বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

বাবার সঙ্গে দেখা

রাহুল দাশগুপ্ত : বাবার সঙ্গে এখন আর দেখা হয় না সুবিমলের। চাকরি পাওয়ার পর থেকেই সুবিমল খুব ব্যস্ত। সারাদিনই তাকে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। খুব ভোরে সে বেরিয়ে যায়। ফেরে অনেক রাতে। ছুটির দিনগুলোয় সারাক্ষণ কানে ফোন নিয়ে বসে থাকে। সবসময় তার মাথার মধ্যে চেপে বসে থাকে অফিসের কাজ। নানারকম চাপ ও উদ্বেগ। দুশ্চিন্তা এখন তার নিত্য সঙ্গী। 
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখন সে মাঝেমধ্যেই বলে, নাঃ, আর পারছি না। চাকরিটা এবার ছেড়েই দেব। 
কিন্তু তারপরই তার সারা শরীর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে থাকে। তার মনে হয়, চাকরি ছেড়ে দিলে সে কী করবে? অলস হয়ে সারাদিন ঘরে বসে থাকবে? নাকি ফাঁকা পকেটে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঢু ঢু করবে? তখন আর সমাজে বা পরিবারে মানসম্মান বলে তার কিছু থাকবে? সবাই তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না? 
সুবিমল তাই মুখ বুজে সমস্ত সহ্য করে। সারা মাস ধরে সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। কারণ সে জানে, মাসের শেষে ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে। ব্যাঙ্কে তার অ্যাকাউন্টে তখন মোটা টাকা ঢুকবে। 
কিন্তু একদিন অফিস থেকে খুব অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল সুবিমল। তখন তার খুব জ্বর। তার সঙ্গে গলায় আর পেটে ব্যথা। শুকনো কাশি। শ্বাসকষ্ট। ঘরে ঢুকেই নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। 
সুবিমলের মা নেই। বাবা রিটায়ার করেছেন। তিনি ছুটে এলেন। জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি? 
সুবিমল কোনওরকমে বলল, শরীর খুব খারাপ লাগছে...
সুবিমলের বাবা সেদিন অনেকক্ষণ ছেলের পাশে বসে রইলেন। তাঁর পরিচিত একজন ডাক্তারকে ফোন করলেন। তাঁর পরামর্শমতো ওষুধ নিয়ে এলেন। খালি বোতলগুলোয় জল ভরে দিলেন। সময় অনুযায়ী সেই ওষুধ ছেলেকে খাইয়ে দিলেন। প্রেশার মাপলেন। ছেলে ঘুমিয়ে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ছেলের কপালে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন।  
সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সুবিমলের। সে উঠে বসল। আর তখনই তার মনে হল, আজ অনেকদিন পর বাবার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছে সে। সামান্য একটু শ্বাসকষ্ট তার তখনও ছিল। এই কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্বাসকষ্টটা যেন কমে গেল। 
এরপর প্রায় দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। ডাক্তার প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন, কোভিড। দু’বার টেস্ট হল সুবিমলের। ফল দু’বারই নেগেটিভ। ইতিমধ্যে আরও বেশ কিছু টেস্ট হয়েছে। বাবা-ই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছেন। তিনি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও খুব সতর্ক। ফলে সুবিমলের কোনও অসুবিধা হয়নি। 
