বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

বিজয় দিবস
পর্ব ২১

সমৃদ্ধ দত্ত : ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১। সকাল সাড়ে ১০টা। দিল্লি। মিলিটারি অপারেশন ডিরেক্টরেট। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ হঠাৎ গটগট করে হেঁটে আসছেন লম্বা করিডর ধরে। ঢুকে পড়লেন কমিউনিকেশন সেকশনে। সেখানে বসে আছেন জিএসও টু বিজয় ওবেরয়। স্বয়ং সেনাপ্রধান তাঁর সেকশনে? কী ব্যাপার? বিজয় উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ইয়েস স্যার।’ 
জেনারেল মানেকশ বললেন, ‘কলকাতায় লাইনটা দাও।’ এই কমিউনিকেশন সেন্টার থেকে সেনার ইস্টার্ন কমান্ডের কলকাতা দপ্তরে সরাসরি হটলাইন আছে। জেনারেল মানেকশ চাইছেন হটলাইনে কথা বলতে। সাধারণ ফোনে কথা বললে শত্রুপক্ষ ইন্টারসেপ্ট করে ফেলতে পারে। তাই হটলাইন।  বিজয়ের হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে নিচু হয়ে  স্যাম মানেকশ বললেন, ‘পুট দ্য লাইন টু চিফ অব স্টাফ, জেনারেল জেকব। স্যাম বলছি।’ কলকাতার প্রান্তে থাকা কমিউনিকেশন অফিসার ছিটকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। খোদ সেনাপ্রধান লাইনে! তিনি দ্রুত লাইন দিলেন জেনারেল জেকবকে। তিনিই এই একাত্তরে ইস্টার্ন পাকিস্তানের অভিযানের প্রধান চালিকাশক্তি।  স্যাম মানেকশকে জেকব বললেন, ‘গুড মর্নিং! জেকব হিয়ার স্যার! এনি অর্ডার?’
স্যাম মানেকশ বললেন, ‘সারেন্ডার করার জন্য পাকিস্তানকে আলটিমেটাম দিয়েছিলাম তার কোনও রেসপন্স এসেছে?’ 
জেনারেল জেকব বললেন, ‘নো স্যার! কোনও উত্তর পাইনি এখনও।’
স্যাম মানেকশ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বললেন, ‘আমরা আবদুল্লার হেডকোয়ার্টার্সের সামনে কয়েকটি রাউন্ড চালাব নাকি? আবদুল্লা মনে হয় সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না!’
জেনারেল জেকব হেসে ফেললেন। বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার। সেটা করা যায়।’ 
স্যাম বললেন, ‘তাহলে তাই করো। ঢাকায় যেখানে পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সে আবদুল্লা বসে আছে, তার যতটা কাছে সম্ভব কিছু বোমা মারো, কিছু গুলি চালাও। ১০ মিনিট পর পর অ্যাটাক করবে। কাউকে টার্গেট করতে হবে না।  ভয় দেখাও শুধু। তাহলেই ওরা  সারেন্ডার করবে। আপাতত ওরা অনাথ হয়ে আছে। কারণ, ওদের গডফাদাররা করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোরে গর্তে ঢুকে বসে আছে। কাওয়ার্ডস! এই ঢাকা আর পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে থাকা নিজেদের ফোর্স কিংবা কমান্ডারদের নিয়ে ওদের আর মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু ভাবছি ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে আবার কিছু না করে বসে। কোথায় রেখেছে কে জানে? এনি ওয়ে। তুমি আগে কাজটা করো। তারপর দেখছি।’
জেকব বললেন, ‘স্যার, শুনছি আমেরিকার সেভেনথ ফ্লিট মালাক্কায় চলে এসেছে? ওদিকে ইউনাইটেড নেশনেও তো যে কোনও সময় রেজ্যুলিউশন করে সিজফায়ার হয়ে যাবে।’
একটা শ্বাস ফেলে স্যাম মানেকশ বললেন, ‘সেই কারণেই তো আমাদের আর টাইম নেই। ম্যাক্সিমাম ৪৮ ঘণ্টা। তার মধ্যেই ঢাকা ক্যাপচার করে ফেলতে হবে।’ 
ততক্ষণে মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লের, ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং ঢাকার বাইরে অপেক্ষা করছেন। যে কোনও সময় গ্রিন সিগন্যাল দিল্লি থেকে এলেই তাঁরা ঢুকে পড়বেন। 
ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের টেলিফোন অপারেটরকে মরিয়া হয়ে একজন কেউ ফোন করছেন। তিনি বললেন, ‘প্লিজ রাষ্ট্রসংঘের রিফিউজি ডিপার্টমেন্টের হেড মিস্টার জন কেলিকে একবার ফোনটা ট্রান্সফার করুন। আমাদের সাহেব কথা বলবেন।’ 
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের টেলিফোন অপারেটর জানতে চাইলেন, কে আপনাদের সাহেব? কী বলব? 
