‘সত্যি বলতে কী আপনার রিস্ট ওয়াচের কালেকশন কিন্তু দেখার মতো মিস্টার অগ্নিভ বসু। আরে আমি তো জানলাম একটা ইউটিউব ভিডিও দেখে। আমার নিজেরও নেশা আছে। তাই অ্যাড্রেস জোগাড় করে চলেই এলাম। বহুদিন দেশের বাইরে ছিলাম। ফিরেছি বছর দু’য়েক হল। তাই আমার বেশিরভাগ কালেকশন বিদেশি বুঝলেন কি না। এখানে এসে গোটা চারেক অকশন পেলাম মাত্র। আপনি এত ওয়াচ সংগ্রহ করলেন কোথা থেকে অগ্নিভ?’
অগ্নিভ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘পুরনো কলকাতায় একটা দোকান আছে, সেখানে অনেকেই এসে ঘড়ি বিক্রি করে যায়। ওই দোকানদারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তিনিই রেয়ার পিস দেখলে ফোন করেন। এই যে, আপনি আমার এত কালেকশন দেখলেন এগুলো কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। আমি মাত্র বছর চারেক জমাচ্ছি।’
লক্ষ্মীকান্তবাবু হেসে বললেন, ‘আরে আপনার বয়সই বা কত? বড়জোর ত্রিশ হবে, কি ভুল বললাম নাকি?’
অগ্নিভ হেসে বলল, ‘আরে না না আপনার ভাবনাই ঠিক। এই মাসেই আমার ত্রিশ হবে। আমি নিজের জন্মদিনে নিজেকে গিফ্ট করব বলে একটা অ্যান্টিক রিস্ট ওয়াচ খুঁজছি। যদি খোঁজ দিতে পারেন, তাহলে অবশ্যই দেবেন। কারণ আপনার এক্সপিরিয়েন্স আমার থেকে অনেক বেশি।’
লক্ষ্মীকান্ত দাস হেসে বললেন, ‘ওহ ডেফিনেটলি। তাছাড়া এই মুহূর্তে আমার নেশাটা হঠাৎই বদলে গেছে। মনের ওপরে তো কোনও জোর চলে না। তাই অবাধ্য মন হঠাৎ ঘোষণা করে বসল, আর ঘড়ি নয়, এবারে গাড়ি সংগ্রহ করতে হবে। বুঝতেই পারছেন মন আমার আচমকা বড়লোক হতে চাইছে। তাই নেশাও বদলে ফেলেছে। দেখি খান পাঁচেক গাড়ি সংগ্রহ করে, তারপর যদি দেখি নেহাতই অসাধ্য তখন আবার ব্যাক টু দ্য প্যাভেলিয়ন। আসুন একদিন আমার বাড়িতে। আমার কালেকশন দেখে যাবেন।’
অগ্নিভ আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘কবে ডাকছেন বলুন? আমি তো এক পায়ে রাজি।’ আগামী কাল সন্ধ্যার আমন্ত্রণ সেরে বেরিয়ে গেলেন লক্ষ্মীকান্তবাবু।
অগ্নিভ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। রোববারের ছুটির আমেজ সামনের রাস্তার দিকে তাকালেই চোখে পড়ছে। অন্যদিনের মতো ছুটোছুটি চোখে পড়ছে না। বরং ভারী ভারী বাজারের ব্যাগ হাতে একটু দুলকি চালে হাঁটছে লোকজন। সেদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছে অগ্নিভ। স্কুলে পড়ার সময় রোববার হলেই বাবা পাঁঠার মাংস নিয়ে এসে বলত, ‘বেশ কষিয়ে রাঁধো তো।’ অগ্নির হাতে সময়ের একটা ফল দিয়ে বলত, ‘ধুয়ে খাবি।’ সেই বাবাটাই আস্তে আস্তে কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগল। বাবার এই পরিবর্তনে বড্ড কষ্ট পেত অগ্নিভ। মাকে জিজ্ঞাসা করলেই মা অগ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, ‘ক’দিন সময় দে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বাবা অকারণে অগ্নি আর মায়ের ওপরে চিৎকার করত। ছোট্ট ছোট্ট ভুলের জন্যও অগ্নি বকা খেত বাবার কাছে।
