বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

অপারেশন ৭১: পর্ব ৫
করাচি  প্ল্যান
সমৃদ্ধ দত্ত

পাকিস্তানের বোট যে তাদের লক্ষ্য করেই অগ্রসর হচ্ছে সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। একমাত্র ডুবসাঁতারই ভরসা। কিন্তু কোন দিকে যাওয়া যায়? এতগুলো মানুষ কর্ণফুলী নদীবক্ষে ছড়িয়ে আছে। সকলের পেটে গামছা দিয়ে বাঁধা আছে লিমপেট মাইন। এই বিস্ফোরক দিয়ে জাহাজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য জাহাজের কাছে পৌঁছতেই হবে। একজন যে সর্বাগ্রে পৌঁছে গিয়েছে, তার আভাস একটু আগেই দেখা গেল। কারণ, একটা বার্জ ধ্বংস হয়ে আগুন জ্বলছে। এখনও আসল যুদ্ধজাহাজগুলিকে টার্গেট করা বাকি। কিন্তু যেভাবে এগিয়ে আসছে পাকিস্তানের বোট, কেউ না কেউ ধরা পড়বেই। তবু সকলেই অদৃশ্য হয়ে গেল। জলের নীচে। এতটাই নীচে যাতে মোটরবোটের তলদেশও শরীরে ধাক্কা না খায়। কর্ণফুলীর গভীরে আরও গভীরে এবং তটভূমি থেকে ক্রমেই সরে গেল তারা। 
দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের নৌসেনার গুলিতে না হলেও এবার শ্বাসরুদ্ধ হয়েই মারা পড়তে হবে। আর কতক্ষণ? একসময় মনে হল, বোটের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে পাকিস্তানের রক্ষীবাহিনী।  কাউকে খুঁজে পেল না তারা। এবার জল থেকে মাথা তুলে যোদ্ধারা যেন প্রাণ ফিরে পেল। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তবু তারা অগ্নিপরীক্ষায় সফল। এবার দ্রুত যেতে হবে কাছে। জাহাজের। একে একে নিঃশব্দে কেবল বক্সের কাছে পৌঁছে যাওয়া হল। কোন টিম কোন জাহাজকে টার্গেট করবে সেটা আগেই বলা আছে। সেইমতো নিখুঁত সাঁতার। আর ২০ মিনিটের মধ্যে একটা আশ্চর্য দৃশ্য। 
চট্টগ্রামের বন্দরে যেন আলোর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। দেড় ঘণ্টার মধ্যেই দেখা গেল অন্তত পাঁচটি পাকিস্তানি জাহাজ আর তিনটি বার্জে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে বিস্ফোরণে। চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি নৌসেনা ৩৯ জন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার কাছে বিপর্যস্ত হয়ে গেল। কেউ জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করল। কেউ জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ। ধ্বংস হয়ে গেল এমভি হারমুজ, বার্জ নম্বর ওরিয়েন্ট সিক্স, ফিশ হারবার...। ধ্বংস হয়ে গেল এমভি আল হাব্বাস জাহাজ। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টন গোলাবারুদ নিমেষে উড়িয়ে দিল পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী যুবকরা। পিছনে ভারতের সামরিক বাহিনীর নিখুঁত প্ল্যান আর ট্রেনিং। দিশাহারা পাকিস্তানি নৌসেনা ভাবছে ইন্ডিয়া অ্যাটাক করছে। করাচিতে খবর পাঠাতে হবে। কিন্তু রেডিও অপারেটর মেসেজিং কাজ করছে না। খবর দেওয়ার আগে বাঁচা দরকার। তাই অপারেটর রুম ফাঁকা করে দিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাক নৌবাহিনীর জওয়ানরা। অপারেশন জ্যাকপটের প্রথম অভিযান সফল। চট্টগ্রাম তো হল? অন্য বন্দরগুলিতে অপারেশন যে সফল সেই সংবাদও আসতে শুরু করেছে। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম মোংলা। 
....
