বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

বৃ দ্ধা শ্র ম
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

কিছুটা হাঁটার পরই আজকাল থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন মনোময়। হাঁটু কেঁপে ওঠে। না দাঁড়ালে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আগামী বৈশাখে সাতষট্টিতে পা দেবেন মনোময়। এ বয়সে এসব সমস্যা সবারই কম-বেশি একটু থাকে। শীতের বিকাল। চারটে বাজে। রোদ বেশ নরম। যদিও মনোময় বৈকালিক ভ্রমণে বেরননি, একটা কাজেই বেরিয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরেই চলে এসেছেন। হাঁটার পথে বেশ কয়েকবার থেমেছেন তিনি, আবারও থামলেন। আর তখনই তাঁর চোখে পড়ল রাস্তার গায়েই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কম্পাউন্ডের গেটটা। তার মাথার ওপর সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা— ‘আনন্দ বৃদ্ধাশ্রম’। তার নীচে কিছুটা ছোট হরফে লেখা— ‘এখানে আনন্দময় পরিবেশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।’
মনোময়দের মতো মফস্‌সল শহরগুলোতেও এমন নানা বৃদ্ধাবাস গড়ে উঠেছে। যাকে বলে বৃদ্ধাশ্রম। শেষ বয়সে যেখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অর্থের বিনিময়ে বাকি জীবনটুকু অতিবাহিত করেন। তবে, ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটা সম্পর্কে একটা বড় অংশের মানুষ এই ধারণা পোষণ করেন যে, যাঁদের নিকটাত্মীয়রা তাঁদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অক্ষম হন, বলা ভালো দায়িত্ব নিতে চান না, তাঁদেরই ঠাঁই মেলে বৃদ্ধাশ্রমে। সে বড় একাকিত্বময় দুঃসহ কষ্টের জীবন। ব্যাপারটা আংশিক সত্যি নিশ্চয়ই। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে মনোময়ের ধারণা অধিকাংশ মানুষের মতোই।
আনন্দ বৃদ্ধাশ্রম! এ নাম যেন তিনি সম্প্রতি কোথাও শুনেছেন! আর এরপরই তাঁর মনে পড়ল, কয়েকদিন আগেই কথা প্রসঙ্গে প্রণব বলেছিল, ‘বুঝলি দিনকাল কী পড়েছে! নতুন বাজারের ওখানে আনন্দ বৃদ্ধাশ্রম নামে একটা বৃদ্ধাবাস খুলেছে। আমাদের নিতাই অর্থাৎ নিত্যানন্দের নাকি শেষপর্যন্ত সেখানেই ঠাঁই হয়েছে! অথচ ওর বউ মারা যাবার পর একা হাতে ছেলেটাকে কীভাবে মানুষ করেছিল তুই বল! তার শেষে এই পরিণতি?’
মনোময়ের একদা সহপাঠী, যৌবনের সহচর, মধ্যবয়সে তাঁর কুশল খবর নেওয়া নিত্যানন্দ বর্তমানে বাস করেন এই বৃদ্ধাশ্রমেই। মাস ছয়েক ধরে এটাই তাঁর ঠিকানা। ছিমছাম পরিবেশের আশ্রমের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তিনি মানিয়ে নিয়েছেন। বিকালের দিকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। বৃদ্ধাবাসের সামনের দিকে একটা ছোট মাঠ আছে। সেখানে বসে অথবা হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করেন তাঁরা। চারটে থেকে পাঁচটা এই একঘণ্টার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের গেটও খুলে দেওয়া হয়। কেউ কেউ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের জনজীবনও প্রত্যক্ষ  করেন। গেট খোলা হবে দেখে এদিনও নিত্যানন্দ বিকালবেলায় গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। সাইনবোর্ড দেখে নিত্যানন্দ সম্পর্কে শোনা কথাগুলো যখন মনোময়ের মনে পড়ল, ঠিক তখনই লোহার বড় গেটটা সরে গেল। মনোময় দেখলেন উন্মুক্ত গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন নিত্যানন্দ। দৃষ্টি বিনিময় হল দুই বন্ধুর মধ্যে।
(দুই)
তাঁরা দু’জনেই বেশ একটু অবাকই হলেন পরস্পরকে দেখে। নিত্যানন্দ দু-পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘আরে তুই! কতদিন পর দেখলাম তোকে! এদিকে কোথায়? এখানেই এসেছিস নাকি?’
