এক
—আজও পাক্কা একঘণ্টা লেট! এভাবে রোজ পার্কে একা একা বসে অপেক্ষা করতে নিজেকে খুব সস্তা মনে হয় রিয়ার।
—এত রাগ করতে নেই সোনা, এরপর যখন তোমার কাছে থাকব, দেখবে সারাদিন সারারাত শুধু তোমার প্রতীক্ষায় থাকবে রিয়া।
সল্টলেকের নার্সিংহোমের দোতলায় আইসিসিইউ-এর বাইরে বসে হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল বছর পনেরো আগে। সংবিৎ ফিরল নার্সের বাজখাঁই গলার চিৎকারে, ‘মিস্টার সুখেন্দু চৌধুরীর বাড়ির লোক কে আছেন?’ ডাঃ অনির্বাণ সারেঙ্গীর চিকিৎসায় প্রায় দু’মাস হয়ে গেল এই নার্সিংহোমে ভর্তি সুখেন্দু। কলকাতা শহরে এত ভালো ট্রমা কেয়ার স্পেশালিস্ট আর কেউ নেই। বাগুইহাটি থানার বড়বাবু অনন্ত হালদারও সেদিন বলছিলেন, ‘চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারেন, ডাক্তার নয় ভগবান। দেড় বছর হয়ে গেল এই থানায় ঘষছি। অন্তত দশ-বারোটা কেস তো কীভাবে সামলালেন নিজের চোখেই দেখলাম।’
ডাঃ সারেঙ্গী আজ রিয়াকে স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন যে, আইসিসিইউতে এভাবে আর বেশিদিন রাখা সম্ভব নয়। সুখেন্দুকে প্রাইভেট কেবিনে শিফ্ট করতে হবে। সেখানে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকবে। একজন অ্যাটেনডেন্ট রাখতে হবে। সব মিলিয়ে খরচও অনেকটাই বাড়ল। ওদিকে আবার তিতির ক্লাস থ্রিতে উঠল। এমাসে অ্যাডমিশন ফি বাবদ হাজার পঁচিশেক তো লাগবে। এসব সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতেই গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক কষল। কিছুটা বেসামাল হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল রিয়া। ব্যস মেজাজ একেবারে সপ্তমে। ‘কতবার বলেছি, গাড়ি আস্তে চালাও। দেখলে তো তোমার জন্য দাদাবাবুর কি অবস্থা হল, তাও তোমার শিক্ষা হয় না!’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফেলল অশোককে। গত পাঁচ বছর ধরে অশোকই সারথি সুখেন্দুর। বাগুইহাটির এই চোদ্দোশো বর্গফুটের ফ্ল্যাটে যেদিন থেকে এসেছে সুখেন্দু, সেদিন থেকে অশোকই ওর ছায়াসঙ্গী। সেদিন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসের উপর দিয়ে বেশ জোরেই গাড়ি চালাচ্ছিল অশোক। পানাগড়ের জ্যামে প্রায় ঘণ্টাখানেক নষ্ট হওয়ায় সুখেন্দুই অশোককে টেনে চালাতে বলেছিল। সামনের ট্রাকটা হঠাৎ করে ব্রেক কষায় অশোকও আচমকা গাড়িটা থামাতে বাধ্য হয়েছিল। পিছন থেকে করুণাময়ীগামী এক্সপ্রেস বাসের ধাক্কায় সুখেন্দুর নতুন কেনা সাধের ওয়াগনারটা তুবড়ে যায়। সেখান থেকে উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, তারপর সোজা সল্টলেকের এই নার্সিংহোমে। থানার বড়বাবু সুখেন্দুকে আগে থেকেই চিনতেন। ওদের হাউজিংয়ের নানা সমস্যা নিয়ে মাঝে মধ্যেই থানায় ডেকে পাঠাতেন সুখেন্দুকে, কারণ গত দু’বছর পদার্পণ হাউজিংয়ের সেক্রেটারি সুখেন্দুর। প্রথমে ড্রাইভার অশোককে