বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

অগ্নিযুগ ও শ্রী অরবিন্দ
উল্লাসকর দত্ত

তাঁর পড়াশোনা বিলেতে। হেলায় ছেড়েছেন আইসিএসের চাকরি। কেন করবেন ইংরেজের গোলামি! তিনিই যে ভারতের অগ্নিযুগের প্রধান ঋত্বিক— বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। গত বছর নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল তাঁর জন্ম সার্ধশতবর্ষ। শ্রীঅরবিন্দ ও অগ্নিযুগকে কলমের আঁচড়ে ধরার প্রয়াস।

পর্ব- ২২
পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়: ১৯০৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার বিডন পার্কে এক বিরাট সভায় বক্তৃতা দিতে আসেন অরবিন্দ। কারও কারও মতে কলকাতার জনসভায় সেই তাঁর প্রথম বক্তৃতা। তিনি জানান, শিক্ষার জন্য বাল্যকালে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল বিলেত, এ কারণে তিনি মাতৃভাষা ভালো করে শেখেননি। এমনকী, মাতৃভাষায় কথা বলতেও অনভ্যস্ত। বিজাতীয় ভাষায় বক্তৃতা করা অপেক্ষা চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে হতো। এ কারণে এতদিন দেশবাসীর সামনে তেমন বক্তৃতা করা হয়ে উঠেনি।
এই সময় তিনি পরপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেন কলকাতার বিভিন্ন স্থানে। অরবিন্দ-শিষ্য ও সহবিপ্লবী নলিনীকান্ত গুপ্ত তেমনই এক জনসভায় দূর থেকে প্রথম দেখেছিলেন বক্তৃতারত অরবিন্দকে। ‘স্মৃতির পাতা’ গ্রন্থে নলিনীকান্ত লিখেছেন— ‘... একদিন দেখেছি শ্রীঅরবিন্দকে, গোলদীঘির এক সভায়, গোধূলির নিলীয়মান আলোকে। একখানা আলোয়ান দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা প্রায়। বোধহয় কিছু অসুস্থ ছিলেন তখন। তাঁর কণ্ঠ মৃদু, কিন্তু প্রতিটি বাক্য সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়। উন্মুক্ত আকাশতলে বিপুল জনসঙ্ঘ নির্বাক নিস্তব্ধ— যাকে বলে ছুঁচটি পড়লেও তার শব্দ শোনা যায়। আমার মনে আছে শুধু এই ক’টি কথা তাঁর— মাতৃভাষা বাংলায় তিনি বলতে পারছেন না, দুঃখের ও লজ্জার কথা। তাঁর শিক্ষা ও পরিবেশ এমন ছিল যে, বিদেশী ইংরেজী ভাষাতেই তাঁকে আত্মপ্রকাশ করতে হচ্ছে— তিনি দেশবাসীর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আর মনে আছে তাঁর সমস্ত ভাষণের মধ্যে কী একটা সঙ্গীতসুলভ ছন্দমাধুর্য লীলায়িত হয়ে চলেছে। শ্রীঅরবিন্দকে সর্বপ্রথম আমি চাক্ষুষ দেখলাম।’
নলিনীকান্ত গুপ্তের মানিকতলার মুরারিপুকুর বাগানে থাকার সময় প্রথম সুযোগ হয় অরবিন্দের সঙ্গে পরিচয় বা কথা বলার। কতজনের কত কৌতূহল তাঁকে নিয়ে। কেমন তাঁর কণ্ঠস্বর ও চাহনি? কেউ বলতেন— মধুর তাঁর কণ্ঠস্বর। কারও কাছে অরবিন্দের কথায় জলতরঙ্গের সুমিষ্ট ধ্বনি।
স্বদেশিযুগের বাংলার লাট স্যার এডওয়ার্ড বেকার আলিপুর জেল পরিদর্শনে গিয়ে অরবিন্দকে দেখে মন্তব্য করেন, তাঁর চোখ দু’টি পাগলের মতো।
আবার বরোদা কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষের মতে— ‘মিঃ ঘোষের চোখ দু’টিতে মিস্টিক আলো ও আগুন জ্বলছে।’
তাঁর বিপ্লবী শিষ্য উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমবার অরবিন্দকে দেখার স্মৃতিকথায় বলেন— ‘তাহাকে দেখিবার জন্য ভারী কৌতূহল হইত। ... ১৯০৬ সালে একদিন অফিসে গিয়ে শুনিলাম পাশের ঘরে তিনি সশরীরে বর্তমান! বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল। আস্তে আস্তে গিয়া দরজায় উঁকি মারিয়া দেখিলাম। আমার এক সহকর্মী কোণের চেয়ারে উপবিষ্ট কাঠের মত আড়ষ্ট এক মূর্তির দিকে দেখাইয়া দিলেন।
ব্যোম ভোলানাথ! এই অরবিন্দ! মা ধরিত্রী দ্বিধা হও, মা! ঐ রোগা, কালো, সিড়িঙ্গে ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট প্রাণী— ঐ অরবিন্দ? ঐ আমাদের Chief?
