বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
হ য ব র ল
 

রামমোহন মিউজিয়ামে একদিন
চকিতা চট্টোপাধ্যায়

 রাধানগরের দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে চলছে সাড়ম্বরে চিতা সাজানোর কাজ। আজ এখানে রামকান্ত রায়ের ছেলে জগন্ময়ের মৃতদেহ দাহ করা হবে! সঙ্গে সহমরণে গিয়ে ‘সতী’ হবেন তাঁর বিধবা স্ত্রী অলকমঞ্জরীদেবী। কিন্তু জগন্ময়ের ভাই সদ্য যুবক রামমোহন রায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এই নির্মম ধর্মীয় প্রথাটিকে!  কিন্তু, তাঁর হাজার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও, দাদার জ্বলন্ত চিতায় উঠে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তাঁর বিধবা বউদি ‘সতী’ হয়েছিলেন সেদিন!
এই ঘটনা গভীর ছাপ ফেলেছিল ভারতের নবজারণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের মনে! তিনিই ছিলেন একাধারে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলা গদ্যের জনক, আবার বাংলা সংবাদপত্রের প্রণেতা। তাই তো তিনি আপ্রাণ লড়াই করে শেষপর্যন্ত সফল হতে পেরেছিলেন এই মধ্যযুগীয় বর্বরপ্রথা ‘সতীদাহ’ বা ‘সহমরণ’ থেকে ভারতবর্ষের বিধবা নারীদের মুক্তি দিতে! তাঁর এই মহান প্রচেষ্টায় তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন তৎকালীন ইংরেজ বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। ১৮২৯ সালে ‘সতীদাহ রদ’ আইন পাশ করা হয়।
দ্বারকেশ্বর নদীর তীরের সেই ‘সতীঘাট’-এর ছবি দেখতে চাও নাকি নিজের চোখে? দেখতে চাও রাজা রামমোহন রায়ের ব্যবহার করা সেই জোব্বা-চাদর-উড়নী-শামলা-জুতো? জানতে চাও কী কী বই পড়তেন তিনি? তাঁর হাতের লেখাই বা কেমন ছিল? পড়তে চাও তাঁর রচনা করা ব্রহ্মসঙ্গীত? তাহলে কিন্তু তোমাদের পৌঁছে যেতেই হবে কলকাতার ৮৫এ, রাজা রামমোহন সরণির (আমহার্স্ট স্ট্রিট) তাঁর সেই বাড়িটিতে, যা এককালে পরিচিত ছিল ‘সিমলা হাউস’ নামে। আর এখন যেখানে গড়ে উঠেছে  ‘রাজা রামমোহন রায় মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’। 
হুগলির রাধানগর থেকে কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সময় প্রথমে তিনি কিনেছিলেন মানিকতলার বাগানবাড়িটি। এই বাড়িতেই স্থাপিত হয়েছিল ‘আত্মীয় সভা’। এটি বতর্মানে ‘পুলিস মিউজিয়াম’। দ্বিতীয় যে বাড়িটি কেনেন, সেটি হল এই ‘সিমলা বাড়ি’টি। সপরিবারে তিনি এখানে বসবাস করতেন। আর মানিকতলার বাড়িতে তখন বিশিষ্ট বাঙালি ও ইংরেজ বন্ধুদের সঙ্গে চলত তাঁর আলোচনা সভাগুলি। জোড়াসাঁকো ও চৌরঙ্গিতে তাঁর আরও দুটি বাড়ির কথা জানা গেলেও সে দুটির সঠিক স্থান নির্ণয় করা যায়নি। 
মিউজিয়ামের গেট পেরলেই একটা পোর্টিকো। রাজা রামমোহন রায়ের আমলের ইতালিয়ান মার্বেল বসানো কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠেই পাবে মিউজিয়ামে ঢোকার টিকিট কাউন্টারটি। টিকিটের দাম মাত্র দশ টাকা! তিনতলা এই বাড়িটি ১৮১৫ সালে ফ্রান্সিস মেমবার্সের কাছ থেকে কিনেছিলেন রাজা রামমোহন। মূল কাঠামোটিকে এক রেখে সংস্কার করার পর কলকাতা কর্পোরেশনের কাছ থেকে এখন ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’-এর তকমাও পেয়ে গিয়েছে বাড়িটি। প্রায় ৭৬ কাঠা জমির ওপর তৈরি  বাগান, পুকুর সমেত এই বাড়িটির একাংশে এখন রামমোহন কলেজের মেয়েদের বিভাগটি রয়েছে। বাড়িটি কিন্তু সম্পূর্ণ চুন-সুরকি নির্মিত।
ওপরে ওঠার জন্য দু’পাশে রয়েছে দু’টি কাঠের সিঁড়ি। একদিকের সিঁড়িটি একদমই ভেঙে পড়াতে নতুনভাবে সেটি তৈরি করে দোতলায় যাবার পথটি করা হয়েছে। অন্যদিকের সিঁড়িটি ব্যবহার করা হয় না এখন। সেটি শুধুমাত্র নিদর্শন হিসেবেই সংরক্ষিত আছে।
একতলার হলঘরটির দেওয়াল সাজানো আছে মূল্যবান সব ছবি দিয়ে। সেখানে আছে বাড়িটির আগের অবস্থার ছবি। যখন রামমোহনের নাতি প্যারীমোহনের দত্তক পুত্র ধরণীমোহন এখানে সপরিবারে বসবাস করতেন, তখন এই বাড়ির মাথার ওপর সোনার ঘড়ি লাগানো ছিল। চুরি গিয়েছে সেটা বহুকাল, তবে গর্তটা রয়ে গিয়েছে। দেখতে পাবে সেই ছবিও। একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর জীবনের হিরোর নাম। তখন তিনি লিখেছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের নাম।  দেখতে পাবে একতলার দেওয়ালে  টাঙানো আছে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লেখা সেই স্বীকারোক্তিটিও! রামমোহন রায়কে কবিগুরু ‘ভারত পথিক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ।
