বাবা ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার বন্ধুদের ছেলেরা সকলে ইংরেজি স্কুলে পড়ে। তাদের মতো অভিজাত পরিবারের ছেলেরা ইংরেজি স্কুলে পড়ে। কিন্তু সে পড়াশোনা করে বাংলা স্কুলে। বাবা মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত করা উচিত। ছেলেটির বাবা যখন ফরিদপুরে চাকরি করছেন, তখন ওই শহরে একটিমাত্র জেলা স্কুল। ছেলেকে পাঠালেন ওই স্কুলে পড়বার জন্য। স্কুলে ছেলেটির সহপাঠীদের মধ্যে ডানদিকে বসে বাবার মুসলমান চাপরাশির ছেলে আর বাঁ-দিকে একজন ধীবরের ছেলে। তাদের সঙ্গে ছেলেটি শুধু লেখাপড়া আর খেলাধুলোই করে না, অবসর সময়ে পশুপাখি জীবজন্তু সম্বন্ধেও অনেক গল্প শোনে। শুনতে শুনতে তার বিস্ময়ের শেষ থাকে না!
স্কুলের আসা-যাওয়ার পথের ধারে নানারকমের গাছপালা, বনজঙ্গল দেখে সে। এরকম একদিন সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার পথে এক বন্ধু বলে উঠল, ‘একটা মজা দেখবি?’
বন্ধুটি লজ্জাবতী লতার বনে একটা গাছকে ছুঁয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতা কুঁকড়ে গিয়ে নুয়ে পড়ল। গাছটা যেন সত্যি লজ্জায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
অবাক হয়ে গেল ছেলেটি। ফেরার পথে গাছের পাতা ছুঁতেই আবার একই কাণ্ড। বাড়ি গিয়ে বাবার কাছে ঘটনাটা বলল। বাবা কিছু বললেন না, শুধু শুনলেন।
পরের দিন খাওয়ার সময় দেখল, গাছের পাতা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। কিন্তু ছুঁয়ে দিতেই একই ঘটনা। দিনের পর দিন একই ঘটনা ঘটে। বালকের মনে কৌতূহল জাগে। কেন এরকম হয়? বাবা অফিসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। সন্ধেবেলায় বাড়ি আসেন ক্লান্ত হয়ে। খাওয়া দাওয়া সেরে রাতে ছেলের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, বনচাঁড়াল আর লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁয়ে দিলে তাদের ডালপালা সবকিছু নিচু হয়ে যায়, কিন্তু আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল ইত্যাদি গাছকে ছুঁলে সেসব গাছের তো কিছু হয় না!’ বাবা ছেলের কৌতূহল দেখে অবাক হয়ে যান। বলেন, ‘আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল সাড়া দেয় কি না তা আমাদের জানা নেই। প্রকৃতির সব রহস্য তো আমরা জানতে পারিনি। তবে মানুষকে আঘাত করলে তার যেমন লাগে, কষ্ট হয়, চোখ দিয়ে জল পড়ে, গাছপালাও তেমনই আঘাত পেলে তাদের লাগে। আমগাছ, সজনে গাছের গায়ে কুড়াল দিয়ে দু-কোপ বসিয়ে দাও, দেখবে কাটা জায়গা থেকে আঠা বেরচ্ছে। সেটাই তাদের চোখের জল।’ বাবার কথা শুনে ছেলেটির মনে আরও আগ্রহ বেড়ে যায়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সে। অনেক কথার উত্তর দিতেন বাবা, আর কখনও কখনও বলতেন, ‘প্রকৃতির অনেক কথা আমরা জানি না। তবে মুনি-ঋষিরা বলে গিয়েছেন মানুষ এবং পশুপাখির মধ্যে যেমন প্রাণ আছে, গাছেরও তেমন প্রাণ আছে। তুমি বড় হয়ে জানবার চেষ্টা কর।’ এভাবেই তাঁর শিশুপুত্রের মনের মধ্যে অনুসন্ধিৎসার বাতিটি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই ছেলেটি পরে মস্ত বড় বিজ্ঞানী হয়েছিলেন। বড় হয়ে অনেক কিছু জেনেছিলেন আর সারা বিশ্বের মানুষকে জানিয়েছিলেন যে, গাছেরও প্রাণ আছে। এটি হাতেনাতে প্রমাণের জন্যে তিনি ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ নামক যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যা উদ্ভিদ দেহের সামান্য সাড়াকে লক্ষগুণ বৃদ্ধি করে প্রদর্শন করে। এই ছেলেটিই প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ময়মনসিংহে। তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল ঢাকা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে। তাঁর বাবার নাম ছিল ভগবানচন্দ্র বসু এবং মা বামাসুন্দরী বসু।