মনটা প্রায় দমিয়া গিয়াছিল, এমন সময় সেই কাষ্ঠমূর্তি ঘুরিয়া আমার দিকে চাহিলেন। সে চাহনির কি বিশেষণ দিব তাহা খুঁজিয়া পাইতেছি না। কালো তারার আশপাশে একটা কৌতুকপ্রিয় তরলতা মাখানো ছিল, কিন্তু ঐ তারার মাঝখানে এমন একটা অতলস্পর্শ ভাব ছিল যাহা আজও বিশ্লেষণ করিয়া উঠিতে পারি নাই।’
বারীন ঘোষ একদিন মানিকতলা মুরারিপুকুর বাগানে নলিনীকান্ত গুপ্তকে পাঠালেন অরবিন্দের কাছে, বললেন, ‘বাগান দেখতে তিনি আসবেন, তুমি গিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসো।’
অরবিন্দের সঙ্গে স্মরণীয় প্রথম পরিচয়ের কথায় নলিনীকান্ত গুপ্ত লিখেছেন, ‘মানিকতলা হল উত্তর কলিকাতার শেষপ্রান্ত (তখন)। আর শ্রীঅরবিন্দ থাকতেন দক্ষিণের দিকে, ওয়েলিংটন স্কোয়ার-এর পাশে (রাজা) সুবোধ মল্লিকের বাসায়। আমি ট্রামে চলে গেলাম, বৈকাল চারটা হবে তখন— দরজায় দণ্ডায়মান দারোয়ানকে বললাম ঘোষ সাহেবকে (তিনি তখন ওখানে ঐভাবে পরিচিত) খবর দিতে। আমি একটা চিট্‌ পাঠিয়ে দিলাম, মানিকতলা বাগান হতে, বারীনদার কাছ থেকে আসছি। আমি নীচের তলায় একটা ঘরে অপেক্ষা করছি— শ্রীঅরবিন্দ নেমে এলেন, এসে দাঁড়ালেন আমার কাছে, আমার দিকে তাকালেন জিজ্ঞাসুনেত্রে। আমি বললাম বাংলাতেই— বারীনদা আমাকে পাঠিয়েছেন, আপনি কি এখন যেতে পারবেন বাগানে আমার সঙ্গে?
উত্তর দিলেন তিনি খুব ধীরে, প্রত্যেকটি বর্ণ পৃথক উচ্চারণ করে (বাংলায় কথা বলা তখনও তাঁর রপ্ত হয়নি মনে হল), বললেন— বারীনকে গিয়ে বল, আমার এখনও আহার হয়নি। এখন আর যাওয়া হয় না।
ব্যস, আর কোন কথা না বলে, নমস্কার করে, আমি ফিরে এলাম— এই আমার পুণ্য সাক্ষাৎ, প্রথম দর্শন ও আলাপন।’
প্রেসিডেন্সি কলেজে নলিনীকান্ত গুপ্তের সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন উল্লাসকর দত্ত। পরিভাষায় একটি আপ্তবাক্য, Histroy repeats itself. বহুজনে বহুবার বিবৃত করেছেন— ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে কেন এবং কীভাবে বাঙালি-বিদ্বেষী প্রফেসর ওটেনকে জুতোপেটা করা হয়েছিল। কিন্তু ক’জন মনে রেখেছেন, এ ব্যাপারে দুঃসাহসী পূর্বসূরি ছিলেন উল্লাসকর দত্ত?
১৯০৫ সাল, বঙ্গভঙ্গের জন্য তুমুল প্রতিবাদের ঝড় বইছে। এমন অশান্ত ও উত্তপ্ত সময়ে এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক রাসেল অতি কুৎসিত এক মন্তব্য করেন বাঙালি জাতি সম্বন্ধে। বারুদের স্তূপে যেন আগুনের ফুলকি। ছাত্রমহলে তীব্র উত্তেজনা, সবার মনে একই প্রশ্ন, এর কি নেই কোনও প্রতিকার? জবাব নেই এই ভারত-বিদ্বেষ ও বাঙালি-ঘৃণার?
