বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

পর্ব- ৭
তেজস্বিনী সরলা
পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়

কলকাতার ময়দানে তখনও সাড়া-জাগানো আবির্ভাব ঘটেনি মোহন বাগানের। পরাধীন দেশে মেডিক্যাল কলেজের ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে খেলা হতো হিন্দু কলেজের ছেলেদের। অনেক সময়েই সেই খেলা পরিণত হতো মারামারিতে, আর মারদাঙ্গার পরিসমাপ্তি রক্তারক্তি, খুনোখুনিতে। প্রতিবার ফিরিঙ্গিদের কাছে শোচনীয় মার খেয়ে ফিরত হিন্দু কলেজের পড়ুয়ারা।
একদিন তরুণী সরলা ঘোষাল তাঁর ক্লাবের ছেলেদের কাছে শুনলেন— আগের দিন খেলার মাঠে হিন্দু কলেজের ছেলেরা জিতেছিল। আম্পায়ারের সঠিক ও নিরপেক্ষ নির্ধারণ সত্ত্বেও খেলার পরিণাম মেনে নিতে পারেনি ফিরিঙ্গি নরপুঙ্গবরা। পরাজয়ের হতাশায় আক্রোশে ‘দল বেঁধে একপাল উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো’ তাড়া করে বাঙালি ছেলেদের। তারা পালিয়ে প্রাণে বাঁচে। হিন্দু কলেজের একটি ছেলেও রুখে দাঁড়ায়নি, এগিয়ে যায়নি সম্মুখসমরে।
ঘটনার বর্ণনাকারীদের সরলা দেবী জিজ্ঞেস করেন— ‘তোমরা ক’জন ছিলে? কী করলে?’
তারা বললে— ‘আমরা দশ-বারোজন ছিলুম। আমরা কী করতে পারি? আমরাও সরে পড়লুম।’
সরলা ঘোষাল ১৮৯০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাশ করে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে প্রবেশ করেন রাজনীতির অঙ্গনে। তাঁর মামা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে গিয়ে মারাঠিদের শক্তিচর্চা দেখে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। সঙ্কল্প করেন— তা বাংলাদেশে প্রবর্তনের। প্রতাপাদিত্য উৎসব, বীরাষ্টমী ব্রত প্রভৃতি সূচনার মাধ্যমে বাংলার যুবকদের শরীরচর্চা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের অন্তরালে সরলা অবতীর্ণ হন স্বদেশি আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় ভূমিকায়।
মেডিক্যাল কলেজের ফিরিঙ্গি ছেলেদের কাছ থেকে পালিয়ে-আসা হিন্দু কলেজের ছেলেদের সরলা ধিক্কার জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বৃথা তোমাদের অস্ত্রবিদ্যা শেখা, বৃথা তোমাদের এখানে লাঠি ঘোরানো। কাল থেকে আর এসো না।’
পরে ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখেন— শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ যুদ্ধে আহত ও সংজ্ঞাশূন্য হলে তাঁর সারথি যখন তাঁকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলাতক হয়, তিনি সংজ্ঞালাভ করে জানতে পেরে তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেন— ‘এ কী করলে? আমার নাম চিরকালের জন্য বীরসমাজ থেকে মুছে দিলে? যদুকুল বৃদ্ধেরা কী বলবেন? আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছি শুনে আমার পিতা-পিতৃব্যেরা কী মনে করবেন? যদুকুলললনারা কি আমায় কাপুরুষ কুলকলঙ্ক বলে ঘৃণা করবেন না? ফিরাও  ফিরাও রথ— আমায় যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে চল, ফেরো সারথি।’
শক্তিচর্চা ও অস্ত্রবিদ্যা-অনুরক্ত বাঙালি ছেলেদের সরলা দেবী বললেন— ‘তোমরা সেই ভারতের সন্তান, যাদের ধমনীতে আজও তোমাদের পূর্বগত ভারতবালক অনিরুদ্ধের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।  সে রক্ত কলঙ্কিত করো না, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিও না। যদি উদারভাবে বল, ক্ষমা করে এসেছ তাদের, তবে জেনো অক্ষমের ধর্ম নয় ক্ষমা। আগে ক্ষমা করবার অধিকারী হও, প্রবল হও, বলবত্তর হও, তবে তোমার চেয়ে যে হীনবল, তার প্রতি দয়া করো, তাকে ক্ষমা করো— তার আগে ক্ষমা করা ভীরুতার কাপুরুষতার নামান্তর।’
দু-তিন মাস পরে চোরাবাগানের বসু পরিবারের তরুণ শৈলেন বসু উপস্থিত কয়েকজন সতীর্থকে সঙ্গে নিয়ে। সরলা দেবীকে প্রণাম করে শৈলেন বললেন— ‘মা চললুম— ছ’মাস পরে আবার আসব।’
 ‘কোথায় যাচ্ছো?’
