বিপুল ঘুম থেকে উঠেই দেখল, চার-চারটে মিসড কল। নামটা দেখেই মটকা গরম হয়ে গেল তার। ঘুম থেকে উঠতে সবুর সয়নি! কী অদ্ভুত মানুষ! এপ্রিল ফুল করার এমন উন্মাদ নেশা যে, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলছে! এপ্রিল ফুল করবে বলে ভোর থেকে ফোন করছে! কী করে যে এমন একটা উন্মাদ উল্লাস ওর পছন্দের খেলা হয়ে উঠল, কে জানে। এই নিয়ে প্রতি বছরই কারওর না কারওর সঙ্গে ধুন্ধুমার অশান্তি হয়ে যায়। গত বছর প্রণবের সঙ্গে এমন ঝামেলা হয়েছিল যে, দীর্ঘদিন আর তাদের তাসের আড্ডায় আসেইনি প্রণব। কত কাণ্ড করে যে মিটমাট করেছে তারা সবাই মিলে! এই সবে মাস দুয়েক হল প্রণব নিয়মিত আড্ডায় আসছে আবার! এখন আবার যদি ওকেও এপ্রিল ফুল করে মনোজ? ব্যস প্রণব আবার বিগড়ে যাবে। এই বয়সে এই সব উটকো ঝামেলা আর ভালো লাগে কারওর! কেন যে মনোজ বোঝে না। বিয়ে-থা না করলে বোধহয় এরকমই হয়। কোনওকালে সাবালক হয় না। বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসারের জাঁতাকলে তো পড়েনি, তাই বুঝতেই পারে না, অন্যের পরিস্থিতির কথা। সব সময় ঠাট্টা-ইয়ার্কি নিয়ে মেতে আছে। পারেও বাবা, নিজের মনেই গজগজ করে বিপুল।
হ্যাঁ, সে মানছে মনোজ মানুষ হিসেবে খুব ভালো। এমনিতে কারওর সাতে পাঁচে থাকে না। সব সময় নিজের লেখাপড়া, সাহিত্য উৎসব এসব নিয়েই মেতে থাকে। কিন্তু বছরের এই একটা দিন ও আমূল পাল্টে যায়। কী করে যে ওর মাথার মধ্যে এই এপ্রিল ফুলের ভূতটা ঢুকল কে জানে! সারা বছর ধরে কারওর সঙ্গে কোনওরকমের ঝুটঝামেলায় থাকে না। মজাদার দিলদরিয়া মানুষ মনোজ। হইহই করে আড্ডা দেয়। সবাইকে মাতিয়ে রাখে। সবাই খুব পছন্দ করে ওকে। ভালোওবাসে। কিন্তু কেন যে ওর মধ্যে এই এপ্রিল ফুল নিয়ে এত মাতামাতি কে জানে। সারা বছর ধরে ওর প্ল্যান প্রোগ্রাম চলতে থাকে। কাকে ও টার্গেট করবে, কীভাবে ঠকাবে সব আগে থেকে ছক কষে রেডি থাকে। এপ্রিল ফুল মিটে যাওয়ার পরও বহুদিন ধরে চলতে থাকে তার রেশ। কোন বছর কাকে কীভাবে ঠকিয়েছে, তাই নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে, আর জয়ের আনন্দে ওর চোখে-মুখে একটা আলো ফুটে ওঠে। ওর জীবনের সমস্ত গ্লানি যন্ত্রণা অপ্রাপ্তি যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় ওই আলোর রোশনাইয়ে। শুধুমাত্র এই একটা দিনের প্রাপ্তিতেই মনোজ তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। ওর ওই পরিতৃপ্তির হাসি, অসহ্য লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। সবার সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙে দুমড়ে সাফ করে দেয় মনোজ। কী এক আশ্চর্য জাদুতে জয়ী হয়ে যায় প্রতি বছর।
কিন্তু এবার মনে মনে কঠিন পণ করেছে সে। কিছুতেই মনোজের কাছে হার মানবে না। দিন পনেরো আগেই তাদের তাসের আড্ডায় চ্যালেঞ্জ করেছে। ব্যঙ্গ করে বলেছে, দেখ বিপুল বৃথাই চেষ্টা করছিস। আমার সঙ্গে পারবি না তুই। আমি যখন বলছি, তোকে এপ্রিল ফুল করব, তখন করবই। কিছুতেই তুই আটকাতে পারবি না, দেখে নিস।
—আলবাত পারব। তুই দেখে নিস, পারি কি না পারি।
—বললাম তো পারবি না। চ্যালেঞ্জ করছি তোকে এপ্রিল ফুল করবই।
মনোজের কথাগুলো মনে পড়তেই সাবধান হল বিপুল। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার বাজল রিংটোন। বিপুল ফোনটা ধরতে গিয়েও তুলে নিল হাতটা! কিছুতেই কোনও ভুল করে ফেললে চলবে না। কোনওরকমের ফাঁদে পা দেবে না সে আজ। মোটেই দুর্বল হবে না! কোনও টেনশনও করবে না! আজ সারাদিন মনোজের ফোন ধরাই যাবে না। দেখি, এবারও কী করে ঠকাতে পারে! বিড়বিড় করতে করতে বারান্দায় বেরিয়ে এল বিপুল! আবারও ফোন ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল। সারা ঘর কেঁপে উঠল তার। বুকের ভেতরটা আতঙ্কে ঝিনঝিন করছে! ইচ্ছা করছে ফোনটা ধরতে, কিন্তু ধরতে গিয়েও সরিয়ে নিচ্ছে হাত। প্রতিবছর এইভাবেই ঠকায় তাকে। কিন্তু বার বার মোবাইলটা বাজছে যত, বিপুলের আতঙ্ক তত বাড়ছে। যদি সত্যিই কোনও প্রয়োজনে করে ফোনটা!