মনোময় জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, অনেকদিন পর দেখা। প্রণব বলেছিল তুই এখানে আছিস।’
মনোময়ের কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা ব্যাপার ছিল যা দেখে নিত্যানন্দর মনে হল, যেন মনোময় তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন। নিত্যানন্দ তাই বললেন, ‘কী যে ভালো লাগছে তুই এখানে এসেছিস! আয় আয়, ভিতরে আয়।’ 
কাজে বেরিয়েছেন মনোময়। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারটা চাক্ষুষ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে নিত্যানন্দের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি পা রাখলেন আশ্রমের ভিতর। সামনে একটা ছোট মাঠ, আর সেটাকে ঘিরে তিনদিকে সার সার ঘর। শেষ বিকালের মায়াবী আলো এসে পড়েছে মাঠের ভিতরে। সেখানে রয়েছেন বেশ কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা প্রৌঢ় মানুষ।  মনোময় দেখার চেষ্টা করতে থাকলেন ঠিক কতখানি বিষণ্ণতা বা একাকিত্ব জেগে আছে তাদের মুখে? কিন্তু পড়ন্ত বিকালের আলোতে তাঁদের অনেকেরই মুখমণ্ডলে যেন প্রশান্তি জেগে আছে।
 নিত্যানন্দ বললেন, ‘চ, আমার ঘরে চ, তাহলে একটু চা অন্তত তোকে খাওয়াতে পারব।’
নিত্যানন্দ কেমনভাবে থাকেন তা দেখার জন্য মনোময় এগলেন তাঁর পিছনে। 
মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে ছোট একটা বারান্দায় উঠে সার সার ঘরের একটায় মনোময় প্রবেশ করলেন নিত্যানন্দর সঙ্গে। মাঝারি আকৃতির ঘর। আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই। অতি সাধারণ সিঙ্গেল বেড, আয়না লাগানো মাঝারি আকৃতির আলমারি। একটা চেয়ার আর ছোট টেবিল। দেওয়ালের তাকের খাঁজে রয়েছে ছোটখাট নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস। হ্যাঁ, একটা টেলিভিশন সেট অবশ্য ঘরের দেওয়ালে লাগানো আছে। তা থাকলেও নিত্যানন্দের বাড়ির সঙ্গে এ ঘরটার কোনও তুলনাই চলে না। আগে একসময় নিত্যানন্দর বাড়ি যাওয়া-আসা ছিল মনোময়ের। কী ছিল না সেই বাড়িতে? বার্মাটিকের ফার্নিচার, সুদৃশ্য পেনসেট থেকে ঝোলা দামি পর্দা, দেওয়ালজোড়া ফ্ল্যাট টিভি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে কার্পেট মোড়ানো মেঝে। আজ নিত্যানন্দের এই অতি সাধারণ ঘরটা দেখে যেন খুশিই হলেন মনোময়। যেন তিনি এমনটাই দেখতে চেয়েছিলেন। আসলে নিত্যানন্দের প্রতি একটা চাপা ঈর্ষা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে তাঁর মনে। এর পিছনে একটা কারণও আছে। স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন তাঁরা দু’জন। পড়াশোনাতে মনোময় অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন নিত্যানন্দের থেকে অথচ জীবনের দৌড়ে নিত্যানন্দ বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর থেকে। কেউ কেউ বলেন এর পিছনে নাকি ছিল নিত্যানন্দের বাস্তব বুদ্ধি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। এই