বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

ছোট  গল্প
রবীন্দ্রজয়ন্তী
চিরন্তন প্রামাণিক

চিরন্তন প্রামাণিক
যে সময়ের কথা বলছি, সেসময় আমার বয়েস ছিল সাত কি আট। অজানা দ্বীপে কুড়িয়ে পাওয়া ঝিনুকের বুকে ঘুমন্ত গোলাপি মুক্তোর মতোই তখন জীবন ছিল নির্মল, নিটোল আর নিষ্পাপ। পরীক্ষার আগে মায়েরা, ছেলেমেয়েদের কপালে দইয়ের ফোঁটা লাগিয়ে শুধু বলতেন, বড় হ। কাউকে বিদেশি সুরে, ‘বেস্ট অফ লাক বেটা’ বলতে শুনতাম না। নিম্ন বুনিয়াদি শিক্ষালয়ের জল চুঁইয়ে পড়া ছাদের তলায় দাঁড়িয়ে ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’ এত এনার্জি নিয়ে চিৎকার করতাম, যে অজগর বুঝে যেত তার চেয়েও বিপজ্জনক প্রাণী পৃথিবীতে রয়েছে। সেখানে না ছিল স্কুল ইউনিফর্ম, না ছিল ‘মে আই কাম ইন স্যার’ বলার ছদ্ম সভ্যতার ডাক। কুকিজ্, চকো ভ্যানিলা, অনলাইন ক্লাস, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা অ্যাডলফ হিটলার, কারওরই নাম শোনার সৌভাগ্য হয়নি তখনও। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে কাঁচা পেয়ারা, ঝালমুড়ি, কখনও বা বাড়ি থেকে আনা সুজির হালুয়া পরম তৃপ্তি করে মুখে দিতাম এবং বলা বাহুল্য হাত ধোয়ার কোন বালাই ছিল না। 
একদিন ধুতি, পাঞ্জাবি আর একখানা স্বাস্থ্যবান শুঁয়োপোকা মার্কা ঝুপো গোঁফ ঝুলিয়ে আমাদের বাংলার শিক্ষক ক্লাসে এসে বললেন, ‘রচনা লেখো।’ আমরা এমন কষে কলমখানা ধরলাম যে, ভাবখানা দেখে মনে হল, শুধু রচনা কেন, সূচনা থেকে শুরু করে বর্ণনা, আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা এবং প্রথাগত ধ্যানধারণা সব কিছুকে কলমের ডগা দিয়ে তছনছ করে ছাড়ব। সরস্বতী বীণা সরিয়ে রেখে হাত জোড় করে বলবে, রক্ষে করো মনুর পুত্র-পুত্রীগণ। সেই ছোট বয়সেই আমরা কী করে যেন জেনে গিয়েছিলাম, ‘পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান সোর্ড’। বাবা নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই তলোয়ারের বদলে কলম হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু এটা জানতাম না, এই প্রবাদ সবার পেনের জন্য সত্যি নয়। আসল মাইটি হল বুদ্ধি, সেটাই কি না চুঁয়ে চুঁয়ে পেনের ডগা দিয়ে নেমে আসে। আর ভগবান বুদ্ধি বণ্টনের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর কৃপণ। গড়পড়তা মানুষের জন্য গণবণ্টন ব্যবস্থায় মাথাপিছু বরাদ্দ এক চা চামচ বুদ্ধি। তিনি চান না পৃথিবীটা খুব বেশি বিদ্বান, বুদ্ধিমানে ভরে যাক।
ঝুপো গোঁফ, জানলার দিকে তাকিয়ে কিছু সময় নিয়ে কতকটা স্বগতোক্তি করে আবার বললেন, ‘রচনা লেখ, রবীন্দ্রজয়ন্তী।’