অ্যারেস্ট করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। রিয়াও তেমন কোনও অভিযোগ করেনি ওর বিরুদ্ধে। যদিও রিয়াকে আশ্বস্ত করেছেন অনন্ত হালদার এই বলে যে, সুখেন্দু ফিরে এলে ওর বয়ানে যদি অশোকের বিরুদ্ধে কিছু পাওয়া যায়, তবে কেস দেওয়া যেতেই পারে। এই দুর্ঘটনার পর থেকে সুখেন্দুর সঙ্গে কোনও কথা হয়নি রিয়ার। প্রায় দু’মাস হয়ে গেল সুখেন্দু ভেন্টিলেশনে।
দুই
কৃষ্ণনগরের করিমপুর অঞ্চলে পাশাপাশি পাড়ায় বড় হয়েছে সুখেন্দু আর রিয়া। ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’য় দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখন যে প্রেমে বদলে গেল দু’জনেরই মনে নেই। দু’জনেই সমবয়সি, তাই রিয়ার বাড়ির লোকজন বেশিদিন অপেক্ষা করতে রাজি হয়নি। একপ্রকার বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়েই রিয়াকে বিয়ে করে সুখেন্দু। ও তখন ঘটকপুকুরে একটা এনজিও-তে চাকরি করত পাঁচ হাজার টাকা মাস মাইনেতে। বাড়ি ভাড়া দিতেই চলে যেত হাজার দেড়েক, তাই বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকটায় খুব বুঝে শুনে চলতে হতো দু’জনকে। তিতির আসতেও তাই বেশ খানিকটা দেরি হয়েছে।
জীবন বিমার এজেন্ট হিসেবে জীবন শুরু করলেও সুখেন্দু এমুহূর্তে একটা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। জীবন বিমার এজেন্সিটা এখন রিয়াই দেখে। তিতিরকে দেখাশোনা করার সব সময়ের লোক আছে একজন। তাছাড়া রান্নার লোক, ড্রাইভার, বাসন মাজা থেকে ঘর পরিষ্কারের লোক সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচটা পরিবার আজ সুখেন্দুর আয়ের উপর নির্ভরশীল। দুর্ঘটনাটা যেহেতু অফিসিয়াল ট্যুরের সময় হয়েছিল, তাই এযাবৎ সুখেন্দুর কোম্পানিই যাবতীয় খরচ দিয়ে এসেছে। তবে এবার ডাঃ সারেঙ্গীর কথা অনুযায়ী প্রাইভেট কেবিনে রাখতে গেলে যে এক্সট্রা খরচ হবে সেটা কোম্পানি যে দিতে পারবে না, কাল কোম্পানির তরফ থেকে মিস্টার বাগচি রিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন। ফ্যামিলি মেডিক্লেমের কাগজপত্র ঘেঁটে কাল রাতেই রিয়া বুঝতে পেরেছে লাখ পাঁচেক টাকার কভারেজ আছে, কিন্তু তা দিয়ে এক মাসও চলবে কি না সন্দেহ। এ মুহূর্তে অন্য কোনও অনামী নার্সিংহোমে শিফ্ট করানোও সম্ভব নয়। তাতে সুখেন্দুকে ফিরে পাওয়ার যেটুকু আশা আছে, সেটাও শেষ হয়ে যাবে। আত্মীয়স্বজন এ ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছে রিয়াকে। আর্থিক সাহায্য একমাত্র বাবা ছাড়া কেউ করবে না রিয়া সেটা জানে। ওটা তো শেষ ভরসা। তার উপর দু’বছর হল মা ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছে, তারও তো খরচ কম নয়।