যেমন গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরই একসঙ্গে দু’জনে সরকারি দপ্তরে ক্লার্কের পরীক্ষা দিয়ে চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন। নিত্যানন্দ সুযোগটা পেয়েই চাকরিতে ঢুকে গিয়েছিলেন। কিন্তু মনোময়ের মনে হয়েছিল, নিত্যানন্দের মতো মাঝারি মানের ছেলেও যখন চাকরিটা পেল তখন এই চাকরি মনোময়ের মতো পড়াশোনাতে আরও এগিয়ে থাকা ছেলের জন্য নয়। কেরানি নয়, অফিসারের চাকরি অপেক্ষা করছে মনোময়ের জন্য। কাজেই কেরানির চাকরি না নিয়ে তিনি সরকারি অফিসারের চাকরির পরীক্ষায় বসতে লাগলেন। কিন্তু অফিসারের চাকরি হল না  মনোময়ের। শেষপর্যন্ত সেই কেরানির চাকরিই নিতে হল মনোময়কে। মাঝখান থেকে পাঁচ-ছ’টা বছর নষ্ট হয়েছিল তাঁর। ততদিনে প্রোমোশন পেয়ে এগিয়ে গিয়েছেন নিত্যানন্দ। সরকারি অফিসার হয়ে  অবসর নেন নিত্যানন্দ। আর মনোময় রিটায়ার্ড হন অফিসের  হেডক্লার্ক হয়ে। এমন আরও বেশ কিছু ঘটনা তাঁদের দু’জনের জীবনে আছে। কিন্তু নিত্যানন্দর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে অথবা মনোময়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অপারগতার কারণে শেষপর্যন্ত সেসব ক্ষেত্রেও নিত্যানন্দ এগিয়ে গিয়েছেন। পড়াশোনাতে নিত্যানন্দের থেকে মনোময় এগিয়ে থাকতেন। তাঁর তুলনায় পিছিয়ে থাকা ছেলের জীবনের দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া মনোময় ঠিক মেনে নিতে পারেননি। 
(তিন)
মনোময়কে চেয়ারে বসিয়ে নিত্যানন্দ বললেন, ‘দাঁড়া আগে চা বসিয়ে নিই, তারপর গল্প করা যাবে। আশ্রম থেকে সকাল-সন্ধ্যা চা দেয় বটে। কিন্তু আমার চায়ের নেশা বলে ইলেকট্রিক কেটলি, টি ব্যাগ এসব এনে রেখেছি। 
নিত্যানন্দ চা করলেন। কৌটো থেকে বিস্কুট আর বেশ অনেকটা চানাচুর বের করে প্লেটে ঢেলে চায়ের কাপ আর প্লেট এগিয়ে দিয়ে  বললেন, ‘নে, খেতে খেতে কথা বল।’
 চায়ের কাপ হাতে মনোময়ের মুখোমুখি খাটে বসলেন নিত্যানন্দ। 
প্লেটের দিকে তাকিয়ে মনোময় মনে মনে হাসলেন। আগে নিত্যানন্দের বাড়ি গেলে তিনি আবশ্যিকভাবে অন্তত দুটো বড় রাজভোগ বা তালশাঁস সন্দেশ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতেন। আর এখন সেই তিনিই অতিথি আপ্যায়ন করছেন কি না দুটো মেরি বিস্কুট আর চানাচুর দিয়ে! কোথায় গেল নিত্যানন্দের বৈভব! তবে একথা মনোময়ের মনে হলেও চোখের সামনে প্লেটটা দেখে জমে থাকা খিদেও যেন চাগাড় দিয়ে উঠল তাঁর পেটে।
মনোময়কে নিত্যানন্দ বললেন, ‘এবার বল কেমন আছিস? বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এক খাবলা চানাচুর মুখে দিয়ে মনোময় বললেন, ‘বেশ আছি। সবাই ভালো আছে। তুই কেমন আছিস?’
নিত্যানন্দ বললেন, ‘এমনিতে ভালোই আছি, তবে স্ত্রীর কথা খুব মনে পড়ে। এ বয়সে পত্নীবিয়োগ হলে যা হয়। অন্য কেউ না বুঝলেও ব্যাপারটা তুই বুঝবি। তোরও স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে কি না!’
