বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

পর্ব  ১: অপারেশন ৭১
সিচ্যুয়েশন রুম
সমৃদ্ধ দত্ত
 

স্যামুয়েল হসকিনসন একটি চার লাইনের মেসেজ লিখেছেন। সেটি পড়তে এতক্ষণ সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর হেনরি কিসিঙ্গার অনেক বেশি সময় নিয়ে সেই নোটপেপারের মতো দেখতে চিরকুটের দিকে তাকিয়ে। তিনি ভাবছেন, এই রিপোর্টের সত্যতা কতটা! এটা কীভাবে সম্ভব? আর এই সম্ভাবনার খবরটি প্রেসিডেন্টকে কীভাবে দেওয়া যায়! স্যামুয়েল হসকিনসন আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অথবা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) দুই গুপ্তচর সংস্থা‌ই সরাসরি রিপোর্ট করে হসকিনসনকে।  এই রিপোর্ট হসকিনসনের কাছে পাঠিয়েছে আমেরিকার বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। আর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর হিসেবে কিসিঙ্গারের কাছে সবরকম গোয়েন্দা আর স্পাই এজেন্সির রিপোর্টই আসবে। কারণ, তিনি ও তাঁর ব্যাক অফিস পর্যালোচনা করে, বাছাই করে এই রিপোর্টগুলির একটি বিশ্লেষণধর্মী নতুন ব্রিফিং দেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে। প্রেসিডেন্টের নাম রিচার্ড নিক্সন। একটি দেশকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। সেটি হল ইন্ডিয়া। নিক্সন প্রকাশ্যেই ভারত বিরোধী। উপমহাদেশে তাঁর পছন্দের মানুষ ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। সেকথা মাঝেমধ্যেই তিনি কিসিঙ্গারকে বলেন, আই লাইক খান। হি হিজ আ ম্যান অফ আওয়ার্স! 
সুতরাং, এহেন নিক্সনকে এই রিপোর্ট দিলে নিক্সন অবশ্যই সাংঘাতিক একটা ওভার রিঅ্যাকশন দেবেন। সেটা কাজের কথা নয়। ব্যাপারটা আরও একটু গভীরভাবে ভাবা দরকার। কিসিঙ্গার তাই সময় নিচ্ছেন। কী লেখা আছে রিপোর্টে? ভারত আর পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক গতিবিধি জেনে বেশ কয়েকদিনের গোপন নজরদারি আর সোর্স মারফত সিআইএ জানতে পেরেছে একটা মারাত্মক তথ্য। সেই রিপোর্ট তারা সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়েছে তাদের বস হসকিনসনকে। আর তৎক্ষণাৎ কয়েক লাইনের মধ্যে বিষয়টি হসকিনসন জানিয়েছেন কিসিঙ্গারকে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের প্রাইম মিনিস্টার ইন্দিরা গান্ধী আর্মিকে সাম্প্রতিক মিটিংয়ে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তান কব্জা করতে। প্রাইম  মিনিস্টার চাইছেন লিমিটেড পিরিয়ড কনফ্লিক্ট। অর্থাৎ স্বল্প সময়ের মধ্যে ঝড়ের গতিতে যেন যুদ্ধ শেষ করে দেওয়া হয়।  সিআইএ রিপোর্টে লিখেছে প্ল্যানটা অনেকটা ইজরায়েলের ‘সিক্স ডে ওয়ারের’ ধাঁচে। ১৯৬৭ সালে আরব গোষ্ঠীকে ইজরায়েল যে প্ল্যা঩নিংয়ে অ্যাটাক করেছে, ঠিক সেভাবেই ইন্ডিয়ার তিনটি ফোর্স তৈরি হচ্ছে ইস্ট পাকিস্তানে ঢুকে পাকিস্তান বাহিনীকে শিক্ষা দিতে। আর সেজন্য পশ্চিম সীমান্তেও হঠাৎ আর্মির ফরওয়ার্ড মুভমেন্ট শুরু হয়েছে। এমনকী, ইতিমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের কয়েকটি সীমান্তে গুলিযুদ্ধও হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে। কিন্তু যেটা এখনও স্পষ্ট নয়, তা হল, ইন্ডিয়া আক্রমণ শুরু করবে কোথা থেকে? কোন ফোর্স আগে আক্রমণে যাবে? আর্মি? এয়ার ফোর্স? নাকি নেভি? কিসিঙ্গার ভাবছেন। ১৯৭১। জুন।  