আপাত হাসিখুশি নির্বিঘ্ন জীবনটায় যে এত অনিশ্চয়তা, এত প্রশ্ন অপেক্ষা করেছিল তা কল্পনাও করতে পারেনি রিয়া। অপেক্ষা করা ছাড়া যে কিছু করারও নেই তার। তিতির ঘুমে অচেতন। বাইরে বৃষ্টির অঝোর আর্তনাদ, ঘরটা ভীষণ চিলড্ হয়ে আছে। এসিটা অফ করে শুয়ে পড়ল রিয়া। কাল রোববার। এই একটা দিন তিতিরকে নিয়ে যেতে পারে সুখেন্দুর কাছে। যদিও তিতির এভাবে শুয়ে থাকতে দেখতে অভ্যস্ত নয় তার সদাব্যস্ত বাবাকে। রোজ সকালে যখন সুখেন্দু কাজে বেরত তখন তিতির ঘুমোচ্ছে আবার প্রায় মধ্যরাতে যখন ফিরে আসত তখনও তিতির ঘুমোচ্ছে। মিল শুধু একটা জায়গায়। বাবা মেয়ের যাবতীয় খুনসুটি ভাব ভালোবাসার দিনটা ছিল এই রোববার।
তিন
আজ রোববার। তিতির মায়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছে আজ একটা আলাদা ঘরে বাবাকে শিফ্ট করবে। সেখানে শুধু বাবা, মা আর তিতির। বাবাকে কখনও যদি বা ঘুমোতে দেখত তিতির ঘুম থেকে তুলেই ছাড়ত। ‘বাবার শরীরটা ভালো নেই তিতির, ওকে বিশ্রাম করতে দাও।’ রিয়ার ধমক উপেক্ষা করে বাবাকে কাছে পাওয়ার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যেত তিতির। আজ যে সেটা সম্ভব নয় জানে আট বছরের ছোট্ট মেয়েটি। বাবা তো ঘুমোচ্ছে না, বাবাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। অ্যাক্সিডেন্টের সময় যেখানে যেখানে ব্যথা পেয়েছে , ওই ব্যথা বেড়ে যাবে জেগে থাকলে। মায়ের কাছে শোনা এই কথাগুলোকে আপ্তবাক্য করে নিয়েছে সে। শুধু বাবার মুখের এই বীভৎস চেহারা, এতগুলো টিউব এত যন্ত্রপাতি খুব কষ্ট দেয় তিতিরকে। রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিতিরের এক প্রশ্ন, ‘মা, বাবা কবে ভালো হবে? কবে ফিরে আসবে?’ রিয়ার ছোট্ট উত্তর, ‘তুমি তো বড় হয়েছ, অপেক্ষা কর, নিশ্চয় আসবে।’ সুখেন্দুর কপালে হাত বোলাতে বোলাতে রিয়ার চোখের জল সামলে নেওয়া লক্ষ করেছে তিতির। নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে মায়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠল তিতির। বাইপাসের বুক চিরে সোজা লেকটাউন, সেখানে ট্রাফিক সিগন্যাল লাল দেখে গাড়ি কিছুক্ষণ দাঁড়াল। অন্যদিন বেলুন দেখলে বায়না করে তিতির। আগে অবশ্য বায়না করতে হতো না, বাবা বেলুনওয়ালা দেখলেই কিনে দিত। যেদিন থেকে গাড়িতে তিতিরের পাশে বাবা নেই, মাকে বলত বেলুন কিনে দিতে। রিয়ার মুড ভালো থাকলে বেলুন কিনে দিত। আজ যে মায়ের মুড ভালো নেই, সেটা বুঝেই তিতির আর বায়না করেনি। সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ হতেই অশোক গিয়ার চেঞ্জ করল।
চার
টিভিতে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ চলছে। অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটি গা এলিয়ে দেখছিল রিয়ার বহুবার দেখা ছবিটা। রিয়া ঘরে ঢুকতেই অস্বস্তিতে রিমোটে হাত দিতেই ‘স্ট্যান্ডবাই মোড’। আপন মনেই হেসে ফেলল রিয়া। এই সিনেমা দেখাকে কেন্দ্র করেই ওদের সাত বছরের সম্পর্ক প্রায় ভেঙে যেতে বসেছিল সেদিন। অনেক কষ্ট করে সকাল থেকে টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে দুটো