তাঁরা বললেন, ‘কাল আবার মাঠে খেলা আছে। এবার আর ফিরিঙ্গিদের প্রহার-ভয়ে আমরা পলাতক হব না— উত্তম-মধ্যম না দিয়ে ছাড়ব না। তার দরুণ যদি জেলে যেতে হয় যাব— আইনেতে ছ’মাসের বেশি সে ধারায় সাজা নেই— তাই বলছি ছ’মাস  পরে আপনার শ্রীচরণে আবার আসব।’
তাঁরা গেলেন, পরের দিন ফিরে এলেন বিজয়ী বীরের বেশে মাথা উঁচু করে— ফিরিঙ্গিরাই এবার  রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাবার পথ খুঁজে পায়নি। জেলে যেতে হয়নি তাঁদের কাউকেই।
সরলা দেবী বলতেন, ‘বড় হয়ে দেখলুম বাঙলার ললাটে প্রধান কলঙ্ক হচ্ছে কাপুরুষতা— সেইটিই মুছতে হবে। হাতে অস্ত্র ধরলেই ভীরুতা যায় না। কিন্তু অস্ত্রচালনার বিদ্যা জানা থাকলে ভরসা থাকে আততায়ীর শরীরে ঠিক কোন জায়গাটি বাঁচিয়ে কোন জায়গায় মারলে সে মরবে না, শুধু ঘা খেয়ে হতবল হবে। হয়তো তাতে মারপিটের দায়ে ধরা পড়তে হতে পারে, কিন্তু খুনের দায়ে নয়। এই ভরসাই সাহস দেয় অস্ত্রবিদকে অস্ত্র চালাতে। কুকুরেরও দাঁত আছে, বেড়ালেরও নখ আছে, আক্রমণ করলে একটি পোকামাকড়ও কামড়ায়— শুধু বাঙালিই কি সাত চড়েও রা কাড়বে না? এত মনুষ্যত্বের অভাব তার চিরকাল? এত হীনতা?
আর একটা জিনিস দেখলুম। হাতের ও মনের দুইয়ের একসঙ্গে ক্রিয়া চাই। লাঠি চালাতে শিখলেও মনের muscles-এর অকর্মণ্যতা অনেক দিন ধরে পুরুষানুক্রমে বাঙালির চলে এসেছে, সেটাকে সরিয়ে ঠেলে ফেলে মনকে কর্মপ্রমুখ করে কাজে ঝাঁপ দেওয়ার অভ্যেস না করলে মনের হুকুম বিনা দরকারের সময় লাঠিবিদের হাত উঠবে না।’
অরবিন্দ জানতেন, ব্রাহ্মসমাজের অন্যদের চেয়ে বিদুষী ও তেজস্বিনী সরলার মাঝে পৃথক এক স্বকীয়তাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ধরা দিয়েছিল বিবেকানন্দের চোখে।
সরলার সঙ্গে পরিচয়ের পর নিবেদিতাকে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘সরলার education perfect, এই রকম education ভারতের সব মেয়েদের হওয়া দরকার।’
সে সময় স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রাটক্লিফ সাহেব। কলকাতার লাউডন স্ট্রিটে এক ইউরোপীয় মহিলার বাসস্থানে রাটক্লিফের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ভগিনী নিবেদিতার। তারপর যত দিন গিয়েছে— রাটক্লিফ ক্রমশ হয়ে ওঠেন পরাধীন ভারতবর্ষের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন।
বিভিন্ন ডিনারে, ইভনিং পার্টিতে মাঝেমধ্যে দেখা হতো সরলা দেবীর সঙ্গে তাঁর। সরলার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড অজানা ছিল না তাঁর। কখনও কখনও সে সম্বন্ধে তাঁরা আলোচনা করতেন খোলাখুলি।
প্রায় একদশক পরে মোহন বাগান যে বছর শাসক গোরাদের  প্রথম পরাস্ত করে— তখন সরলা দেবী ছিলেন পাঞ্জাবে আর ‌রাটক্লিফ ফিরে গিয়েছেন ইংল্যান্ডে ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’-এর সম্পাদকরূপে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের অভূতপূর্ব জয়ের খবরটা ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে’ দিয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে লেখেন— ‘আমরা জানি এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত যিনি হবেন তিনি হচ্ছেন— সরলা দেবী— বাংলার এক নন্দিনী।’