সবার আগে একবার আমেরিকার সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভবন হোয়াইট হাউসের সিচ্যুয়েশন রুমে ডেকে পাঠানো হল চিফ অব আর্মি স্টাফকে। জেনারেল উইলিয়ম ওয়েস্টগোরল্যান্ড।  ইন্ডিয়া পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে কী হতে পারে চিফ? জানতে চাইলেন কিসিঙ্গার। বেশি ভাবলেন না জেনারেল ওয়েস্টগোরল্যান্ড। নির্দ্বিধায় বললেন, অনায়াসে পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দেবে ইন্ডিয়া। যে কোনও যুদ্ধে। আর বিশেষ করে যেখানে সরাসরি মস্কো সাপোর্ট দেবে বোঝাই যাচ্ছে। 
কিসিঙ্গার বুঝলেন, মিসেস গান্ধীকে আন্ডারএস্টিমেট করা তাঁদের প্রথম থেকে ভুল হয়েছে। তাহলে এখন কী করা যায়? ভারতকে ঠেকাতে হবে। পাকিস্তান একের পর এক যুদ্ধে ভারতের কাছে হেরে যাবে, এটা মেনে নেবেন না নিক্সন। একটা উপায় আছে। যদি আমেরিকাও পাকিস্তানের পাশে সরাসরি দাঁড়ায়? অন্তত নৌসেনা দিয়ে? জেনারেল মাথা নাড়লেন। বললেন, তাহলে তো আর ঘুরপথে নয়। সোজাসুজি সোভিয়েত নামবে ভারতের হয়ে। আর আপনি নিশ্চয় জানেন, মিসেস গান্ধী তাঁর গোটা ফরেন অ্যাফেয়ার্স টিমকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠাতে শুরু করেছেন। তাঁরা সাপোর্ট চাইছেন। কখনও ফরেন মিনিস্টার, কখনও অ্যাম্বাসাডর, কখনও হোম অ্যাফেয়ার্স মিনিস্টার। কেউ লাতিন আমেরিকা, কেউ এশিয়া, কেউ ইউরোপ। এসব জানেন কিসিঙ্গার। মিসেস গান্ধীর চিঠি আমেরিকার কাছেও এসেছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, আপনারা বলছেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি কেন? কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে ঢুকে পড়ছে। এক কোটি পেরিয়ে গিয়েছে। আমরা এত চাপ কীভাবে সামলাব? আর কেনই বা সামলাব? সবেথেকে বড় কথা পাকিস্তান এত অত্যাচার করছে কেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর? আমাদের পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। ইন্দিরা গান্ধীর এই চিঠির মধ্যেই অবশ্য আভাস আছে যে, ভারত আক্রমণাত্মক কিছু ভাবছে।  আর সিআইএ রিপোর্ট তো ভুল হওয়ার কথা নয়! 
........

যা ভাবা হয়েছিল তাই। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন শুনেই ক্ষিপ্ত। ওভাল অফিসে বসে কিসিঙ্গারকে নিক্সন বললেন, যদি আর একটা দুর্ভিক্ষ চায়, তাহলে ইন্ডিয়া যুদ্ধে যাক। আমরা পাকিস্তানকে কোনওভা঩বেই কঠোর বার্তা দেব না। সে ইন্ডিয়া যাই বলুক। আমরা ম্যাক্সিমাম যেটা করতে পারি, ওই রিফিউজিদের জন্য ইন্ডিয়াকে অনুদান দিতে পারি ইউনাইটেড নেশনের রুলে। কিসিঙ্গার একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, বাট প্রেসিডেন্ট, আমাদের একই সঙ্গে নিশ্চিত করা উচিত, যাতে ভারত যুদ্ধে না যায়। সেটা হলে আমরা ঠিক জানি না, পাকিস্তান হ্যান্ডল করতে পারবে কি না। নিক্সন তখনও রেগে আছেন। তবু বললেন, কীভাবে ভারতকে কন্ট্রোল করা যাবে? সিচ্যুয়েশন এখানে বসে বোঝা সম্ভব নয়। আপনি নিজেই একবার যান। গিয়ে জানার চেষ্টা করুন চীন কী ভাবছে। পিকিং (বর্তমান বেজিং) ঠিক এই অবস্থায় কী চাইছে, সেটা জেনে নেওয়া দরকার আমাদের। ওদের স্ট্যান্ড আমাদের কাছে ইম্পর্ট্যান্ট। আর যাওয়ার পথে দিল্লির নার্ভ বোঝার চেষ্টা করবেন। কখন যাবেন, সেটা ঠিক করুন। আর ভারত যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে ওরা দুর্ভিক্ষে মরুক!
