বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

দেশ-বিদেশের আলোর উৎসব
তরুণ চক্রবর্তী

আমাদের মনের আলো, আমাদের চেতনার আলো জ্বালিয়ে দিতে চেয়েই আজকের দিনটিতে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন মহামানব যিশু খ্রিস্ট। ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় যন্ত্রণাক্ত হতে হতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর ঘাতকদেরও ক্ষমা করে। আজ আলোই বুঝি তাঁকে প্রণামের সর্বোত্তম উপাদান। বেথেলহেম থেকে বোর্নিও, প্যারিস থেকে প্রাগ, দেশে দেশে, দিশে দিশে, গির্জায় গির্জায়, পথে-প্রান্তরে, উদ্যানে সূর্য অস্তাচলে গেলেই বড়দিনের বর্ণময় আলোর বন্যা। এত আলোও থাকতে পারে! শুধুই তো নিত্যদিনের নিত্যকালের সূর্য-চন্দ্র-তারার আলো নয়, এ পৃথিবীতে যত রং থাকতে পারে, তার সবকিছু দিয়ে আলোর সম্ভার সাজিয়েও বুঝি আশ মেটে না আমাদের। এ আলোর অভিমুখ যে পরম করুণাময় যিশু খ্রিস্ট— সবারই প্রার্থনা, এই আলো যেন পরিশুদ্ধ করে আমাদের। ঘুচিয়ে দেয় ভেদ, হিংসা, দ্বন্দ্ব, হানাহানি। আলোই তো যাবতীয় অন্ধকার বিনাশ করে। আলো মানে আনন্দ, আলো মানে জ্ঞান। আলো হল ঐশ্বর্য, শক্তি, শুভ। আলো শুধু চোখে দেখারই নয়, মনেপ্রাণে সুরে সুরে বাজিয়ে নেওয়ারও সম্পদ। বড়দিনের আলোর উৎসবও তাই অনেক কথা বলে। আলোর ভাষাও কত জীবনচিহ্ন, কবোষ্ণ, ইতিহাসাশ্রয়ী কত স্মৃতিবাহী! কেবল মাটির প্রদীপের আলোই তো নয়, দেউড়িতে মশালের আলো, রাজমহলে বেলোয়ারি ঝাড়ের থেকে ঠিকরে পড়া আলো আকাশ থেকে উপচে পড়া ইন্দ্রপুরীর কোন রমণীর বাসরপ্রদীপের আলোর মতো আশ্চর্য জ্যোতি যুগে যুগে কত না বার্তা বয়ে এনেছে! আলোই আমাদের সর্বোত্তম আনন্দ।
ক’দিন আগেই তো আমরা উদযাপন করলাম দীপান্বিতার উৎসব। প্রতিবারের মতো দেখলাম, হর্ম্যপ্রাসাদের শীর্ষ থেকে অলিন্দ, সাধারণ মানুষের দুয়ার থেকে ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত সারি সারি আলো, যেন কেউ তির ছুড়ে গেঁথে দিয়েছে আলোর অনুপম মালা।
সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছেই আলো আদরণীয়, অতি প্রয়োজনীয় এবং চির প্রার্থনীয়। আলো আমাদের চাই-ই চাই। সময় বিশেষে আমরা সবাই মেতে উঠি আলোর উৎসবে। সেদিক থেকে আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন লোক উৎসব দীপাবলি বা দেওয়ালিকে ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব বলা যেতেই পারে। দীপাবলির মূল উৎসবটি কার্তিক মাসের অমাবস্যার সন্ধ্যায় হলেও তার কয়েকদিন আগে থেকেই প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ি-ঘর সাজানোর রীতি আছে। আমাদের দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। নানা অনুষঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এ সময় বুদ্ধদেবের গৃহত্যাগ এবং তাঁর শিষ্য মহামোগগলায়নের পরিনির্বাণ উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। সেও আলোরই উৎসব। বৌদ্ধ মঠে ও গুম্ফাগুলি রাতে সেজে ওঠে আলোর মালায়।
জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ দিনটি খুবই পবিত্র। ৫২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে কার্তিক মাসে, মতান্তরে কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাতে জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর নির্বাণ লাভ করেন। ভক্তরা তাঁর নির্বাণস্থল পাবা নগরীতে দীপদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেই থেকে জৈনরা দীপমালা সাজিয়ে এই উৎসব উদ্‌যাপন করে আসছেন।
শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেও দিনটি পবিত্র। ষোলোশো খ্রিস্টাব্দের এই দিনেই গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি গুরু হরগোবিন্দ সিং মুক্তি লাভ করে অমৃতসরে ফিরে এসেছিলেন। সেই দিনটির স্মরণে প্রতি বছর অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির তো বটেই, দেশের গুরুদ্বারগুলিও আলো দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে।
মারাঠিরা এ দিনটি উদ্‌যাপন করেন ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজি প্রতি বছর দীপাবলির দিন বেরতেন অভিযানে। তাঁর ঐতিহাসিক কৃতিত্বকে সম্মান জানাতে এদিন মারাঠি শিশুরা মাটির কেল্লা তৈরি করে সন্ধ্যা হলেই সেগুলি আলো দিয়ে সাজিয়ে আনন্দোৎসবে মেতে ওঠে।
দেশে দেশে সময় বিশেষে, কোথাও ধর্মীয় অনুষঙ্গে, কোথাও আবার বিজয়োৎসবের মতো আনন্দোজ্জ্বল কোনও ঘটনার আবহে উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে আলোর উৎসব। এক এক দেশে তার নাম যেমন ভিন্ন, উৎসবের আঙ্গিক ও রীতিতেও পার্থক্য আছে কিছু। 
প্রতি বছর নভেম্বর মাসে লুনার থাই ক্যালেন্ডারের দ্বাদশ দিনে থাইল্যান্ডের মানুষ শয়ে শয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেন। মেতে ওঠেন আলোর উৎসব ‘লাই ক্রাথং’-এ। সুসজ্জিত ঝুড়িতে জ্বলন্ত প্রদীপ সাজিয়ে জলে ভাসানোর মধ্যে দিয়ে আলোকে বরণ করেন তাঁরা। সে দেশে এটি একটি ধর্মীয় প্রথা, জলদেবীরই আরাধনার অঙ্গ। এই উৎসব চলে ২১ থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত।
আলোর এমন উৎসবের সঙ্গে চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাংলায় মুর্শিদাবাদের বেড়া উৎসবের। ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন সেকালের সুবে বাংলা, অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও ওড়িশার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। বেড়া উৎসবের নেপথ্যে আছে ছোট একটি কাহিনি। সেকালে মুর্শিদাবাদ থেকে নদীপথে দিল্লির মুঘল সম্রাটের দরবারে নজরানা পৌঁছে দেওয়া হতো। সেই নজরানা মাঝে মাঝেই জলদস্যুরা লুঠ করে নিয়ে পালাত। নবাব এর প্রতিকার খুঁজতে শরণ নিলেন জলদেবতা হজরত খৌজা খিজির আল্লা হো সালামের। তাঁকে তুষ্ট করতে তিনি নানা খাদ্যসামগ্রী বোঝাই করে, আলোয় সাজানো একটি বজরা ভাসিয়ে দিলেন নদীতে। সেদিন থেকেই শুরু হল বেড়া উৎসব। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার, মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি সন্নিহিত ভাগীরথী নদীতে, কলার ভেলার তৈরি একটি নৌকার মধ্যে কুমিরমুখো ছোট চারটি নৌকা রাখা হয় প্রতীকী হিসেবে। এরপর নৌকা, সাজানো হয় প্রদীপ, রঙিন মোমবাতি আর আতসবাজি দিয়ে। সন্ধ্যায় সেগুলি জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীজলে। কলার ভেলার পিছনে বড় একটি নৌকোয় বাজতে থাকে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। নদীর দুই তীরের মানুষজনও তখন আতসবাজি পুড়িয়ে শামিল হন এই উৎসবে।