অরবিন্দ বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টার ঊষালগ্নে —বরোদার সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরিচয়পত্রসহ কলকাতায় সরলা দেবীর কাছে পাঠানোর বছর চারেক পূর্বে তাঁর পরিচয় বিবেকানন্দের সঙ্গে।
স্বামীজির সান্নিধ্যে সরলার জীবননদী বইতে শুরু করে যে নতুন ধারায় সে সম্বন্ধে স্বয়ং বলেছেন, ‘...তারপরে এলেন এক dynamic personality— স্বামী বিবেকানন্দ। ‘Dynamic সেই— যার ভিতর বারুদের ধর্ম আছে, প্রচণ্ড তেজ, প্রচণ্ড ভাঙাগড়ার শক্তি। সেই বারুদের আগুন থেকে একটা স্ফুলিঙ্গ আমার ভিতর এসে পড়েছিল— আমায় ভেঙে  গড়ে তুলেছিল।’
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের পুত্রী সরলা ঘোষালের মাত্র ২৪ বছর বয়সে ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনায় নিযুক্ত থাকার সময় বিবেকানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ। তাঁর কথায়, ‘আমার হাতের ভারতী শুধু সুকুমার সাহিত্যের রঙ্গভূমি ছিল না, বাহন হয়েছিল জাতীয়তার...। আমার জাতীয়তা যখন জাতিকে আত্মমর্যাদার কণ্টকঘন সর্বাবস্থায় পথের কাঁটা তুলে তুলে চালাতে ব্যস্ত তখন স্বামী বিবেকানন্দের অভ্যুদয় হল।’
সেই সময় দেশের বহু মানুষের উপর  স্বামীজির বিচিত্র প্রভাব সম্বন্ধে সরলা দেবী লিখছেন— ‘অনেকে অনেক কিছু মনে করত স্বামী বিবেকানন্দকে। জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে জাতীয়তার পতাকাধারী বলে দেখত, কর্মবাদীরা তাঁকে কর্মের প্রচণ্ড উত্তেজক বলে জানত। তাঁর শিষ্যেরাই কেউ কেউ বলতেন— পরমহংসদেবের আমলে বেশ ছিলুম। ভগবানের ধ্যানে ভোঁ হয়ে থাকতুম, কোন বালাই ছিল না। স্বামীজির কি হল আমেরিকা থেকে ফিরে এসে খালি বলেন— কাজ, কাজ, কাজ— সেবা, সেবা, সেবা। একদণ্ড স্থির হয়ে বসার যো নেই, মহাবিপদেই পড়া গেছে।’
বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে অরবিন্দের সঙ্গে  যোগাযোগের বিষয়ে সরলা দেবী লিখেছেন, ‘বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষের চিঠি নিয়ে আমার কাছে এলেন যতীন বাঁড়ুয্যে। অরবিন্দের দাদা অক্সফোর্ড খ্যাত কবি মনোমোহন ঘোষ আমার খুব বন্ধু হয়েছিলেন। তাঁর অতি সুন্দর কবিত্ব রসপূর্ণ চিঠিতে আমার ডেক্স ভরে গিয়েছিল। দুই ভাই-ই প্রকৃতিগত ‘visionary’ ছিলেন। একজনের vision বা স্বপ্ন কাব্যেই পর্যবসিত ছিল, আর একজনের vision  কার্যে অনুদিত হল। যতীন বাঁড়ু঩য্যে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার জন্যে বরোদা সৈন্যে ভর্তি হওয়া একজন সামান্য সৈনিক। আমি তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে লাগলুম। সেও আমার খুব অনুগত হল। বারীন ঘোষের নেতৃত্বে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কলকাতার এক পাড়ায় ভারত-উদ্ধার দল স্থাপিত হল। যতীন বাঁড়ুয্যে তার একজন প্রধান কর্মকর্তা— সেখানেই খায়-দায়, থাকে, আর যারা দলে আসে তাদের কসরত ও ড্রিল করায় এবং ঘোড়ায় চড়া শেখায়।’ 