কলমখানা কষে ধরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু বিষয়বস্তু শুনে আমার আঙুলের নার্ভগুলো ঢিলে হয়ে এল। প্যান্টের পুরনো ইলাস্টিকের মতোই। এমনিতেই অপুষ্টি সারা বছর আমার পিছু ছাড়তে চাইত না। আজ ম্যালেরিয়া, কাল পেট খারাপ, পরশু ঠান্ডা লাগা লেগেই ছিল। বাসক, কালমেঘ, থানকুনি আর কুলেখাড়া খেতে খেতে আমার পাকস্থলী হয়তো ধরেই নিয়েছিল যে, এটা ছাগলের পেট, আমিষ জোটার কোনও সম্ভাবনা নেই।
‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ শুনে পেনের ডগা নীরবে দু’ফোঁটা কালি মানে অশ্রু বিসর্জন করল। এত বিষয় থাকতে রবীন্দ্রনাথ? গোরু, বর্ষণমুখর সন্ধ্যা বা শরৎকাল মুখস্থ করেও কাজে এল না! নিদেনপক্ষে ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ দিলেও দেড় পাতা নামিয়ে দিতাম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে বড় খটমট বিষয়। তিনি কি মানুষ না ঠাকুর? কাঠের না পেতলের? মন্দিরে পূজিত হন? রোজ যে মাকে দেখি সন্ধ্যায় তার ছবিতে ধূপ দেখাতে! প্যান্টে সর্দি মোছা অগণিত ছাত্রের মতোই, আমার কাছে তখন রবীন্দ্রনাথ মানে শ্মশ্রুশোভিত, এখনকার ‘স্লিম ফিট’ স্টাইল স্টেটমেন্টের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা এক মানুষ। যার গ্রীবা চুম্বিত কেশগুচ্ছ, ঢিলেঢালা আলখাল্লা আর সম্মোহিত দৃষ্টি দেখে মনে হয় তিনি বুঝি জাদুকর গোছের কেউ। তন্ত্র মন্ত্র সাধক। মনে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি রাশভারী? তিনিও কি আমাদের মতো হেসে লুটোপুটি খান? তাঁর সম্পর্কে সহজপাঠ, জোড়াসাঁকো ও নোবেল এই তিনটি শব্দের বেশি অন্যকিছু জানতাম না। মনেই থাকত না। আসলে আমি বরাবরই সাহিত্যের অমনোযোগী ছাত্র। না, একটু ভুল বললাম, ওঁর ওই প্রতিবাদী সত্তাটা বেশ মনে ধরেছিল। ইংরেজদের মুখের উপর রবিনহুড না নাইটহুড উপাধি ত্যাগের বিষয়টা ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিত। কিন্তু এই কয়েকটা সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথকে দাঁড় করাব কী করে? এক আঁটি খড় দিয়ে মা দুর্গার কাঠামো বানানো সম্ভব? কাঠামো যদিওবা হল, প্রাণ সঞ্চার হবে কী করে?
ভেষজ রসে পুষ্ট শিথিল হাত, কমিউনিস্টদের মতো মুষ্টিবদ্ধ করে শুরু করলাম রচনা। আমাদের ফার্স্ট বয় বিমলানন্দ আগেই আমাকে কানে কানে গুপ্তমন্ত্র দিয়েছিল, ‘যখনই আমাদের দেশের কোনও মহাপুরুষ নিয়ে রচনা লিখবি, শুরুটা করবি এই ভাবে, রত্নগর্ভা ভারতবর্ষ যুগে যুগে যে সব মহান রত্ন এই পুণ্যভূমিতে প্রসব করিয়াছেন, যেসব জ্যোতির্ময় আত্মা অন্ধকারের ভ্রুকুটি ছেদিয়া দীপ্তোজ্জ্বল অংশুমালা হাতে অমৃতের পথে মানুষকে পথ দেখাইয়াছেন, তাহাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম হইলেন ...।’ 
আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘দেশ আবার মানুষের বাচ্চা প্রসব করে নাকি?’