সাবেক বার্মা বা মায়ানমারে ‘থান্ডিং ইয়ুট’ নামে আলোর একটি উৎসব উদ্‌যা঩পিত হয় বর্মি ক্যালেন্ডারের সপ্তম মাসে। সাধারণত এই সময়টি পড়ে অক্টোবর মাসের শুরুতে। সেদেশের বৌদ্ধদের বিশ্বাস, ওই সময়টিতে ভগবান বুদ্ধ স্বর্গে তাঁর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে এসে মর্তভূমিতে অবতরণ করেন। তাঁর সেই পথ আলোকোজ্জ্বল করার জন্য মায়ানমারে সব বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও প্যাগোডাগুলি আলো দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্র আর মাটিতে রংবেরঙের আলোর মালার সঙ্গে আতসবাজির প্রদর্শন— সব মিলিয়ে সারা দেশ হয়ে ওঠে উৎসব মুখর। আমাদের দীপাবলির মতোই মায়ানমারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের বাড়ির বারান্দা ও অন্যত্র মোমবাতি জ্বালিয়ে আনন্দ উপভোগ করে।
মায়ানমারের এই উৎসবের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর অনুষঙ্গের। বাংলায় আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি থেকে সারা কার্তিক মাস ধরে, এককালে প্রতি সন্ধ্যায় লক্ষ্মীনারায়ণের উদ্দেশে তিলতেল বা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে, বিষ্ণুমন্দিরে বা আকাশে দীপদান করা হতো। নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে এই আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর রীতিটি খুবই প্রচলিত ছিল। লম্বা একটি বাঁশের মাথায় সাদা পাতলা কাপড়ের ঘেরাটোপ বানিয়ে অথবা রঙিন কাগজের বাক্সের মধ্যে বড় একটি পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে বাঁশটি বাড়ির ছাদে বা উঠোনে খাড়া করে রাখা হতো। প্রচলিত ধারণা, প্রয়াত পূর্বপুরুষদের স্বর্গারোহণের পথ আলোকিত করতেই কবে একদিন হিন্দু পরিবারে এই প্রথা চালু হয়েছিল। বাংলায় এ প্রথা আজ ক্ষীয়মাণ হলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কোথাও কোথাও গাঁয়ের মানুষ আজও আকাশ প্রদীপ জ্বালান। তবে, এখন তা বৈদ্যুতিক আলো। বিদ্যুতের আলো আজ হঠিয়ে দিয়েছে অনেক কিছুই, তবে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে আজও।
তাইওয়ানে একটি আলোর উৎসবের আয়োজন করে থাকে সে দেশের পর্যটন দপ্তর। এই উৎসবের প্রধান বার্তাটি হল, ‘এ শহর নিরাপদ’। চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসের পঞ্চম দিনে আকাশে রঙিন ফানুস বা লণ্ঠন জ্বালিয়ে চলে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়। সেদেশের উত্তরাঞ্চলে পিঙ্গজি জেলায় যখন হাজার হাজার রংবেরঙের ফানুস আকাশে বর্ণময় আলোর বন্যা আনে, দক্ষিণে ইয়ানশুয়েই জেলার মানুষ তখন মেতে ওঠেন আতসবাজির প্রদর্শনে। সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই উৎসবের আর এক উদ্দেশ্য লোকসংস্কৃতি ধারাটি বহমান রাখা।
