বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

এ লগন গান   শোনাবার   
সমৃদ্ধ দত্ত

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আজীবন শব্দ আর বাক্য নিয়ে নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গিয়েছেন। দেশভাগ পরবর্তী বাংলায় তিনি একে একে বাঙালির হৃৎপিণ্ড তোলপাড় করা গানের কথা উপহার দিয়েছিলেন।
 
অনেক লড়াই করতে হয়েছে। কখনও সুরের সঙ্গে। কখনও আধুনিকতা বনাম ঐতিহ্যের দ্বিধায়।  কখনও লঘুতা আর তারল্যের সন্দেহের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে। অন্তহীন পরীক্ষা দিয়েছে বাংলা গানের কথা। প্রতিটি দশকে, প্রতিটি যুগে, কথাকে দাঁড় করানো হয়েছে শিল্পশৈলী এবং রুচি-সংশয়ের কাঠগড়ায়। কখনও সে জয়ী হয়েছে। কখনও পিছু হটেছে। আর তাই বোধহয় বাংলা গানের কথা নিয়ে আজ পর্যন্ত যত পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, সেই নজির অন্য ভাষার গান-বিবর্তনে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ তৈরি হয়। ১৯৩৩ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সের এক সুরকার কমল দাশগুপ্ত নবীন গীতিকার প্রণব রায়কে বলেছিলেন তখনও প্রায় কিশোরী এক শিল্পীর জন্য গান লিখতে। রেকর্ড করা হবে। কন্যার নাম যূথিকা রায়। প্রণব রায় আশ্চর্য পরীক্ষা করেছিলেন। লিখেছিলেন দু’টি গান। ‘আমি ভোরের যূথিকা’ এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’। বাংলা আধুনিক গানের কথার সড়কপার্শ্বে এই দুই গানের ফলক স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেই যাত্রাপথ কেমন ছিল? কঠিনতম। কারণ, শুধু তো কথা নয়। কমল দাশগুপ্ত এমন সুর ও আবহসঙ্গীত ব্যবহার করলেন, যা ছিল অভিনব। তবলাই নেই। রঞ্জিত রায়ের পিয়ানো আর পরিতোষ শীলের বেহালা। পিয়ানোর মধ্যেই যেন তবলার তাল। কিন্তু যাঁরা রেকর্ড বিক্রি অথবা গানের বাণিজ্য দেখবেন, সেই ডিলাররা নারাজ এই গান নিয়ে ঝুঁকি নিতে। তাঁদের আগে নমুনা রেকর্ড দিয়ে শোনাতে হয়। শুনে তাঁদের বক্তব্য, না হয়েছে রাগপ্রধান। আবার পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ধাঁচও নেই। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ও সুরের ধারায় হলেও একটা বোঝা যায়। কিন্তু কোনওটাই নয়। এই গানের কথা ও সুর তো সম্পূর্ণ অচেনা। এই রেকর্ড নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যায় না। ঘটনাচক্রে গান যখন বাজছিল তখন সেই ঘরের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। কোনও কাজে এসেছেন। তিনি তো শুনে মুগ্ধ। ডিলারদের দ্বিধা দেখে ধমক দিয়ে বললেন, আরে এখনই রিলিজ করাও রেকর্ড। আমি বলছি, ভালো বিক্রি হবে। ডিলাররা কাজীসাহেবের কথা তো ফেলতে পারেন না। তারা শুধু ভাবছে দুশো কপি বিক্রি হলেই লোকসানটা বেঁচে যাবে। যূথিকা রায়ের সেই রেকর্ড ৬০ হাজারের বেশি বিক্রি হয়েছিল! বাংলা আধুনিক গান ভোরবেলাতেই একটি কঠিন যুদ্ধ জয় করেছিল নিজস্ব পরীক্ষাকে শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থান করে দিয়ে। 