‘আলবৎ করে। বড় হ, সব বুঝতে পারবি।’ মুচকি হেসে বিমলানন্দ জবাব দিয়েছিল।
আমি পাল্টা প্রশ্ন করতে সাহস পাইনি, তুই বড় না হয়েই কীভাবে বুঝে গেলি! আসলে সাহিত্য মানেই আমার কনফিডেন্স একেবারে তলানিতে। তৃষ্ণার্ত কাক তাতে যতই নুড়ি ফেলুক, জলস্তর মানে আত্মবিশ্বাস উঠে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই।
আমি বিমলানন্দের পথ অনুসরণ করে সস্তার কালির কলমে লিখতে শুরু করলাম, ‘রত্নগর্ভা ভারতবর্ষ...।’ সত্যিই বিমলের জবাব নেই। এমন একখানা সর্বজনীন মুখবন্ধ, যে সব মনীষীদের সঙ্গেই খাপ খায়। সে কালিদাস থেকে শুরু করে মোহনদাস হোক বা চিত্তরঞ্জন দাস। ফার্স্ট বয় কি শ্যাওড়া গাছে ফলে?
আমার পাশে বসেছিল রাসু। সে ছিল দুর্দান্ত রকমের জেদি আর ডানপিটে। তার রণ পায়ের কেরামতি দেখে অনেকে বলতো রাসু বড় হয়ে আর কিছু না হোক, ডাকাতিতে নাম কিনবে। ভরা অজয় সাঁতরে পার হওয়া, অন্যের বাগানে রাতের অন্ধকারে আম চুরি করা, গর্তে হাত ঢুকিয়ে শেয়ালের বাচ্চা বের করে আনা এবং ডিঙি নৌকা চালানো যদি আর্ট হয় তবে সে ছিল উঁচু দরের আর্টিস্ট। ওই ছোট বয়সেই অন্য এক পৃথিবীর বুকে সে তার প্রতিভার ছাপ রাখছিল।
তবে রাসুর মেধাকে এককথায় ব্যাখ্যা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। বিমলানন্দের কথা ধার করে বলা যেতে পারে, ‘ভারতবর্ষ যুগে যুগে যে সব মহান অজ্ঞানী, অব্যুৎপন্ন, অকোবিদ, অপ্রাজ্ঞ, আকাট এবং অচেতন ছাত্রের জন্ম দিয়েছে তার মধ্যেও রাসুর বুদ্ধির হ্যারিকেন ছিল সবচেয়ে অনুজ্জ্বল।’ বেচারি মনে রাখতে পারত না কিছুই। সবচেয়ে নাজেহাল হতো নামতার ক্লাসে। রাসু প্রায়ই আমাকে বলত, ‘নামতা না জানা কিছু মানুষ যদি পৃথিবীতে সকাল বিকাল ঘোরাফেরা করে তাতে বাকিদের অসুবিধাটা কোথায়?’ 
আমি কলম চালাচ্ছি পুরোদমে। আড়চোখে দেখলাম রাসু শূন্য খাতার উপর ধ্যানস্থ। চোখ স্থির। শুনেছি মহান পুরুষেরা নাকি এভাবেই মনোনিবেশ করে পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে! কিন্তু লেখা শুরু করেনি কেন ও?
আমি তাকাতেই রাসু একটু সাহস পেল। স্যারের অবস্থান দেখে নিয়ে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, ‘রবীন্দ্র মানে তো রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু জয়ন্তীটা কে রে?’