ক্লাস এইটে পড়ার সময় পলাশ একটা ঝকঝকে ঘড়ি হাতে দিয়ে স্কুলে এসেছিল। ক্লাসের সবাই ঝুঁকে পড়েছিল ওর ঘড়িটা দেখতে। ওর বাবা নাকি বাইরে থেকে এনে দিয়েছে। সে ঘড়ির ভিতরে তিনটে পাথর বসানো ছিল। ঠিক যেন তিন ফোঁটা জল। পলাশ যেহেতু লাস্টবেঞ্চের ছেলে তাই ওকে কেউই তেমন পাত্তা দিত না। কিন্তু সেদিন ওর হাতে ঘড়িটা দেখার জন্য সকলেই বেশ তোয়াজ করছিল ওকে। ফার্স্টবয় বলেই হয়তো অগ্নিভকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না পলাশ। অগ্নিভ অবশ্য কোনওদিনই কাউকে বিরক্ত করেনি ক্লাসে। তবুও বেশ কয়েকজন অগ্নিভকে পছন্দ করত না। ওর ইচ্ছা করছিল ওই ঝকঝকে ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখতে, তাই গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পলাশের বেঞ্চের পাশে।পলাশ ওকে দেখে বেশ আনন্দ করেই বলেছিল, ‘এই অগ্নি পরবি একবার আমার ঘড়িটা?’ ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ‘না পরব না। একবার হাতে নিয়ে দেখব।’ পলাশ শোনেনি ওর কথা। জোর করে অগ্নির হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘এই ক্লাসটা তুই পরে থাক।’ অগ্নিভর অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছিল ঘড়িটা পরে। মনে হচ্ছিল এটা যেন ওর হাতের জন্যই তৈরি। কী সুন্দর মানিয়েছিল ওর হাতটা। ঠিক সেই সময়েই জীবন বিজ্ঞানের স্যর অজিতবাবু হাতে বেত নিয়ে ঢুকলেন। ছুটে গিয়ে যে যার সিটে বসে পড়েছিল।
অজিত স্যর ঢুকেই পড়া ধরলেন পলাশকে। যথারীতি পলাশ পড়া পারল না। পলাশের উত্তরটা জানতে চেয়েছিলেন অগ্নিভর কাছে। অগ্নিভ উত্তর দেবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই পলাশ আচমকা চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল, ‘স্যর আমার ঘড়ি চুরি করেছে অগ্নিভ। ওই দেখুন ওর হাতে ঘড়িটা।’ ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠেছিল অগ্নিভ। ও কিছু বলার আগেই স্যর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এটা পলাশের ঘড়ি?’ অগ্নিভ বলেছিল, ‘হ্যাঁ স্যর পলাশের ঘড়ি। কিন্তু আমি চুরি করিনি।’
শেষের বাক্যটা আর শোনেননি স্যর। পিঠে সজোরে বেতের বাড়ি মেরে বলেছিলেন, ‘লজ্জা করে না চুরি করতে? তোদের এই শেখাই আমরা?’
