বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
শরীর ও স্বাস্থ্য
 

 পেট ব্যথা কখন বিপজ্জনক?

লিখেছেন পিয়ারলেস হাসপাতাল এবং বি কে রায় রিসার্চ সেন্টারের গ্যাস্ট্রোসার্জেন ডাঃ রুদ্রকৃষ্ণ মৈত্র।  

অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের মাঝে মধ্যেই পেটে ব্যথা হয়। তৎক্ষণাৎ তাঁরা একটা অ্যান্টাসিড বা গ্যাসের ওষুধ খেয়ে নেন। কিছুক্ষণ পরে হয়তো ব্যথাও কমে। তাই পেট ব্যথাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না কেউ! অভ্যেসমতো ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমার অপেক্ষা করেন। আর অপেক্ষা করতে গিয়েই যত গণ্ডগোল করে ফেলেন তাঁরা। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বেশ কয়েকজন রোগীকে দেখেছি, যাঁরা ৩ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত মারাত্মক পেট ব্যথা সহ্য করে তারপর হাসপাতালে ঢুকেছেন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। এমনকী কারও কারও মধ্যে ওষুধের দোকানে গিয়ে একটা ইঞ্জেকশন নিয়ে ব্যথা কমানোর মতো বিপজ্জনক প্রবণতাও দেখা যায়। মনে রাখবেন, অসুখ লুকোলে শেষে রোগীকেই ভুগতে হয়। 
অতএব কোন ধরনের পেট ব্যথা বিপজ্জনক তা আগেভাগে চিনতে হবে। সঙ্গে নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শও। দেখা যাক বিপদসূচক ব্যথার লক্ষণ কোনগুলি—
 সাধারণ ব্যথা কমার ও গ্যাস-অম্বলের ওষুধ খেয়েও এক ঘণ্টা পরে ব্যথা না কমলে  পেটের ব্যথা কমানোর ইঞ্জেকশন নিতে হলে  ২৪ ঘণ্টা পেরনোর পরও ব্যথা থেকে গেলে  পেটে ব্যথা হচ্ছে ও নড়াচড়া করলেই ব্যথা বাড়লে।

কেন হয় পেট ব্যথা?
পেট বা অ্যাবডোমেনকে ডান, বাম, ওপর, নীচ এই চারভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হল মূলভাগ। আরও কিছু উপভাগ রয়েছে। যেমন— ডানদিকের পেটের ওপরের অংশকে বলে রাইট আপার কোয়াড্রেন্ট। নীচের অংশকে  বলে রাইট লোয়ার কোয়াড্রেন্ট। আবার বামদিকের ওপর অংশকে লেফট আপার কোয়াড্রেন্ট ও নীচের অংশকে লেফট লোয়ার কোয়াড্রেন্ট বলে।