তাইওয়ানের মতো চীন দেশেও আকাশে ফানুস উড়িয়ে, রং-বাহারি লণ্ঠন জ্বালিয়ে বর্ণাঢ্য আলোর উৎসব উদ্‌যা঩পিত হয়। চীনা নববর্ষের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণও ওই আলোর বাহার। চান্দ্রবর্ষের পঞ্চদশ দিবসে, ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে এ উৎসব উদ্‌যাপন করা হয়। সারা দেশের পার্ক বা উদ্যান ও পর্যটন ক্ষেত্রগুলি এ সময় রঙিন আলোয় সেজে ওঠে। বাড়িতে বাড়িতে চলে বিশেষ খানা-পিনা, নানা জায়গায় পরিবেশিত হয় সঙ্গীত এবং সিংহ ও ড্রাগন নৃত্য। শিল্পীরা বর্ণাঢ্য পোশাক পরে অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। ইংরেজিতে এই উৎসবটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যাল’। এ উৎসব সেদেশে চলে আসছে দু’হাজার বছর ধরে। হান শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক সম্রাট হানমিংদি একদিন শুনলেন, প্রথম চান্দ্রমাসের পঞ্চম দিন এলেই কয়েকজন শ্রমণ মন্দিরে গিয়ে লণ্ঠন জ্বালিয়ে ভগবান বুদ্ধের পুজো করেন। ব্যাপারটি বেশ মনে ধরেছিল তাঁর। এরপর তিনি ওই দিনটিতে দেশের সব মন্দির, বাড়িঘর এবং তাঁর প্রাসাদে সন্ধ্যা হলেই লণ্ঠন জ্বালিয়ে আলোকসজ্জার আদেশ দেন। সেই বৌদ্ধ রীতিই জনগণের উৎসাহে ক্রমে মহাসমারোহের আলোর উৎসব হয়ে দাঁড়ায়।
জাপানিরা যেমন বুদ্ধের উপাসক, সেই সঙ্গে তাঁরা প্রকৃতি তথা সুন্দরেরও পূজারি। আলো তাঁদের জীবনে যে কতখানি মহিমান্বিত, তার প্রমাণ, সে দেশের জাতীয় পতাকায় সূর্যের প্রতিচ্ছবি। জাপানের প্রধান দেবতা সূর্য এবং সে দেশের সম্রাটকে সূর্যেরই প্রতিনিধি জ্ঞানে সম্মান জানানো হয়ে থাকে। জাপানে প্রায় সারা বছর ধরেই কোনও না কোনও উৎসব লেগেই থাকে। আর সব উৎসবেই দেখা যায় আলোর সমারোহ। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে আয়োজিত হয় শীতকালীন আলোকোৎসব। সে আলোর রং, রূপ, ভাষা বিস্ময়াবিষ্ট করে তোলে দর্শক ও পর্যটকদের। এক একটি শহর বা স্থানের আলোকসজ্জা এক এক শিল্পকর্মের অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—টোকিও মারুনৌচি, শিনজুকু, কারেত্তা শিওদোম, ওসাকা-র মিদোসুজি প্রভৃতি স্থান। নাগোইয়া শহরের বাইরে আশি লক্ষেরও বেশি এলইডি লাইট দিয়ে গড়ে তোলা হয় স্বপ্নপুরীর পরিবেশ। হাজার হাজার শিল্পী ও কর্মী একটানা চারমাস ধরে রচনা করেন এই আলোকসজ্জা। জাপানের প্রাচীনতম একটি আলোর উৎসব হয় কোবে শহরে। কান্তো প্রদেশে সাগামি হ্রদ সংলগ্ন বিখ্যাত অরণ্য আবাসের আলোকসজ্জার খ্যাতি তো বিশ্বজোড়া। এই উৎসব চলে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। আলোর এই উৎসবের মূল সুর বাঁধা থাকে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার মন্ত্রে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ‘আলোকের এই ঝরনাধারায়’, ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক।’