দু’সপ্তাহ ধরে সুবিমল বাড়িতেই আছে। কিন্তু সে একটু নিজের মতো থাকতেই ভালোবাসে। হয় হাতে বই নিয়ে বসে থাকে। নয়তো কোনও সিনেমা চালিয়ে দেয়। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারে, শরীর এখনও তেমন জুতের নয়। তাই একটু পরেই আর কিছু ভালো লাগে না। সে ঝিমোতে থাকে। মাঝে মাঝে ফোন আসে। কিন্তু একটু কথা বলার পরই খুব ক্লান্ত লাগে। ফোন রেখে চাদরের তলায় ঢুকে যায় সুবিমল। সবসময়ই এখন তার কেমন একটা শীত শীত ভাব। চাদরটাকে ভালো করে সারা গায়ে জড়িয়ে আবার সে ঝিমোতে থাকে। 
বাবা দরকারের সময় আসেন। কিন্তু তারপর আবার নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাড়ির সব কাজ তিনিই করেন। এখনও তিনি যথেষ্ট কর্মক্ষম। নিয়মিত ব্যায়াম করেন। নিজের হাতে বাগান করেন। মাটি কোপান। গাছের গোড়ায় জল দেন। ফুলগুলোর পরিচর্যা করেন। ব্যাঙ্কে যান। পোস্ট অফিসে যান। বাজার করেন। দেওয়াল ঘড়িতে দম দেন। রাঁধুনি না এলে রান্না করেন। কাজের লোক না এলে কাপড় কাচেন, বাসন মাজেন। ফলে সুবিমলের সঙ্গে ওর বাবার তেমন একটা দেখাসাক্ষাৎ হয় না। 
কিন্তু এবার একজন বড় ডাক্তার না দেখালেই নয়। বাবা-ই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেন। ওদের একটা গাড়ি আছে। সেন্টার থেকে ড্রাইভার নিয়ে একদিন ওরা সেই গাড়িতে চেপে বসল। অনেকদিন পর বাবার পাশে বসল সুবিমল। দু’জনেই চুপচাপ বসে আছে। একটু পরে সেন্টারের ড্রাইভার গান চালিয়ে দিল। 
কিছু দূর যাওয়ার পরই সুবিমলের হঠাৎ সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হল। বাবা জানতে চাইলেন, কী হয়েছে তোর? ইনহেলার দেব? 
সুবিমল মাথা নাড়ে। বাবা ইনহেলার বের করে দেন। ওষুধটা নিয়ে চোখ বুজে দেন সুবিমল। একটু পরেই শ্বাস–প্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। 
আবার সব চুপচাপ। বাবা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। সুবিমল চোখ বুজে আছে। কথা বলতে এখন আর ইচ্ছা করছে না তার। তাছাড়া কী কথাই বা বলবে? বাবার সঙ্গে এখন আর তার কোনও কথা নেই। দু’জনের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গিয়েছে। তাদের কথাও আলাদা হয়ে গিয়েছে। বিনিময়ের রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে কবে যেন। সুবিমল কিছু টেরই পায়নি। বাবা একটু একটু করে তার থেকে আজ অনেক দূরে সরে গিয়েছেন। 
নিজের মনের ভিতর হাতড়াতে থাকে সুবিমল। কী কথা বলা যায় বাবার সঙ্গে? এতদিন পর দু’জনে পাশাপাশি বসে আছে। কিছু তো বলতেই হয়। কিন্তু যত হাতড়ায়, বুকের ভেতরটা ততই যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে টের পায়, কোনও কথাই নেই। হ্যাঁ, বাবাকে বলার মতো কোনও কথাই নেই তার কাছে। 
ঠিক সেই সময় ড্রাইভার বলে ওঠে, তেল নিতে হবে, স্যার...
সুবিমল চোখ খোলে। কিন্তু সে মানি ব্যাগ বের করার আগেই বাবা বলে ওঠেন, তুই ঘুমো। আমি দেখছি...
তেল নিয়ে গাড়ি আবার চলতে থাকে। সুবিমল আবার কথা খোঁজে। শব্দ খোঁজে। তার মনে পড়ে, কতদিন বাবার সঙ্গে তার গল্পগুজব হয় না। মামুলি, দরকারি দু-চারটে কথা ছাড়া আর কিছুই হয় না। বাবাকে সে ঠেলতে ঠেলতে নিজের জীবন থেকেই বের করে দিয়েছে। বাবা এখন তার জীবনে একজন আউটসাইডার। যেন একজন অপরিচিত মানুষ তার পাশে বসে আছেন। এই মানুষটাকে সে ভালো করে চেনেই না। কীভাবে এই মানুষটা দিন কাটান,  সেটা তার অজানা। 
দু’জন অপরিচিত মানুষ যেন পাশাপাশি বসে থাকে। ওরা যখন হাসপাতালে পৌঁছয়, তখনও ডাক্তার আসেননি। ওরা অপেক্ষা করতে থাকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তার আসেন। এখনও অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। ওদের নাম রয়েছে আট নম্বরে...
