১৯০৭ সাল। দ্বিজেন্দ্রলাল তখন গয়ার ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট। কোলি সাহেবের কার্যকাল শেষ হলে তৎকালীন ইংরেজ সরকার এই দায়িত্ব দিয়েছিল তাঁকে। দেখতে দেখতে পুজো চলে এল। পুজোর ছুটি উপলক্ষ্যে কলকাতা থেকে একে একে এসে হাজির হলেন প্রসাদদাস গোঁসাই, গিরীশ শর্মা, প্রিয়নাথ সেন, মন্মথ সেন প্রমুখ। তা ছাড়া লোকেন পালিত তো ছিলেনই। মূলত লোকেন পালিত ও প্রিয়নাথ সেনের উদ্যোগেই গয়ায় দ্বিজেন্দ্রলালের বাড়ির সাহিত্যিক মজলিশটা সরগরম হয়ে উঠেছিল। এখানে বসে তিনি লিখলেন, ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ।’
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে কবির আলাপ ছিল আগে থেকেই। গয়ায় এসে দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীতচিন্তা ও রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী। কবি কণ্ঠে কয়েকটি গান শুনে জগদীশচন্দ্র দ্বিজেন্দ্রলালকে বলেছিলেন, ‘আপনি রাণা প্রতাপ, দুর্গাদাস প্রভৃতির অনুপম চরিত-গাথা বঙ্গবাসীকে শুনাইতেছেন বটে;... আমাদের এই বাঙ্গালা দেশের আবহাওয়ায় জন্মিয়া, আমাদের ভিতর দিয়াই বাড়িয়া-উঠিয়া, সমগ্র জগতের শীর্ষস্থান অধিকার করিতে পারিয়াছেন,—যদি সম্ভব হয়, যদি পারেন, একবার সেই আদর্শ এ বাঙ্গালী জাতিকে দেখাইয়া, আবার তাহাদিগকে জীয়াইয়া, মাতাইয়া তুলুন।’
সেদিন কবির অন্তরে এক অভূতপূর্ব রোমাঞ্চ জেগেছিল। বাইরে অষ্টমী পুজোর ঢাক বাজছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে কবির বাসায় তখন মুখোমুখি বসে দু’জন। কবি আর কবিজীবনীকার দেবকুমার রায়চৌধুরী। হঠাৎই কবি বলে উঠলেন, ‘—দেখ, আমার মাথায় মধ্যে একটা গানের কয়েকটা লাইন আসিয়া ভারী জ্বালাতন করিতেছে। তুমি একটু বসো ভাই, আমি সেগুলি গেঁথে নিয়ে আসি।’ প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ঘরে ঢুকলেন কবি। গান গাইছেন গুনগুন করে। এর পরেই হাততালি দিতে দিতে সারা ঘর নেচে নেচে গাইতে লাগলেন—
‘কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য?/ কিসের লজ্জা, কিসের ক্লেশ?
সপ্ত কোটি মিলিত কণ্ঠে/ ডাকে যখন আমার দেশ’
বন্ধু লোকেন পালিত সেই সময় গয়ায় জজিয়তি করতেন। এই গান শুনে তিনি এতটাই অভিভূত হন যে, সেই রাতে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে নাচতে দ্বিজেন্দ্রলালের পিছুপিছু ঘুরেছিলেন। শেষে কবির সঙ্গে করমর্দ্দন করে বলেন, ‘Oh! how wonderful— how magnificent! Let me confess my dear. Dwiju, It’s undoubtedly the very-very-very best and noblest national song that I’ve ever heard or read in my life. It’s indeed a Devine inspiration.’