টান টান উত্তেজনায় যেন নিশ্বাস পড়ছে না তখন কলকাতার ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার আর দিল্লির সাউথ ব্লকের ওয়ার রুমে। ভারতের নৌপ্রধান অ্যাডমিরাল নন্দা, আর্মির লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (RAW) প্রধান আর এন কাও— সকলেই বিনিদ্র! কারণ, বাকি সব অপারেশন হয়ে গিয়েছে। সফল। কিছু মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছে। দু’জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে অপারেশন সফল! একমাত্র মোংলা বন্দরের কোনও রকম খবর আসছে না কেন? সেখানে কী হচ্ছে? সত্যিই তো! মোংলায় যোদ্ধারা কী করছে? ব্যর্থ হল নাকি তারা? নাকি ধরা পড়ে গিয়েছে?
একটি পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে মোংলা অপারেশনের সেই টিমকে। নদীবন্দর আর ডাংমারি বিলের পিছনে  জমিদার বাড়িটিকেই বেসক্যাম্প করা হয়েছে। এখান থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব নৌকায় অন্তত এক ঘণ্টা। কাছেই পুশুর নদী। এরকম ভয়ঙ্কর নদী আর কি আছে কোথাও? স্থানীয় গ্রামবাসীরা পর্যন্ত ভয়ে কোনও সময় এই নদীতে নামে না। সাপ, কামট, কুমির, হাঙর আর চোরাস্রোত। ভয়ের কোনও সীমা নেই এই পুশুর নদীর অভ্যন্তরে। গ্রাম থেকে মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যায় কিশোর, বালক বালিকা। কারণ, তারা না জেনে বাবা-মায়ের অজান্তে নদীতে নেমে উধাও হয়ে গিয়েছে। পেটে গিয়েছে কুমিরের। মোক্ষম মুহূর্তে রেডিওতে বেজে উঠল অ্যাকশনের সেই গান। ‘আমার পুতুল...।’ 
এখানে পৌঁছল কীভাবে এই টিম? দেখা যাক! টিমের লিডার আমিনুর রহমান খসরু। সঙ্গে আছে ২০ বাক্স হ্যান্ড গ্রেনেড, ৩০০ মিটার কর্টেক্স, ৩০ কেজি বিস্ফোরক, ১৫টি লাইট মেশিনগান, ১৪৫টি স্টেন গান, ১১০টি সেলফ লোডিং রাইফেল। ড্রাই আর টিনড ফুড। ২৭ জুলাই রওনা হয়েছিল তারা ক্যানিং থেকে। রাত ১২টা। সময় বয়ে যাচ্ছে। ক্যানিং বন্দর থেকে আমিনুর রহমান খুসরুর নেতৃত্বের টিম রওনা হয়ে রাত সাড়ে ১০টার পর পৌঁছেছিল ইছামতী নদীতে। এটাই ইন্ডিয়ার শেষ প্রান্ত। এবার পাকিস্তান। মোট ১৫টা বোটের মধ্যে ছড়িয়ে আছে ৬টি টিম। সাতটি বোটে টিম। এদের হাতে লাইট মেশিনগান। ইছামতী ক্রস করার সময় চরম টেনশন। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একটু দূরেই মোটরবোটের শব্দ। নির্ঘাত পাকিস্তানের সেনা! দলনেতা আমিনুর রহমান আগেই বলেছেন, যতক্ষণ সম্ভব আমরা কনফ্রন্টেশনে যাব না। একবার যেই পাকিস্তান টের পাবে কিছু একটা গোপন অভিযানের চক্রান্ত চলছে, তৎক্ষণাৎ তারা নিরাপত্তা কয়েকগুণ করে দেবে। আর সতর্কতা চরম আকার নেবে। মোটরবোট এগিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধাদের যেন শ্বাসরুদ্ধ। কী করা উচিত? আমাদের গুলি করলে আমরা কী করব? তখনও চুপচাপ গুলি খেতে হবে নাকি?
কিন্তু আশ্চর্য! কিছুই ঘটল না। মোটরবোটটি কাদের? বোঝা গেল না। সামনে এল। দূরত্ব রেখে গতি কমাল। তারপর হঠাৎ তীব্র স্পিড নিয়ে চলে গেল অন্যদিকে। পাকিস্তানের এলাকায় এই রহস্যময় মোটরবোট কাদের? যারা সামনে সন্দেহজনক একঝাঁক বোটের আনাগোনা দেখেও নীরবে চলে গেল? চ্যালেঞ্জ করল না কেন? কেউ জানে না যে, এই বোট আসলে ভারতের নেভি ইনটেলিজেন্স টিমের। যেখানে আছে ভারতের স্পাই বাহিনীর কয়েকজন অফিসারও। তাঁরা পাকিস্তানের পতাকা বোটে লাগিয়ে আসলে পাকিস্তানি নেভির ছদ্মবেশে শত্রুপক্ষের জলসীমায় ঢুকে পড়েছে। দেখতে এসেছিল অপারেশন জ্যাকপটের এই টিম সঠিক টার্গেটে এগচ্ছে কি না। দূর থেকে দেখে তারা বুঝে গেল এরা কারা! তাই নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল। অর্থাৎ আসলে তারা গোপন ব্যাক আপ টিম! 