প্রত্যক্ষদর্শী নলিনীকান্ত গুপ্ত লিখেছেন, ‘আমাদের একটি ক্লাস ছুটি হয়েছে, বারান্দা দিয়ে আমরা আর এক ক্লাসে চলেছি এমন সময়ে হঠাৎ চারদিক উদ্বেলিত মুখরিত করে শতকণ্ঠে বিরাট ধ্বনি উঠল বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম। সবাই ছুটল এদিক-ওদিক— কী হল, কী হল— Russel-কে জুতো মেরেছে! —কে? কে?
প্রিন্সিপাল উপস্থিত Dr P.K Roy-প্রেসিডেন্সি কলেজের সেই প্রথম বাঙালী প্রিন্সিপাল, তাও অস্থায়ী— সবাই আমরা ক্লাসে চলে এলাম। আমাদের ক্লাসেই (ঘটনার ঠিক পাশেই ঘরটি ছিল বলে) প্রথমে তিনি প্রবেশ করলেন Russel সমভিব্যহারে। রাসেলের মুখ ক্ষোভে লজ্জায় আরক্ত— তাকিয়ে দেখলেন উপস্থিত সব ছাত্রদের দিকে। বললেন, কাউকে তিনি চিনতে পারছেন না। ক্লাস হয়ে গেলে আমরা গেলাম Physics Thetre-এ— Physics-এর ক্লাস তখন। সেখানেও আবার ঢুকলেন প্রিন্সিপাল সাহেব, জলদগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন I see Bande Matarm has become a war-cry! কিন্তু সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ নিবাতনিষ্কম্প— আগে যে তুমুল আলোড়ন উত্তেজনাপূর্ণ জনতা ছিল এখন সব প্রশান্ত মূক স্থাণু সব সুশীল সুবোধ ছেলে।
কিন্তু কে এই কাণ্ড করেছিল? উল্লাসকর দত্ত— আমাদের সহপাঠী। সে থাকত ইডেন হিন্দু হস্টেলে। এক পাটি চটি খবরের কাগজে মুড়ে সে কলেজে এসেছিল এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র তার সদ্ব্যবহার করেছিল। এই উল্লাসকরের জীবন কাহিনী একখানি ড্রামা— যদিও পরিণতি কারুণ্যপূর্ণ। এই ঘটনার পরে সে বারীন ঘোষের মানিকতলায় যোগ দেয় এবং তার সমস্ত বুদ্ধি ও শক্তি নিয়োগ করে বোমার আবিষ্কারে। বোমার ব পর্যন্ত তার জানা ছিল না। সে-ই কেমিস্ট্রি বই পড়ে, নানা পুস্তক থেকে আহরণ করে, explosives তত্ত্ব আয়ত্ত করে— কেউ তাকে শেখায়নি। তার বাবা দ্বিজদাস দত্ত শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর ছিলেন— তাঁর বাসায় একটা ছোট ল্যাবরেটরির মত ছিল— উল্লাসকর গোপনে সেখানে হাত মক্স করত। এ কাজে কতদূর সফল হয়েছিল তার প্রমাণ তার তৈরি প্রথম বোমায় আমাদের নিজেদেরই একজনকে শহীদ হতে হল (প্রফুল্ল চক্রবর্তী)— এ কাজে সহকর্মীদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন।’
উল্লাসকরের ডাকনাম পালু। ব্রাহ্মণ বাড়িয়ার কালীকচ্ছ গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাবা দ্বিজদাস দত্ত বৈদিক সাহিত্যের পণ্ডিত। দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে কৃষিবিদ্যা অধ্যয়ন করতে যান বিলেত। কৃষিবিজ্ঞান অধ্যয়নের পর দেশে ফিরে বেথুন কলেজে অধ্যাপনা, তারপর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ, পরিশেষে শিবপুর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কৃষিবিজ্ঞানের অধ্যাপনা। দ্বিজদাস অত্যন্ত তেজস্বী, তবে ইংরেজভক্ত।
