ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এখন বেশ ঝকঝকে আকাশ। মাঘের শেষ অথচ বাতাসে ফাল্গুনের আমেজ। এক গা সাদা ফুলঝুরি নিয়ে স্কুলের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিষ্পত্র সজনে গাছটা। রিভু আর সালেমা, অমর একুশের গানের শুরুতে যে হারমোনি করতে হয়, বাকিদের নিয়ে তোমরা সেটা শুরু করো। পল্লবী আর নাসিফা তোমাদের কাজটা মনে আছে তো! আলপনা দেবে তোমরা। মেহবুব ও অর্ক চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে, কেমনভাবে সাজাবে গোটা অনুষ্ঠানটা।
কিন্তু ভাষা শহিদদের ছবিগুলো এত ঝাপসা কেন? দেখলে যেন মনে হয়, ভিড়ের মানুষ। কঠিন পদার্থের মতো আকারহীন। চেহারার বিস্মৃতিতে বিলীয়মান আদল। মনে হয় আবার কী, সত্যিই তো তাঁরা ভিড়ের মানুষ। কেউ সরকারি অফিসের পিওন। কেউ হাইকোর্টের কেরানি। কেউ বাদামতলীর প্রেসের মালিক। কেউ আবার রিকশওয়ালা। ভাস্কর রাশা বর্ণনাভিত্তিক কল্পিত ছবি এঁকেছিলেন। তা না হলে হয়তো তাঁদের ছবিই থাকত না।
শহিদ আবদুস সালাম আমৃত্যু ছিলেন ৮৫ নম্বর দিলকুশার ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজের রেকর্ড কিপার। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় একটা ছবি তোলা হয়েছিল বটে। কিন্তু পরে তা হারিয়ে যায়। একমনে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল অর্ক। রোমাঞ্চিত হচ্ছিল পল্লবীর সারা শরীর। রোমকূপগুলো জানান দিচ্ছিল, কীসের এক উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে সে।
পাশ থেকে মেহবুব বলে ওঠে, এই মাঘের আকাশ, নিষ্পত্র সজনে গাছে সাদা ফুলের মঞ্জরি দেখেই কি উচ্চকিত হৃদয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি! কথাটা শেষ না হতেই প্রবল আপত্তি ধেয়ে আসে রিভুর দিক থেকে। নতুন আবার কী? ভাষার অধিকার কি নতুন? সে তো আদি। মায়ের কোলে শিশুর দোল খাওয়ার মতো। ইতিহাসটা মনে করিয়ে দেয় সালেমা।
১৯২৫-এর পাড়াগাঁয়ে তখন জমাটি শীত। সৃষ্টির ছন্দে লক্ষ্মণপুর গ্রামে দৌলতুন্নেসার কোলজুড়ে এসেছিলেন তিনি। আবদুস সালাম। বাবা বর্গাচাষি মহম্মদ ফাজেল মিঁঞা। বাইরের পৃথিবীতে ততদিনে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। মুসোলিনের কুখ্যাত ভাষণ দেওয়া শেষ। হিটলার ছাপিয়ে গিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে লোকজন দেখে ফেলেছেন প্রথম টেলিভিশন। এতসব ডামাডোলের মাঝেও আজকের বাংলাদেশ শান্ত দিঘির জলের মতোই স্থির। পাড়াগাঁয়ে দু-একটা সিঁধেল চোরের উৎপাত ছাড়া তেমন কোনও ঝামেলা নেই। গ্রামে স্কুল নেই। আকাশের বুক চিরে যাওয়া আসা নেই উড়োজাহাজের। আছে মুঘল আমলের মসজিদ। আর হাত ধরাধরি করে আছে ধানখেত, কলাবাগানের ভিতর দিয়ে মায়ের সিঁথির মতো সরু আলপথ।
সেই পথ ধরেই পাশের গাঁয়ে পাঠশালায় পা রেখেছিলেন আবদুস সালাম। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে। কিন্তু কী যেন হল ছেলেটার! তখন ক্লাস নাইন। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। চলে এলেন কলকাতায়। আসলে জীবন সংগ্রাম তখন টানা শ্বাস ফেলছে ঘাড়ে। তাই তো কাজের সন্ধান। একটা কাজ জুটেও গেল শিল্প দপ্তরে। তখন শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্বযুদ্ধ। ‘অবাক পৃথিবী’ আর ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’ দেখতে পাচ্ছেন সালাম। ঘাড় গুঁজে হয়তো চাকরিটা করে যাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু মেরুদণ্ডটা যে বাঁকতে চায় না। অন্যায্যের প্রতি সবসময় শিরদাঁড়া টান করে গর্জে উঠেছেন প্রতিবাদে। ভারত ভাগ হওয়ার পরে ফিরে গিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু নিজভূমেও কেমন যেন অযাচিত মনে হতে লাগল নিজেকে। চাচাতো ভাইয়ের সহায়তায় রেকর্ড কিপারের কাজ পেলেন সালাম। ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজে ৮৫ নম্বর দিলকুশায়। তখন সে ছাব্বিশ বছরের এক টানটান যুবক। কে জানে, তাল-তমাল ঘেরা শাপলা ফোটা পুকুরপাড়ে কোনও উদাসী কন্যা তাঁর বাগদত্তা ছিল কি না। কিন্তু তাঁর চোখে তখন আগুন জ্বলছে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির বিকেল। বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল এগিয়ে চলেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে। ১৪৪ ধারা ভাঙতেই ধেয়ে এল বুলেট। ঝাঁঝরা করে দিল সালামকে। বলতে বলতে গলাটা বুজে আসে সালেমার।