পলাশের দুটো বন্ধুও সাক্ষী দিয়েছিল পলাশের হয়ে, ‘হ্যাঁ স্যর ওটা পলাশের ঘড়ি, অগ্নিভ চুরি করেছে।’
স্যর একটানে ঘড়িটা খুলে নিয়েছিল অগ্নিভর হাত থেকে। পলাশের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্কুলে ঘড়ি পরে আসার দরকার নেই।’ জীবনের প্রথম মার তাও বিনা দোষে, চুরির অপবাদে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অগ্নিভ। ভাবতেই পারছিল না, পলাশ এভাবে বদলা নেবে নিজের অক্ষমতার। আপাত শান্ত অগ্নির জেদ চেপে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরেই বাবার আলমারি খুলে লাল ভেলভেটের বক্সে রাখা ঘড়িটা বের করে হাতে পরেছিল। বাবার ঘড়িটা যে আরও দামি সেটা আগেই জানত। অগ্নিভর দাদু তার নিজের ঘড়িটা জামাইকে দিয়েছিল বিয়েতে। সোনা আর হীরে আছে এ ঘড়িতে, মা একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিল বাবাকে। ঘড়িটা হাতে পরার পর মারের আর অপমানের ব্যথাটা যেন একটু হলেও কমেছিল অগ্নিভর। ভয়ে ভয়েই কাউকে না জানিয়ে বাবার ঘড়িটা পরে পরের দিন স্কুলে গিয়েছিল অগ্নিভ। বন্ধুরা সবাই ওকে ঘিরে ধরে সোনার ঘড়ি দেখতে ব্যস্ত ছিল। পলাশ ধারে কাছে আসেনি সেদিন। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরতেই বাবার হাতে ধরা পড়েছিল অগ্নিভ। হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল বাবা ওই ঘড়িটা। সঙ্গে জুটেছিল বেধড়ক মার। কেন বাবার আলমারি খুলেছে? এত সাহস পেল কোথায়? এসব বলেই সেদিন আরেক চোট মার খেয়েছিল অগ্নি। সেদিন ফার্স্ট হয়েও মনে হয়েছিল, পলাশের মতো লাস্ট হলেও ক্ষতি নেই, শুধু ওর বাবার মতো ভালো মনের বাবা থাকলেই চলত।
মা বলেছিল, ‘মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করলে তোকে বাবা ওই ঘড়িটা দেবে।’ মাধ্যমিক- উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট সব পাশ করার পরেও ওই ঘড়ি বাবা দেয়নি অগ্নিকে। সত্যি বলতে কী এত স্বার্থপর বাবা অগ্নি খুব কম দেখেছে। শুধু পড়ার বই আর টিউশন ছাড়া আর কোনও খরচ করেনি বাবা অগ্নিভর পিছনে। অথচ বেশ ভালো চাকরি করত ওর বাবা। অসম্ভব কিপটে একটা মানুষ। মাও ছিল তেমন, কিছুতেই বাবার দোষ দেখতে পেত না। সেই ছোট থেকে বাবার ওপরে একটা অদ্ভুত আক্রোশ জন্মেছিল অগ্নির। বিশেষ করে ওই ঘড়িটাকে কেন্দ্র করে বাবা যেটা করেছিল সেটা আজও মেনে নিতে পারে না সে। জীবনে এত ঘড়ি সংগ্রহ করেছে কিন্তু ওই ঘড়িটাকে কিছুতেই ভুলতে পারেনি। ডাক্তারি পাশ করে প্র্যাকটিস শুরু করার আগেই বাবা মারা গিয়েছিল। ক্রমশ রোগা হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু জীবনে ডাক্তারের কাছে যেতে দেখেনি অগ্নি। আসলে অসম্ভব গোঁয়ার মানুষদের মতিগতি বোঝা মুশকিল। মা যদিও নিজে টাকা জমিয়ে অগ্নিকে একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল, কিন্তু ও সে ঘড়ি কোনওদিন পরেনি। সংগ্রহটা নেশা, কিন্তু নিজে একটিও পরে না। সেই যে ক্লাসে চুরির জন্য মার খেয়েছিল, সেই যে বাবা চূড়ান্ত অপমান করে হাত থেকে ঘড়িটা ছিনিয়ে নিয়েছিল, তারপর থেকে ঘড়ি পরার ইচ্ছেটাই চলে গেছে।
