বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
হ য ব র ল
 

বিবর্তনবাদের জনক
মৃণাল শীল

 আজ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের জন্মদিন। তাঁর তত্ত্ব জীবকুলের উদ্ভব নিয়ে প্রাচীন ধ্যান ধারণা ভেঙে দেয়। তাই এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিনটি পৃথিবীজুড়ে ‘ডারউইন ডে’ নামে পালিত হয়।
 
১৮৩১ সাল। ব্রিটিশ সরকার ‘এইচএমএস বিগল’ নামে একটি জাহাজের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন ফিজরয়ের নেতৃত্বে দক্ষিণ আমেরিকা অভিযানের পরিকল্পনা করল। কেমব্রিজের উদ্ভিদ বিদ্যার অধ্যাপক হেনসেলোর সুপারিশে বছর বাইশের চার্লস ডারউইন নামে এক যুবক সেই অভিযানে শামিল হলেন। মুশকিল হল অন্য জায়গায়। পয়সা দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁর। যদিও অধ্যাপক হেনসেলোর সুপারিশ ছিল, কিন্তু ক্যাপ্টেন ফিজরয় বিনা পয়সায় ডারউইনকে সঙ্গী করতে নারাজ। শেষে একটা ফন্দি আঁটলেন সেই যুবক। তিনি ক্যাপ্টেনের সব ফাইফরমাস খেটে দেবেন, পরিবর্তে তাঁকে টাকা-পয়সা দিতে হবে না— এই শর্তে ‘এইচএমএস বিগল’-এর ক্যাপ্টেনকে রাজি করান তিনি।
পরবর্তীকালে এই ডারউইন হয়েছিলেন পৃথিবীর প্রাণীকুলের বিবর্তনবাদের জনক। তাঁর জন্ম হয় ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বস্তুত তাঁর সমসাময়িককালে মানুষের জীব সৃষ্টি বিষয়ে ধারণা ছিল ধর্মগ্রন্থ ভিত্তিক। অর্থাৎ পৃথিবীর এই সমগ্র মানবজাতির উৎপত্তি আদম ও ইভ নামে দুই ব্যক্তির থেকে। ডারউইনই তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত্বের মাধ্যমে এই ধারণা সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দেন। 
তাঁর বাবা ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। মাত্র আট বছর বয়সেই ডারউইন মাকে হারান। তিনি মানুষ হন দিদি ও বাবার অভিভাবকত্বে। নয় বছর বয়সে তিনি স্কুলে ভর্তি হলেও চিরাচরিত পড়াশোনায় তাঁর কোনও আগ্রহই ছিল না। বরং তিনি বেশি উৎসাহী ছিলেন তাঁর বাড়িতেই দাদার তৈরি ল্যাবরেটরি নিয়ে। সেখানে বিভিন্ন মজার রাসায়নিক বিক্রিয়া ছিল তাঁর খেলার বিষয়। 
এদিকে, চিকিৎসক পিতা চেয়েছিলেন চার্লসও যেন একজন ডাক্তার হয়। এ জন্য ষোলো বছরের চার্লসকে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি করে দেওয়া হয় এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডারউইনের কিন্তু ডাক্তারি পড়ার এতটুকুও ইচ্ছে ছিল না। ওষুধের নাম তিনি মনে রাখতে পারতেন না। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাম মনে রাখতে বিরক্তি বোধ করতেন। আর অপারেশনের নাম শুনলেই তাঁর যেন গায়ে জ্বর আসত। চার্লসের স্নেহশীল পিতা বুঝলেন যে, তাঁর ছেলের পক্ষে ডাক্তারি পড়া সম্ভব নয়। ফলে তিনি ডারউইনকে ভর্তি করলেন কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে। এবারের উদ্দেশ্য ধর্মযাজক তৈরি করা। এই সময়ই চার্লসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে অধ্যাপক হেনসেলোর। এর কিছুদিন পরে যখন কেমব্রিজ থেকে পাশ করে তিনি ভূমিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করছেন, সেই সময় ‘এইচএমএস বিগল’-এর সেই বিখ্যাত ঘটনাটি ঘটে।
১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে তাঁরা ঘুরে বেড়ালেন দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, তাহিত্যি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালদ্বীপ, সেন্ট হেলেনা। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে ডারউইন ৫৩৫ দিন কাটিয়েছিলেন সাগরে আর প্রায় ১ হাজার ২০০ দিন মাটিতে। এই সময় তিনি যাই দেখতেন তার বিবরণ, স্থান, সংগ্রহের তারিখ সব বিশদে লিখে রাখতেন। ১৮৩৪ সালের ২৪ জুলাই তাঁর ডায়েরির এক স্থানে তিনি লেখেন, ‘৪৮০০ পাতার বিবরণ লিখেছি। এর মধ্যে অর্ধেক ভূমিবিদ্যা বাকি সব বিভিন্ন জীবজন্তুর বিবরণ।’ বস্তুত ডারউইন গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকেই বিভিন্ন জীবাশ্মের নমুনা সংগ্রহ করেন। প্রায় পাঁচ বছরের দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রা শেষ করে ডারউইন ইংল্যান্ডে ফেরেন ১৮৩৬ সালে। এই সময় তিনি অসুস্থ। সেই অবস্থাতেই তাঁর সংগৃহীত নমুনা আর ডায়েরির ভিত্তিতে হাত দেন বই লেখার কাজে। 