ওই প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ‘জনাব এ এম মালিক। গভর্নর সাহেব।’ অপারেটর চমকে উঠলেন। ইস্ট পাকিস্তানের গভর্নর এ এম মালিক! যিনি পাকিস্তানের পাঠানো প্রশাসক, তিনি এভাবে অনুনয় বিনয় করে ফোন চাইছেন! যিনি এতদিন ধরে বিরাট দাপট দেখাতেন! তাহলে কি পাকিস্তান পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে? ইন্ডিয়া কি ঢুকে পড়েছে নাকি ঢাকায়? নাহলে এত সুর নরম? আর এরকম ভয়ে কাঁপছে কেন সব? তিনি ফোনটা ট্রান্সফার করলেন রাষ্ট্রসংঘের রিফিউজি অফিসারকে। গভর্নর এ এম মালিক রাষ্ট্রসঙ্ঘের অফিসারদের বললেন, ‘আপনারা একবার গভর্নর হাউসে আসুন। আমরা কিছু সাজেশন চাই আপনাদের কাছে।’ 
এই সমস্ত কথাবার্তা কলকাতায় বসে গোপনে ইন্টারসেপ্ট করে শুনে নিচ্ছেন কর্নেল পি সি ভাল্লা। ইস্টার্ন কমান্ড কলকাতার সিগন্যাল ইনটেলিজেন্স ইনচার্জ। তিনি তৎক্ষণাৎ জেনারেল জেকবকে বললেন, ‘স্যার ঢাকার গভর্নর হাউসে একটা মিটিং হবে।’ ‘কোথায় হবে মিটিং?’ মেজর জেনারেল জেকব জানতে চাইছেন। পি সি ভাল্লা বললেন, ‘কনফারেন্স রুমে।’
জেনারেল জেকবের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এয়ার ভাইস মার্শাল দেবেশরকে। তিনি হলেন শিলংয়ে থাকা ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের দায়িত্বে। জানা গেল দুপুর ১২টায় মিটিং। যেখানে পাকিস্তানের অফিসার, রাষ্ট্রসংঘ, আমেরিকান এমব্যাসির প্রতিনিধিরা থাকবেন। প্ল্যান করা হল, ঢাকায় এই মিটিং হওয়ার এক ঘণ্টা আগে ওই কনফারেন্স রুমের আশপাশে বম্বিং করা হবে। যাতে মিটিংয়ের আগেই এই এয়ার অ্যাটাক দেখে ভয় পেয়ে যান ইস্ট পাকিস্তানের  গভর্নর। রাষ্ট্রসংঘ ও আমেরিকাও টের পায় যে, ভারত ঢাকায় ঢুকে পড়েছে। ওদেরও একটু শিক্ষা দিতে হবে।
 যুদ্ধকালীন তৎপরতা একেই বলে। মিনিট বাই মিনিট এখন জরুরি। হাতে সময় নেই। লোকেশন ব্রিফ করতে হবে ফাইটার জেটের পা‌ইলটদের। তাঁরা তো সঠিক জায়গাটা জানে না। গুয়াহাটি থেকে ২০ মিনিটের ফ্লাইট। চার্জে গ্রুপ ক্যাপ্টেন উলেন। তিনি ঝড়ের গতিতে বাছাই করলেন অপারেশন টিমকে। ক্যান্টিনে চা খাচ্ছিলেন উইং কমান্ডার বিষ্ণয়, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট চন্দ্রশেখর। তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে কয়েক মিনিটে উলেন বললেন, ‘যাও ঢাকায় সার্কিট হাউসে কয়েকটা বম্বিং করে এসো। কোনও ক্যাজুয়ালটি চাই না। মৃত্যু যেন না হয়। ওপেন স্পেসে লঞ্চ করবে।’ এই দুজনের সঙ্গে থাকবেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জি বালা এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হেমু সরদেশাই। 
চারটি মিগ টোয়েন্টি ওয়ান আকাশে উড়ে গেল। দেড়শো মাইল দূরের হাসিমারা এয়ারফোর্স স্ট্রিপ থেকেও একই মিশনে টেক অফ করল আরও দু’টি মিগ। ছোড়া হবে টি টেন রকেট। ঢাকায় গভর্নর হাউসে তখন মিটিং শুরু হয়েছে। গভর্নর এ এম মালিক, জন কেলি কথা বলছেন। হঠাৎ মাথার উপরে আকাশে গোঁ গোঁ শব্দ। চমকে সকলে উঠে দাঁড়ালেন। একের পর এক রকেট ছুটে আসছে। বম্বিং হচ্ছে গোটা প্রাঙ্গণে। আগুন ধরে গেল গভর্নর হাউসে। অন্যদিকে সার্কিট হাউসেও চলছে বম্বিং। এসব কী হচ্ছে? সারেন্ডার করার টাইম দিয়ে ইন্ডিয়া এসব কী করছে? দিশাহারা গভর্নর এম মালিক। তাঁকে জন কেলি ধাক্কা মেরে বললেন, চলুন পালাই। সকলেই পিছনের দিকে বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু বেরলেই মৃত্যু। তার থেকে বাঙ্কারে যাওয়া ভালো। তাই হল। ১২৮টা রকেট ছুঁড়ে অল ক্লিয়ার করে চলে গেল ভারতীয় এয়ার ফোর্স বাহিনী। ততক্ষণে যা আতঙ্ক ছড়ানোর হয়ে গিয়েছে। থরথর করে কাঁপছে সকলে। এটা হল ইন্ডিয়ার দিক থেকে একটা থ্রেট। যদি পাকিস্তান এখনই সারেন্ডার না করে, তাহলে চারদিক থেকে আর্মি ঢুকবে। আকাশে আসবে এয়ারফোর্স। বাঁচার পথ নেই। 