প্রায় শ’পাঁচেক গান রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। এর মধ্যে যেমন আছে প্রেমের গান, তেমনই আছে নাটক, হাসি ও স্বদেশি গান। স্ত্রী সুরবালার সঙ্গে দাম্পত্য-জীবনই তাঁকে প্রেমের গানের দ্বিজেন্দ্রলাল বানিয়ে তুলেছিল। যদিও সেই সময় তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন একমাত্র হাসির গান রচনার ক্ষেত্রে। শেষ জীবনে গ্রামোফোন কোম্পানি দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানই রেকর্ড করেছিল। যদিও এই গানই তাঁর একমাত্র অভিজ্ঞান ছিল না। আত্মবিস্মৃত বাঙালি হয়তো ভুলেছে অনেক কিছুই। ভুলে গিয়েছে, সুরের কাঠামো তৈরি করে গানের কথা বসানোর বিষয়টি। শ’পাঁচেক গানের মধ্যে সুর করেছিলেন ১৩২টির। গান রচনা করলেও সব গানের স্বরলিপি তৈরির চেষ্টা করেননি তিনি। তবে সঙ্গীতে মধুর ছন্দবোধ সেই সময় ক’জনেরই বা ছিল! ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ বা ‘আমরা মলয় বাতাসে ভেসে যাব’—এমন হাতে গোণা কয়েকটি গানের মধ্যে দিয়েই তাঁকে স্মরণ করছে বাঙালি।
বাবা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেওয়ান। তিনিও খুব ভালো গাইতেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নামকরা গায়ক ছিলেন। ‘আমার পিতা একজন সুবিখ্যাত গায়ক ছিলেন। প্রত্যুষে উঠিয়া তিনি যখন ভেঁরো, আশোয়ারি ইত্যাদির সুর ভাঁজতেন, আমি অন্তরালে থাকিয়া শুনিতাম।’ এমনই লিখেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। কার্তিকেয়চন্দ্র সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি লিখেছেন কিছু গ্রন্থ— ‘গীতমঞ্জরী’, ‘আত্মজীবনচরিত’ সে কথাই বলে। মা প্রসন্নময়ী ছিলেন অদ্বৈত আচার্য্যের বংশধর। বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, দীনবন্ধু মিত্রের মতো মানুষের স্নেহে ধন্য হয়েছিল তাঁদের পরিবার। নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সেনাপতি ছিলেন দ্বিজুবাবুর ঠাকুরদা। ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ঠাকুরদা মদনগোপাল রায়ের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে—‘রায় বকসী মদনগোপাল মহামতি’।
সাহিত্যের জগতের মানুষ হলেও দ্বিজেন্দ্রলাল বিলেতে গিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়তে। সেখানেই ‘দি লিরিকস অব ইন্ড’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন। বিলেতে থাকাকালীন সঙ্গীতের পাশাপাশি তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় স্কট আর আইরিশ গানে। রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি কখনও বিদেশি গানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে অনুবাদ করেছেন, কখনও বা প্রভাবিত হয়ে নতুন সৃষ্টিতে মেতে উঠেছেন। মাত্র ন’বছর বয়সে গান রচনায় হাতেখড়ি। ওই গানগুলিই পরবর্তীকালে ‘আর্য্যগাথা’-য় (প্রথম ভাগ) স্থান পায়। প্রথমে বাড়ির পরিবেশ, পরে বিলেতি শিক্ষাগ্রহণ—এভাবেই ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতে এসেছিলেন তিনি।
বিলেত থেকে কৃষিবিদ্যার তিনটে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে ব্রিটিশ সরকারের কৃষি বিভাগে কাজ করেছেন। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বদলি হয়েছেন কাজের সূত্রে। ল্যান্ড রেজিস্ট্রারের পাশাপাশি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দীনবন্ধু মিত্র বা বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মিল পাওয়া যায়। একবার তিনি আচমকাই মেদিনীপুরের সুজমুঠা পরগনার কৃষকদের খাজনা কমিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন ওখানকার সেটলমেন্টের দায়িত্বে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজদের চক্ষুশূল হয়ে গেলেন তিনি। বিষয়টি গড়াল আদালত পর্যন্ত। স্বয়ং ছোটলাট বিষয়টির পরিদর্শনে এসে জলঘোলা করলেও দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন এ বিষয়ে নীরব। কোনওরকমে চাকরি বাঁচলেও বঙ্গদেশের কৃষকের এই উপকারে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। সেদিন থেকেই মেদিনীপুরের কৃষকরা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে ডাকা শুরু করেছিল ‘দয়াল রায়’ নামে।
