উনিশ শতক তখন সবে দ্বিতীয় দশকে পড়েছে। এক বিকেলে কলকাতার হোয়াইট টাউন বা সাহেব পাড়ায় একটি শ্বেতাঙ্গ শিশু বেড়াতে এল তার আয়ার সঙ্গে। শিশুটির দেখাশোনার জন্য বেয়ারা, খিদমতগার, হরকরা, রাঁধুনি আগেই নিয়োগ করা হয়েছিল। তারা ছাড়াও সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিল দু’জন বেয়ারা। একজনের হাতে একটি রুপোর লাঠি আর অন্যজন বাঁশের খুঁটিতে লাগানো এক বিশাল গোল ছাতা ধরে ছিল মেয়েটির মাথায়।
ঘটনাটির উল্লেখ করে শিশুটির বাবা বিশপ হেবার তার রোজনামচায় লিখেছেন যে, বিশপের স্ত্রী কয়েকদিনের মধ্যেই এই সহায়ক দলের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সাহেব জেনেছিলেন যে, বাচ্চাদের বিশাল সেবকদলের পেছনে মোটা অর্থব্যয় করাই সে সময় কলকাতার সামাজিক রীতি।
কলকাতায় ছাতার সঙ্গে বিশপ হেবারের প্রথম সাক্ষাতের আগে থেকেই ছাতা এবং ছাতা বইবার ভৃত্য, অর্থাৎ ছাতাবরদার ছিল এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব কর্মচারীদের বড়মানুষির অঙ্গ। পালকি চড়ে চলতেন সাহেব আর ছাতাবরদার তাঁর মাথায় ধরত ছাতা। গোল আকারের জন্য সাহেবরা বলতেন ‘রাউন্ডেল’ এবং ছাতাবরদাদের বলা হতো ‘রাউন্ডেল-বয়’। এমনকী, সাধারণ কেরানি বা রাইটাররাও গা ভাসাতেন এই বড়লোকি চালে, যার উৎসে অবশ্যই থাকত নানা অসাধু উপায়ের রোজগার। কোম্পানির কর্তৃপক্ষ নানাভাবে চেষ্টা করতেন কর্মচারীদের রুখতে। একবার খোদ লন্ডন থেকে আদেশ এল যে, কোনও জুনিয়র রাইটার রাউন্ডেল ব্যবহার করতে এবং ‘রাউন্ডেল-বয়’ নিয়োগ করতে পারবে না। কিন্তু দেখা গেল যে, সেই নোটিস পাওয়ার পরও এক ছোকরা দিব্যি ব্যবহার করছে ছাতা। তাকে চেপে ধরতেই সে সোজা জানিয়ে দিলে যে, কোনও আদেশ লঙ্ঘন করা হয়নি। বলা হয়েছিল ‘রাউন্ডেল’ ব্যবহার না করতে এবং সেটা সে মেনেও চলেছে। শুধু গোল আকারের পরিবর্তে চৌকো ছাতা তৈরি করে রাউন্ডেল নয়, ‘স্কোয়ারডেল’ করে নিয়েছে!
গোল ছাতা আর চৌকো ছাতার চক্করে কোম্পানির কর্তারা ঘোল খেতে পারেন। কিন্তু ভারতে এই ধারণা নতুন নয়। বরাহমিহির তার বৃহৎসংহিতার ‘ছত্রলক্ষণ’ অধ্যায়ে জানিয়েছেন যে, গোল ছাতার ব্যবহার সংরক্ষিত ছিল ব্রাহ্মণদের জন্য এবং অন্যরা ব্যবহার করতেন চৌকো ছাতা। রোদ-জল নিবারণ করা ছাড়াও ছাতা ছিল সম্মানের প্রতীক। তাই রাজা, রাজকর্মচারী বা ব্রাহ্মণের মতো সম্মানীয় ব্যক্তির জন্য ছাতার আকার ও প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখতে পাই বহু প্রাচীন শাস্ত্রে। বরাহমিহির ছাড়াও ছাতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ভোজরাজ তাঁর ‘যুক্তিকল্পতরু’তে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে রাজছত্রের কথা বিশেষ ভাব উল্লেখিত হয়েছে। সারা ভারতে দেব বিগ্রহের মাথায় ছাতা ধরার প্রচলন আছে। কলকাতার দুর্গাপুজো বা অন্য ধর্মীয় উৎসবে অনেক বনেদি বাড়িতে প্রাচীন ছাতার ব্যবহার দেখা যায়।