নীপা অবশ্য ভ্যালেন্টাইনডেতে ওকে গত তিন বছর ধরে ঘড়িই গিফট করে, আর প্রতিবার আক্ষেপ করে বলে, ‘কী লাভ হয় এত ঘড়ি কিনে? হাতে তো একটাও পরতে দেখি না।’ নীপার এমডি হয়ে গেলেই ওদের বিয়ে, এমনই কথাবার্তা হয়ে আছে। অগ্নির মায়ের ইচ্ছে কৃষ্ণদেবপুরের বাড়ি থেকে ওদের বিয়েটা হোক। কিন্তু অগ্নি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে সে কলকাতার ফ্ল্যাট থেকেই বিয়ে করবে। কীসের স্মৃতি আছে ওই গ্রামের বাড়িতে? কথায় কথায় বাবার চোখরাঙানি আর শাসন ছাড়া ওখানের উঠোনে, ঘরে আর তো কোনও স্মৃতিই পড়ে নেই অগ্নির। একটা বিজবিজে রাগ হতো মায়ের ওপরেও। মা সর্বদা বাবার অন্যায়গুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করত। কোনওদিন রুখে দাঁড়িয়ে বলেনি, ‘অগ্নিকে বকছ কেন? ছেলেটা তো কিছুই করেনি।’ এই কারণেই ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছে সে। মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের ছোট ঘরটাও যেন ওর কাছে শান্তির ছিল বাড়ির থেকে।
ধুর, একলা থাকলেই ওই পিছনের ফেলে আসা খারাপ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে বড্ড উৎপাত করে। অগ্নি যত ভুলতে চায় ওর পাস্টটাকে ততই যেন অতীত ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে সোচ্চারে ঘোষণা করে— তুমি তোমার বাবার বড় অবহেলার সন্তান।
লক্ষ্মীকান্ত মানুষটা বেশ মিশুকে। এতদিন বাইরে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাংলা কী সুন্দর বলেন। তাছাড়া সামান্য একটা ইউটিউব ভিডিও দেখে খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির। ভদ্রলোকের কোনও অহঙ্কার নেই। ওঁর বাড়ি যাওয়ার সময় কী নিয়ে যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘আমি মনে প্রাণে খাঁটি বাঙালি।’ তাহলে ফুল, চকোলেট বাদ দিয়ে রসগোল্লা নিয়ে যাবে বরং।
সল্টলেক এলাকায় সুন্দর সাজানো বাড়ি লক্ষ্মীকান্তবাবুর। বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় বেশ সম্ভ্রান্ত। চারদিকে অ্যান্টিক জিনিসের ছড়াছড়ি। অগ্নিভকে খাতির করে নিয়ে গিয়ে বসালেন ড্রইংরুমের বিশাল সোফাতে। ফিসফ্রাই, ফিসফিঙ্গার, নানা রকমের মিষ্টি সাজিয়ে বললেন, ‘নিন খান দেখি।’
অগ্নিভ অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘কী মুশকিল আমি তো এসেছি ঘড়ির কালেকশন দেখতে, আপনি তো খাবারের এক্সিবিশন বসিয়ে দিলেন মশাই।’
দরাজ হেসে বললেন, ‘আমরা হলাম বাঙালি, খাওয়া ছাড়া কাজে মন বসে না বুঝলেন।’ নিয়ে গেলেন দেওয়াল জোড়া বিরাট কাচের আলমারির সামনে।
চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মতো বিদেশি ঘড়ির কালেকশন।
প্রতিটা ঘড়ির নীচে একটা করে কাগজ ভাঁজ করা আছে। অগ্নিভ বলল, ‘ওগুলো কী মিস্টার দাস?’
