাফ হাজির থাকেন। নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে ভোর বেলা বা রাত ২টোর সময়ে ডেলিভারি হলে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীকে পড়িমড়ি করে হাসপাতালে ছুটে আসতে হয়। ব্যবস্থা করতে হয়।
তাছাড়া আমাদের দেশে জনসংখ্যার চাপও যথেষ্ট বেশি। একটি হাসপাতালে সিজারিয়ান ডেলিভারি করাতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা। নর্মাল ডেলিভারিতে সেখানে ১৮-২০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে এই দীর্ঘ সময়ে কোনও চিকিৎসাকর্মীর পক্ষেই সেখানে একটানা সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ তাঁদের অন্য প্রসূতিকেও পরিষেবা দিতে হয়। ফলে একইসঙ্গে একাধিক সন্তানসম্ভবার শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে সব জায়গাতেই চিকিৎসক ও নার্সের অভাব তৈরি হতে পারে। ঘটতে পারে অঘটন। সেদিক থেকে বিচার করলে সিজারিয়ান ডেলিভারিতে চিকিৎসক বা নার্সের উপস্থিতির অভাব বোধ হয় না, কারণ আগে থেকেই সমস্ত পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হয়। 

বিদেশ-স্বদেশ
আমাদের দেশে লোকসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা কম। বিদেশে লোকসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি। ফলে সন্তানসম্ভবার নর্মাল ডেলিভারি করানোর সময়কালে চিকিৎসাকর্মী, নার্স ও চিকিৎসক তাঁর পাশে থাকতে পারেন। অতএব যেখানে যেমন পরিস্থিতি সেভাবেই কাজ করতে হবে। তাই সিজারিয়ানও থাকুক, নর্মাল ডেলিভারিও থাকুক। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াই সঙ্গত। কারণ বাচ্চার অবস্থান ঘুরে গেলে তখন সিজারিয়ান ছাড়া গতি থাকে না। 
সর্বোচ্চ কত বার সিজারিয়ান?
আগে মনে করা হতো সর্বোচ্চ ৩ বারের বেশি সিজারিয়ান করা যায় না। তবে একই মহিলার ৫ বার সিজার করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বস্তুতঃ বিষয়টি নির্ভর করে প্রসূতির শারীরিক অবস্থা, চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির উপর। তবে বারবার আঘাত পেলে ইউটেরাস খানিকটা হলেও দুর্বল হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে একাধিকবার সিজার করার ক্ষেত্রে আলাদা সতর্কতা নিতেই হয়।
লিখেছেন সুপ্রিয় নায়েক

5th     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