কেন রিচার্ড নিক্সন এতটা ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধী? কারণ একাধিক। নিক্সন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে যখন‌ই এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে গিয়েছেন তিনি দেখতে পেয়েছেন, প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধানের চোখে এক সমীহ। এক বিশেষ শ্রদ্ধামিশ্রিত ভীতি। কারণ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলে কথা। ইনি সর্বশক্তিমান। সুতরাং নিক্সন আনুগত্য পেতেই অভ্যস্ত। তাঁর স্বভাবও সেরকম। একমাত্র ব্যতিক্রম এই মহিলা। আজ থেকে নয়। ভারতের এই নারীটির কাছে নিক্সন বারংবার অপমানিত হয়েছেন। মহিলাটি ঠান্ডা মাথায় যে কোনও ব্যক্তিত্বকে চরম উপেক্ষা আর অসম্মান করতে পারেন বলে নিক্সনের ধারণা। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে থেকেই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। তখন থেকে তিনি পছন্দ করেন না ঩মিসেস গান্ধীকে। কী হয়েছিল? ১৯৬৭ সালে সাধারণ  আমেরিকান নাগরিক হিসেবে নিক্সন ভারত সফরে এসেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলই। তিনি যে দ্রুত আমেরিকার প্রশাসনে উঠে আসছেন, সেটা কয়েকবছর আগে থেকেই স্পষ্ট। তাই তিনি আশা করেছিলেন তাঁকে বিশেষ কদর করা হবে। কিছু ভারতীয় এমপির সঙ্গে দেখা করলেন। পার্লামেন্ট ভিজিট করলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। যথা সময়ে গিয়েছেন তিনি। ১৫ মিনিটও কথা হয়নি। নিয়ম হল বিদেশি অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে আসেন ভারতের বিদেশমন্ত্রকের কোনও এক ডেপুটি সেক্রেটারি স্তরের অফিসার। যাকে সরকারি পরিভাষায় বলা হয় এসকর্ট। ১৫ মিনিট কথা বলার মাঝেই ইন্দিরা গান্ধীর মুখচোখ ক্রমেই শীতল ও নির্লিপ্ত হয়ে উঠছে। তিনি কোনও আগ্রহ বোধ করছেন না। কারণ, নিক্সন ভারতের নানাবিধ সরকারি পলিসির দুর্বলতা এবং আগামী দিনে ভারত কী করতে চলেছে এসব জেনে নিতে চাইছেন। ভারতের সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ নেই। সাম্প্রতিক আর্ট অথবা সাহিত্য নিয়ে কথা বলেন না। 
বেশিক্ষণ এরকম মানুষের সঙ্গে কথা চালাতে পছন্দ করেন না ইন্দিরা গান্ধী। কথাবার্তার ১৫ মিনিটের মধ্যেই হঠাৎ তিনি হিন্দিতে সেই ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই মিটিং-এ কতক্ষণ টাইম অ্যালট করা আছে? আর কতক্ষণ কথা বলতে হবে? সেই ডেপুটি সেক্রেটারি অপ্রতিভ হয়ে বলেছিলেন, হাফ অ্যান আওয়ার ম্যাডাম! ইন্দিরা গান্ধী মুখে হাসি বজায় রেখেই হঠাৎ দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিলেন। আর বুদ্ধিমান নিক্সন তৎক্ষণাৎ আন্দাজ করে নিলেন, প্রাইম মিনিস্টার হিন্দিতে কী প্রশ্ন করেছিলেন ওই এসকর্টকে। তাঁর ইগোয় এতটাই লাগল যে, এরপর সেই মিটিং বেশিক্ষণ গড়ায়নি। 
আবার ১৯৬৯। পয়লা আগস্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এয়ার ফোর্স ওয়ান ফ্লা‌ইটে দিল্লি ল্যান্ড করার পর ভেবেছিলেন সাধারণ মিটিংয়ের পাশাপাশি কোনও একটা বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ রিসেপশন হবে তাঁর জন্য।  