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফরিদপুরে, তারপর ১৮৬৯ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুল, সেখান থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। তিনি ১৮৭৫ সালে ষোলো বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৭৭ সালে অনার্স এবং ১৮৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৮৮০ সালে ভারত ছেড়ে লন্ডনে ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে পড়া থমকে যায়। ১৮৮৪ সালে কেমব্রিজ ক্রাইস্ট কলেজ থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ে ট্রাইপোস (কেমব্রিজে বিশেষ কোর্স) এবং একই সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন।
১৮৮৫ সালে জগদীশচন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। প্রথম জীবনে তিনি ইথার তরঙ্গ ও বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার প্রথম সাফল্য ছিল বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে সঙ্কেত বা সংবাদ প্রেরণের আবিষ্কার। ১৮৯৪ সালে জগদীশচন্দ্র বোস দেখিয়েছিলেন যে, বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গগুলিকে কীভাবে যোগাযোগের সঙ্কেত হিসাবে ব্যবহার করে ঘরের দেওয়াল ভেদ করে ৭৫ ফুট দূরে অবস্থিত একটি ঘণ্টাকে বাজাতে পারে, ওই তরঙ্গগুলির মাধ্যমে কিছু বারুদকে জ্বালানো যেতে পারে। অর্থাৎ জগদীশ বসুর আবিষ্কার ছিল অতি ক্ষুদ্র বেতার তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ যা পরবর্তীতে ‘সলিড স্টেট ফিজিক্স’-এর বিকাশে সাহায্য করেছিল। মাইক্রোওয়েভ আবিষ্কারের ব্যাপারটা ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। আজকের দিনে মহাকাশ বিজ্ঞানে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে, টেলিভিশন সম্প্রচারে এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে মাইক্রোওয়েভ কাজে লাগে। কমিউনিকেশনের (যোগাযোগ) ক্ষেত্রে আরও বিশেষ করে এই তরঙ্গ কাজে লাগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন সাবমেরিন এল, রাডার এল তখন মানুষ বুঝতে পারল এই মাইক্রোওয়েভের গুরুত্ব কতখানি। পরে পদার্থবিজ্ঞানের আরও গুরুত্বপূর্ণ নানা আবিষ্কার করেন। চৌকো মুখ ফানেল আকৃতির একটি হর্ন অ্যান্টেনা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আজ বিশ্বে, যুদ্ধকালীন যোগাযোগ বা রাডার যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও অনেক ধরনের রিসিভার, ডিটেক্টর ইত্যাদি উনি তৈরি করেছিলেন, যা আজও বহুল ব্যবহৃত। আমরা যে রেডিওতে গানের মূর্ছনায় হারিয়ে যাই, তার আবিষ্কারক হিসাবে গোটা বিশ্ববাসী ইতালির বিজ্ঞানী গুগলিয়েমো মার্কোনিকেই জানত। মার্কোনি তাঁর এই কৃতিত্বের জন্যে ১৯০৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু ১৯৯৮ সালে নিউইয়র্ক থেকে ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারস-এর প্রকাশিত প্রসিডিংসে আমাদের জগদীশচন্দ্র বসুকে রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কারণ, মার্কোনি তাঁর আবিষ্কারে অনেক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন, যার মধ্যে একটি হচ্ছে কোহেরার (২টি ধাতব পাতের মাঝে খানিকটা পারদ), যা ছিল রেডিও বা তারহীন সঙ্কেত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় মূল বিষয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই, কোহেরার-এর প্রকৃত আবিষ্কারক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, যা মার্কোনি বা তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা কেউ স্বীকার করেননি। যদিও বেতারের আবিষ্কারক হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন মার্কোনি। কারণ জগদীশচন্দ্র এই আবিষ্কারটিকে নিজের নামে পেটেন্ট করেননি। এখন প্রশ্ন হল তিনি নিজের নামে পেটেন্ট করেননি কেন? ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে বলেন যে, ‘আমি যদি একবার টাকার মোহে পড়ে যাই তাহলে আর বের হতে পারব না।’
টাকার প্রতি তাঁর লোভ ছিল না বলেই তিনি পেটেন্ট নিজের নামে করেননি। পদার্থবিজ্ঞানে অসাধারণ অবদান সত্ত্বেও জগদীশচন্দ্র বসু সারা বিশ্বে খ্যাতিলাভ করেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসাবে। অথচ, তিনি আদৌ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছিলেন না। আসলে তিনি পদার্থবিদ্যার সঙ্গে উদ্ভিদবিদ্যার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। পদার্থবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে যে যন্ত্র তিনি তৈরি করেছিলেন, সেটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন উদ্ভিদবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারে। গাছের যে প্রাণ আছে, তার কিছু স্থূল লক্ষণ সম্পর্কে মানুষ আগে থেকেই জানত— যেমন গাছ জন্ম নেয়, বড় হয়, একদিন মরেও যায়। অতি প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের মানুষ বিশ্বাস করত গাছ একটা জীবন্ত সত্তা। একই বিশ্বাস ছিল অ্যারিস্টটলেরও। তাহলে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারে নতুনত্ব কোথায় ছিল? বাইরের কোন উদ্দীপক বস্তু ব্যবহার করলে বা গাছকে আঘাত করলে গাছ কীভাবে সাড়া দেয়, সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখান। ক্রেসকোগ্রাফ এমন একটি যন্ত্র, যা দিয়ে দেখিয়েছিলেন একটা গাছ এক সেকেন্ডে কতটা বাড়ে। তাঁর আবিষ্কৃত এই যন্ত্র উদ্ভিদ দেহের সামান্য সাড়াকে লক্ষ গুণ বৃদ্ধি করে প্রদর্শনের ক্ষমতা রাখে। সূক্ষ্ম একটি অক্ষদণ্ডের সঙ্গে সংলগ্ন দু’টি লিভারের সাহায্যে ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রটির মূল কাঠামোটি তৈরি করেছিলেন। প্রথম লিভারের গোড়ার দিকে পরীক্ষাধীন গাছটিকে জুড়ে দেওয়া হয় এবং এই লিভারের ডগাটি দ্বিতীয় লিভারটির গোড়ার দিকে সংযুক্ত থাকার ফলে গাছের বৃদ্ধি বা উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার অনুভূতিকে দশ হাজার গুণ বর্ধিত আকারে প্রকাশ করে। দ্বিতীয় লিভারের বাঁকানো মুখটা ভুসোকালি মাখানো কাচের প্লেটের সামনে রাখা থাকে। প্লেটটি ঘড়িকলের সাহায্যে ক্রমশ ডান থেকে বাঁদিকে সরতে থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর এগিয়ে এসে লিভারের মুখটাকে ছুঁয়ে যায়। এভাবেই প্লেটের উপর গাছের বৃদ্ধি বা সাড়া বিন্দুর সারি দিয়ে পর পর আঁকা হয়ে যায়।
১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর কর্মময় জীবন থেকে চিরবিদায় নিলেন। আমরা তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পেলাম ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। তিনি একজন সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর লেখা ‘অব্যক্ত’ বাংলা ভাষার একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশনটির নাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’।