রাজভবন থেকে প্রায় প্রাণ হাতে করে ইস্টার্ন কমান্ড দপ্তরে চলে এলেন গভর্নর। এসেই দেখলেন মেজর জেনারেল আবদুল্লা নিয়াজি দাঁড়িয়ে আছেন ব্যালকনিতে। তিনি গভর্নরকে দেখে বললেন, ‘জানি অ্যাটাক করেছে ইন্ডিয়া। চলেও গিয়েছে। কিন্তু আমাদের আর কোনও চমক দেওয়ার দরকার নেই। খেলা শেষ।’ 
‘মানে?’ জানতে চাইলেন গভর্নর মালিক। 
নিয়াজি বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট মেসেজ দিয়েছেন। অবশেষে।’ নিয়াজি জানালেন সেই মেসেজ। ইয়াহিয়া খানের সব দাপট খতম। আমেরিকা বঙ্গোপসাগর থেকে পিছু হটেছে। কারণ যেই আমেরিকা নিজেদের পরমাণু অস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে বঙ্গোপসাগরের দিকে, সেটা জেনেই তৎক্ষণাৎ সাবমেরিন সহ এক যুদ্ধজাহাজ বাহিনীর টাস্ক ফোর্স পাঠানোর হুমকি দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমেরিকা এগলেই সোভিয়েত চার্জ করবে। আমেরিকা অযথা পাকিস্তানের সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে নতুন যুদ্ধে জড়াতে রাজি নয়। তারা আসলে ইন্ডিয়াকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু আর কোনও কাজ হবে না। ইয়াহিয়া খান তাই মেসেজ পাঠিয়েছেন ঢাকায়। লিখেছেন। তোমরা বীরের মতো যুদ্ধ করেছ। কিন্তু আর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যে সম্ভব নয় সেটা স্পষ্ট। নিজেদের এবং আমাদের ফোর্সের প্রাণ বাঁচাতে তোমরা লড়াই বন্ধ করার ব্যবস্থা করো। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এবারও দায়িত্ব এড়িয়ে গেলেন। সারেন্ডারের নামোচ্চারণ করলেন না। শুধু অনেক দূরের রাওয়ালপিন্ডিতে বসে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন নিয়াজি ও মালিকের হাতে। তাঁরা দিশাহারা হয়ে ভাবছেন কী করা যায়? একমাত্র ভরসা আমেরিকা। এই আমেরিকার মদতেই তো এত ঢাকঢোল পিটিয়ে যুদ্ধে নামা। আর আজ এভাবে পরাজয়। 
ঢাকায় আমেরিকার এমব্যাসিতে হাজির হলেন মেজর জেনারেল নিয়াজি। কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাককে বললেন, আপনারা একটা সম্মানজনক শর্ত কিংবা যুদ্ধবিরতি চুক্তির ব্যবস্থা করুন। সরাসরি যাতে আমাদের আত্মসমর্পণ করতে না হয়। আত্মসমর্পণ কথাটা আমরা এড়াতে চাইছি। কিছু একটা করুন। কিন্তু আমেরিকা আর কোনও দায় নেবে না। হার্বার্ট স্পষ্ট জানালেন, দেখুন, আমাদের পক্ষে নেগোশিয়েট করা সম্ভব নয়। আপনারা একটা মেসেজ লিখুন। আমি খুব বেশি হলে ইন্ডিয়ার কাছে সেটা পৌঁছে দেব। 
স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন নিয়াজি। তারপর একটা সাদা কাগজে লিখলেন শর্তাবলী। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশকে উদ্দেশ্য করে। সেই চিঠি ঢাকার আমেরিকার দূতাবাস পাঠিয়ে দিল দিল্লির আমেরিকান দূতাবাসে। সেখান থেকে পরদিন দুপুর আড়াইটের সময় স্যাম মানেকশর কাছে। 
১৫ ডিসেম্বর। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ভাষণে জেনারেল স্যাম মানেকশ পাকিস্তানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাদের চিঠি পেয়েছি। কিন্তু যুদ্ধবিরতি আবার কী? আমরা সোজাসুজি আপনাদের সারেন্ডার করতে বলছি। আর সেজন্য সময় দিচ্ছি। আজ বিকেল ৫টা থেকে আগামী কাল অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত আমরা কোনও মিলিটারি অপারেশন করব না। কীভাবে সারেন্ডার করবেন জানান। 
....