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আজীবন শব্দ আর বাক্য নিয়ে এই নিবিড় পরীক্ষাটি করে গিয়েছিলেন। একাধারে তিনি সরল কথাকে কাব্যসুষমার অলঙ্কার পরাতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার অন্যদিকে, বাংলা ভাষার সৌকর্য ও ঝংকারকে গানে যে কী আশ্চর্য দক্ষতায় উদ্ভাসিত করা যায় সেটাও শিক্ষণীয় তাঁর কাছে। যে মানুষটি বিরহের প্রসঙ্গে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে বলে দেবেন, ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ ওগো দু’টি দিকে গেছে বেঁকে’, সেই গীতিকারই আবার স্থানকালপাত্র বিচার করে চূড়ান্ত এক বিশুদ্ধতার গুণমানে কলমকে নিমজ্জিত করে লিখবেন, ‘মম সরসীতে তব উজল প্রভা/ বিম্বিত যেন লাজে/ আমি যামিনী তুমি শশী হে...’। 
এক উত্তাল রাজনৈতিক এবং সামাজিক অভিঘাতের দেশভাগ পরবর্তী বাংলায় একটি অগ্ন্যুৎপাতের জন্ম হয়েছিল বঙ্গসংস্কৃতির বিনোদন অঙ্গনে। সেই অগ্ন্যুৎপাতের নাম ছিল ‘অগ্নিপরীক্ষা’। যে ছবিটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসের নদীপথের আগামী দিনের গতিমুখই বদলে দিয়েছিল। সচরাচর মনে করা হয় বুঝি সেই অগ্ন্যুৎপাতের ঝলকানির জন্ম দিয়েছিলেন দুই নারীপুরুষ। উত্তমকুমার আর সুচিত্রা সেন। বাঙালি জীবনের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, প্রেম, বিরহ, ফ্যাশন, স্টাইলের সপ্তপদী এই দু’‌জন রচনা করে গিয়েছিলেন। একথা ঠিক। আর তাঁদের সঙ্গেই হাজির হয়েছিল দু’টি কণ্ঠ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এই চারজনই ছিলেন নতুন ও ভবিষ্যৎ বাংলা সিনেমা-সঙ্গীতের ভগীরথ। কিন্তু সেখানেই কি সব বলা হয়ে গেল? একেবারেই নয়। কারণ এই চারজনের ওই উজ্জ্বল আলোকবৃত্তের আড়ালে হাজির হয়েছিলেন জাদুকলম হাতে পাবনার বাচ্চু মজুমদারও। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার নামে যাঁকে উত্তরকাল প্রণাম করবে। তিনি হয়েছিলেন ওই চার নারী পুরুষের বঙ্গহৃদয় বিজয়ের অশ্বমেধের ঘোড়ার অন্যতম অদৃশ্য চালিকাশক্তি। কারণ তিনি একে একে বাঙালির হৃৎপিণ্ড তোলপাড় করা গানের কথা উপহার দিলেন। বাংলা জুড়ে অসংখ্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা সেনেরা তাঁদের উত্তমকুমারের উদ্দেশে চিরকাল মনে মনে বলে গেলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মন্ত্র:
‘কে তুমি আমারে ডাকো/ অলখে লুকায়ে থাকো/ ফিরে ফিরে চাই/ দেখিতে না পাই’। 
এখানেই শেষ নয়। সেই দুই নতুন ছেলেমেয়ে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের বিশ্বজয়ের সূত্রপাতেই  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বাঙালি প্রেমিকাদের চিরন্তন প্রেম প্রস্তাবের ধ্রুবপদ দিয়ে গেলেন, যা আজও গুনগুন করে চলেছে প্রতিটি মন। 
‘...মিতা মোর কাকলি কুহু
সুর শুধু যে ঝরাতে চায়
আবেশ ছড়াতে চায়
প্রাণে মোর
গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু।’
উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন নামক দুই ক্ষণজন্মা মহাজাগতিক নক্ষত্রের যুগলবন্দির ইতিহাস সৃষ্টি করার সঙ্গে কী কী অনুঘটক যুক্ত হয়েছিল? একের পর এক ছবিতে ঘটেছিল সেই অনুঘটকের স্ফুরণ। আসলে অনুঘটকটিকে গানের মতো দেখতে। কিন্তু আসলে ছিল একটি করে ম্যাজিক। সেই ম্যাজিশিয়ানরা ছিলেন কখনও রবিন চট্টোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার জুটি। কখনও সেই ম্যাজিকের নাম ছিল— 
‘ঘুম ঘুম চাঁদ
ঝিকিমিকি তারা
এই মাধবী রাত
আসেনি তো বুঝি আর
জীবনে আমার’
আবার কখনও সেই জাদুশব্দগুলি আকাশবাণী ও গ্রামোফোন রেকর্ডে ঝড় তুলে বলেছিল—
‘সে এক রূপকথারই দেশ
ফাগুন যেথা হয় না কভু শেষ
তারারই ফুল পাপড়ি ঝরায়
যেথায় পথের ধারে
সাত সাগরের পাড়ে
আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে...’