প্রশ্ন দেখা দেয়, সরলা দেবীর সঙ্গে অরবিন্দের প্রথম পরিচয় কখন? এ ব্যাপারে দু’জনেই কখনও কিছু সুস্পষ্টভাবে বলেননি। এ বিষয়ে গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী খানিকটা আলোকপাত করেন—‘সরলা দেবী, তাঁহার মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বোম্বাই প্রদেশে শোলাপুরে জজ ছিলেন (সম্ভবত ১৮৯২ খৃঃ), তখন তিনি তাঁহার ঐ মাতুলের কাছে গিয়াছিলেন এবং মারাঠার নূতন জাতীয় আন্দোলনের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন। পরে তিনি মাইসোর গিয়াছিলেন এবং কলিকাতা ফিরিয়া ১৮৯৭ খৃঃ জাতীয়তাবোধকল্পে লাঠিখেলা প্রভৃতি শক্তি-উপাসনা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। পরে আবার একবার তিনি তাঁহার মাতুল সত্যেন ঠাকুরের সহিত বরোদারাজ্যে গমন করেন। সেখানে অরবিন্দের সহিত তাঁহার পরিচয় হয়। সরলা দেবী তাঁহার এক বন্ধুর নিকট অরবিন্দের উপর গ্রীক প্রভাব লক্ষ্য করিয়া প্রশংসা করেন।...
সরলা দেবী ও যতীন ব্যানার্জ্জী কিছুদিন একসঙ্গে কাজ করিলেন এবং ১৯০৪ খৃস্টাব্দে যতীন ব্যানার্জ্জী বারীন্দ্রকুমারের সহিত ঝগড়া করিয়া রাজনীতি ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইলেন। সেই ঘটনার পূর্ব পর্য্যন্ত সরলা দেবীর সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সংস্রব ছিল।’
১৯০২ সালে অরবিন্দ-প্রেরিত যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কলকাতার সার্কুলার রোডে (রাজাবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে) শরীরচর্চার আখড়ার অন্তরালে তৈরি হয় গুপ্ত সমিতি। সেখান থেকে শুরু বিপ্লববাদের পথ অনুসরণ করে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের বিবিধ কর্মযজ্ঞ। গঠিত হয় পাঁচজন সদস্যের একটি গোপন কার্যনির্বাহক কমিটি। ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র ছিলেন এর সভাপতি, সহকারী সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাশ ও অরবিন্দ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন কোষাধ্যক্ষ। পাঁচ সদস্যের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা।
কিছুদিন পরে এই সমিতিতে যোগ দেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, দেবব্রত বসু, বিবেকানন্দ-সহোদর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতো অগ্নিপথের যাত্রী।
বিপ্লবী দলের কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন ছিল ইতালির কার্বোনারি ও রাশিয়ার গুপ্ত সমিতিগুলির প্রভাব, আবার  অন্যদিকে ছিল গীতার সংগ্রাম-দর্শনের সুমহান প্রেরণা। শরীরচর্চার সঙ্গে ছিল নিয়মিত রাজনৈতিক পাঠ ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন— ‘সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পি. মিত্র, সখারাম গণেশ দেউস্কর প্রধানত বক্তৃতা দিতেন। বই পড়িয়া সব বুঝাইয়া দেওয়া হইত।’
অবিনাশচন্দ্রের লেখা থেকে আরও জানা যায়, সমিতির কাজকর্মের জন্য যে অর্থভাণ্ডার খোলা হয় তাতে চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রমথনাথ মিত্র প্রমুখ চাঁদা দিতেন। প্রথম থেকেই মোটা টাকা দিতেন অরবিন্দ।