জাপানের ঐতিহ্যবাহী আর একটি আলোকোৎসব ‘তেরো নাগাসি’ বা ‘ফ্লোয়িং ল্যান্টার্নস’। এর আয়োজন হয় আগস্ট মাসের শেষ দিকে, তিন দিনের বুদ্ধ উৎসবের সমাপ্তিতে। এ উৎসবে বিশেষ আকর্ষণ, নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হাজার হাজার জাপানি লণ্ঠন ‘মুকায়েবি’। লণ্ঠনগুলি ভাসতে ভাসতে চলে যায় দূরে, আর সেই সঙ্গে চলে আলো-আঁধারের খেলা। মৃত পরিজনদের আত্মার স্মরণ ও কল্যাণ কামনা করেই আলোর এই উৎসব। জাপানিদের বিশ্বাস, ওই সময়েই প্রয়াত আত্মীয় স্বজনদের আত্মা ক্ষণকালের জন্য নিজেদের বাড়িতে নেমে আসে। তাঁদের পথ দেখাতেই আকাশ জুড়ে ভাসানো হয় আলোর লণ্ঠন। আমাদের আকাশ প্রদীপেরই সমতুল। কম্বোডিয়ায় সাধারণত নভেম্বর মাসে, কখনও বা অক্টোবরের শেষ দিকে আয়োজিত হয় ‘বন ওম তৌক’, যা একইসঙ্গে চন্দ্রোৎসব ও নৌ বাইচ প্রতিযোগিতাও। তোনলে স্যাপ নামে নদীটির জলস্রোত এই সময় বিপরীতমুখী হয়। চওড়া নৌকা আলোর মালায় সাজিয়ে আর সারি সারি লণ্ঠন ভাসিয়ে দেওয়া হয় সেই নদীতে। এক একটি রাজকীয় নৌকা, ময়ূরপঙ্খি নাওয়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। বর্ণিল আলোর সেই তরণী ভাসে পূর্ণিমার রাতে। পাশাপাশি জলে ভাসে হাজার হাজার লণ্ঠন। দেশের সমস্ত প্রদেশের মানুষ রাজধানী নম পেন্‌-এ আসেন এই উৎসবে শামিল হতে। তিনদিনের এই উৎসবের সঙ্গে মিল আছে আমাদের গঙ্গাপূজা বা গঙ্গা দশেরার। রংচঙে পোশাক পরে চীনের মতো সেদেশেও ড্রাগন বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন অনেকে। এর মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন করা হয় আঙ্কোরে পূর্বতন সামরিক শাসকদের প্রতি। এছাড়া জলদেবীকে তুষ্ট করাও উৎসবের আর এক উদ্দেশ্য। আঙ্কোর রাজ সপ্তম জয় বর্মনের সময়ে প্রবর্তিত এই উৎসবের উদ্দেশ্য ছিল, রাজার নৌবাহিনীকে মাছ ধরায় উৎসাহ দেওয়া।
শ্রীলঙ্কায় যেদিন পূর্ণিমা, সেদিনই ‘পোয়া দিবস’। সেদেশের তামিলরা আমাদের মতো দীপাবলি ছাড়াও সে মাসের পূর্ণিমায় উদ্‌যাপন করেন ‘ভেসাক পোয়া’, ভগবান বুদ্ধের জন্ম, বোধি ও মহাপরিনির্বাণ স্মরণে। মাটির প্রদীপ কাগজের লণ্ঠনে সাজিয়ে এ সময় সন্ধ্যায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গৃহপ্রাঙ্গণে, জানলায়, অলিন্দে। বৌদ্ধরা ব্রতী হন বুদ্ধের পূজায়। পরিবেশিত হয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পথে পথে অস্থায়ী দোকান থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হয় খাদ্য ও পানীয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে ৩ থেকে ৬ নভেম্বর যে তিহার অনুষ্ঠিত হয়, তা একাধারে সামাজিক, ধর্মীয় ও আলোরও উৎসব। শস্য ভাবনা, প্রাণী সম্পদের বিকাশ ও মানব কল্যাণ কামনাই এ উৎসবের লক্ষ্য। সন্ধ্যায় সারা নেপাল সেজে ওঠে আলোয়। আতসবাজির প্রদর্শন বাড়িয়ে তোলে উৎসবের আনন্দ। 
বাংলাদেশে তো বটেই, পাকিস্তানের হিন্দুরাও দীপাবলি উৎসবে আলো দিয়ে সাজান বাড়িঘর। করাচির স্বামীনারায়ণ মন্দিরটি সাজানো হয় আলোর মালায়। লাহোর ও রাওয়ালপিণ্ডির কৃষ্ণমন্দিরগুলিও আলোয় সাজে। দীপাবলি হয় পেশোয়ার এবং সিন্ধের সুক্কুরে। গৃহস্থরা আলপনা দেন বাড়ির আঙিনায়।
এ পৃথিবীতেও আশ্চর্য যা কিছু, তার অন্যতম এই আলোর তাৎক্ষণিক প্রতিফলন। আমাদের চেতনার রঙেই তো চুনি হয় রাঙা, পান্না হয় সবুজ। এ শক্তি তাই মনের ক্ষুধাভবনের ক্ষেত্রেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দেহ আর মন নিয়েই যেহেতু জীবন, তাই আলোর উৎসব আমাদের জীবনেরই উৎসব। এ উৎসব তুলনাহীন।

25th     December,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