বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
হ য ব র ল
 

৩৪ বছরের জীবনে
ভাষায় দখল
সোমনাথ সরকার

ছেলেটির বয়স বোধহয় তিন কি চার বছর। বাবা প্রথম ভাগের বই এনে দিলেন। ছেলে তো মহাব্যস্ত হয়ে উঠল সেটি পড়ার জন্য। ছেলের বায়নায় রান্নার কাজের ফাঁকে মা পুরো বই একবার ছেলেকে পড়িয়ে দিলেন। সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরলে অবাক হওয়ার পালা। ছেলে গোটা বইটা মুখস্থ বলে গেল।  বাবা বুঝলেন, এ ছেলে তো সাধারণ ছেলে নয়! 
সব্জি কাটতে কাটতে একদিন ছেলেকে সব্জির খোসা দিয়ে বর্ণমালার অক্ষরগুলি সাজিয়ে দেখাচ্ছিলেন মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ বর্ণমালা শিখে ফেলেছিল প্রতিভাধর ছেলে! অসাধারণ মেধাবী এই ছেলেই পরে  আন্তর্জাতিক ভাষাবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পান— তিনি হরিনাথ দে। 
চব্বিশ পরগনার আড়িয়াদহ গ্রামে (দক্ষিণেশ্বরের কাছে) ভূমিষ্ঠ হন এই কৃতী সন্তান। সেখানে ছিল তাঁর মামার বাড়ি। বাবা বাহাদুর ভূতনাথ দে ছিলেন সরকারি আধিকারিক। শিক্ষাজীবনে  লাতিন ও ইংরেজিতে ডাবল অনার্স নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাশ করে স্কলারশিপ পান।  লাতিন ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ৭৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হরিনাথ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এমএ পাশ করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রভূত সম্মান অর্জন করেন তিনি। 
বিভিন্ন ভাষাশিক্ষায় হরিনাথের বিস্ময়কর প্রতিভা বিশ্বখ্যাত অধ্যাপকদেরও মুগ্ধ করেছিল। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, গ্রিক, লাতিন, মধ্যযুগীয় জার্মান ভাষা, মধ্যযুগীয় ফরাসি ভাষা, আধুনিক জার্মান ও ফরাসি, ইতালিয়ান, স্প্যানিস ও পর্তুগিজ ইত্যাদি ভাষায় হরিনাথের অসামান্য দখল ছিল। মোট ৩৪টি ভাষা জানা ছিল তাঁর। অন্তত ১৪টি ভাষায় স্নাতকোত্তর (এমএ) ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন।
একবার ভ্যাটিকান সিটিতে মহামান্য পোপের মুখোমুখি হয়ে লাতিন ভাষায় তাঁকে অভিবাদন জানালেন। চোস্ত লাতিন উচ্চারণ শুনে চমৎকৃত পোপ পরামর্শ দিলেন, এবার তবে ইতালীয় ভাষাটাও শিখে ফেলা হোক! পোপকে স্তম্ভিত করে হরিনাথ তাঁর সঙ্গে ইতালীয়তেই কথা বলতে লাগলেন!
লর্ড কার্জন সাহেবকে তাঁর অনুবাদ করা একটি বই উপহার দেন হরিনাথ।  বইয়ের উৎসর্গপত্রটি  লাতিনে লেখা। বিস্মিত কার্জন ঢাকায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
হরিনাথ দে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন।  বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি ভাষা বিষয়ের প্রশ্নপত্র রচয়িতা ও পরীক্ষক ছিলেন। বৌদ্ধদর্শন বিষয়ে হরিনাথ বহু গ্রন্থাদি রচনা করেন। ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি) প্রথম ভারতীয় লাইব্রেরিয়ান হয়েছিলেন হরিনাথ দে।
হরিনাথ বিভিন্ন ভাষায় রচিত গ্রন্থাবলি অন্যান্য ভাষাতে অনুবাদ করেন।  আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন ইবন বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘কিতাব-উর-রিহলা’ এবং জালালউদ্দিন আবু জাফর মহম্মদের ‘আল-ফখরি’ গ্রন্থ দু’টি। মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’-এর ছন্দোবদ্ধ ইংরেজি অনুবাদ, বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা রচনা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ও ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’  তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। ঋগ্বেদের অনেকগুলো শ্লোকের ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
এই ক্ষণজন্মা মানুষটির নেশা ছিল দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করা। অনুসন্ধান করে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’-এর প্রাচীনতম পুঁথিটি পেয়েছিলেন। মুঘল শাহজাদা দারা সুকোর করা বেদের অনুবাদ ছিল হরিনাথের নিজস্ব সংগ্রহে।
সরস্বতীর বরপুত্র এই বঙ্গসন্তান মাত্র ৩৪ বছরে (১৮৭৭-১৯১১)  বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। বহু ভাষাবিদ হরিনাথ দে ছিলেন স্বয়ং এক চলমান গ্রন্থাগার। লেলিহান চিতার আগুনে তাঁর মৃতদেহ দেখে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনুভব করেন একটি গ্রন্থশালা যেন সর্বগ্রাসী আগুনে ধ্বংস হচ্ছে।  ইতিহাসের পাতা থেকে  ঐতিহ্যবাহী পাঠাগার ধ্বংসকরণের মর্মান্তিক চিত্র ভেসে এসেছিল ছন্দের জাদুকরের মানসপটে। চোখের জলে ভিজে তাই তিনি লিখেছিলেন—
‘যাচ্ছে পুড়ে দেশের গর্ব,
শ্মশান শুধুই হচ্ছে আলা।
যাচ্ছে পুড়ে নতুন করে সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থশালা।’

28th     May,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