নিত্যানন্দের কথায় মৃদু বিষণ্ণতা ধরা পড়াতে মনোময়ের মনে হল নিত্যানন্দ ভালো নেই। ব্যাপারটায় যেন মৃদু তৃপ্তিবোধ করলেন তিনি। তিনি জানতে চাইলেন, ‘এখানে খাবারের ব্যবস্থা কীরকম?’
চায়ে চুমুক দিয়ে নিত্যানন্দ বললেন, ‘ভোরে চা-বিস্কুট, টিফিনে রুটি-তরকারি, দুপুরে ভাত-ডাল-তরকারি। সঙ্গে তিনদিন মাছ, একদিন মুরগির মাংস। বিকালে চা-বিস্কুট, সন্ধ্যায় মুড়িমাখা, হালকা টিফিন, রাতে রুটি-সব্জি।’ 
নিত্যানন্দের কথার মধ্যে থেকে মনোময় আসল পয়েন্টটা খুঁজে নিয়ে বললেন, ‘তার মানে তুই তিনদিন নিরামিষ খাস এখানে? রাতে শুধু রুটি-সব্জি! তুই তো মাছ-মাংস ছাড়া ভাত মুখেই তুলতে পারতিস না!’
মনোময়ের কথার জবাবে নিত্যানন্দ হেসে বললেন, ‘তা ঠিক, কিন্তু আর উপায় কী আছে বল? তোর মতো তো বাড়িতে থাকি না যে, যা মন চায় খাব? তবে খাবার একটু কষ্ট হলেও যা খাই, শান্তিতে খাই।’
তাঁর কথা শুনে মুহূর্তের জন্য একটু থমকে গেলেন মনোময়। পরক্ষণেই তাঁর মনে হল, নিত্যানন্দ যে এখানে খুব একটা ভালো নেই তা ধীরে ধীরে তাঁর কথার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে। আর তা বুঝে মনোময় তৃপ্তিবোধ করছেন। এরপর চা শেষ করে চানাচুর খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ অন্য নানা প্রসঙ্গে কথা বলার পর মনোময় আবার ফিরে এলেন আগের আলোচনাতে। এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হচ্ছে বলে নিত্যানন্দের মনে কতটা রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে তা দেখে যেন তৃপ্ত হতে চাইলেন তিনি। 
শীতের ছোট বিকাল। দ্রুত সূর্য ঢলতে শুরু করেছে। মনোময় তাঁকে বললেন, ‘তোর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একলা হাতে তুই তোর ছেলেটাকে কত পরিশ্রম করে মানুষ করলি। সে জন্যই তো আজ এত ভালো চাকরি করে ও। ভালো ঘর দেখে শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়েও দিলি। তারপরও শেষ জীবনে তোকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হল!’
নিত্যানন্দ বললেন, ‘ছেলে প্রোমোশন নিয়ে চেন্নাই চলে গেল। বউমার স্কুল কলকাতাতে। এই মফস্‌সল শহর থেকে যেতে আসতেই চার-পাঁচঘণ্টা  সময় চলে যায়। ওর খুব সমস্যা হচ্ছিল। তাই শেষপর্যন্ত আমি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিলাম। হ্যাঁ, বাড়িতে একলা থাকতে পারতাম আমি। কিন্তু একলা থাকাটা উচিতবোধ করলাম না। রাতবিরেতে যদি কোনও বিপদ ঘটে, তখন কাকে ডাকব? বরং এখানে হাঁক দিলে পাশের ঘরে লোক পাব। সন্ধ্যায় একটু তেল মাখা মুড়ি পাব।’
মনোময় কথাটা শুনে বলে উঠলেন, ‘তুই যাই বল, তোর ছেলে, ছেলের বউ যদি ইচ্ছা করত, তাহলে কিন্তু তোকে দেখতেই পারত। তোর ছেলে তো মোটা মাইনের চাকরি করে। তার ওপর তোর মোটা সরকারি পেনশন। তোর বউমার চাকরির কী দরকার? সে কি চাকরি ছাড়তে পারত না? অথবা বুড়ো বাবাকে একলা রেখে ছেলের কি প্রোমোশন নেওয়ার খুব দরকার ছিল? আমার ছেলে-বউমা তো আমাকে ছেড়ে যায়নি?’—কথাটা বলে মনোময় প্লেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখলেন, কথা বলতে বলতে কখন যে তিনি একপ্লেট চানাচুর শেষ করে ফেলেছেন!