পরদিন সারাদিন নদীবক্ষে। ডানদিকে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে তটভূমিতে সারিবদ্ধ হয়ে বিশ্রাম করছে কুমিরের দল। সুতরাং নামা যাবে না। অবশেষে সন্ধ্যার পর একটা গ্রামের চিহ্ন। এক কমান্ডো চাপা স্বরে বলে উঠল, এটা হল পাটখালি। নদীর পাশে হাট আছে। একবার নামা যেতে পারে। বোটের গাইড আফজল আগে নৌকা লাগাল। আর একসঙ্গে এতগুলো নৌকা দেখে বাজারের একাংশে সাড়া পড়ে গেল। কী ব্যাপার? এরা কারা? আফজল আগেই গিয়ে একটি দোকানির কানে কানে কিছু একটা বললেন। চকিতে যেন ভোলবদল হয়ে গেল। হঠাৎ দিকবিদিক বিদীর্ণ করে শুরু হল চিৎকার, জয় বাংলা...জয় বাংলা...জয় মুক্তি...! যোদ্ধারা প্রাথমিকভাবে হতচকিত! তারপর বোঝা গেল গ্রামবাসী যেন তাদের নায়কদের জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। সেখানে আর এক দফা জানা গেল রুট। আর নেওয়া হল শুকনো খাবার। তারপর আবার নেমে পড়া হল নদীতে। 
১৮ দিনের লম্বা জার্নি শেষে শিবশা নদীতে এসে পড়েছে যোদ্ধারা। মোংলার রুট এখান থেকে শুরু। কোথায় মোংলা? খুলনা থেকে ৪৮ কিলোমিটার। এভাবেই এই টিম এসে পৌঁছল পরিত্যক্ত সেই জমিদার বাড়িতে। এবার চূড়ান্ত অ্যাটাক। ১৩ আগস্ট। রাত ১২টা। বেরিয়ে পড়া হয়েছে। আপাতত একটি নৌকায়। কারণ এটা আসল অপারেশন নয়। এটা হল মহড়া। গাইড আফজল, কমান্ডার আমিনুর রহমান ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড রাজা। তাঁদের কাজ গোপনে দেখতে যাওয়া যে, কোথায় রাখা আছে পাকিস্তানের জাহাজগুলি। আগে দেখে নিয়ে তারপর সেইমতো প্ল্যান করে এগতে হবে। এটা পুশুর নদী। নিঃশব্দে অগ্রসর হচ্ছে সেই নৌকা। 
কিছুটা এগিয়ে এসেই দেখা গেল চীনের একটা জাহাজ ল্যান্ড করা আছে। উল্টোদিকে সোমালিয়ান জাহাজ। জায়গাটার নাম বানিয়া সান্তা। কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লি। নৌকা থেকেই দেখা যাচ্ছে বিদেশি নাবিকের দল ঘোরাঘুরি করছে সেই মহল্লায়। ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তানি সেনারাও। আর সামনেই একটা পাকিস্তানি ট্রেঞ্চ। স্বাভাবিকভাবেই নদীতট থেকে আরও কিছুটা সরে যাওয়া হল, যাতে হঠাৎ করে চোখে না পড়ে যে, একটা নৌকা চলেছে। আরও এগনোর পর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল পাকিস্তানের জাহাজ। একটা নয়। অন্তত চারটি। আর অদূরে ভাসমান বার্জ। জমিদার বাড়ি থেকে মোংলার এই বন্দরের কাছে আসতে সময় লেগেছে ১ ঘণ্টা। সুতরাং প্ল্যান সেভাবেই করতে হবে। ফিরে এল এই টিম। এবার সিগন্যাল গানের অপেক্ষা। হ্যাঁ, অবশেষে ১৪ আগস্ট সকালে এবং রাতে দু’বার বাজল রেডিওতে সেই সিগন্যালের গান। 