টিকিট কেটেছিল সুখেন্দু। শো শুরু দুপুর আড়াইটেয়, রিয়া পৌঁছেছিল প্রায় পৌনে চারটে নাগাদ। এত রাগতে কোনওদিন দেখেনি সুখেন্দুকে। ওর মুখের ওপর টিকিট ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সুখেন্দু। আজ যে অনন্ত প্রতীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে— কাকে রাগ দেখাবে রিয়া! এই অনুযোগ শোনার অবসরও যে নেই ওর সুখেন্দুর। কেমন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে, হয়তো ভেতরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ..কে জানে! লাস্ট সপ্তাহের বিল, যেটা রিসেপশন থেকে পাঠিয়েছে রিয়ার হাতে তুলে দিল অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটি। মেয়েটির বাপের বাড়ি নদীয়া, নবদ্বীপ শহরে। খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে, নাম তনয়া। শ্যামবর্ণা কিন্তু মুখটা ভারী মিষ্টি। বেশি কথা বলে না। ‘নেক্সট শনিবার তুমি যদি চাও দেশের বাড়ি যেতে পার। আমি ওদিন থাকব দাদার কাছে। সন্ধে সাতটার মধ্যে ঢুকে যাব।’ তনয়ার চোখ দুটোতে কৃতজ্ঞতার ছবি। ‘আমি আবার সোমবার আসব দিদি। রোববার তপতী আসবে। ভালো মেয়ে। অনেকদিন আছে এই নার্সিংহোমে। তোমাদের ওদিকেই বাড়ি।’ এবার খাম থেকে আস্তে আস্তে নার্সিংহোমের বিলটা বার করল রিয়া। যা ভেবেছিল তাই। ওষুধ-বিষুধ, অ্যাটেনডেন্ট, রুম রেন্ট সব মিলিয়ে প্রায় লাখ দুয়েক টাকার বিল। ভাগ্যিস অপারেশনটা প্রথম দিনেই হয়ে গেছিল। নইলে ওতেই তো লাখ তিনেক খরচ হয়ে যেত মেডিক্লেম থেকে। আজ একটু কাছ থেকে সুখেন্দুকে দেখতে ইচ্ছে করল রিয়ার।
—সত্যি তুমি পার বটে রিয়া। একটু আদর করব বলেছি, তাতেও এক বছর অপেক্ষা করালে, অন্য কেউ হলে না তোমায় ছেড়ে চলে যেত।
—যাও না। যে অপেক্ষা করাবে না তার কাছে যাও। আমি জানি, আমার সুখ আমায় ছেড়ে কারও কাছে যাবে না। এটাই আমার গর্ব , আমার কনফিডেন্স। বুঝলে হাঁদুরাম!
জীবনের প্রতি বাঁকে কতই না প্রতীক্ষা করতে হয়েছে তোমাকে। আজ কি তাই এভাবে প্রতিশোধ তুলছ তুমি? আমার অপরাধের জন্য ছোট মেয়েটাকে এত কষ্ট দিও না। আমি আর পারছি না সুখ, বিশ্বাস কর, আমি আর পারছি না। আজ যেন চোখের জল বাঁধ মানছে না রিয়ার। তনয়া ফিরে আসতেই নিজেকে কিছুটা সামলে নিল রিয়া। ‘যাই আজ একবার ডাঃ সারেঙ্গীর সঙ্গে দেখা করব, দেখি উনি কী বলেন।’ এই বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রিয়া। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ডাঃ সারেঙ্গীর দেখা পেল না। ওটিতে আছেন, একটা মেজর অপারেশন, কতক্ষণ লাগবে বলতে পারল না এনকোয়েরি থেকে। বাড়ির পথে পা বাড়াল রিয়া।
পাঁচ