সুবিমল বলে, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসছি...
বাবা বলেন, আয়। 
—আমাকে ফোন করো।
—করব।
—এখানে বসে থাকতে তোমার কষ্ট হবে না? 
—না। একজনকে তো অপেক্ষা করতেই হবে। তুই ঘুরে আয়।
বাবা আবার আশ্বাস দিলেন। 
সুবিমল বাইরে এল। হাসপাতালের পাশেই একটা পার্ক। তার মধ্যে একটা পুকুর আছে। পুকুরটার চারদিকে পামগাছের সারি। একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল সুবিমল। তার মনে হল,  তার শরীর আবার একটু একটু করে গরম হয়ে উঠছে। জ্বর আসছে বোধহয়। 
একটু পরেই ওর চোখ বুজে এল। আর তখনই ওর মনে পড়ল, বছর পনেরো আগে বাবার সঙ্গে সে মর্নিং ওয়াক করতে যেত। নদীর ধার দিয়ে সরু একটা রাস্তা। ওরা দু’জনে গল্প করতে করতে তিন-চার কিলোমিটার হাঁটত। আর সেই সময় ওর কথা যেন ফুরোতেই চাইত না। মনে হতো, বাবার কাছে নিজেকে উজাড় করে দিই। কোনও কথাই যেন বাদ না থাকে। জীবনের সব কথাই তখন তার বাবাকে বলতে ইচ্ছা করত। সামান্য কোনও কথা বাদ গেলেও পরে আপশোস হতো। সে জানত, তার বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। ওই সামান্য কথাটা বলার জন্য তাকে হয়তো আবার পরদিন সকাল পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে। 
কবে যে একটু একটু করে সে নিজের কথা নিজের কাছেই রাখতে শুরু করেছিল, তা এখন আর সুবিমলের মনে নেই। তার বাবা তার কাছে অচেনা হয়ে যেতে শুরু করেছিল। আর সে-ও তার নিজের জীবন নিয়ে সরে যেতে শুরু করেছিল বাবার কাছ থেকে। নিজের কথা নিজের কাছেই রাখতে শুরু করেছিল। নিজের কথা বাবার কাছ থেকে লুকোতে শুরু করেছিল। এই নিয়ে বাবার কোনও গোপন অভিমান ছিল কি না,  তা সে কখনও জানতে চায়নি।
সুবিমলের শরীর আবার একটু একটু করে গরম হয়ে উঠছে। কিন্তু এখান থেকে যেতেও ইচ্ছা করছে না। প্রাইভেট হাসপাতালের ওই ঘরটায় এই মহামারীর সময়ও খুব ভিড়। ঘরটার চারধারে ডাক্তারদের ছোট ছোট চেম্বার। ওইখানে সে বাবাকে বসিয়ে এসেছে। বাবার বয়স হয়েছে। গত মাসে সত্তরে পা দিলেন। তাঁর চারদিকে নানা ধরনের রোগী। তাদের মধ্যে বাবা মোটেই নিরাপদ নন। তবু ঝুঁকি নিয়েও তিনি সেখানে বসে আছেন। নিজে বাইরে বেরিয়ে তিনি ছেলেকে ওখানে বসতে বলতে পারতেন। কিন্তু তাতে ছেলের কষ্ট বাড়ত। ছেলে যাতে আরাম পায়, তাই তিনি ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর নিজে ওই হরেক রকমের রোগীদের মধ্যে বসে আছেন। তাঁর মুখে মাস্ক। ওইভাবে মাস্ক পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন বৃদ্ধ মানুষের বসে থাকতে যে কত কষ্ট হয়, তা কী আর জানে না সুবিমল! 