মনোজ শিকদার তার বন্ধু! সেই ছোট্টবেলা থেকেই তারা দু’জন দু’জনকার খুব কাছের বন্ধু। পাড়ায় তখন তারা ছাড়া কোনও বাচ্চাই ছিল না। তখন এ পাড়ায় ক’ঘরই বা লোক বাস করত। জায়গাটার নামটাই তো ছিল ব্রহ্মপুর। চারদিকে ধু ধু প্রান্তর জলাজমি। বর্ষায় পুরো এলাকায় সমুদ্রের মতো জল থইথই করত! একটা পানসি নৌকা ছিল জ্যাঠামশাইয়ের। তখন এ পাড়ার অনেকেরই একটা করে ছোট নৌকা ছিল। না হলে বর্ষার ক’দিন খুব অসুবিধে হতো মানুষের! সেই জলে ভাসা ব্রহ্মপুর! কত পাল্টে গিয়েছে! চারদিকে বহুতল ফ্ল্যাট। ঝকঝক করছে রাস্তাঘাট, মার্কেট। কিন্তু সেন পাড়ার মানুষজন এখনও সেই একই রকম আছে। সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থাকে, হইহই করে দিন কাটায়। কলকাতা শহরের অতীব ব্যস্ত জীবনের আদবকায়দা এই পাড়ার মানুষ এখনও আয়ত্ত করেনি। তাই এখনও এ পাড়ায় মনোজের মতো পাগলাটে মানুষও খুশিতে বাঁচে। মোটের উপর তার এই পাগলামো কম-বেশি সহ্যও করে পাড়ার মানুষজন। এইসব নিয়ে হইহুল্লোড় করে কাটায় সবাই জীবনটা।
পয়লা এপ্রিল এলে শিকারি বিড়ালের মতো ওঁত পেতে থাকে মনোজ! কখন কাকে ঠকাবে এই হিসেব কষতে থাকে মনে মনে। মানুষকে বোকা বানিয়ে কী যে এত আনন্দ পায় কে জানে। কত লোককে যে এপ্রিল ফুল করে সারাদিন ধরে তার ঠিক নেই। বিপুল প্রতি বছর ভাবে কিছুতেই ঠকবে না। অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। কোনও না কোনওভাবে তার কাছে ফেঁসে গিয়েছে। কিন্তু এ বছর কঠিন পণ করেছে সে! সেই ছাত্রজীবন থেকে তাকে মুরগি করছে মনোজ। এই নিয়ে এতদিন মজাই পেত! এ বছর কেন যে হঠাৎ করে মনোজের উপর এত বিরক্ত লাগছে কে জানে! বেশ কিছুদিন আগে থেকেই একটা অদম্য জেদ চাপছিল মনের মধ্যে। কিছুতেই ওর ফাঁদে পা দেবে না। তাই আজ ওর ফোন রিসিভ করার কোনও মানেই হয় না।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বেজে উঠল ফোনটা! খুব অস্বস্তি হচ্ছে বিপুলের! ভয়ও করছে। এই সকালবেলাতেই কেন ফোন করছে কে জানে। মানুষের বিপদ-আপদের কথা কি আগে থেকে কিছু বলা যায়! মনোজের কিছু হল না তো আবার! একা একা থাকে মানুষটা। সাহিত্য পাগল ভবঘুরে ব্যাচেলর! লেখালেখি করবে বলে চাকরি-বাকরিরও তেমন চেষ্টা করেনি কোনও দিন। দু-চারটে টিউশন করে! আর লিখে কিছু টুকটাক রোজগার করে! তাতেই চলে যায় যা হোক করে! অসুখ-বিসুখ করলে কেউ উঁকি মেরে দেখবার নেই। দায়ে-আয়ে বিপদে তাদের কাছেই আসে বেশি। ঠকার ভয়ে ফোনটা ধরছে না বটে, কিন্তু মাথা থেকে দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। যদি সত্যিই কোনও প্রয়োজনে ফোনটা করে! বিপদের কথা তো বলা যায় না। তাকে ঠকিয়ে না হয় একটু মজাই পেল। চিরটা কাল না হয় ওর কাছে বোকাই থাকল, তাতে কী এমন ক্ষতি হচ্ছে। বিশ্বজগৎ জানে, সে কী। ছাত্রজীবন থেকেই তার তুখোড় বুদ্ধি। ব্যাঙ্কে উঁচু পদে চাকরি করেছে! বন্ধুর কাছে এপ্রিল ফুল হওয়াকে এতটা গুরুত্ব কেন দিচ্ছে! ঠকতে হয় ঠকবে! এসব কথা ভেবে, এগিয়ে গেল ফোনের কাছে। কিন্তু ফোনে হাত দিতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নিল সে। ফিরে এসে বসল বারান্দায়।
