বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
হ য ব র ল
 

প্রাচীন ভারতে 
বিজ্ঞানচর্চা

শূন্য আবিষ্কার হয়েছিল এ দেশেই। দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিরও প্রচলন হয় এখান থেকেই। শুধু গণিতশাস্ত্রই নয় জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শল্যচিকিৎসা— বিজ্ঞানের একাধিক শাখার জন্মভূমি প্রাচীন ভারতবর্ষ।

প্রাচীন ভারত। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অনন্য এক সভ্যতার উদাহরণ। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, পুরাণ ও বিজ্ঞানের এই চারণভূমি একদিকে ছিল যেমন মুনি-ঋষিদের তীর্থক্ষেত্র, তেমনই সময়ে সময়ে উপহার দিয়েছে জগদ্বিখ্যাত অনেক বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও মনীষীকে। ভারতে বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছিল সেই প্রাচীন কালেই, যা পরবর্তীতে পৃথিবীর অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে। প্রাচীন ভারতের আবিষ্কার করা বিভিন্ন জিনিস থেকে সাহায্য নিয়ে গড়ে উঠেছে অন্যান্য সভ্যতার বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও গণিতের ভিত্তিপ্রস্তর। প্রাচীন ভারতে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার পৃথিবীর কত রহস্য উদঘাটন করে গিয়েছে, তা শুনলে তোমরা অবাক হবে। কী সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার?

শূন্যের ধারণা
গণিতের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার শূন্য। শূন্যের আবিষ্কারের পরেই পৃথিবীতে গণিতের চিত্ররূপ পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছিল এবং বাজিমাত করে দিয়েছিল মানব-ইতিহাসের পথ। মায়ান বা মেসোপটেমীয় সভ্যতায় শূন্যের ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও সর্বপ্রথম এর বিবরণ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতে। যেখানে প্রথম শূন্যকে  সংকেত বা প্রতীকের খোলস ভেঙে বের করে সরাসরি সংখ্যা হিসেবে ব্যবহারের কৃতিত্ব দেখা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীর দিকে ভারতে হিসাব-নিকাশ করার সময় শূন্য ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকের মধ্যে ভারতীয় গণিতবিদ পিঙ্গলার ছন্দ-সূত্রতে শূন্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীতে ভারতের গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত উল্লেখ করেছেন, কোনও সংখ্যার সঙ্গে শূন্য যোগ বা বিয়োগ করলে সেই সংখ্যার কোনও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। কোনও সংখ্যাকে শূন্য দ্বারা গুণ করলে এর মানও হয়ে যায় শূন্য। আর ভাগ করলে এর মান হয় অসংজ্ঞায়িত! শূন্য শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘শুণ্যোয়া’ থেকে এসেছে। পরবর্তীতে তা আরবে ‘সিফর’ হয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমী দুনিয়ায় ‘জিরো’-তে পরিণত হয়।

দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি
বর্তমান পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয় হল দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে দুই হাতের দশটি  আঙুল গণনার উপর ভিত্তি করে। দশভিত্তিক গণনা পদ্ধতির প্রধান বিষয়টি হচ্ছে শূন্যের ব্যবহার। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মায়া সভ্যতায় শূন্যের ধারণা প্রচলিত থাকলেও তারা শূন্যকে অনুপস্থিতি, অভাব ও অশুভ কিছু বলে বিবেচনা করত। শূন্যের কার্যকর ব্যবহার এবং এর আলোকে দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি আবিষ্কার ও লিপিবদ্ধ ব্যবহারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় ভারতীয় সভ্যতাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালের দিকে ভারতবর্ষে দশভিত্তিক সংখ্যা ব্যবহারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৮ সালে গণিতবিদ আর্যভট্ট একটি সংস্কৃত কাব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘স্থানম স্থানম দশ গুণম’ অর্থাৎ স্থান হতে স্থান দশগুণ।
শূন্যের প্রণালীবদ্ধ নিয়ম গঠনের ফলে সহজ হয়ে গিয়েছিল সংখ্যা লিখন পদ্ধতি। যত বড় সংখ্যাই হোক না কেন, তা ০-৯ পর্যন্ত মাত্র ১০টি অঙ্ক ব্যবহার করেই দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির সাহায্যে অনায়াসে লেখা যেত। এটি এখনও পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ভারতের কাছ থেকে ধার করা এই জ্ঞান, ইউরোপসহ সারাবিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলে আরবীয় গণিতবিদরা। আরব পণ্ডিতরা এর উপর বিস্তর গবেষণা চালিয়ে এর আরও উন্নতি রূপ দেন।

দৈর্ঘ্য মাপার কাঠি ও বাটখারা
প্রাচীন ভারতের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে খননকার্য চালিয়ে গজদন্ত ও খোলের তৈরি স্কেল সদৃশ অনেক পরিমাপক কাঠির সন্ধান মিলেছে, যা দিয়ে মূলত দৈর্ঘ্য মাপা হতো। পাওয়া গিয়েছে কয়েকটি দাঁড়িপাল্লার ভগ্নাবশেষও। তাদের ওজন পরিমাপ পদ্ধতি ছিল ১৬ ভিত্তিক। যেমন, ১৬, ৬৪, ১৬০, ৩২০ ইত্যাদি। ওজন পরিমাপ করার নানা সামগ্রীর উৎপত্তিস্থল মূলত প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতাকেই ধরা হয়। সেখানে ব্যবহার হতো বিভিন্ন চারকোনা ও গোলাকার বাটখারা।