ইংরেজদের দেওয়া এই চাকরিকে তিনি মনে করতেন ‘দাস্য’। তবে এই চাকরিই শেষপর্যন্ত তাঁকে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে সাহায্য করেছিল। মানুষের জীবনের নানা খবর পেতে পেতে থিয়েটারের সেন্স যেটা তাঁর মধ্যে ছিল, সেটা ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠেছিল এই কারণেই। বিলেতে যাওয়ার পরে থিয়েটার দেখতে দেখতে তাঁর থিয়েটার প্রেম নিশ্চিতরূপে স্ট্রং হয়েছিল। ফিরে এসে সেটি পরিণত হতেই তিনি ঢুকে পড়েছিলেন নাটকে। সেই সময়ে নাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বিখ্যাত ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। তাঁর লেখা নাটকে সেই সময় কেঁপে কেঁপে উঠেছে কলকাতার রঙ্গমঞ্চ।
চাকরি জীবনে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রচুর স্বদেশভাবনামূলক গান লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। যেটা অন্যায় মনে করেছেন, খোলা মনে তার প্রতিবাদ করেছেন। এর জন্য প্রচুর নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে তাঁকে। ফলে অনেক বাজে জায়গায় বদলি হতে হয়েছে। রুচি, শিক্ষা, আভিজাত্য নিয়ে এ দেশে জন্মগ্রহণ করেও শেষপর্যন্ত তাঁকে হতে হয়েছিল একঘরে। সেই সূত্রে লিখেছিলেন ‘একঘরে’ প্রহসন। তাঁর অপরাধ ছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য কালাপানি পার হওয়া। “আমাদের দেশে যিনি প্রথম মেডিক্যাল কলেজে পুত্রকে পাঠাইয়াছিলেন তিনি একঘরে। যিনি প্রথম পৌত্তলিকতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি একঘরে। একদিন ঈশা, গ্যালিলিও একঘরে হয়েছিলেন। দেখছি, এই পৃথিবীর যাঁরা নবপ্রয়াস নবনীতির, নবধর্মের নেতা, তাঁহারা একঘরে।” ক্ষোভে দুঃখে একসময় একথা বলেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, তাঁর বিয়ের বরযাত্রীদের জানানো হয়েছিল, যারা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে তাদের সমাজচ্যুত করা হবে। এই খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ বরযাত্রীরা বিবাহবাসর থেকে ফিরে এসেছিল। নবদম্পতিকে পুরোপুরি বয়কট করেছিল জন্মভূমি কৃষ্ণনগরের নাগরিক সমাজ।
রবীন্দ্রযুগে জন্মগ্রহণ করেও রবীন্দ্রস্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। বাংলা নাট্যসাহিত্য এবং বাংলা রঙ্গমঞ্চে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে নাট্যকার হিসেবে যতটা বিখ্যাত এবং প্রতিষ্ঠিত দেখা গেছে কবি হিসেবে ততটা নয়। কিন্তু তিনি ‘আর্য্যগাথা’ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ), ‘মন্দ্র’, ‘আষাঢ়ে’, ‘হাসির গান’, ‘ত্রিবেণী’, ‘আলেখ্য’ এইসব কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। তবুও কবি হিসেবে ততটা সুখ্যাতি পেলেন না তিনি, কারণ সেই সময় রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন মধ্যগগনে। রবীন্দ্রনাথের থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল মাত্র দু’বছরের ছোট ছিলেন। তিনি যখন কাব্য লিখছেন সেই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। ‘কবি কাহিনি’, ‘কালমৃগয়া’, ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’— এ ছাড়াও ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ লিখছেন তিনি। ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসও লিখেছেন। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে বটবৃক্ষের পাশাপাশি বসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে কাব্য লিখতে হয়েছিল।