রিভুর আবৃত্তির গলাটা বেশ ভালো। সে ফজলে লোহানির একুশে কবিতার কয়েকটা লাইন বলে ওঠে,
‘শহরে সেদিন মিছিল ছিল।
পৃথিবী সেদিন উল্টো ঘোরেনি; এগিয়ে গেছে।
সবাই শুনলো: খুন হয়ে গেছে, খুন হয়ে গেল।
মায়ের দু’চোখের দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়েছে রমনার পথে।’
রিভুর হাতটা চেপে ধরল পল্লবী। তারপর বলল, সেদিনের মিছিলে আর কত প্রাণ ঝরেছিল, কারা গুলি চালিয়েছিল, সেসব তো জানা। কেউ কেউ বলেন, গোড়ালির ক্ষতে গ্যাংগ্রিন হয়ে দেড়মাস বেঁচে ছিলেন সালাম। মারা যান ৭ এপ্রিল। তাই যদি হয়, একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, দেড়মাস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের তপ্ত মাঠ দেখে ছটফট করতে করতে কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি। শহিদের রক্তমাখা জামা আর সাদাকালো ছবির ট্রাঙ্কটা কোথায় গেল! সিঁধেল চোরে নিয়ে গিয়েছে। নাকি এর পিছনে রয়েছে বড় কোনও ষড়যন্ত্র।
বিতর্ক থাক, আদর্শ মানুষের মৃত্যুদিন থাকতে নেই। আবদুস সালাম মরেননি। মরতে পারেন না। সরকারি গেজেটে লক্ষ্মণপুর হয়েছে সালামপুর। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। এপার বাংলাতেও তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের মনের ভিতর। শুধু একটি দিনের জন্য নয়। প্রতিদিন সকাল থেকে মাঝরাত, স্মার্ট ফোন হাতে চ্যাট করার সময় যখন আমরা প্রতিনিয়ত জগাখিচুড়ি বাংলা লিখে চলেছি, একটা চরম অনীহার সঙ্গে বাংলা বলে চলেছি, তখনও মনে রাখতে হবে সালামদের কথা। তবেই তো একুশের সকালে ‘আমি কি ভুলিতে পারি’ গাইবার সার্থকতা।
চুপিচুপি পাশে এসে রিভু, অর্ক, সালেমাদের কথা শুনছিলেন স্কুলে বাংলার শিক্ষক সুবিমলবাবু। নিজেকে সামলাতে না পেরে অবশেষে বলেই ফেললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করে বিষ্ণু দে একটি কাব্যের নাম রেখেছিলেন, ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ!’ বাংলা ও তৃতীয় বিশ্বের শত শত মাতৃভাষার দুরবস্থা দেখে বিষ্ণু দে’র অনুসরণে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জাগে, একুশে ফেব্রুয়ারি, তুমি কি শুধুই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস? পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষা নিয়ে নতুন সম্ভাবনার উৎস হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, এমনটাই তো প্রত্যাশা ছিল আমাদের। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু ভাষা মরে গিয়েছে। লুপ্ত হয়ে গিয়েছে চিরতরে। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক পিটার কে অস্টিনের মতে, পৃথিবীজুড়ে সাত হাজার ভাষার মধ্যে চার হাজার ভাষা এখন বিপন্ন। বিগত কয়েক বছরে হারিয়ে গিয়েছে অন্তত তিনশো ভাষা। একুশ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়া বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর আদি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের ভাষা নিয়ে আবেগসিক্ত কথা বলার একটা বার্ষিক পার্বণ হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবে ওইসব ভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কি, প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষার আগ্রাসনে বাঙালির মাতৃভাষা বলিভিয়ার আয়মারা কি কুয়োদুয়া ভাষার মতো নির্মম পরিণতির শিকার হবে না তো? থেকে যায় এ প্রশ্নও। আমরা সারাক্ষণ ইংরেজি কিংবা হিন্দিতে ভাবছি। তার গা জোয়ারি অনুবাদ করে বাংলা বলছি। ভাষার পরিবর্তন হতে পারে। সেটা ভাষার ধর্ম। কিন্তু পরিবর্তন আর বিকৃতি তো এক নয়। টিভি সিরিয়াল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় চ্যাট, সবক্ষেত্রেই বিকৃত প্রয়োগে বাংলা ভাষার আত্মার মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এক গীতিকার তো ঠিকই বলেছেন, বাংলায় কথা বলতে গিয়ে আমরা ভাবছি অ-বাংলায়। এনিয়ে আমাদের কোনও হেলদোল নেই। মুখে না বললেও আমরা অনেকেই বাংলাকে অসম্মানের ভাষা বলে ভাবতে শিখছি। আমরা ভাবি, হিন্দি বা ইংরেজির সঙ্গে যেন একটা ঝকঝকে সপ্রতিভ বিষয় আছে, বাংলার মধ্যে সেটা নেই। এই ধারণার বদল ঘটা খুব জরুরি। না হলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাংলা ভাষার মৃত্যু অনিবার্য। আর সেদিন গুরুত্বহীন হয়ে যাবে ‘অমর একুশে’।
ছবি : ইন্দ্রজিৎ রায়