মীরপুর ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা কর্নেল কে এস পান্নু নির্ভয় শর্মার কাছে একটা চিরকুট দিলেন। বললেন, মেজর জেনারেল নাগরা দিলেন। মেসেজটা নিয়ে যেতে হবে পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড কর্তা অবদুল্লা নিয়াজির কাছে। মেসেজে লেখা আছে, ‘মাই ডিয়ার আবদুল্লা, আই অ্যাম হিয়ার। দ্য গেম ইজ আপ। আ‌ই সাজেস্ট ইউ, গিভ ইয়োরসেল্ফ আপ টু মি অ্যান্ড আই উইল টেক কেয়ার অফ ইউ।’  মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরার সঙ্গে আবদুল্লা নিয়াজির পরিচিতি অনেকদিনের। তাই তাঁরা পরস্পরকে এভাবেই নাম ধরে সম্বোধন করেন।  
সকাল ১০টা ৪২। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারা টু রেজিমেন্ট প্রথম প্রবেশ করল ঢাকা শহরে। ১৩ দিনের রুদ্ধশ্বাস এক যুদ্ধের পর অবশেষে এই সমাপ্তি পর্বটিও বেশ নাটকীয়। নির্ভয় শর্মার জিপেই আছেন মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরা, কর্নেল পান্নু। হঠাৎ পিছনে আর একটা জিপের শব্দ। সকলে চমকে তাকালেন।  লাফ দিয়ে সেই জিপ থেকে নামলেন যিনি, তিনি এক রূপকথার নায়ক। কাদের সিদ্দিকি। জেনারেল নাগরা হেসে বললেন, ‘আপনিও চলুন।’ পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের অফিসের গেটে প্রহরায় থাকা কয়েকজন গার্ড এই ভারতীয় বাহিনীকে আটকে কিছু বলতে গেল। তাদের  ধাক্কা মেরে ঢুকে এল ভারতীয় বাহিনীর অফিসাররা। দেখা গেল, মেজর জেনারেল আবদুল্লা নিয়াজি মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে। মেজর জেনারেল নাগরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হ্যালো আবদুল্লা, হাউ আর ইউ?’ 
বিরস মুখে করমর্দন করে নিয়াজি বিড়বিড় করে বললেন, ‘ইয়ে পিন্ডিমে ব্যয়ঠে হারামজাদাও নে মারওয়া দিয়া।’ নাগরা হেসে উঠলেন! খেল খতম আবদুল্লা!