সেসব কিছুই হল না। রাষ্ট্রপতি হিদায়েতুল্লা একটি নৈশভোজের আয়োজন করলেন। যেটা যে কোনও রাষ্ট্রপ্রধান দিল্লি সফর করলেই হওয়া নিয়ম। কিন্তু আলাদা করে ইন্দিরা গান্ধী কোনও বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন না নিক্সনের সম্মানে। কারণ নিক্সন শুরু থেকেই একের পর এক বিবৃতি দিয়েছিলেন ভারত সম্পর্কে যে, ভারত আমেরিকার কাছে শুধু ডলার অথবা খাদ্যের মতো অনুদানই চায়। আমেরিকার কী কাজে আসবে ইন্ডিয়া? নিক্সনের ধারণাই ছিল না যে, ইন্দিরা গান্ধীর ইগো নিক্সনের দশগুণ! ইন্দিরা গান্ধী অবস্থান নিয়েছিলেন, তিনি আরও বেশি বেশি সোভিয়েতপন্থী করে তুলবেন ভারতকে। আমেরিকাকে এতটাই উপেক্ষা করবেন যে, আমেরিকার মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়ে যাবে। সুতরাং, এটাই স্বাভাবিক, সেই থেকে নিক্সন বনাম ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে এক অঘোষিত ইগোর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এখন দেখা যাক কিসিঙ্গারের টেবিলে যে রিপোর্ট এসে পৌঁছেছে সেটা কতটা ঠিক?
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর ধরেই নিয়েছেন, তাঁদের গুপ্তচর সংস্থা বিশ্বখ্যাত স্পা‌ই এজেন্সি সিআইএ সঠিক খবর দিয়েছে। অর্থাৎ যে কোনও মুহূর্তে ভারত ঢাকা আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু সবটাই তাঁদের চোখে ধুলো দেওয়া। ভারতের স্পাইমাস্টার আর এন কাও-এর প্ল্যান। ভারত জানে, পাকিস্তানের এই হম্বিতম্বির আসল মদতদাতা আমেরিকা। আর তাই ভারতের মধ্যে ক্ষমতার করিডরে যে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ ওত পেতে রয়েছে গোপন খবর সংগ্রহের জন্য, সেটা জানেন একজন মানুষ। তার নাম আর এন কাও।  ভারতের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা কর্তা। আর এন কাও এবং ইন্দিরা গান্ধী ঠিক করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের ফর্মাল ট্রেনিং দেওয়া দরকার। তারা যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানেই আছে, তাই ভিতর থেকে পাকিস্তান সেনাকে আক্রমণ করবে। যাবতীয় ব্যাক আপ জোগাবে ভারত। ট্রেনিং থেকে অস্ত্র। ঠিক সময়মতো ভারতীয় সেনা চলে আসবে সামনে। কবে? সেটাই আসল প্রশ্ন! আমেরিকার কাছে সিআইএ ভারতের যুদ্ধপ্রস্তুতির সেই রিপোর্ট দেওয়ার দু’মাস আগেই একটি গোপন মিটিং হয়েছিল দিল্লির সাউথ ব্লকে। সেখানেই ঠিক হয়ে যায় স্ট্র্যাটেজি। যা জানতেই পারেনি সিআইএ। কী ছিল সেই কৌশল?
কিন্তু যেভাবে সীমান্ত পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু অসম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় ঢুকছে ভয়ে আতঙ্কে! কেন এই পরিস্থিতি? সেটা সর্বজনবিদিত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান ঢাকায় কী ভয়ঙ্কর গণহত্যা আর তাণ্ডব চালিয়ে হাজার হাজার মৃত্যু-উৎসবের সূচনা করেছিল, তার বিবরণ ইতিহাসে আজও জীবন্ত। সেই গণহত্যায় হিন্দু-মুসলিম বাছাবাছি করেনি পাকিস্তানি শাসককুল। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রীতিমতো প্ল্যান করে এমন অত্যাচার চালাচ্ছে, যাতে পূর্ব পাকিস্তান অনেকটাই বাঙালিশূন্য হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯৪৭-এর মতোই প্ল্যান। যত বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তুর চাপ ভারতের ঘাড়ে চাপিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতকে পঙ্গু করে দেওয়া যায়। এসব সহ্য করা হবে না। জবাব এখনই দিতে হবে। ভাবলেন ইন্দিরা গান্ধী। ডেকে পাঠালেন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশকে। 
এপ্রিল, ১৯৭১। ক্যাবিনেট মিটিং চলছে। মন্ত্রীদের পাশাপাশি রয়েছেন গোয়েন্দা কর্তা আর এন কাও। জেনারেল স্যাম মানেকশকে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, আপনারা কী করছেন?