ভাগলপুরের জেলাশাসক দাম্ভিক স্যার ফ্রেডরিক হ্যামিলটন পালকি বা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে কিংবা ছাতা মাথায় তাঁর সামনে দিয়ে কোনও ভারতীয়কে যেতে দিতেন না। ১৮০৯ সালে একবার নদীর ঘাটের ইটের পাঁজার কাছে তিনি যখন দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন সেখান দিয়ে পালকি চড়ে যাচ্ছিলেন রামমোহন। তিনি নিজে বা তাঁর ভৃত্য কিংবা পালকি বেহারারা কেউই সাহেবকে দেখতে পাননি। সাহেব কুৎসিত ভাষায় তাদের গালিগালাজ শুরু করেন। রামমোহন নিজে সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইলেও সাহেব এই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ ভৃত্যটিকে বরখাস্ত করার হুকুম দিয়ে চলে যান! 
রামমোহন তখন বড়লাট লর্ড মিন্টোকে চিঠি লিখে জানান তাঁর এই সম্মানহানির কথা এবং এজন্য ক্ষতিপূরণও চান। ব্রিটিশ সরকার ঘটনার তদন্ত করার পর হ্যামিলটন সাহেবকে সতর্ক করে দেন! রাজা রামমোহনের জীবনের আত্মসম্মানবোধের জ্বলন্ত নিদর্শন এই ঘটনাটিসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছবি ও মডেল সহযোগে সাজানো আছে দোতলার হলঘর ও তার পাশের ঘরগুলোতে। আছে ব্রিস্টলে যে বাড়িতে তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন, সেই মেরি কার্পেনটারের বাড়ি থেকে আনা তাঁর ব্যবহৃত আসবাবপত্র, টানা পাখা, এস্রাজ, পাখোয়াজ, তাঁর লেখা ব্রহ্মসঙ্গীতের খসড়া এবং তাঁর সেই আইকনিক পোশাকটি! তিনিই একমাত্র ভারতীয় যাঁর মৃত্যুর পর, তৎকালীন প্রথা অনুসারে তাঁর ব্রোঞ্জের ‘ডেথ-মাস্ক’ তৈরি করা হয়েছিল। এখানে দেখতে পাবে সেই ডেথ-মাস্কটির রেপ্লিকাও!
ক্ষমতাচ্যুত মুঘল বাদশা দ্বিতীয় আকবরের সরকারি বৃত্তি বাড়ানোর আবেদন করতে প্রতিনিধি হিসেবে রামমোহন রায়কে বিলেত পাঠানো হয় ১৮৩০ সালে ‘আলবিয়ান’ নামক জাহাজে। যাবার আগে বাদশা তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর ইংল্যান্ডের বুকে তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ ছিল— সতীদাহ প্রথা রদ আইনের পক্ষে প্রিভি কাউন্সিলের সামনে সওয়াল করা।
কিন্তু সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রমে বিধ্বস্ত রামমোহন ব্রিস্টলের স্টেপলটন গ্রোভের কাছে তাঁর বন্ধু রেভারেন্ড উডল্যান্ড কার্পেন্টারের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৮৩৩ সালের  ২৭ সেপ্টেম্বর এই বাড়িতেই তিনি  মেনিনজাইটিস বা ব্রেন-ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মিউজিয়ামের দোতলায় আছে তাঁর সেই মৃত্যুশয্যার তৈলচিত্রটি। আছে ব্রিস্টলে  প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের তৈরি করানো রামমোহনের সমাধি-মন্দিরের ছবিও।
তিনতলায় আছে একটি গ্যালারি। সেই সময়ের বিশিষ্ট যে সব মানুষ তাঁকে সমর্থন করেছিলেন এবং বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের ছবি ও পরিচিতি দিয়ে সাজানো।
বাড়িটির নীচে পুকুরে যাওয়ার ঘাটের নক্সাটি একসময় সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ছিল! এখানে আছে একটি ঐতিহাসিক দোলনা, যাতে একসময় রাজা রামমোহনের ছেলে   রমাপ্রসাদের স্কুলের সহপাঠী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় রোজ স্কুল ফেরত এসে দোল খেতেন তাঁর বন্ধুর সঙ্গে। মজার ঘটনা হল, তাঁদের দোল খাওয়া হয়ে গেলে স্বয়ং রামমোহন দোলনায় বসতেন, আর রমাপ্রসাদ ও দেবেন্দ্রনাথকে বলতেন তাঁকে দোল দিতে! তিনি দোল খেতে খেতে সামনের পুকুরের দিকে চেয়ে থাকতেন! একদিন কৌতূহলবশত ভৃত্য এর কারণ জানতে চাওয়ায় রামমোহন বলেছিলেন যে, তিনি যখন বিলেত যাবেন, তখন জাহাজের দোলানিতে তাঁর কেমন লাগবে সেটা অভ্যাস করার জন্যই তিনি রোজ  এইভাবে দোল খান! বিশাল লম্বা স্ট্যান্ডটি রয়ে গেলেও দোলনাটি অবশ্য চুরি হয়ে গিয়েছে!
নিজের চোখে এই সব কিছু দেখতে খুব ইচ্ছে করছে নিশ্চয়ই? তাহলে, সোমবার বাদে যে কোনও দিন সেখানে পৌঁছে যেও সকাল এগারোটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে।

19th     June,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