রাইট আপার কোয়াড্রেন্ট
এই অংশে ব্যথা সাধারণত গলস্টোন বা পিত্তথলির পাথর বা গলব্লাডারজনিত সমস্যাকে নির্দেশ করে। লিভারে সংক্রমণের কারণেও পেটের এই অংশে উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে। আবার লিভার থেকে যে নালিকা বেরিয়ে আসে, সেই টিউবে পাথর আটকে গিয়ে জন্ডিস সহ পেটব্যথা শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গলস্টোনের আগাম লক্ষণ থাকে না। অন্য অসুখের কারণে আলট্রাসাউন্ড করানোর সময় কাকতালীয়ভাবে রোগীর গলস্টোন ধরা পড়েছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। 
 গলস্টোনের প্রকৃতি সাধারণত তিন ধরনের হয়— ১. উপসর্গহীন স্টোন। অর্থাৎ গলব্লাডারে স্টোন বসে আছে, তবে কোনও শারীরিক সমস্যা তৈরি করছে না। ২. গলস্টোন আছে ও মাঝে মধ্যে পিত্তথলির মুখে আটকে যাচ্ছে। রোগীর কয়েক দিন অন্তর অল্পস্বল্প পেট ব্যথা হচ্ছে। ৩. জটিল গলস্টোন। এক্ষেত্রে গলস্টোন আটকে যায় বাইল ডাক্ট বা পিত্তনালীতে (পিত্তথলি থেকে যে নালীর মাধ্যমে পাকস্থলীতে পিত্তরস যায়)। রোগীর পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। জন্ডিসের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলাঞ্জিওপ্যাংক্রিয়েটোগ্রাফি (ইআরসিপি) করতে পারেন।
জটিল গলস্টোনের আরও একটি লক্ষণ হল প্যাংক্রিয়াটাইটিস। 
 দেখা গিয়েছে প্যাংক্রিয়াটাইটিস হয় দু’টি কারণে। প্রথমত গলস্টোনের কারণে। দ্বিতীয়ত অত্যধিক মদ্যপানের কারণে। এখন কোনও ব্যক্তির প্যাংক্রিয়াটাইটিস হয়েছে তা কীভাবে বোঝা যাবে? প্যাংক্রিয়াটাইটিসের প্রধান লক্ষণ হল এপিগ্যাসট্রিক পেইন (পেটের উপরের অংশে ব্যথা)। রোগীর এতটাই ব্যথা হয় যে তাঁর মনে হয় পেটের সামনে থেকে পিছন পর্যন্ত যেন কিছু একটা ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। এছাড়া রোগীর বারবার বমি হওয়ার মতো লক্ষণও থাকে।
 প্যাংক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত রোগীর ৫ জনের মধ্যে ১ জনের সিভিয়র অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিস হয়। এতে প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা দূর করা যায় না। তাই, প্যাংক্রিয়াটাইটিস হলে রোগীর উচিত কোনও মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো। কারণ, ফ্লুইড এবং ব্যথার ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সাধারণ ধরনের প্যাংক্রিয়াটাইটিস। তবে সিভিয়ার প্যাংক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে বহু রকমের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় যা উপযুক্ত হাসপাতাল ছাড়া করা অসম্ভব। উদাহরণ হিসেবে এন্ডোস্কোপিক ড্রেনেজ, সিটি স্ক্যান ড্রেনেজ-এর কথা বলা যায়। দরকারে অপারেশন করাতেও হতে পারে। 
 প্যাংক্রিয়াস সার্জারির জন্য কিন্তু বিশেষজ্ঞ প্যাংক্রিয়াটিক সার্জেন-এর প্রয়োজন। কারণ এই সার্জারি সকলে করতে পারেন না। আর হ্যাঁ, গলস্টোনের কারণে প্যাংক্রিয়াটাইটিস হয়ে থাকলে অবশ্যই গলস্টোন অপারেশন করতে হবে। তবে গলস্টোনের সার্জারি হবে প্যাংক্রিয়াটাইটিস-এর সমস্যা দূর হওয়ার পরেই। অন্যদিকে মদ্যপানজনিত কারণে প্যাংক্রিয়াটাইটিস হলে অবশ্যই মদ্যপান ছাড়তে হবে।
 গলস্টোন জটিল আকার ধারণ করার নেপথ্যে গলব্লাডার সংক্রমণও বা কোলেসিস্টাইটিস কিন্তু অন্যতম প্রধান কারণ। কোলেসিস্টাইটিস হলে রাইট আপার কোয়াড্রান্ট-এ একটানা যন্ত্রণা হয়। সঙ্গে থাকে জ্বরের উপসর্গ। প্রশ্ন হল কোন ক্ষেত্রে গলস্টোন অপারেশন লাগবে আর কোন ক্ষেত্রে অপেক্ষা করা যাবে? এক্ষেত্রে বলা যায়, রোগী জটিল ধরনের গলস্টোনের সমস্যায় আক্রান্ত হলে দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি মাঝে মধ্যে সমস্যায় ভুগছেন, তাঁর ক্ষেত্রে গলস্টোনের সার্জারি না করালে তা জটিল ধরনের গলস্টোনে রূপান্তরিত হওয়ার ২০ শতাংশ আশঙ্কা থাকে। অতএব উপসর্গযুক্ত গলস্টোনের সমস্যায় হাতে সময় থাকতে সার্জারি করে নেওয়াই ভালো। 
 এখন প্রশ্ন, লক্ষণহীন গলস্টোনে রোগীরা কী করবেন? শতকরা হিসেবে বলা যায়, প্রতি ১০০ জন উপসর্গহীন গলস্টোনে আক্রান্তের মধ্যে ৭০ জনের সমস্যা দেখা দেয় না। তবে বাকি ৩০ জনের কোনও না কোনও সময় জটিলতা দেখা দিতে পারে। মুশকিল হল, উপসর্গহীন গলস্টোন কখন উপসর্গ নিয়ে প্রকাশ পাবে তা আগে থেকে বলা যায় না। উপসর্গহীন গলস্টোন নিয়ে দুর্গম এলাকায় বেড়াতে যাওয়ার পর পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হলে তাঁকে সুপারস্পেশালিটি হসপিটালে নিয়ে দৌড়ানো সম্ভব নাও হতে পারে। তাই উপসর্গহীন গলস্টোন থাকলে পরিকল্পনা করে একসময় অপারেশন করে ফেলাই ভালো। সার্জারি নিয়ে অযথা আতঙ্কে ভোগার প্রয়োজন নেই। ১০০০ টি অপারেশনের মধ্যে বড়জোর ১টি ক্ষেত্রে জটিলতার আশঙ্কা থাকে। 