১৫ আগস্ট। রাত ১২টা। ১৫টা নৌকা। জমিদার বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। এই টিম জানতে পারছে না যে, ততক্ষণে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ সর্বত্র অপারেশন শুরু হয়েছে। আগের রাতেই। কোথাও কোথাও অভিযান শেষও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মোংলা অভিযানের টিমের ভাগ্য সদয় নয়। সময় লাগার কথা ১ ঘণ্টা। কিন্তু এ কী! সময় কাটছে না কেন? আর কতদূর? চারদিকে জল আর জল। হঠাৎ গাইড আফজলের  দিকে বন্দুক নিশানা করা হল। ঠিক করে বলো এসব কী হচ্ছে? আমাদের ফাঁদে ফেলতে চাইছ? আফজল নিজেও বিরক্ত। সে বুঝতে পারছে না কেন এই বিভ্রান্তি। সে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুগামী। বিশ্বস্ত। তাই তাকে এই কাজে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাহলে সে কেন ঘুরপথে নিয়ে আসছে? কী হয়েছে? সে কি ডাবল এজেন্ট? আফজল জানে অভিযানের গুরুত্ব। সে থরথর করে কাঁপছে। তার কোনও দোষ নেই। অথচ তাকেই অবিশ্বাস? মাঝিরা এই বিভ্রান্তির কাজটা করেছে। কারণ, হঠাৎ স্রোতের বিপরীতমুখী এমন এক চরিত্র উপস্থিত হয়েছে যে, সোজাসুজি বন্দরের দিকে মুখ করে নৌকা বাওয়া হলে স্রোতের টানে সমুদ্রের দিকে চলে যেতে পারে নৌকা। সেই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্যই অনেকটা‌ ঘুরপথে আসতে হয়েছে। কিন্তু ঩সেজন্য যেন সময় নষ্ট হচ্ছে। ভোর চারটে। ২৪ জন কমান্ডোকে ৬টি মিনি গ্রুপে বিভাজিত করা হয়েছে। এখনও অন্ধকার। কিন্তু যে কোনও সময় ভোর কেটে আলো ফুটবে। সুতরাং যা করার এখনই। বেছে বেছে পাকিস্তানের জাহাজেই আক্রমণ করা হবে এটা আর সম্ভব নয়। অন্ধকার থাকতেই সামনে যে জাহাজ পাওয়া যাবে সেখানেই বিস্ফোরক বেঁধে দেওয়া হবে। বিদেশি জাহাজে বিস্ফোরণ হলে বিশ্বজুড়ে আরও বেশি করে যাবে বার্তা যে, পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল। পাকিস্তান আরও চাপে পড়ে যাবে। 
এই ২৪ জনকে ঘিরে মোংলা বাঁধের কাছে পাহারায় থাকছে ২০০ জনের বেশি ব্যাকআপ টিম। আমিনুর রহমানের সিগন্যাল ছিল সাড়ে চারটেয় নদীতে নামতে হবে। তাই হল। পুশুর নদীতে ঝাঁপ দিতে হল। যে নদীতে কামট, কুমিরের আক্রমণ যে কোনও সময় হবে। হয়তো হাত কাটা যাবে। হয়তো পা। কিন্তু অকুতোভয় সেই যোদ্ধারা এগিয়ে চলেছে সাঁতরে। সবার আগে এস এস লাইটনিং নামের জাহাজ। এটা সোমালিয়ার। ভোর ৬টা ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় প্রতিটি জাহাজে লাগিয়ে দেওয়া হল লিমপেট মাইন। মাইন লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বেগে চলে আসতে হচ্ছে। ঠিক সাড়ে ৬টা থেকে শুরু হল বিস্ফোরণ। এক...দুই...তিন...চার...। পুশুর নদীতে যেন আগুনের উৎসব শুরু হয়েছে। সাইরেন বেজে উঠল তিনটি রেসকিউ শিপ থেকে। চতুর্দিকে সেই শব্দ বিদীর্ণ করে দিচ্ছে চরাচরকে। গোটা মোংলা বন্দর আর সংলগ্ন গ্রামগুলি থেকে মানুষ বেরিয়ে আসছে। জলের বহ্ন্যুৎসব তো এভাবে দেখা যায়নি কোনওদিন। এসব কী হচ্ছে? কাদের কাজ?