ভালোবাসা প্রকাশের মধ্যে কোনও জটিলতা থাকবে কেন? মনের কথা সরলভাবে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়াই তো স্বাভাবিক। অতএব সারল্য এবং কাব্যময়তার নিখুঁত ভারসাম্য রচনা করে বঙ্গপ্রেমের জগৎকে একের পর কোটেশন উপহার দিয়ে গেলেন গৌরীপ্রসন্ন। কী সেইসব গানের বৈশিষ্ট্য? গানের কথা কষ্ট করে মনে রাখতে হয় না। অনায়াসে তারা নিজেদের স্থাপন করে নেয় সুরেলা সরলতায়। সেই সুরের ভেলায় উত্তম আর সুচিত্রা বঙ্গমহাকাব্য নির্মাণ করলেন। সরাসরি বললেন তাঁরা একে অন্যকে হৃদয়বার্তা। এর থেকে স্পষ্ট মনের কথা আর হতেই পারে না। অথচ কী মধুর কাব্যরূপ!
‘তুমি যে আমার
ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো
তুমি যে আমার’
অথবা 
‘এ শুধু গানের দিন
এ লগন গান শোনাবার।’
আকাশে চাঁদ দেখলে প্রিয়ের কথা মনে পড়লে যুগ যুগ ধরে কোন গান গুঞ্জরিত হয়েছে বাঙালির হৃদয়ে? ‘এই রাত তোমার আমার/ওই চাঁদ তোমার আমার/ শুধু দু’জনের/ এই রাত শুধু যে গানের...’
 যাকে আধুনিক সময়ের গান বলা হচ্ছে, যার স্থানকালপাত্র সমকালীন, সেই কাহিনি বর্ণনায় সদা পরিচিত ও নিয়ত ব্যবহৃত কথ্যভাষাই তো ব্যবহার করা হবে? এটাই তো নিয়ম? কিন্তু তিনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ১৯২৫ সালে জন্ম। কলকাতা জয় করতে আসবেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই সাহিত্যের এমএ পাশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাবার ইচ্ছায় সিভিল সার্ভিস অথবা ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতের যাওয়ার আহ্বান হেলায় সরিয়ে দিয়েছেন গানের টানে। কলেজে কবিতা লিখে পত্রিকায় পাঠানো সত্ত্বেও সেই কবিতা মনোনীত না হওয়ায় আত্মসম্মানে বিদ্ধ তরুণ প্রতিজ্ঞা করবেন যে, আমার লেখা একদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে! ছাত্রাবস্থায় কালিদাসের ‘মেঘদূত’ অনুবাদ করা হয়ে গিয়েছে। সুতরাং সেই তিনি কেন স্রোতে গান ভাসাবেন?  অতএব গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সূক্ষ্মভাবে কথ্য ভাষা ও সাধু ভাষার সুচারু সম্মিলন ঘটালেন গানের পর গানে। লিখলেন—
‘তুমি না হয় রহিতে কাছে
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে’
কিংবা 
‘এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু
একটি সে নাম আমি লিখেছিনু
আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে
তারে যেন মুছিয়া দিলাম’