সকালটা আজ বেশ ঝলমল করছে। উঠোনে চন্দ্রমল্লিকার গাছে দু-একটা ফুল এখনও ফুটছে। এমন দিনকেই বোধহয় সানি ডে বলে। রোদ ঝলমলে দিন। বসন্তের আবেশ ছড়িয়ে আছে সারা বাড়িময়। পাশের বাড়ি থেকে গান ভেসে আসছে ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল...। সব মিলিয়ে আজকের সকালটা বেশ অন্য রকমের সকাল। বিপুলের মনটা ভালো হয়ে গেল। অকারণেই বেশ হালকা বোধ করছিল। বুকের ভেতর থেকে একটা জমাট বরফ যেন গলে জল হয়ে মিশে গেল নদীর সঙ্গে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফোনটা বেজে উঠল ঝন ঝন করে।
বিপুল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। খুব আতঙ্ক নিয়েই এগিয়ে গেল ফোনটার দিকে। কিন্তু এখন স্কিনে ভেসে উঠেছে আননোন নম্বর। ‘হ্যালো’ বলল যেই, ওপাশ থেকে একটা অচেনা গলা ভেসে এল। ভারিক্কি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘বিপুলবাবু বাড়ি আছেন?’
—হ্যাঁ বলুন।
—আপনিই বিপুলবাবু?
বিপুলের মেজাজ গেল বিগড়ে। রেগে গিয়ে বলল, আপনি কি সকালবেলা মজা করছেন আমার সঙ্গে?
—আহা! রেগে যাচ্ছেন কেন। নেহাত বিপদে পড়েছি বলেই তো সাতসকালে ফোনটা করেছি।
বিপুল থমকে গেল, বিপদ? কার কী হল আবার। গলা শান্ত করে বলল, ‘স্যরি। বলুন কী হয়েছে?’
—আপনার বন্ধু মনোজবাবু সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। মনে হচ্ছে স্ট্রোক। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে পাড়ার ছেলেরা। উনি আপনাকে ছাড়া যেতেই চাইছেন না। কেবল বলছেন বিপুলকে খবরটা দাও। ও আগে আসুক। তারপর যাব। আমরা ডাক্তার ডেকেছি।
বিপুল ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে! তারপর হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।
মনোজের বাড়ির সামনে এসে দেখল লোকে লোকারণ্য! তাকে দেখেই রাস্তা ছেড়ে দিল সবাই! ঘরে গিয়ে যখন পৌঁছল, দেখল, পাড়ার নীলাদ্রি ডাক্তার মুখ ভার করে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে আসছেন। তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যরি বিপুলদা! আর কিছু করার ছিল না গো। এই একটু আগেই এক্সপায়ার করে গিয়েছেন!
বিপুল ছলছল চোখে তাকাল মনোজের নিথর দেহটার দিকে। চোখ বুজে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মনোজ। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠল। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে গেল মনোজের দিকে! বিপুল তখন আর তাকাতে পারছে না। দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। সারা ঘর তাকিয়ে দেখছে সে! কী যেন খুঁজছে! মনে হল, কী জানি এটাও বুঝি মনোজের এপ্রিল ফুল! হয়তো এখনই উঠে হাসতে হাসতে বলবে, দেখ কেমন দিলাম। হেরে গোহারা হলি তো! ঠকবি না মানে! আমার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করা? দেখলি তো কেমন গোহারা হারলি।
বিপুল চোখ মুছে ভালো করে তাকিয়ে দেখল ঘরের চারদিক। মনোজের নিথর শরীরটার দিকে এগিয়ে গেল খুব ধীর পদক্ষেপে! আস্তে আস্তে, মনোজের গায়ে হাত দিয়ে নাড়িয়ে দেখল একবার! কিন্তু না কোনও সাড়া নেই তো।
ঠিক সেই মুহূর্তে যেন সেই হাসি শুনতে পেল! কোথা থেকে যেন বলছে মনোজ, কী রে বিশ্বাস হচ্ছে না তোর!
না আ...আ বলে দু’হাতে কান ঢেকে, ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল বিপুল! তারপর থেকে কোথাও থামতেই আর ভয় করছে। মনোজের সেই কণ্ঠস্বর যেন ধেয়ে আসছে তার পিছন পিছন!