পুত্র উল্লাসকর বাঁশি বাজান, দোতারায় পারদর্শী, জীবনের কঠিন দুঃখের সময়েও বিসর্জিত হয় না উদাত্ত গলায় গান। নলিনীকান্ত গুপ্ত লিখছেন, ‘উল্লাসকর সার্থকনামা পুরুষ ছিলেন— সত্য সত্য উল্লাসের অফুরন্ত আকর। জেল থেকে আমাদের যখন Prison Van-এ করে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হত তখন সারাটি পথ গান গেয়ে দিক ফাটিয়ে আমরা চলে যেতাম— উল্লাসকর তার পাণ্ডা ছিলেন, মুখ্য গায়েন আর আমরা সব দোহারি।  আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, বাংলার মাটি বাংলার জল, মেরা সোনেকী হিন্দুস্থান প্রভৃতি গান এখনও কানে বাজে, এখনও কণ্ঠস্থ। সে কলধ্বনি হঠাৎ শুনলে মনে হবে স্বদেশী প্রসেশন চলেছে, কে বলবে কয়েদীর দল? সে-সঙ্গীত এমন প্রাণমন মাতোয়ারা ছিল  যে আমাদের পুলিস-প্রহরী বা গাড়ী-চালক কোনো দিন কোনো আপত্তি তোলেনি।
...দশ-বারো বৎসর আন্দামানের কারাজীবন তাঁর দেহকে মস্তিষ্ককে বিকল করে দেয়। কিন্তু যজ্ঞের এই তো নিয়ম— বারীনদা যেমন বলতেন, এ বিবাহের এই মন্ত্র।’
উল্লাসকর যে হাতে সারা দিনমান বাজাতেন বাঁশি— ভারতের স্বাধীনতার জন্য একদিন সেই হাতে তুলে নেন পিকরিক অ্যাসিডের বোমা। ব্রিটিশ-রাজের বিচারে ঘোষিত তাঁর ফাঁসি পরে তা লাঘব হয়ে দীপান্তর। অভিশপ্ত আন্দামান সেলুলার জেলে ব্রিটিশ শাসনের হেন শাস্তি নেই— যা না দীর্ঘকাল সহ্য করতে হয় তাঁকে। পরিণামে উল্লাসকর স্থানান্তরিত হন মাদ্রাজ পাগলাগারদে। চেষ্টা করেন আত্মহননের।
অথচ একদা দিলখোলা, ভীষণ ভাবপ্রবণ, ক্যারিকেচারিস্ট, হরেক রকম রঙ্গব্যঙ্গে সুনিপুণ ছিলেন উল্লাসকর। ভেন্ট্রিলোকুইজমে ওস্তাদ হয়ে ওঠেন অতি অল্প বয়সেই।
একবার রোজকার মতো সকালে প্রিয় বন্ধু ডাঃ সুন্দরীমোহন দাসের বাড়িতে গিয়ে বিপিনচন্দ্র পালের চোখে পড়ে— উল্লাসকর দাঁড়িয়ে, হাতে একটি মজার পুতুল। সেখানে রয়েছেন সুন্দরীমোহনের পরিজনেরা। বিপিন পাল সোফায় বসতেই তাঁকে দেখিয়ে উল্লাসকর পুতুলটাকে জিজ্ঞেস করেন, মিস্টার ফ্রি ম্যান, বলুন তো ইনি কে?
মৃদু হাসিতে তাকিয়ে উল্লাসকর। পুতুল দুলে দুলে বড়ো বিচিত্র গলায় বলল, ইনি শ্রীশীল শ্রীযুক্ত মহামহিম বিপিনচন্দ্র পাল।
সবাই হাসিতে ফেটে পড়েন। বিপিন পালের বুঝতে দেরি হয় না, এ ছেলেটি ভেন্ট্রিলোকুইজমে সিদ্ধহস্ত।
বিপিন পালের কন্যা লীলাকে ভালোবাসতেন উল্লাসকর। কিন্তু দেশকে ভালোবাসার জন্য  তাঁকে মূল্য দিতে হয় জীবনের প্রিয় সবকিছু।
ফাঁসির মঞ্চ পেরিয়ে নির্বাসিত আন্দামানের সেলুলার জেলে— সেলুলার জেল থেকে মাদ্রাজের মানসিক স্বাস্থ্য নিবাস— তারপর ধ্বস্ত শরীর, ভাঙা মন উল্লাসকর পেলেন মুক্তি। তখন তাঁর একে একে সব আশা ঝরে ঝরে পড়ে যায়। যে দেশের জন্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন পিকরিক অ্যাসিডের বোমা— সেই দেশ দ্বিখণ্ডিত হল, ভাগ হল বাংলা। যৌবনের প্রেমিকা লীলাকে খুঁজে পেলেন বিবাহিতা পক্ষাঘাত অবস্থায়। হাসপাতাল থেকে লীলাকে কোলে তুলে নিয়ে উল্লাসকর আসেন ব্রাহ্মমিশন প্রেসের দোতলায়। আপাতত তাঁর ঠাঁই হল সেখানে। জীবন-যুদ্ধে কিছুতেই হেরে না-যাওয়া, — শেষক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রামী ইতিহাস-পুরুষের এ এক করুণ কাহিনি।
উল্লাসকরের আত্মকথা ‘কারাজীবনী’-তে তাঁর নিজের কথা খুব একটা মেলে না। এইসব সূর্যসন্তানদের আত্মকথনে অনীহা ছিল অত্যন্ত। জীবনের ভয়ংকর রুদ্ররূপ দেখার কথা লিখতে লিখতে বার বার তিনি হারিয়ে যান অতিলৌকিকতার দুরবগাহে।
পণ্ডিচেরিতে অরবিন্দ একদা নীরদবরণকে বলেন, ‘বিপিন পাল ছিলেন মস্ত বক্তা, সে-সময় তাঁর বক্তৃতায় আগুন জ্বলত। তাকে এক ধরনের অবতরণই বলতে পার। পরে তাঁর সেই বাক্‌শ঩ক্তি হ্রাস পায়!’