মানেকশর মতো দৃপ্ত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন সেনাপ্রধান কম পাওয়া যায়। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপারে? 
এই যে পাকিস্তান যেভাবে উদ্বাস্তু ঢোকাচ্ছে?
মানেকশ বললেন, আমার ঩ফোর্সের তো কোনও ভূমিকা নেই এখানে! আপনি আর মিস্টার কাও স্থির করেছেন ইস্ট পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা মদত দেব। সেই কনসাল্টেশন প্রসেসে আমি ছিলাম না। এখন তো অবাধে যাতায়াত হবেই! 
ইন্দিরা গান্ধীর মুখের উপর এভাবে সেনাপ্রধান কথা বলছেন? মন্ত্রীরাই ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছেন।
ইন্দিরা গান্ধী ভ্রু কুঁচকে বললেন, আমি চাই আপনারা পাকিস্তানে  প্রবেশ করুন।
জেনারেল মানেকশ বললেন, তার মানে তো যুদ্ধ?
প্রধানমন্ত্রী শীতল কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, যুদ্ধ হলে হোক! 
মানেকশ বললেন, আপনি প্রস্তুত? আমি কিন্তু রেডি নই। 
ইন্দিরা গান্ধী বললেন, কেন?
মানেকশ বললেন, এখন এপ্রিল। হিমালয়ান পাস খুলছে। চীন পাল্টা অ্যাটাক করার সুযোগ পেয়ে যাবে। আর কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষা শুরু হয়ে যাবে। সেখানে বর্ষা সাংঘাতিক। গোটা গ্রামীণ এলাকার নদনদী ভেসে যায়। জলমগ্ন থাকে কয়েকমাস। হিমালয়ের বরফ গলছে, অন্যদিকে বন্যার সম্ভাবনা বর্ষায়। তার মানে আমাদের অ্যাটাক একমাত্র সীমাবদ্ধ রাখতে হবে স্থলপথে। এয়ারফোর্স কাজে আসবে না এই ভরা বর্ষায়। আমাদের তাই একটু সময় দরকার। প্রাইম মিনিস্টার, নাউ ইউ গিভ মি অর্ডারস! 
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হঠাৎ বললেন, ক্যাবিনেট মিটিং আবার হবে বিকেল চারটেয়। আপনারা তখন আসবেন আবার! সকলে উঠে চলে যাচ্ছে। ইন্দিরা বললেন, জেনারেল আপনি যাবেন না। ওয়েট করুন। সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী কিছু বলার আগেই স্যাম মানেকশ বললেন, আপনি কিছু বলার আগে আমি একটা কথা বলছি। আমি কি ইস্তফা দেব? হেলথ গ্রাউন্ডে? 
ইন্দিরা গান্ধী বললেন, স্যাম, আপনি আমাকে যা বলেছেন, সেটা সত্যি। 
মানেকশ বললেন, আমার ডিউটি আপনাকে সত্যিটাই বলার। আর একই রকম আমার ডিউটি লড়াই করার। আর লড়াই করে জেতার। 
ইন্দিরা এই প্রথম হাসলেন। বললেন, অল রাইট স্যাম! আপনি জানেন আমি কী চাই! 
মানেকশ ঘাড় নেড়ে বললেন, ইয়েস ম্যাডাম, আমি জানি আপনি কী চান। 
ইন্দিরা গান্ধী বললেন, কতদিন সময় লাগবে আমাদের রেডি হতে?
মানেকশ বললেন, অন্তত পাঁচ-ছয় মাস। 
ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ওকে, আপনি প্ল্যান করুন আপনার মতো করে। এই মাঝের সময়টা‌য় আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে। ঘরে ছিলেন গোয়েন্দা কর্তা আর এন কাও! তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন ইন্দিরা গান্ধী। আর এন কাও সেটা দেখে শুধু ঘাড় নাড়লেন! তিনি বুঝেছেন, কী করতে হবে এখন! 
(চলবে)
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
 

3rd     October,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