আমি তখন সবে ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’র মুখবন্ধ শেষ করে গলা দিয়ে নেমে অন্ত্রের কুটিল অন্ধকারে মশাল জ্বেলে ভাবার চেষ্টা করছি রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী কী কারণে স্কুলে যেতে চাননি। এমন সময় রাসুর এই প্রশ্ন, আমার তিলতিল করে গড়ে তোলা ভাবনার ইমারতে অ্যাটম বোম নিক্ষেপ করল। চিন্তার জগতে সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে গেলাম আমি।
ভীষণ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলতে গেলাম, তুই জয়ন্তীকে ইগনোর করে রবীন্দ্রনাথেই ফোকাস কর। কিন্তু বলা হল না। তার আগেই রাসু সোল্লাশে বলে উঠল, ‘মনে পড়েছে, জয়ন্তী নিশ্চয় ওনার সহকর্মিণী।’
‘এই যে ডেঁপোর দল, ওখানে এত আওয়াজ কীসের?’ ঝুপো গোঁফ হাঁক পাড়লেন। আমি ‘দিকচক্রবাল’, ‘মুমূর্ষু’, ‘আত্মবলিদান’ এবং আরও অনেক বাংলা শব্দের মতোই ‘ডেঁপো’ শব্দের মানেও জানতাম না, তবে সেটা যে আমার চরিত্রের প্রশংসাসূচক কিছু নয়, তা বুঝতে অসুবিধা হল না। আমরা যে যার খাতায় ফিরে এলাম। রাসুর জন্য চিন্তা হচ্ছিল খুব। তার থেকেও বেশি চিন্তা হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য। আজ তিনি বিপজ্জনক এক লেখকের হাতে পড়েছেন। নৌকাডুবির হাত থেকে তার সোনার তরিকে আজ কেউ বাঁচাতে পারবে না। রাসুকে কি আদৌ লেখক বলা সমীচীন? মাস্টারমশাই ওর খাতা দেখে নিশ্চয় কষ্ট পাবেন অথবা ঘুমের মধ্যে বিলাপ করবেন। সহকর্মিণী বলে রাসু কি আসলে সহধর্মিণী বোঝাতে চাইল?
দু’দিন পর রচনা পরীক্ষার ফল বের হল। মাস্টারমশাই একের পর এক ছাত্রের নাম ডাকছেন আর যে যার মতো উঠে খাতা নিয়ে আসছে। প্রথমেই বিমলানন্দ। দশে সাড়ে নয়। একটাও বানান ভুল নেই। ভাষা জ্ঞান শাণিত মোগল খঞ্জরের মতো ঝিকমিকিয়ে উঠছে। স্যার বললেন, ‘তাত্ত্বিকভাবে লিটারেচারে ফুল মার্কস দেওয়া যায় না। নাহলে দশে দশই প্রাপ্য ছিল।’ বিমল খুশি হল, না মনঃক্ষুণ্ণ হল বুঝতে পারলাম না। শুধু ওকে মনখারাপ করে বলতে শুনলাম, ‘এখনও রবীন্দ্রনাথকে ভালো করে জানতে হবে, চিনতে হবে।’ ভাবলাম ওকে জিজ্ঞাসা করি, কবে নাগাদ তোর এই চেনা জানার পালাটা শেষ হবে বলতে পারিস? ভালো করে না জেনেই যদি সাড়ে নয় আসে, তবে আরও ভালো চেনার দরকারটা কোথায়? কিন্তু পারলাম না। কী জানি, কী বলতে কি বলে ফেলব। সাহিত্য মানেই আমার কনফিডেন্স একেবারে তলানিতে।
এরপর একের পর এক ছাত্রছাত্রীর আসা যাওয়ার মিছিল শুরু হল। কেউ ভাবলেশহীন, কেউ উত্তেজিত, কারওর মনে আবার রবীন্দ্রনাথ ছাপ ফেলতে পুরোপুরি ব্যর্থ। আমি জানলার বাইরে তাকিয়ে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করছিলাম। পৃথিবীটাকে বড় দুঃখের, বড় কষ্টের জায়গা মনে হচ্ছিল।
‘সতু।’ গর্জনশীল চল্লিশার আওয়াজে কেঁপে উঠল বুনিয়াদি প্রাথমিকের নোনা দেওয়াল।