উল্লেখ্য, দ্বিজেন্দ্রলাল কলকাতায় তাঁর ৫ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে একটা সাহিত্য বাসর বসাতেন প্রতি মাসে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে সাহিত্য বাসরের সূচনা করেছিলেন তিনি। নাম দিয়েছিলেন ‘পূর্ণিমা মিলন’। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, তাঁর দাদারা—দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, তখনকার নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ সেখানে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ সেখানে প্রবন্ধ পড়েছেন, গান গেয়েছেন, আড্ডাও দিয়েছেন। সাহিত্য বাসরের প্রথম দিনই ছিল বসন্ত উৎসব। আড্ডায় হাজির রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্র-পুত্র দিলীপকুমারের লেখায় জানা যাচ্ছে, “রবীন্দ্রনাথ সেদিন আমাদের সুকিয়া স্ট্রিটের বাসায় এসে ‘সে যে আমার জননী রে’ গানটি গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। গানের শেষে পিতৃদেব তাঁকে আবীরে রাঙিয়ে দেন।” আবীর মেখে কিঞ্চিৎ হেসে সেদিন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আজ দ্বিজেন্দ্রবাবু শুধু আমাদের মনোরঞ্জন করেছেন, তাই নয়—আমাদের সর্বাঙ্গ রঞ্জন করলেন।” প্রশংসায় উদ্বেল হয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’-কে বলেছিলেন ‘ধর্মগ্রন্থ’। পাশাপাশি ‘বিরহ’ প্রহসনটি উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ‘আর্য্যগাথা’ (দ্বিতীয় ভাগ), ‘মন্দ্র’ ইত্যাদি কাব্য পড়ে দ্বিজুবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তাতে চির ধরিয়েছিল কিছু বাঙালি কানভাঙানিয়া। স্তাবকের দল প্রতিনিয়ত দ্বিজেন্দ্রলাল আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রতিযোগিতার বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দ্বিজেন্দ্রলালের কাছে নিজেদের বিশ্বাসভাজন করে তোলা।
সুতরাং আগুপিছু না ভেবে ‘সোনার তরী’ কাব্যের সমালোচনা করে বসলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। কাব্যিক দৃষ্টিতে না দেখে তিনি ‘সোনার তরী’-কে বিশ্লেষণ করলেন বাস্তব দৃষ্টিতে। তাই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল— বর্ষাকালে ধান রোপণ না করে কাটার প্রসঙ্গ, আবার জমিটি যদি দ্বীপে অবস্থিত হয়, তবে সে জমিতে কীভাবে চাষ হবে ইত্যাদি। পরে ‘আনন্দ বিদায়’ প্রহসনের মাধ্যমে দ্বিজেন্দ্রলাল তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে। প্রহসনটি অভিনীত হয় ১৯১২ সালের ১৬ নভেম্বর। কলকাতার স্টার থিয়েটারে। অভিনয় শুরু হলে দর্শকদের একাংশ গণ্ডগোল শুরু করে। রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা হয়েছে বলে তারা নাটক অভিনয়ে আপত্তি জানায়। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে হলের মধ্যেই। দর্শকাসন ভাঙচুর করে। দর্শক বিরোধিতায় শেষপর্যন্ত স্টার কর্তৃপক্ষ অভিনয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। নাট্যকার হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। জনতার রোষ থেকে বাঁচতে তাঁকে বাধ্য হয়ে রঙ্গমঞ্চের পিছন দিয়ে গোপনে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল।
এই দ্বিজেন্দ্রলালই কিন্তু ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সূচনা অংশে রবীন্দ্রনাথসহ বঙ্গসাহিত্যের গুণগান করে লিখেছিলেন, “আমাদের শাসন-কর্ত্তারা যদি বঙ্গসাহিত্যের আদর জানিতেন, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও মাইকেল পিয়ারেজ পাইতেন ও রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধিতে ভূষিত হইতেন।” রবীন্দ্রনাথ ‘নাইটহুড’ পেয়েছিলেন বটে, তবে দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পরে ১৯১৫ সালে। দুর্ভাগ্যের এই যে, দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর স্বপ্নের পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’ চোখে দেখে যেতে পারেননি। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশের আগেই তিনি পরলোকে চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে তাঁর মৃত্যুর নয় বছর পর রবীন্দ্রনাথ দিলীপকুমার রায়কে লিখেছিলেন, “তোমার পিতাকে আমি শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধা করেছি। সে কথা জানিয়ে তাঁকে ইংল্যাণ্ড থেকে আমি পত্র লিখেছিলাম, শুনেছি সে পত্র তিনি মৃত্যুশয্যায় পেয়েছিলেন। সে উত্তর আমার হাতে পৌঁছায়নি।”
একটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে, দ্বিজেন্দ্রলাল যখন নিজের জায়গা তৈরি করছেন তখন মহীরুহের মতো রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গান, নাটক, কাব্য ইত্যাদি রয়েছে স্বমহিমায়। তখন প্রায় সমস্ত লেখকই সে ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল যতদিন কাব্য বা গান লিখেছেন, ততদিন সেই ছায়ায় ঢাকা পড়েছিলেন। কোনও কাব্যই দ্বিজেন্দ্রলালকে, দ্বিজেন্দ্রলাল হিসেবে পরিচিত করায়নি। তিনি যখন নাটক রচনায় এলেন, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের সময়ে—তখন থেকেই দ্বিজেন্দ্রলাল, দ্বিজেন্দ্রলাল হয়ে উঠছেন। জন্মের ১৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাঙালিরা তাঁকে মনে রেখেছে ঐতিহাসিক নাটকের জন্য। সেইসঙ্গে তাঁর লেখা হাসির গান। তাঁর নাটক-প্রহসনের সংখ্যা একুশ। অনেক নাটকই কলকাতার থিয়েটার পাড়ায় সেইসময় দাপিয়ে বেরিয়েছে। ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’, ‘দুর্গাদাস’, ‘নূরজাহান’, ‘মেবার পতন’, ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘পাষাণী’, ‘সীতা’ ইত্যাদি। যখন তিনি ঐতিহাসিক নাটকে এলেন, বাংলা রঙ্গমঞ্চে তখন ঐতিহাসিক নাটকের চল ছিল না। ফলে দ্বিজেন্দ্রলাল তখন থেকেই প্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন।
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের সময়ে বাঙালির জাতীয় চেতনা দারুণভাবে জেগেছিল। এই প্রথম বাঙালিরা মাঠে নেমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। মূলত এই আন্দোলন থেকেই এসেছে দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলো। রবীন্দ্রনাথও রাস্তায় নেমে গাইলেন, বাংলার মাটি বাংলার জল…। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ তার আগে পঁচিশ বছর নাটক লিখেছেন, কিন্তু তাঁর ভাণ্ডারে ব্রিটিশ বিরোধী কোনও নাটক নেই। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে দাঁড়িয়ে আলেকজাণ্ডার যে বিচিত্র দেশের বর্ণনা দিচ্ছেন, সে দেশও বঙ্গদেশ। যার মূলে রয়েছে ১৯০৫-এর জাতীয় উন্মাদনা। ‘চন্দ্রগুপ্ত’-এ গ্রিক কাহিনির সেলুকাস, অ্যান্টিগোনাস ও হেলেন বৃত্তান্ত—বিংশ শতকের গোড়ায় বেশ সারা ফেলেছিল কলকাতার থিয়েটারপাড়ায়। নাটকের শুরুতেই সেকেন্দার (পড়ুন আলেকজান্ডার) এ দেশের প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে সেলুকাসকে বলেছিলেন, ‘সত্য সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ।’
‘সাজাহান’ নাটকে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…’ গানটি গাইছে রাজপুতানার চারণীরা। অথচ গানের পরিবেশ সবটাই বাংলাদেশের। নদী, প্রকৃতি, আবহাওয়া, সবুজ শ্যামলিমা কোনওটাই রাজপুতানার নয়। এখানেই তিনি লিখেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ স্বদেশভূমির প্রতি কতটা প্রেম, কতটা শ্রদ্ধা, কতটা আনুগত্য থাকলে এই ধরনের গান লেখা যায়! রবীন্দ্রনাথ দেশের মাটিতে বিশ্বমায়ের আঁচল অনুভব করে বলতে পেরেছেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’। আর দ্বিজেন্দ্রলাল দেশমাতৃকার কাছে প্রার্থনা করে লিখেছেন, ‘ও মা তোমার চরণ দু’টি বক্ষে আমার ধরি/ আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।’
লেখক: কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়