বাংলার বৈপ্লবিক কর্মপ্রচেষ্টার প্রারম্ভ থেকে পরবর্তী কয়েক বছর অরবিন্দই ছিলেন এই নব আন্দোলনের প্রধান মন্ত্রণা গুরু। সেই সময়কার গোপন পুলিস রিপোর্টে লেখা হয়— ‘... that he (Arabinda) was the head and front of the whole movement need not be doubted.’ (I.B. records, West Bengal, F.N. 1022 P)
সেই বিপ্লবী দলের প্রতিজ্ঞাপত্র ছিল সংস্কৃত ভাষায়। সমিতির সভ্য হতো হলে প্রত্যেককে স্বাক্ষর করতে হতো প্রতিজ্ঞাপত্রে। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার নামে শপথ নিতেন বিপ্লবীরা। কলকাতায় গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি সূচনার অল্পকালের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতে থাকে অমন অনেক গুপ্ত সমিতি।
এমন সময় লোকমান্য তিলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে অরবিন্দের। আমেদাবাদ কংগ্রেস অধিবেশনে দেশের রাজনৈতিক অচলায়তন বিষয়ে বিস্তৃত কথা হয় দু’জনের। তিলক অরবিন্দকে সম্মেলনের প্যান্ডেলের বাইরে নিয়ে এসে আলোচনা করেন সুদীর্ঘ সময়। তাঁর কাছে রাজনৈতিক সংস্কারপন্থী আন্দোলনের প্রতি সুস্পষ্ট তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেন তিলক। এভাবেই সূত্রপাত ভারতের সমকালীন রাজনীতির দুই নক্ষত্র পুরুষের নিবিড় বন্ধুত্বের।
যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বদেশি দলের সঙ্গে একসময় মতভেদ দেখা দেয় সরলা দেবীর— তা নিরসনে তিনি কলকাতা থেকে সুদূর পুনেতে গিয়ে লোকমান্য তিলকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
‘জীবনের ঝরাপাতা’য় সরলা দেবী লিখেছেন— ‘...আমার মতভেদ হল যখন শুনলুম, তাদের দল থেকে ডাকাতি চালানোর হুকুম বেরিয়েছে। এ বিষয়ে নাকি নিবেদিতার সঙ্গে তাদের দলের সম্পূর্ণ ঐকমত্য ছিল। নিবেদিতা বলতেন বটে, ব্রিটিশ-শাসনে দেশ থেকে চোর-ডাকাতের ভয় লুপ্ত হয়ে দেশব্যাপী শান্তি বিস্তারটাই হল এ দেশের পৌরুষ ধ্বংসের কারণ; কতকটা অশান্তি না থাকলে পৌরুষ জাগ্রত হয় না, সেইজন্যে ডাকাত থাকার দরকার। ওখানে যা কিছু পরামর্শাদি হত, যতীন বাঁড়ুয্যে আমাকে জানাত।’
তিনি একদিন সরলা দেবীকে বলেন— ‘কাল ভোররাত্রে একদল লোক ডায়মন্ড হারবারের কাছে একটা বুড়ির বাড়ি গিয়ে তাকে মেরে মাটির নিচে পোঁতা তার অগাধ ধন নিয়ে আসবে। বুড়ির কেউ নেই।’
শুনে সরলা দেবী বললেন— ‘অতি চমৎকার কথা! এক অসহায় বুড়িকে মেরে তার ধন নেবে তোমরা! বাহবা! কত পৌরুষ! —এ রক্তকলুষিত ধন নিয়ে করবে কী তোমরা?’
 ‘দেশের কাজ করব।’
 ‘দেশমাতা কি তোমাদের এই মলিন হাতের কাজ গ্রহণ করবেন? তাঁর একটি নিঃসহায় নিরপরাধিনী বৃদ্ধা সন্তানের হনন তাঁর সইবে?’ ‘নিশ্চয়ই! তিলক মহারাজের এই আদেশ।’
সরলা দেবী বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারিনে— যতক্ষণ না তাঁর নিজের মুখে শুনি। আমি যাব তাঁর কাছে, তাঁকে জিজ্ঞেস করব। যতদিন না আমি ফিরি, ততদিন পর্যন্ত এ হত্যা তোমরা স্থগিত রাখবে— আমাকে কথা দাও।’
 ‘আচ্ছা তাই হবে।’
(চলবে)

15th     May,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