রাইট লোয়ার কোয়াড্রেন্ট
পেটের এই অংশে ব্যথা হওয়ার প্রধান কারণ হল অ্যাপেন্ডেসাইটিস। এক্ষেত্রে অপারেশন ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। আবার মহিলাদের মেনস্ট্রুয়েশনের সময় রেট্রোগেট মেনস্ট্রুয়েশন (ব্লাডের কিছুটা অংশ বাইরে না বেরিয়ে ভিতরে চলে যায়) হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ব্যথা হতে পারে সেই কারণেও। ওভারিতে সিস্ট হওয়ার কারণেও ব্যথা হতে পারে। শেষোক্ত দুটির জন্য আলাদা করে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

লেফট আপার কোয়াড্রেন্ট
পেটের এই অংশে ব্যথা সাধারণত হয় না। হলেও তা হয় পাকস্থলী অথবা কোলনের (মলাশয়) ক্র্যাম্পের জন্য। তবে এপিগ্যাসট্রিয়ামে (পাঁজরের ঠিক নীচে এবং পেটের মধ্যরেখার উপরে) ব্যথা হলে ভাববার অবকাশ থেকে যায়। হাইপার অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রাইটিস-এর কারণে ওই অংশে আকছার ব্যথা হতে দেখা যায়। আলসারের কারণেও এপিগ্যাসট্রিয়ামে ব্যথা হতে পারে। আবার একটানা ব্যথা, সঙ্গে বমির মতো উপসর্গ কিন্তু প্যাংক্রিয়াটাইটিসের দিকে ইঙ্গিত দেয়।

লেফট লোয়ার কোয়াড্রেন্ট
কোষ্ঠকাঠিন্য, বাওয়েল স্পাজম (অন্ত্রের খিঁচুনি) এবং ডাইভার্টিকুলাইটিস-এর কারণে পেটের এই অংশে হতে পারে ব্যথা। ডাইভার্টিকুলাইটিস রোগটি হওয়ার পিছনে মূল কারণ হল কম ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যেস। ডানদিক ও বামদিকের পেটের নীচে ব্যথা হলে ও তার পিছনে কোনও কারণ খুঁজে না পাওয়া গেলে একবার কোলনোস্কোপি করে নেওয়া উচিত। এই দু’টি জায়গায় ব্যথা কিন্তু বাওয়েল ক্যান্সারের উপসর্গও হতে পারে।
পেটের মাঝে ব্যথা সাধারণত গ্যাস এবং অ্যাসিডিটির কারণে হয়। গ্যাস্ট্রিক আলসারের জন্যও ব্যথা হয় এই অংশে। তবে গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগীর সংখ্যা বেশি নয়। সমস্যা হল, গ্যাস, অম্বল আলসার ছাড়াও পেটের মাঝে ব্যথা কিন্তু পাকস্থলী ও ইসোফেগাসের (খাদ্যনালী) ক্যান্সারের দিকেও ইঙ্গিত করে। স্টমাক এবং ইসোফেগাস ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণগুলি হল, গলায় খাবার আটকে যাওয়া এবং অল্প খাবার খেলেই পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি হওয়া। সঙ্গে থাকে দ্রুত ওজন কমে যাওয়ার লক্ষণ।
আমাদের দেশে ফলমূল ও শাকসব্জিহীন অস্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়া, ধূমপান ও দোক্তা সেবনের অভ্যেস যথেষ্ট বেশি। ফলে বিদেশের তুলনায় এদেশে পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতাও থাকে বেশি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তির হঠাৎ করে পেট ব্যথা শুরু হলে অবশ্যই একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এছাড়া একটানা অম্বল-গ্যাসের সমস্যায় ভুগলেও ডাক্তার দেখানো দরকার। 

শেষ কথা
রোগ লুকিয়ে রাখলে রোগীকেই বেশি সমস্যা পোহাতে হয়। খরচও বাড়বে। তাই পেট ব্যথার উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। 

9th     December,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