 ইংরেজির ছাত্র? দেখি তো কেমন অনুবাদের হাত? শচীন দেব বর্মণ বাড়িতে আসা কলেজ ছাত্রটির পরীক্ষা নিলেন এবং গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার উত্তীর্ণ। সেই সংযোগকে সঙ্গীতের ঈশ্বর কোথায় নিয়ে যাবেন একদিন? বাস্তব মাঝে মাঝে স্বপ্নকেও হারিয়ে দেয়। তাই হল! শচীন কর্তার কোন গান আজও বাঙালির কানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে? ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/ ও যে ডাকাতিয়া বাঁশি’। গৌরীপ্রসন্নকে দিয়ে লেখালেন শচীন কর্তা। 
কলেজ জীবনের বন্ধু তো অনেকেই হয়। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত চলার সঙ্গী হয়ে রয়ে যায় ক’জন? ক’জন বন্ধুই বা একই নৌকায় চেপে জীবনতরণী বেয়ে পৌঁছতে পারে কালজয়ী সাফল্যে? গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এরকম বন্ধু পেয়েছিলেন। যাঁর নাম নচিকেতা ঘোষ। ঠিক কেমন বন্ধুত্ব আর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ছিল? মধ্যরাতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি রাগের বিলম্বিৎ শুনতে শুনতে আচমকা নচিকেতা ঘোষ কান বন্ধ করে দৌড় শুরু করলেন। ওই সুর তাঁর মনে আরও একটি সুরের জন্ম দিয়েছে। সেই সুর যেন চলে না যায়। তাই ছুটছেন তিনি! বাড়িতে ঢুকেই সুরটি তৈরি করছেন মনে মনে। ফোন করলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে। চলে আসতে হবে এখনই । গৌরীবাবু বলছেন, আরে! এখনও বাসই চালু হয়নি! ওসব জানি না আসতে হবে! নাছোড় নচিকেতা ঘোষ। অগত্যা গৌরীবাবু এলেন এবং তৈরি হল —‘বনে নয়, মনে মোর/ পাখি আজ গান গায়।’ 
এইচএমভি চাইছে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়াতে। সুর কে দেবেন? বলা হল মান্না দে-কে। তিনি সুরও দিলেন। গানের কথা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন বম্বেতে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। মান্না দে অত্যন্ত যত্ন করে মনপ্রাণ ঢেলে সুর করলেন। লতা মঙ্গেশকরকে ডেকে তিনি সেই দুই গান তুলিয়েও দিলেন। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের দিন আর লতা এলেন না। হতেই পারে। কোনও কারণে আসতে পারেননি। আবার নতুন রেকর্ডিংয়ের দিন স্থির হল। কিন্তু একি! সেদিনও লতা গরহাজির! এবার মান্না দে বিরক্ত! তিনি ভাবলেন, আমি নিজেই গান দুটো গেয়ে দিই! ১৯৫৩ সাল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা কোন বাংলা গান গাইলেন মান্না দে? যা তাঁর প্রথম বাংলা গান হিসেবে থাকবে? যদিও সেই গান প্রথমেই রিলিজ করেনি। কিন্তু রেকর্ড তো হয়েই রইল। গান দু’টি আজও ভাস্বর এবং মান্না দে মানেই ওই গান দুটির কথা মনে পড়বেই! ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ এবং ‘হায় হায় গো রাত যায় যায় গো’! 