গুটি গুটি পায়ে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের খাতার দিকে চেয়ে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। ধরণী যে দু’ফাঁক হয়ে আমাকে জায়গা দেবে সে সম্ভাবনাও ছিল না। কলি যুগ বড়ই স্বার্থপর। খাতা জুড়ে শুধু লাল কালির একাধিপত্য। বানান, বাক্য গঠন, তথ্য এবং সাহিত্য রস— রচনার প্রতিটা বিভাগেই আমি নিজের এবং বংশ মর্যাদার কুলীন আত্মার গায়ে নির্দয়ভাবে ছুরি চালিয়েছি। গলার কাছে চাপা কষ্ট দলা পাকিয়ে এল। ইচ্ছে হল মা ভবতারিণীর যূপকাষ্ঠে গলা ঢুকিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্তি দিই। ইচ্ছে হল ওঁর পা দুটোকে জড়িয়ে ধরে বলি, বিশ্বাস করুন আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি, কিন্তু সাহিত্য আমার আসে না। পারলাম না বলতে। দেড় নম্বর পেয়ে কাঠের বেঞ্চে ফিরে এসে আমি জীবনে প্রথমবারের মতো দার্শনিক হয়ে গেলাম। মনে হল সাড়ে নয় পেয়ে যদি বিমলানন্দ বলতে পারে এখনও রবীন্দ্রনাথকে চেনা বাকি, তাহলে নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথ আমার থেকে এখনও শত আলোকবর্ষ দূরে। খুব যদি অঘটন না ঘটে তাহলে এজন্মে তাঁকে আর চেনা হয়ে উঠল না। 
সবার খাতা দেওয়ার পর, স্যার উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু রাসুর খাতা কই? পাশেই রাসু নির্বিকার মুখে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বঁড়শিতে ফাতনার সুতো বাঁধছিল। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে বাংলার স্যার আবার কী মনে করে ফিরে এলেন। আমরা উঠে গিয়েও আবার বসে পড়লাম।
‘রাসু কোথায়?’
অকুতোভয় রাসু বঁড়শি পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল। চোখ মুখ ভাবলেশহীন। পাথরে খোদাই রামকিঙ্করের মূর্তি। অপমান, তাচ্ছিল্য আর উপহাসের ত্রিফলা পেরেক তাকে যিশুর মতো গেঁথে ফেলবে জেনেও নিস্পৃহ থাকতে গেলে যে সাহস দরকার তা রাসুর ছিল। সাহস আসলে উত্তম ও অধম দুইয়ের সঙ্গেই ঘর বাঁধে। আমাদের মতো মাঝারিপন্থীরা সাহস আর আশঙ্কার হাইব্রিড লাড্ডু খেতে খেতে যখন বুঝতে পারি জীবনে আর একটু সাহসী হলে ভালো হতো তখন ট্রেন স্টেশন ছেড়ে ডিসস্ট্যান্ট সিগনাল পার করে অনেকদূর চলে গিয়েছে।
রাসুর দিকে তাকিয়ে স্যার কুড়ি সেকেন্ড নীরবতা পালন করলেন। রাসুও স্যারের দিকে অপলক চেয়ে রইল। আমার মনে হচ্ছিল ব্যাটারির ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই প্রান্ত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বজ্রপাত ও রক্তারক্তি শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কিছুই হল না। স্যার চশমা খুলে ধুতির খুট দিয়ে চোখ মুছে বললেন, ‘এতদিন জানতাম গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা যায়, কিন্তু তুই, তুই...। মর্কট আর গাধার এক বিরল সংমিশ্রণ তুই। আমি হয়তো তোকে ক্ষমা করে দিলাম, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তোকে আজীবন অভিসম্পাত করবেন।’
সামনের বেঞ্চ থেকে চাপা হাসির বুদবুদ শুনতে পাচ্ছিলাম। এইমাত্র স্যার, রাসুকে প্রাণীজগতের শ্রেণিবিন্যাসে যে বিচিত্র পর্যায়ভুক্ত করলেন তার জন্য ওকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখলাম না। স্যারের উপেক্ষা, বিদ্রুপ আর সহপাঠীদের উপহাসকে অবলীলায় ক্ষমা করে রাসু আমার পাশে সরে এসে বলল, ‘উত্তরপাড়ার বিলে শুনলাম বড় মাছ উঠছে। আজ বেশ মেঘলাও রয়েছে। যাবি?’
অখ্যাত নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের এক কোণে আমি সেই প্রথম রাসুর মুখে স্কুল পালানো, চার দেওয়ালের শিকল ছেঁড়া রবীন্দ্রনাথের মুখের ছবি প্রতিভাত হতে দেখলাম। মুখে শুধু বললাম, ‘যাব।’ 

20th     November,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