আধঘণ্টার মধ্যেই আকাশে উপস্থিত হল চারটি পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের ফাইটার জেট।  রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র যেন। ফাইটার জেটগুলি খুঁজছে আক্রমণকারীদের। মাথার উপরে এরারক্র্যাফট আর হেলিকপ্টার। আর নদীবক্ষে সাঁতার দিচ্ছে একঝাঁক মানুষ। তারা একটি নতুন দেশের জন্ম চায়। চায় নিজেদের স্বাতন্ত্র্য, অধিকার আর সম্মান। সুতরাং মরণপণ এই যুদ্ধে প্রাণ যায় যাক। কিন্তু সাঁতরাতে সাঁতরাতেই যখন প্রবল বিস্ফোরণ শোনা যাচ্ছে, সেটা যেন এক পরম শান্তি। ভারতীয় নৌসেনার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা পেরেছে ভারতীয় সেনার ভরসা অক্ষুণ্ণ রাখতে। চার পাকিস্তানি এয়ারক্র্যাফট আকাশে নিরন্তর উড়ছে। অথচ দেখা যাচ্ছে না কারা আক্রমণ করল! কোথায় পালাল তারা? অপারেশন জ্যাকপট সম্পূর্ণ সফল। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ অথবা মোংলা পাকিস্তানের নৌবাহিনী বিধ্বস্ত! 
ক্ষিপ্ত হয়ে নদীতটে থাকা পাকিস্তানের ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবার প্রকৃত স্বরূপে আবার ফিরে গেল। অর্থাৎ মোংলা বন্দরের আশপাশের গ্রামে ঢুকে তাণ্ডব, গণহত্যা, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া। গ্রামবাসীদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে কোথায় গেল মুক্তিরা বল! কারা আশ্রয় দিয়েছিস? উত্তর না পেয়েই গুলি। লুটিয়ে পড়ছিল একের পর এক গ্রামবাসী। রাগে ফুঁসছে পাকিস্তানি সেনারা। রাগে ফুঁসছেন অনেক দূরে করাচিতে একটি সামরিক শিবিরের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে ইস্ট পাকিস্তানের এই ভয়ঙ্কর খবরটি পাওয়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট  ইয়াহিয়া খান। শুধুই ক্রোধ? নাকি ইয়াহিয়া খান এই প্রথম আসলে ভয় পেতেও শুরু করেছেন? কারণ, এই নিখুঁত অভিযানের পরিকল্পনা রূপায়ণ শুধুই পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কি সম্ভব হতে পারে? অসম্ভব! তার অর্থ কী? তাহলে কি, হিন্দুস্তান প্রক্সি ওয়ার শুরু করে দিয়েছে গোপনে? আশঙ্কার কালো মেঘ ছড়াল ইয়াহিয়া খানের মুখে! 
....
ইয়াহিয়া খান মনে করেন যে, ইন্ডিয়ার ওই মহিলা প্রাইম মিনিস্টার অত্যন্ত ধুরন্ধর! তিনি আমেরিকাকে পর্যন্ত চোখ রাঙিয়েছেন। তাঁকে বিশ্বাস নেই। যে কোনও মুহূর্তে ঢাকায় আর্মি পাঠাতে পারেন। তার আগেই আমাদের অ্যাক্টিভ হতে হবে। এরকমই ভেবে ইয়াহিয়া খান তাঁর সামরিক বাহিনীর তিন কমান্ডারকেই ডেকে পাঠালেন রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানেই স্থির হল এক ভয়ঙ্কর প্ল্যান! ভারত যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে পাকিস্তানের এবং একঝাঁক বিদেশি জাহাজ পাকিস্তানের বন্দরে ধ্বংস করে দিয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতেই হবে!
নভেম্বর, ১৯৭১। পাকিস্তানের নৌবাহিনীর দুর্ধর্ষ অফিসার কমান্ডার জাফর মহম্মদ খানকে ডেকে পাঠানো হল করাচি ন্যাভাল হেডকোয়ার্টারে। তিনি তখন করাচি গলফ ক্লাবে। খেলার মাঝেই ক্লাবরুমে এসে ফোন ধরলেন।  বললেন, বিকেলে আসছি। কিন্তু তাঁকে বলা হল, একটু পরই আসতে হবে। অর্থাৎ খেলা বন্ধ রেখেই ছুটতে হবে। এতটাই জরুরি তলব। কেন? কারণ ‘করাচি প্ল্যান’! কী সেটা? 
(চলবে)
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

31st     October,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