কেন তুমি এভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছ বাবা? সুবিমল মনে মনে বলে। তোমার যদি কিছু হয়ে যায়? তোমারও তো রোগ-ব্যাধি কিছু কম নেই! আমি তোমার কে হই? তুমিই বা আমার কে হও? আমরা কেউ কাউকে চিনি না। একদিন তুমিই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলে। আর এখন? তুমি আমার জীবনে একজন আউটসাইডার। আর তোমার জীবনে আমিও তাই...
সুবিমল উঠে দাঁড়ায়। এত দুর্বল হয়ে পড়েছে সে! বাবাকে সঙ্গে করে আনা তার উচিত হয়নি। কিন্তু না এনেও যে উপায় ছিল না! তার সঙ্গে আসার মতো আর কেউ যে নেই! আর একা আসার মতো অবস্থাও তার নেই। বাবা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সুবিমল কিছু না বললেও, তিনি নিজের থেকেই তাই এসেছেন। সুবিমলের মৃদু আপত্তিকে গ্রাহ্যই করেননি। সুবিমলও ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পেয়েছিল। তার জীবনে এই তো একমাত্র মানুষ, যার ওপর সে আশৈশব ভরসা করে এসেছে!   
সুবিমল উঠে দাঁড়াল। বাবা এখনও ফোন করেননি। তার মানে, এখনও সময় হয়নি। প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গিয়েছে। বাবা তার প্রয়োজনে তার কথা ভেবেই তার সঙ্গে এসেছেন। কিন্তু বাবাকে একা ফেলে সে চলে এসেছে। এটা ঠিক হয়নি। বাবার হয়তো একা লাগছে। ওই বদ্ধ ঘরে গিজগিজে রোগীদের মধ্যে বসে থাকতে হয়তো কষ্ট হচ্ছে। তবু তার কষ্টের কথা ভেবে মুখ বুজে আছেন। এটা ঠিক নয়। এবার সে বসবে। বাবা না হয় বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসুন। ওকে দেখেই বাবা জানতে চাইলেন, কেমন লাগছে? 
—আবার জ্বর আসছে।
—আয়, আমার পাশে বোস।
—আর কত দেরি আছে? 
—হয়ে এসেছে। আমি তোকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
একটু পরে ডাক্তার দেখলেন। তারপর বললেন, আমি একবার এক্স রে রিপোর্টটা দেখতে চাই। এক্ষুনি করিয়ে নিয়ে আসুন। 
বাবা-ই দৌড়ে গিয়ে টাকা জমা দিলেন। এক্স রে–র ওখানে গিয়ে সুবিমলের পাশে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পাশাপাশি দু’জনে চুপ করে বসে রইল। যেন দু’জন অপরিচিত মানুষ। সুবিমল যখন এক্স রে করতে ঢুকল, বাবা তখন উদগ্রীব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওরা বাবাকে ঢুকতে দেয়নি। সুবিমল বাবার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, কিছু বলবে? 
বাবা মাথা নাড়লেন। না, তাকে বাবার কিছুই বলার নেই। ওদের মধ্যে সব কথা ফুরিয়ে গিয়েছে। 
ডাক্তার এক্স রে রিপোর্ট দেখে অন্য একজন ডাক্তারের উল্লেখ করে বললেন, ওঁকে একবার দেখিয়ে নিন। আমার বন্ধু। এটা ঠিক আমার বিষয় নয়।
বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন, চিন্তার কোনও কারণ নেই তো? 
—না, না, তেমন কিছু নয়।
—আজই দেখাব? 
—হ্যাঁ। দেরি করবেন না।
—উনি কোথায় বসেন? 