ছাতার এবং রাজকীয় অধিকারের সম্পর্কটা পরবর্তীকালে ইংরেজদের উপরেও প্রভাব ফেলে। ১৮৭৫-’৭৬ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস-এর বিখ্যাত ভারত ভ্রমণের সময় রাজকীয় অতিথিকে রাজছত্র ছাড়া বাইরে বেরতে বিশেষভাবে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমন করলে জনসাধারণের চোখে ব্রিটিশরাজের মর্যাদাহানি হবে, কারণ দেশীয় শাসকবর্গ রাজছত্র ছাড়া কখনওই বেরতেন না। পরে পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি যখন ভারতে এলেন এবং দিল্লি দরবার অনুষ্ঠিত হল, তখনও ব্যক্তিগত ছাতা ব্যবহারের পাশাপাশি জনসমক্ষে তাদের মাথায় ধরা হয়েছিল রাজছত্র।
ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে ছাতা ছিল বিদেশি শাসকদের একান্ত সহচর। শ্রীরামপুরের দিনেমার উপনিবেশের সচিব ও বিচারক ফ্রেডরিক এমিল এলবারলিং তার স্মৃতিকথা জানিয়েছেন, শীতের জায়গার মানুষ এই সাহেবরা সব সময় ভয় পেতেন যে, এই গরমের মধ্যে অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম তাদের দুর্বল ও অসুস্থ করে দেবে। এলবেরিং প্রাথমিকভাবে যাতায়াতের জন্য ঘোড়া রাখতে চাননি। মনে করেছিলেন যে, ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটেই কাজ চালাতে পারবেন। কিন্তু উপনিবেশের ডাক্তারের পরামর্শে ঘোড়া এবং সেই ঘোড়ার দেখাশনার জন্য তিনজন সহায়ক নিয়োগ করতে হয় তাঁকে।
ফিরে আসা যাক উনিশ শতকের কলকাতার কথায়। বড়বাজার থেকে পটলডাঙার সংস্কৃত কলেজে হেঁটে পড়তে আসা ছিল একটি বেঁটে রোগা বালকের দৈনন্দিন রুটিন। মাথায় থাকত এক মস্ত ছাতা। লোকে মনে করত যে, একটা ছাতা চলে যাচ্ছে রাজপথ দিয়ে। বিদ্যাসাগরের ছাত্রবেলার এই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাতার কথা। শুধু সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা নয়, কলেজের অধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের বিশাল দশ-বারো হাত পরিধির ঘেরাটোপের সঙ্গে আট-ন’হাত দণ্ড যুক্ত ছাতার কথাও জানা যায়। এই ছাতা ছিল তালপাতার তৈরি গোল ছাতা, যার সঙ্গে যুক্ত দণ্ডটি হতো বাঁশের। এক ভৃত্য সেই বিশাল ছাতা কাঁধে নিয়ে চলত আর তর্কপঞ্চানন মহাশয় চলতেন তার ছায়ার নীচে।
পণ্ডিতমশাইয়ের ছাতার কথা বলার পর সাহেব প্রফেসারের কথা না বললে ভারসাম্য থাকে না। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর নেওয়ার পর তার জায়গায় এলেন প্রফেসর সি ডব্লু পীক। সে সময় পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপককেই হাওয়া অফিসের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতে হতো। জগদীশচন্দ্র এই দায়িত্ব কোনওদিন গ্রহণ করেননি। কিন্তু পীক সাহেব সে দায়িত্ব নিলেন এবং সেই কাজের চাপে বা চাপের অছিলায় প্রায়দিনই কলেজ কামাই করতেন। ছাত্ররা আবহাওয়া অফিসের রোদ-বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়ার কর্তব্যের প্রতি তির্যক টিপ্পনি সহ সাহেবের নতুন নাম দিল— ‘ছাতাওয়ালা পীক’!