ডারউইন যে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব লিখেছিলেন, সেখানে তিনি ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ নামে একটি ধারণার অবতারণা করেছিলেন। যার অর্থ হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। অর্থাৎ জীবজগতের মধ্যে সেই সকল জীবই বংশ পরম্পরায় ভবিষ্যতে অগ্রসর হয়, যাদের প্রকৃতি নির্বাচন করে বা যারা প্রাকৃতিক সুবিধা ভোগ করে। বলা বাহুল্য এই নির্বাচনবাদ হয়তো বা তাঁর নিজের জীবনের ক্ষেত্রেও সত্য। কারণ, ছোটবেলা থেকেই শারীরিকভাবে তিনি মোটেই সুস্থ ছিলেন না। মায়ের মৃত্যুর কারণে সেই অর্থে উপযুক্ত যত্ন তাঁর জোটেনি। লেখাপড়ায় যে খুব মেধাবী ছিলেন তাও নয়। বরং কিছুটা উল্টোই। তাঁর স্কুল জীবনে শিক্ষকরা ধরেই নিয়েছিলেন যে, ডারউইনের পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়ানো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু তাঁর অসুস্থতার জন্যই তিনি প্রশ্রয় পেয়েছিলেন মন যা চায় তাই করার। এই ঘটনাই হয়তো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাঁর ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্বের মতোই কাজ করেছিল। 
একবার ডারউইন তাঁর স্ত্রী এমাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যান। বেড়াতে বেড়াতে এমা হঠাৎই তাঁকে বলেন, ‘তোমাকে না ঠিক শিম্পাঞ্জির মতো দেখতে।’ মজাচ্ছলে বলা এমার এই কথাটিই ডারউইনকে তাঁর অভিযোজন তত্ত্বের যে ধারণা অর্থাৎ বর্তমান মানুষের উদ্ভব আদিম বনমানুষ (এপ) থেকে, তা প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। 
শেষ বয়সে ডারউইন কেবল যে জীববিজ্ঞানের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন তা নয়। সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধ পড়তেন। যদিও তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, গণিত বা পদার্থ বিদ্যার সমীকরণের জটিলতা তিনি বোঝেন না। কিন্তু দুরূহের সমাধানের চেষ্টাতেই তিনি আনন্দ পেতেন। শেক্সপিয়রের রচনা ছিল তাঁর বড় প্রিয়। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি বিভিন্ন উপন্যাসের পাঠ শুনতেন তাঁর স্ত্রীর কাছে। মিলনাত্মক গল্পই ছিল তাঁর অধিক প্রিয়। কার্ল মার্কস তাঁর ‘দাস ক্যাপিটাল’ বইটি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন ডারউইনকে। কারণ হিসেবে মার্কস নাকি বলেছিলেন যে, তাঁর এই বইটা রচনা করার জন্য অনেক ধারণাই পেয়েছেন ডারউইনের লেখা ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ বা ‘মিনস অব ন্যাচারাল সিলেকশন’ থেকে। কিন্তু বিতর্কের ভয়ে রাজি হননি ডারউইন। 
শোনা যায়, ডারউইন নাকি তাঁর এই বই লেখার ব্যাপারে এতটাই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন যে, প্রায় দুই দশক পাণ্ডুলিপি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছিলেন যে, সেটাকে আদৌ বই আকারে প্রকাশ করা যায় কি না। শেষে বইটা যখন প্রকাশিত হয়, তখন প্রায় চল্লিশ হাজার কপি বিক্রি হয় বারো বছরে। ডারউইনের এই বই প্রকাশের পর সংঘাত বাধে সেই সময়কার ধর্মযাজকদের সঙ্গে। যদিও ডারউইন তাঁর প্রথম জীবনে নাস্তিক ছিলেন এমনটা নয়। কিন্তু এইচএমএস বিগলে সমুদ্রযাত্রা তাঁর জীবনকে আমূল পাল্টে দেয়। এমনকী, সমুদ্র যাত্রা থেকে ফেরার পর তাঁর বাবা পর্যন্ত বলেছিলেন ‘এ কি, এ যে দেখছি, মাথার খুলির গড়নটাই পাল্টে গিয়েছে।’ সত্যিই পাঁচটা বছর সমুদ্রযাত্রা তাঁর চিন্তাভাবনা, ধ্যান ধারণা সবকিছু পাল্টে দেয়। তিনি চরম নাস্তিকে পরিণত হন।
১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল ৭৩ বছর বয়সে এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে। বস্তুত ইংল্যান্ডে রাজ পরিবারের বাইরে যে ক’জন মানুষকে রাজকীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল ডারউইন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আরেকজন মহান বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটনের সমাধির কাছেই সমাধিস্থ করা হয় এই মহাবিজ্ঞানীকে।
পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের সরকার ডারউইনের কাজকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল অদ্ভুতভাবে। তারা ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় আঠারো বছর ১০ পাউন্ডের নোটে ডারউইনের ছবি  ছাপাত আর নোটের উল্টো দিকে ছাপা থাকত তাঁর যাত্রা করা জাহাজ এইচএমএস বিগলের ছবি। 

12th     February,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