অরবিন্দের সংস্পর্শে আসার পূর্বে উল্লাসকর সিটি কলেজে পড়ার সময় একদিন গিয়েছিলেন সেই অনলবর্ষী-বক্তা বিপিন পালের বক্তৃতা শুনতে। ঘটনাবহুল অবিস্মরণীয় দিনটি মনের অজান্তে পাল্টে দেয় তাঁর পরবর্তী জীবনের গতিপথ। সেই দিন থেকেই শুরু উল্লাসকরের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘কারাজীবনী’। তিনি লেখেন—
‘আমি তখন কলিকাতার সিটি কলেজে পড়ি। একদিন ষ্টার থিয়েটার হলে বিপিনবাবুর বক্তৃতা শুনিতে যাইয়া রাজনীতি বিষয়ক আলোচনার প্রথম আস্বাদন পাই। মনে আছে একটি কথা তখন তিনি বলিয়াছিলেন যাহা এমন কৌতূহল ও সুযুক্তিপূর্ণ ভাষায় আর কাহারও নিকট শুনি নাই। ইতিপূর্বে কংগ্রেস কনফারেন্স ইত্যাদি প্রায় ২০-২৫  বৎসর যাবৎ সরকার বাহাদুরের নিকট দেশের কল্যাণ কামনায় আবেদন-নিবেদন ইত্যাদি করিয়া কোনও আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় উক্ত পন্থা যে প্রকৃত পন্থা নহে ইহাই প্রতীয়মান করাইবার জন্য বিপিনবাবু বলিলেন, আমরা কেবল চাহি ক্রন্দনের রোলে সুকোমল-কম্বল-লালিত ইংরাজের সুখ-নিদ্রার ব্যাঘাত জন্মাইয়া আমাদিগের উদ্দেশ্য সফল করিয়া লইব ইত্যাদি।  যদিও তখন বলিতে গেলে এই প্রথম বক্তৃতা শুনিতে যাওয়া, ইহার পূর্বে কী রাজনীতি, কী ধর্মনীতি কোন বিষয়েই বক্তৃতা শুনিবার বড় একটা স্পৃহা জন্মে নাই এবং শুনিলেও বুঝিবার ক্ষমতা হয় নাই, তথাপি ঐ কথাগুলি যেন কেমন কানে বাজিল।’
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দামান সেলুলার জেলে প্রতিনিয়ত কী নিষ্ঠুর অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত করা হতো— বা উল্লাসকরের শরীর ও মন যে পাশবিক নিষ্পেষণে থেঁতো করে দেওয়া হয়,তার জীবন্ত দলিল ‘কারাজীবনী’ বইখানি।
কিন্তু এই আত্মকথায় নেই— আন্দামান-মুক্ত বিপ্লবী গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য ঘিয়ের দোকান করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তারপর ফিরে গেছেন জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার কালীকচ্ছ গ্রামে। সপ্তাহে একদিন সরাইল থানায় হাজিরা দিতে হয় উল্লাসকরকে। বন্দিদশার দুঃসহ যন্ত্রণাটা তখন জেগে ওঠে মনে। নিজের হাতে বানানো ছিপ নৌকো নিয়ে ভেসে বেড়ান তিতাস নদীর বক্ষমাঝে। দোতারা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে আপন মনে ঘুরে বেড়াতেন কালীকচ্ছের মেঠোপথে। বিপ্লবী উল্লাসকর নিরন্তর খুঁজে ফিরতেন পালুর কবি হৃদয়। জীবনের সকালবেলা বাজাতেন বাঁশি, গাইতেন রবিগান। কারামুক্ত পালু শেষের নিঃসঙ্গ দিনগুলোয় ফের গুনগুন করে গাইতেন ‘সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায় ব্যথার ভৈরবী— আন বাঁশি তোর, আয় কবি।’
(চলবে)

28th     August,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