কথায় কথায় আমরা বিশ শতকে পৌঁছে গিয়েছি। ছাতার গল্পের খেই ধরে আবার একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ছাতার এই গল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ উনিশ শতকের সাত ও আটের দশক। বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি ও তার ফলে বাংলার চাষির আর্থিক সমৃদ্ধি বাংলার শহর ও গ্রামে নিয়ে এল ভোগ্য পণ্যের বাজারে বড় পরিবর্তন। হাতের উদ্বৃত্ত অর্থ গ্রামের মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিল সুইডিশ দেশলাই, কেরোসিনের আলো, সিগারেটের মতো পণ্যের সঙ্গে আমদানি করা ছাতা। গ্রামীণ এলাকায় সব থেকে চোখে পড়ার মতো বদল এল মহিলাদের দামি অলঙ্কারের চাহিদা বৃদ্ধি এবং পুরুষদের কেশ বিন্যাস এবং ছাতা ব্যবহারের প্রবণতায়। হান্টার সাহেবের ‘স্টাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গলে’ দেখছি যে, ১৮৭৬ সালে সুদূর চট্টগ্রাম জেলায় আমদানি করা গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বিলিতি ছাতা।
এই সময়ে বিলিতি ছাতার ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে ১৮৯৩-’৯৪ সালে কলকাতায় আমদানি হয়েছিল প্রায় ৩০ লক্ষ ছাতা। এই ছাতাগুলি কিছুদিন পর ভেঙে গেলে বা পুরনো হয়ে গেলেও তার মূল্য থাকত। শশীচন্দ্র দত্ত ১৮৭৭ নাগাদ রামবাগানের গলিতে যে সব ফেরিওয়ালার ডাক লিপিবদ্ধ করেছেন, তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ভাঙা ছাতা কেনার ফেরিওয়ালা ডেকে যেত— ‘পুরানা ছাতা বিক্রি...’। কিন্তু বিলিতি ছাতার এই সুদিন কিন্তু বেশি সময় স্থায়ী হল না। স্থানীয় উদ্যোগে ছাতা তৈরি শুরু হয়ে গেল মূলত আমদানি করা স্টিলের শিক ও কাপড় একত্রিত করে। এক বাঙালি ব্যবসায়ী তাঁর বেনিয়াপুকুর লেনের বাড়িতে কুটির শিল্প হিসেবে ১৮৮২ সালে শুরু করে দিলেন ছাতা তৈরি। ফলে আমদানি করা ছাতার চাহিদা কমতে থাকল। সমাজের মুষ্ঠিমেয় মানুষের ব্যবহারযোগ্য বস্তু থেকে উনিশ শতকের শেষার্ধে ছাতার সর্বজনীন জনপ্রিয়তার একটা ছবি পাওয়া যায় শরৎকুমারী চৌধুরানির ‘স্বায়ত্ত সুখ’ গল্পে। সেখানে ১৫ টাকা মাস মাইনের কেরানির বার্ষিক নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকায় চার জোড়া ধুতি, দু’জোড়া জুতো, দু’টি উড়নি, চারটি পিরানের পাশে একটি ছাতাও জায়গা করে নিয়েছে। দাম ধরা হয়েছে ১ টাকা। তবে, বিলিতি ছাতা ছিল বিতর্কের কেন্দ্রেও। বিলিতি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি প্রচলনের প্রবক্তারা বিদেশ থেকে আমদানি করা কাপড়, দেশলাই ইত্যাদির পাশে তোপ দেগেছিলেন বিলিতি ছাতার বিরুদ্ধেও। শরৎকুমারী চৌধুরানির লেখাতেই পাওয়া যায়— ‘ঢৌকা গোলপাতার ছাতা আর বিক্রয় হয় না। দশ বারো আনায় দিব্য একটি একটি বিলাতী ছাতা হয়। রৌদ্র বৃষ্টি যত আটকাক্ আর না আটকাক্, দেখতে কেমন সুশ্রী, কেমন মোড়া যায়, কেমন সুবিধা, ছাতাকে ছাতা, লাঠিকে লাঠি।’
অবশ্য প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে লাঠির থেকেও কার্যকর আত্মরক্ষার হাতিয়ার হওয়ার দাবিও উঠেছে ছাতার পক্ষে। উনিশ শতকে ছাতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে উইলিয়াম স্যাংস্টার উপনিবেশের একটি ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, জঙ্গলে পিকনিক করতে যাওয়া সাহেব-মেমদের উপর এক রয়াল বেঙ্গল টাইগার আক্রমণ করে। সে সময় এক সাহসী মেম বাঘের মুখের উপর হঠাৎ করে ছাতা খুলে ধরার ফলে বাঘটি ঘাবড়ে যায় এবং চম্পট দেয়। রসিক লেখক মন্তব্য করেছেন যে, এই সাহসিকতার ফলে মেমসাহেব নিজের জীবন এবং নিজের মধ্যাহ্নভোজ— উভয়কেই বাঁচাতে সক্ষম হন।
রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে ব্রিটিশ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টার একটি উদাহরণ এই গল্প বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় বাঘ কীভাবে এক সামান্য ইউরোপীয় ছাতার সামনে ঘাবড়ে যায় সেটাই সূক্ষ্মভাবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেশ অদ্ভুত লাগে যখন দেখি, ১৮৫০ সালে প্রকাশিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’র তৃতীয় ভাগে এই গল্পের উল্লেখ দেখি। আবার রবীন্দ্রনাথও এর সাড়ে তিন দশক পর তার ‘গুটিকতক গল্প’ রচনায় উল্লেখ করেছেন একই ঘটনার। তবে রবীন্দ্রনাথ ঘটনার সত্যাসত্য নিয়ে যে সংশয় প্রকাশ করেছেন মশকরার ছলে সেটাও দৃষ্টি এড়ায় না। সাহসী মেমসাহেবের ছাতা ব্যবহারের পাশাপাশি বঙ্গ মহিলাদের অবস্থাটা একবার দেখা যাক। বিলেতে ছাতা একমাত্র মহিলারাই ব্যবহার করতেন। আঠারো শতকের মাঝামাঝি জোনাস হ্যানওয়ে নামে এক ভদ্রলোক যখন বর্ষার সময় প্রকাশ্যে ছাতা নিয়ে লন্ডনের পথে বেরলেন, তখন সারা শহর জুড়ে বিদ্রুপ, টিটকিরির ঝড় বয়ে গেল। অন্যদিকে আমাদের দেশে অবস্থাটা ছিল ঠিক বিপরীত। বহু প্রাচীন পরিবারের গিন্নিমায়েরা মনে করতেন যে, স্বামী মাথার উপর ছাতা হয়ে থাকতে আবার আলাদা ছাতার কী প্রয়োজন? তবে সম্রাট হর্ষবর্ধনের আমলে অবস্থাটা এমন ছিল না। বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তে মহিলাদের সেবায় ‘ছত্রধারিণী’ থাকার কথা জানা যায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের সামাজিক অবস্থানের পতনের ফলে তাদের মাথার উপর ছাতাও অদৃশ্য হল।
সে সময়ের অবস্থা বুঝতে আমাদের সাহায্য করে রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’র কয়েকটি বাক্য। ‘মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির হাঁপ ধরানো অন্ধকারে, গাড়ি চড়তে ছিল ভারী লজ্জা। রোদবৃষ্টিতে মাথায় ছাতা উঠত না। কোনো মেয়ের গায়ে সেমিজ, পায়ে জুতো দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি; তার মানে, লজ্জাশরমের মাথা খাওয়া।’ নানা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মেয়েরা বাইরে বেরনোর অধিকার পাওয়ার সঙ্গেই রোদ-জল থেকে বাঁচার জন্য তাঁদের মাথায়ও উঠল ছাতা।
বাইরে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা আর্থিক স্বাবলম্বনের পথে শুরু করলেন যাত্রা। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে শুরু করলেন তাঁরা। স্বাভাবিকভাবেই সমাজের একটা বড় অংশ এই পরিবর্তনকে ভালো চোখে দেখেনি। কাজের বাজারে পুরুষদের একচেটিয়া অধিকারের ক্ষেত্রে মেয়েদের পা রাখাকে সমাজের এই অংশ কীভাবে দেখেছে, সেটা ফুটে উঠেছে বিনয়চন্দ্র বোসের ‘মেয়ে কেরানী’ নামের ব্যঙ্গচিত্রে। ১৯২০ সাল নাগাদ প্রকাশিত কার্টুনটিতে ব্যঙ্গ করা হয়েছে কাজে যাওয়ার তাড়ায় তথাকথিত মহিলা সুলভ চলন ছেড়ে নো-নন্সেন্স পোশাকে ও ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া কর্মরত মহিলাকে। যার হাতে ধরা একটি বড় কালো ছাতা— যা লন্ডন ও কলকাতা দুই শহরেরই কেরানিকুলের প্রতীক।
একদিকে মহিলাদের ক্ষমতায়নের প্রতীক এবং অন্যদিকে রক্ষণশীল সমাজের বিদ্রুপের লক্ষ্য হয়েছে ছাতা। কিন্তু এমন ঠাট্টা বিদ্রুপে যে বঙ্গনারীর অগ্রগতিকে রুখতে পারবে না, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ই। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে ছাতা দোলাতে দোলাতে রাস্তায় চলা লাবণ্যের সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় করাচ্ছেন তিনি, ততদিনে ছাতা হয়ে উঠছে স্বাধীন নারীর ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
রাজছত্র থেকে সমাজের অভিজাত শ্রেণির একচেটিয়া অধিকারের এক্তিয়ার ঘুরে সাধারণ মানুষের মাথায় ওঠার এই যাত্রায় ছাতা পেরিয়ে এসেছে অনেকটা পথ। সেই পথের প্রতিটি বাঁকে পড়ে আছে আমাদের সমাজ বিবর্তনের নানা ঐতিহাসিক চিহ্ন। দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিস যে আটপৌরে দৃষ্টিতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত, তার থেকে একটু অন্যভাবে দেখলেই বেরিয়ে পড়া সেই সব গল্প, যা কোনও উপন্যাসের থেকে কম আকর্ষক নয়।