বাড়িতে ফিরতেই মিনতির গোমড়া মুখ। আজ তিতিরের ক্লাস টিচার খুব মুখ করেছেন ওকে। কাল রিয়াকে দেখা করতে বলেছেন প্রিন্সিপাল। এই নিয়ে শেষ এক মাসে তিনবার সায়েন্স হোমওয়ার্ক করে নিয়ে যায়নি তিতির। সত্যি তিতিরটার একদম যত্ন করতে পারি না। একা মানুষ ক’দিক দেখব। তাও দু’জনের রোজগারে সংসারে টাকার অভাব নেই, নইলে যে কী হতো! এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে ঘুম চলে এল রিয়ার। মাঝরাতে একটা দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল রিয়ার। সারারাত এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল। দু’চোখের পাতা আর এক হল না। কখনও মনে পড়ছে জামাইবাবুর কথাগুলো— এসব ভেন্টিলেশনের চক্করে পড়েছ কি মরেছ। সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। টাকার টাকাও যাবে, মানুষটাও ফিরে আসবে না।
তা বলে কি ভেন্টিলেশন উইথড্র করে নিতে বলা যায়! তিতির যদি বড় হয়ে জানতে চায় এসব কথা, কী বলব ওকে! আর আত্মীয়স্বজনরাই বা কী বলবে! কী জবাব দেব সুখের বন্ধুদের! যদিও যাদের কথা রিয়া ভাবছে, দিন দশেকের পর থেকে আর কাউকে দেখতে পায়নি রিয়া। প্রথম প্রথম তাও অনেকে ফোন করত, এক কথা বলতে ওর বিরক্ত লাগত। এখন আর কেউ ফোনও করে না। সকালে উঠে তিতিরকে স্কুলে পাঠিয়ে রিয়া একবার নার্সিংহোমে ফোন করে সুখেন্দুর খবর নিল। তারপর স্নান সেরে নিজেও খেয়েদেয়ে বেরল সারাদিনের জন্য। আজ আবার তিতিরের প্রিন্সিপাল কী বলবেন কে জানে! বেশি কিছু বললে স্কুল ছাড়িয়ে দেব। এত কথার কী আছে! এ চত্বরে এমন হাজারটা স্কুল আছে। রিয়াও বুঝতে পারছে ওর ধৈর্য কমছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে, তবু লড়াইটা করে যেতে হবে। আজ নার্সিংহোমের বিল পেমেন্ট করে একবার অনুরোধ করবে যদি প্রাইভেট কেবিন থেকে সরিয়ে আইসিসিইউ-তে ফিরিয়ে নেওয়া যায়।
না, রিয়ার অনুরোধ রাখেনি। আজ সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতেই তনয়াকে ছেড়ে দিয়েছে রিয়া। কাল সকাল আটটায় তপতী আসবে। তার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে। শেষবারের মতো সুখেন্দুর পা দুটো ছুঁয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল রিয়া। ‘প্রতীক্ষার এই পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হতে পারলাম না সুখ। তিতিরের কথা ভেবে, সংসারের কথা ভেবে এই সিদ্ধান্তটা আমি নিলাম। পারলে আমায় ক্ষমা কর। পরজন্মে যেন তোমায় আবার ফিরে পাই, কথা দিচ্ছি আর কখনও আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়।’ ভেন্টিলেটরের পাইপটা আলগা করে ঝাপসা চোখে কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরল রিয়া। আজ অশোককেও ছুটি দিয়েছে রিয়া। ক্যাবে উঠে ভাঙা ভাঙা স্বরে কোনও রকমে কোড নম্বরটা বলল, নম্বর মিলতেই ক্যাব স্টার্ট দিল। গন্তব্য পদার্পণ অ্যাপার্টমেন্ট। তিতির তখনও ঘুমোয়নি। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরতেই ইন্টারকমটা বেজে উঠল।
সিকিউরিটি গার্ড জানাল, ‘ম্যাডাম, বাগুইহাটি থানার বড়বাবু অনন্ত হালদার এসেছেন।’ হয়তো আর এক প্রতীক্ষার জন্ম হল।
অঙ্কন : সোমনাথ পাল