১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। ঠিক ৯টা বাজার কিছুক্ষণ আগে ভারতের কাছে পাকিস্তান থেকে মেসেজ এল। তারা আরও সময় চাইছে যুদ্ধবিরতির।  ভারতীয় কোনও অফিসারকে যেন পাঠানো হয় ঢাকায়। আলোচনার জন্য।  জেনারেল স্যাম মানেকশ তৎক্ষণাৎ কলকাতায় ফোন করলেন। জেনারেল জেকবকে বললেন, হ্যালো, জেকস, প্রসিড টু ঢাকা! জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে সারেন্ডার টার্মস ফাইনালাইজ করো। আজই কিন্তু সারেন্ডার। কোনও দেরি নয়। জেনারেল জেকব, অ্যাডভান্স এয়ার হেডকোয়ার্টার্সের এয়ার কমান্ডার পুরুষোত্তম এবং ইনটেলিজেন্স কর্পসের কর্নেল এম এস খেরাকে সঙ্গে নিলেন। আর্মির চেতক হেলিকপ্টারে উড়ল ঢাকার দিকে। 
জেনারেল জেকব সোজা গেলেন পাকিস্তান আর্মি অফিসে। নিয়াজি, রাও ফরমান আলি, এ এম মালিক বসে। কিন্তু শেষ মুহূর্তেও নিয়াজি যেন মরিয়া চেষ্টা করছেন সম্মান বাঁচাতে। জেনারেল জেকব যখন তাঁকে সারেন্ডারের নথিপত্র দিলেন, নিয়াজি বললেন, এটা কিন্তু যুদ্ধবিরতি হবে। সারেন্ডারে আমরা স্বাক্ষর করব না। জেনারেল জেকব এক মুহূর্তে জ্বলে উঠলেন। কঠোর কণ্ঠে বললেন, লুক জেনারেল, তিনদিন ধরে আমরা আপনাদের বলে চলেছি যে, সারেন্ডার একমাত্র পথ। কোনও যুদ্ধবিরতি নয়। এখনও জেদ ধরে থাকলে এরপর যা হবে তার দায় আপনার। মুক্তিবাহিনী ঢাকায় ঢুকে পড়েছে। আমাদের ফোর্স শহরের বাইরে। সুতরাং....। ৩ মিনিট সময় দিলাম। ভাবুন। বলে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলেন জেকব।
মেজর জেনারেল ফরমান আলি নিয়াজিকে বললেন, ‘কুছ পাল্লে হ্যায়?’ অর্থাৎ কিছু রিজার্ভ ফোর্স কিংবা লড়াইয়ের রসদ আছে? মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে তাকালেন নিয়াজি। জেনারেল জামশেদ মাথা নেড়ে বললেন, কিছুই নেই। ফরমান আলি বললেন, তাহলে ইন্ডিয়া যা বলছে তাই করুন। 
৩০ মিনিট পর জেনারেল জেকব ঢুকলেন। জানতে চাইলেন, কী ঠিক করলেন? জেনারেল নিয়াজি চুপ। জেকব বললেন, তাহলে আমি ধরে নিলাম সারেন্ডার  করছেন। জেনারেল, রেস কোর্সে সাধারণ মানুষের সামনে আপনারা সারেন্ডার করবেন। চারটে নাগাদ। ইজ দ্যাট ওকে? নিয়াজি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। 
বিকেল সাড়ে ৪টে। ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ইন সি জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা এসে পৌঁছলেন ঢাকা এয়ারপোর্টে। জেকব আর নিয়াজি গেলেন তাঁকে রিসিভ করতে। রেস কোর্স ময়দান। সাড়ে ৪টে।  জনসমুদ্র। জয় বাংলা...জয় ইন্ডিয়া...জয় মুজিব...জয় ইন্দিরা ধ্বনিতে চারদিকে উৎসব। অসংখ্য মানুষ কাঁদছেন আনন্দে। উড়ছে ফুল। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে আসার পর জেনারেল আরোরার পক্ষে জিপে ঢোকা সম্ভব হল না। তাঁকে কাঁধে তুলে নিল কিছু মানুষ। মঞ্চে স্বাক্ষর পর্ব হওয়ার পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের প্রোটোকল অনুযায়ী নিজের রিভলবার জেনারেল নিয়াজি তুলে দিলেন জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার হাতে। ভারতের হাতে পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয়ের সাক্ষী রইল ঢাকার সেই মুহূর্তটি। 
শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কিছুতেই যেন হার স্বীকার করবেন না। তিনি জানেন, এবার তাঁকে গদি ছাড়তে হবে পরাজয়ের পর। অতএব যাওয়ার আগে শেষ আঘাত করবেন। পাকিস্তানে জেলবন্দি শেখ মুজিবকে বেঁচে ফিরতে দেওয়া যাবে না। তড়িঘড়ি দেশদ্রোহের তকমা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সই করলেন। ভোরে ঠিক হয়েছিল ফাঁসি হবে মুজিবুর রহমানের। কিন্তু রাত সাড়ে ৩টের সময় মুজিবকে গোপনে জেল থেকে কোনও এক অজানা জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হল। সেখানে তাঁকে রাখা হয়েছে ২ দিন ধরে। ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত জানেন না মুজিব কোথায়। কী ঘটল সেখানে? সে এক অন্য কাহিনি! ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে অবশেষে ফিরলেন স্বাধীন এক মাটিতে। মাটির নাম বাংলাদেশ!                  (শেষ)

20th     February,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