নিত্যানন্দ জবাবে বললেন, ‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু তাদেরও তো জীবন পড়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা সিদ্ধান্তটা আমিই নিয়েছি।’
মনোময় বললেন, ‘তুই যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করিস না কেন, সত্যিকথা বল, তুই কি শেষ জীবনটা এইভাবে বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে চেয়েছিলিস? চাসনি সবাইকে নিয়ে থাকতে? হ্যাঁ অথবা না-তে জবাব দে।’ 
কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ বসে রইলেন নিত্যানন্দ। বাইরে থেকে আসা আবছা আলোতে এবার স্পষ্ট বিষণ্ণতা যেন তার মুখমণ্ডলে ধরা দিল। তারপর তিনি বললেন, ‘না চাইনি, সবাই কি আর তোর মতো ভাগ্যবান হয়? ছেলে-বউমা-নাতি সবাইকে নিয়ে থাকতে পারে?’
নিত্যানন্দর কথা শুনে মনোময়ের জীবনে এই প্রথম মনে হল, নিত্যানন্দ যেন জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মনোময়কেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন। মনোময় জিতে গিয়েছেন। পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠল তাঁর বুক। মনোময় এবার খেয়াল করে দেখলেন প্রায় পাঁচটা বাজতে চলেছে কথায় কথায়। তিনি বললেন, ‘আজ এবার উঠি। সময় পেলে আবার আসব।’ নিত্যানন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে মেন গেট পর্যন্ত মনোময়কে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আবার আসিস, কেমন? তোর জন্য অপেক্ষা করব।’
(চার)
বৃদ্ধাশ্রমের গেট ছেড়ে বেরিয়ে কয়েক পা এগতে না এগতেই মনোময়ের ছোট্ট মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। তাঁর ছেলের ফোন। তিনি ফোনটা রিসিভ করতেই ছেলে বলল, ‘তোমার কী আক্কেল বলো তো বাবা? লন্ড্রি থেকে শাড়িটা আনতে এত সময় লাগে? জানো এখনই বিয়েবাড়িতে রওনা হবার কথা।’
এরপর ছেলের হাত থেকে ফোন চলে গেল বউমার হাতে। সে বলল, ‘আজ দুপুরে ভাত দিইনি তাতেও আপনার শিক্ষা হল না? বাড়ি তালা দিয়ে চলে যাচ্ছি। রাতের খাওয়া বন্ধ। রাত পর্যন্ত যত ইচ্ছা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়ান।’ কথাগুলো বলেই ফোনটা সে কেটে দিল। মনোময় জানেন বউমার কথাগুলো নিছক হুমকি নয়। সে যা বলছে সেটাই করবে। মনোময় যে মানসিক পরিতৃপ্তি নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের বাইরে পা রেখেছিলেন, তা মুহূর্তের মধ্যে মুছে গেল ফোনটা পেয়ে। 
কয়েক মুহূর্ত মোবাইলটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। শীতের রাতে কোথায় ঘুরে বেড়াবেন তিনি? দ্রুত অন্ধকার নামতে চলেছে তাঁর চারপাশে। মনোময়ের মনে হল নিত্যানন্দের সিদ্ধান্ত এবারও যেন তাঁকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। না, আর তিনি তাঁর কাছে হারবেন না। এবার তিনিও জিতবেন। পিছনে তাকিয়ে তিনি দেখলেন আশ্রমের গেটটা ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে। মনোময় মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগলেন সেই গেটের দিকে। গেটটা পুরো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে তাঁকে প্রবেশ করতে হবে তার ভিতর। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় পাওয়া যায় তেলেভাজা মুড়ি আর আশ্রয়...
অলঙ্করণ : সুব্রত মাজী

2nd     January,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