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার চিরকালই রেকর্ড করতে ভালোবাসেন। তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করতেই এসেছিলেন বঙ্গসঙ্গীত দুনিয়ায়। তাই যে কোনও শিল্পীর যে গানটি তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর, সেই গানের গীতিকার সর্বদাই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। আবার খ্যাতনামাদের জীবনে প্রথম গানের কৃতিত্বের সঙ্গেও যুক্ত গৌরীবাবু। ধরা যাক, হেমন্তবাবুর আধুনিক বাংলা গান! এই বাক্যটি শুনলে কোন গানের কথা এবং সুর ভেসে ওঠে মনে? যা মিথ হয়ে গিয়েছে? ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’। কার লেখা? গৌরীবাবুর।  ১৯৫২ সালে ভি শান্তারামের অমর ভূপালি নামক একটি হিন্দি সিনেমার বাংলা ভার্সনে প্রথমবার লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন যে গান, সেটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারেরই লেখা। মান্না দে নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য গানের পুষ্পস্তবক ভাসে। কিন্তু সব প্রজন্মের কাছে সর্বাগ্রে কোন গানটি আজও অম্লান? সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ সেই গানের কাহিনি শুনিয়েছেন অনেকবারই। বাবা নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে গল্প করতে দেখে সুপর্ণকান্তি হালকা ছলে বলেছিলেন, কী সব প্রেম বিরহের গান লিখছ। এই আড্ডা নিয়েই একটা গান লিখতে পারবে? চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন গৌরীবাবু। আর তারই ফলশ্রুতি কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। যার শেষ পঙ্‌ক্তি অসুস্থ অবস্থায় চেন্নাইয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগে হাওড়া স্টেশনে বসে লিখেছিলেন। ‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই...’
 আট ও নয়ের দশক পর্যন্ত দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেল কীভাবে বোঝা যেত পাড়ায় পাড়ায়? গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কলম ধরে। আকাশ বাতাস জুড়ে পাড়ার পুজোর মাইক জানিয়ে দিত দিনভর যে আজ ষষ্ঠী অথবা সপ্তমী। কখনও লতা মঙ্গেশকরের ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ বাজিয়ে। কখনও ‘যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে’। কখনও আবার ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’। কিংবা ‘কথা দিয়ে এলে না’। 
লখনউয়ের শিল্পপতি বি কে রায়ের পুত্র প্রশান্তকুমার রায়ের শখ ছিল গান গাওয়া। তবে সে ছদ্মনামে রেডিওয় গান গায়। সেই অভিজিৎ চৌধুরীর গানে বাংলা শ্রোতারা মুগ্ধ। অথচ সে প্রকাশ্যে না আসারই পণ করেছে। সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হল। কারণ, তাঁর প্রিয় বন্ধু কবি ও গীতিকার সুকান্ত যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য অর্থ চাই। অতএব অভিজিৎ চৌধুরী লাইভ প্রোগ্রামে রাজি। সেই সুকান্তেরই লেখা গান গাইলেন তিনি— ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেব ভেবেছিল একটি পাখি’। সুকান্ত ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে বেঁচে গেল। কিন্তু ওই গানের প্রকৃত রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯৮৬ সালে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে চেন্নাই-মুম্বই-কলকাতা চিকিৎসার জন্য ঘুরলেন বটে। লড়াইটা জিততে পারলেন না। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন? নচেৎ রোগশয্যায় লিখবেন কেন মান্না দে-র সেই হৃদয়ছেঁড়া গান? ‘আমি কি আর ভালো হব না ডাক্তার রায়’! ১৯৬১ সালে ‘সপ্তপদী’ নামক এক সিনেমাবাহিত হয়ে একটি বাইকে চেপে বাঙালি মন বেরিয়েছিল নিরুদ্দেশে! যাত্রাটির থিম সং ছিল একটি অমোঘ প্রশ্ন! চিরকালীন প্রেমের আবেদন! সেই সফর আজও শেষ হয়নি! গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বুঝেছিলেন ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না! তাই প্রশ্ন রেখে গিয়েছিলেন: ‘এই পথ যদি না শেষ হয়/ তবে কেমন হতো তুমি বল তো?’  ঠিক যেমন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গানের জাদুও শেষ হয় না!

6th     August,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