সৌরজগতের মতবাদ
প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদরা প্রায় সময়ই গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় গণনা করার জন্য গাণিতিক জ্ঞানকে ব্যবহার করতেন। প্রাচীন গণিতশাস্ত্রের কিংবদন্তি আর্যভট্ট গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কীয় বিবিধ তথ্য ‘আর্যভট্টীয়’ নামে গ্রন্থে চার খণ্ডে মোট ১১৮টি স্তোত্রে লিপিবদ্ধ করে  গিয়েছেন। আর্যভট্ট সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগৎ ও পৃথিবীর আহ্নিক গতির ধারণা দিয়েছেন গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, ব্রুনোদের হাজার বছর আগেই। তিনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পৃথিবী নিজ অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরে। তিনি পৃথিবীর আহ্নিক গতির হিসাবও করেছিলেন। তাঁর হিসেবে পৃথিবীর পরিধি ৩৯ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে পৃথিবীর নির্ণীত পরিধি হল ৪০ হাজার ২৩৪ কিলোমিটার প্রায়। তাঁর হিসেবে ভুলের পরিমাণ ছিল অতি নগণ্য, মাত্র ০.২ শতাংশ। এছাড়াও তিনি চাঁদ ও সূর্যের গ্রহণ সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের গণিতবিদ সূর্য সিদ্ধান্ত গাণিতিক হিসেব কষে বের করেছিলেন, পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে মোট সময় লাগে ৩৬৫.২৫৬৩৬২৭ দিন। যা আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে বের করা সময় ৩৬৫.২৫৬৩৬৩০০৪ দিনের চেয়ে মাত্র ১.৫ সেকেন্ড বেশি। আজ থেকে প্রায় ২ হাজার ৭০০ বছর আগে, না ছিল কোনও টেলিস্কোপ, না ছিল কোনও উন্নত যন্ত্র। তবুও গণিতের কাঁধে ভর করে, এত সূক্ষ্ম মান কীভাবে তিনি বের করেছিলেন, সেটা আজও বিস্ময়।

প্লাস্টিক সার্জারি
সুশ্রুত প্রাচীন বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক বিস্ময়ের নাম। আজ থেকে প্রায় ২ হাজার ৬০০ বছর আগে প্রাচীন ভারতে জন্ম নেওয়া এই মহর্ষির কাছে চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেকভাবেই ঋণী। সর্বকালের সেরা শল্যচিকিৎসকদের তালিকায় স্থান করে   নেওয়া সুশ্রুত লিখে গিয়েছেন ‘সুশ্রুত সংহিতা’ নামে এক গ্রন্থ, যা বিশ্বের সেরা শাস্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। পৌরাণিক কাহিনিতে সুশ্রুতকে বর্ণনা করা হয়েছে ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্র কিংবা ধন্বন্তরির বংশধর হিসেবে। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ধন্বন্তরির পরিচয় পাওয়া যায় দেবতাদের চিকিৎসক হিসেবে। সুশ্রুত শল্যচিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি  প্রসূতিবিদ্যার নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি সেই  প্রাচীন যুগেই রাইনোপ্লাস্টি (নাকের অস্ত্রোপচার ),  অস্টোপ্লাস্টি,   ল্যারিংগোপ্লাস্টির মতো জিনিসেরও বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন। মূলত প্রণালীবদ্ধ সূক্ষ্ম ও সঠিক শল্যচিকিৎসার পথিকৃৎ তিনিই। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ছানি দূরীকরণের নজির পাওয়া যায় সুশ্রুতের আমলেই, সেই খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে। চোখ থেকে ছানি অপসারণে সুশ্রুত ‘জবামুখী শলাকা’ নামে এক প্রকার সুচ ব্যবহার করতেন। এর মাধ্যমে মূলত লেন্স আলগা করে, চাপ দিয়ে ছানিকে বের করে আনা হতো। তারপর চোখ সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সেটাকে ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়ে রাখা হতো।

আয়ুর্বেদ
হিপ্পোক্রেটিসের জন্মের বহু আগেই ‘চরকসংহিতা’ গ্রন্থের লেখক আচার্য চরক শরীরতত্ত্ব নিয়ে লিপিবদ্ধ বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছেন। প্রাচীন এই ভারতীয় মনীষীকে বলা হয় ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক। পৃথিবীতে তিনিই প্রথম চিকিৎসক, যিনি হজম-ক্রিয়া, বিপাক-ক্রিয়া, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বিশদ আলোচনা তাঁর শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। এছাড়াও তাঁর বইয়ে দেহতত্ত্ব, নিদানতত্ত্ব ও ভ্রূণতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক।
আশ্চর্যের বিষয় যে, উইলিয়াম হার্ভের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে তিনি মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের কথা ব্যক্ত করে গিয়েছিলেন। এককালে পৃথিবীর প্রায় সকল ভাষাতেই গ্রন্থটিকে অনুবাদ করা হয়েছিল। প্রাচীনকালে এত সম্মান বোধহয় আর কোনও গ্রন্থের ভাগ্যে জোটেনি। 
প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কোনও ব্যক্তিবিশেষের গবেষণার ফল নয় বলেই ধরা হয়। হাজার বছরের অজস্র প্রতিভার বিচ্ছুরণেই এমন এক পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাবিজ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।

5th     December,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