লক্ষ্মীকান্তবাবু বললেন, ‘ওগুলো আমার পাগলামি বলতে পারেন। প্রতিটা ঘড়ির নীচে যে কাগজটা আছে ওটাতে এই ঘড়ির মালিক বদলের গল্প আছে। দাঁড়ান বাঙালি একজনের চিঠি পড়ছি।’
একটা কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলেন লক্ষ্মীকান্তবাবু। ‘আমি শ্রী অমল গুপ্ত, সজ্ঞানে এ ঘড়িটি বিক্রি করছি। আমার মেয়ের বিয়ের সময় উপস্থিত, তাই সত্বর অর্থের প্রয়োজন। এ ঘড়ি চোরাই নয়। এ ঘড়ি আমার ঠাকুরদার।’
অগ্নিভ হেসে বলল, ‘মানে প্রতিটা ঘড়ি আপনি কার কাছ থেকে কিনেছেন সেটা ওই কাগজ পড়লেই মনে পড়ে যাবে। ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া।’ কথা বলতে বলতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তিনটি হীরে বসানো ঘড়িটার দিকে। বড্ড চেনা লাগছে ঘড়িটা। তবে ও যেটা ভাবছে সেটা না হবারই একশো পার্সেন্ট সম্ভাবনা। কারণ বাবা মারা যাবার পরেও বাবার আলমারিতে লাল ভেলভেটের বাক্সটাকে দেখেছে অগ্নি। যদিও ওটাতে হাত দেওয়ার প্রবৃত্তি হয়নি ওর।
‘মিস্টার দাস, ওই ঘড়ির নীচের চিঠিটা একবার পড়বেন প্লিজ?’ লক্ষ্মীকান্তবাবু হেসে বললেন, ‘আপনার দেখছি কালেকশন দেখার থেকে চিঠি পড়ার নেশা বেশি।’
‘আমি শ্রীযুক্ত অরুণাভ বসু, গ্রাম কৃষ্ণদেবপুর। আমার সন্তান মেডিক্যালে চান্স পাওয়ায় আমার অর্থের প্রয়োজন হেতু এ ঘড়িটি আমি বিক্রয় করছি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়। এ ঘড়িটি আমার শ্বশুরমশাই আমায় দিয়েছিলেন আশীর্বাদ স্বরূপ।’
আর পড়তে পারছিল না অগ্নিভ। এতদিনের চেনা মানুষটার মুখটা কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছিল। যে ঘড়িটায় হাত দিয়েছিল বলে অগ্নিভকে বকেছিল বাবা, সেটাই ওর পড়াশোনার খরচ চালাতে অবলীলায় বিক্রি করে দিয়েছিল লোকটা! অগ্নিভ ধরা গলায় বলেছিল, ‘মিস্টার দাস এ ঘড়িটা আমায় আপনি বিক্রি করবেন? আমার সব কালেকশন দিয়ে দেব আপনাকে।’
লক্ষ্মীকান্তবাবু কী বুঝলেন কে জানে! বললেন, ‘প্রায় বছর বারো আগে কয়েকদিনের জন্য দেশে ফিরেছিলাম, তখনই একটা অকশনে কিনেছিলাম এটা। আমি যে দামে কিনেছিলাম আপনি সেটাই দিন আমায় তাহলেই হবে।’
ঘড়িটা হাতে পরে অগ্নি সোজা গেল কৃষ্ণদেবপুর মায়ের কাছে। এ বাড়ি ছেড়ে মা কোনওদিন কোথাও থাকবে না জানে অগ্নি।
ঘড়িটা দেখে মা বলল, ‘হ্যাঁ, বেচে দিয়েছিল তোর বাবা। চুরির মিথ্যে অপবাদে ব্যাঙ্কের চাকরিটা চলে গিয়েছিল তোর বাবার।
ছোট একটা কাজ জুটিয়েছিল। এদিকে নিজের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। সব মিলিয়ে মানুষটা যেন কেমন পাল্টে গেল। মিথ্যে অপবাদটা মেনে নিতে পারেনি কোনওদিন। দিনরাত বলত, ছেলেটাকে ঠিক মতো কিছুই দিতে পারছি না আমি। অপদার্থ বাবা। কথায় কথায় রেগে যেত।’
অগ্নিভ বহুদিন পরে বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ হয়ে। ক্ষমা চাওয়া উচিত কি না বুঝতে পারছে না। ঘড়িটা হাত থেকে খুলে বাবার ছবির সামনে রেখে ঘর থেকে নীরবে বেরিয়ে এল।
অঙ্কন : সোমনাথ পাল