ডাক্তার অন্য একটা হাসপাতালের নাম করলেন। ওরা সেখানে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল। চার ঘণ্টা এখনও দেরি আছে। 
সুবিমল বলল, তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও। 
না, না, বাবা প্রায় ফিসফিস করে বললেন। 
—অনেক রাত হবে। তোমার রেস্ট হবে না। খাওয়া হবে না ঠিকঠাক। খুব কষ্ট হবে। 
আমি ঠিক আছি, বাবা সংক্ষেপে বললেন। ওরা দু’জন সেই পার্কটায় গিয়ে বসল। পাশাপাশি বসে আছে দু’জনে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। একটু পরে দু’জনেই কাঁধের ঝোলা থেকে দুটো বই বের করে পড়তে শুরু করল। তিন ঘণ্টা কখন যে কেটে গেল টেরই পেল না। 
যে হাসপাতালে ওরা যাবে, সেটা শহরের অন্য প্রান্তে। ওরা ঠিক সময়ই পৌঁছল। তারপরও অপেক্ষা করতে হল ঘণ্টা দুয়েক। আস্তে আস্তে ওদের চারপাশের ভিড় হালকা হয়ে এল। বাবা মাথা নিচু করে বসেছিলেন। সুবিমল ফাঁকা করিডোরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল। 
ও বাবার কাছাকাছি আসতেই বাবা মুখ তুলে তাকাচ্ছিলেন। যেন আশা করছিলেন, সুবিমল কিছু বলবে। সুবিমলও সত্যিই কিছু বলতে চাইছিল। মরিয়া হয়ে হাতড়াচ্ছিল বলার মতো কিছু শব্দ। কিন্তু কিছুই না বলে সে আবার ঘুরে যাচ্ছিল। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল করিডোরের অন্য প্রান্তে। তার পা দুটো ভারী হয়ে উঠছিল। যেন কেউ পাথর বেঁধে দিয়েছে দুটো পায়ের সঙ্গে। কেন বাবাকে বলার মতো কোনও কথাই সে খুঁজে পাচ্ছে না? বাবাকে বলার মতো সত্যিই কি তার কিছু নেই? 
ওরাই ছিল শেষ পেশেন্ট। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে গভীর তৃপ্তি নিয়ে বললেন, এক মাসের আগে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না। নেহাত আপনারা আমার বন্ধুর রেফারেন্স দিলেন, তাই দেখে দিলাম।
ওরা যখন বেরিয়ে এল, বাইরে তখন বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফিরতে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। 
গাড়িতে উঠে বাবা বললেন, এখন কেমন লাগছে? 
—ভালো। তুমি ঠিক আছ তো? যা গেল সারাটা দিন...
বাবা কম কথার মানুষ। তিনি বললেন, ফেরার সময় ওষুধটা নিতে হবে। আজ রাত থেকেই শুরু করে দিতে হবে। 
একটা পরিচিত ওষুধের দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে বাবা নেমে গেলেন। 
সুবিমল চোখ বুজে রইল। কতদিন পর বাবার সঙ্গে দেখা হল তার? কতদিন পর? ছোটবেলায় তার পায়ে ব্যথা হলে বাবা সারা রাত জেগে পা টিপে দিতেন। তার হাঁপানি ধরা পড়ার পর তাকে নিয়ে কত ডাক্তারের কাছে ছুটে ছুটে গিয়েছেন। সে যখন অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল, তখন দু’বেলা কে তাকে দেখতে যেত? অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে সে–ই বা কাকে খুঁজেছিল? 
তার বাবা তার জীবন থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন। তার সেই বাবা, যিনি ছিলেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন! তার জীবনের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা! 
আজ বহুদিন পর সেই হারিয়ে যাওয়া বাবার সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। সুবিমল চোখ খুলল। ওষুধের দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখল, অত রাতেও সেখানে ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, তারই ওষুধের জন্য, সেই ছেলেবেলার মতোই...
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল

6th     February,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