আজ ২ জুলাই। বাংলার ইতিহাসে এই দিন ফিরে ফিরে এসেছে। কলকাতা হয়েছে আলিনগর, কিংবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন সিরাজ-উদ-দৌলা। অতীতকে শব্দে ধরলেন সৌম্য নিয়োগী
‘হলওয়েল মনুমেন্ট জাতীয় পরাধীনতার অন্যতম চিহ্নস্বরূপ। ৩ জুলাই সিরাজউদ্দৌলার স্মৃতিদিবসের মধ্যে সেটি লোকচক্ষুর অন্তরালে সরাইয়া লইবার দাবি বাংলার সরকারের নিকট করা হইয়াছে।’ আজকের কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের নাম তখন অ্যালবার্ট হল। তিল ধারণের জায়গা নেই। বক্তব্য রাখছেন সুভাষচন্দ্র বসু। ২৯ জুন, ১৯৪০। হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলন চরম আকার নিচ্ছে। শুধু জনসভা নয়, ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকাতেও সুভাষের ঘোষণা, ‘আগামী ৩ জুলাই আমাদের অভিযান শুরু হবে। প্রথম দিনের বাহিনী পরিচালনা করব আমি নিজে।’ প্রমাদ গুণল ইংরেজ সরকার। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হলেন সুভাষচন্দ্র। তারিখটা বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ২ জুলাই। কলকাতা, নবাব সিরাজ, ইংরেজ— কার ভাগ্য জড়িয়ে নেই এই তারিখের সঙ্গে। এই দিনের চক্করে কলকাতা নিজের নামটাই হারাতে বসেছিল। আজও দৈবাৎ পুরনো বইপত্র ঘাঁটতে বসলে সামনে চলে আসে সেই নাম... আলিনগর।
সেই ইতিহাস সুভাষচন্দ্রের গ্রেপ্তারি থেকে আরও ১৮৪ বছর আগের। ৯ রজব, ১১৬৯ হিজরি। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ৯ এপ্রিল, ১৭৫৬। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন আলীবর্দী খাঁ মহাবত জঙ-বাহাদুর। এক সপ্তাহের মধ্যেই সিরাজউদ্দৌলা বিনা বাধায় বাংলার তখ্তে বসলেন। প্রথমে কিছুটা প্রশাসনিক সংস্কার। বলা ভালো, বেগড়বাঁই করার সম্ভাবনা থাকা কর্মচারীদের ছেঁটে ফেলা শুরু হল। সিরাজকে সরানোর ষড়যন্ত্র অবশ্য তার আগে থেকে শুরু করে দিয়েছেন বড় মাসি ঘসেটি বেগম। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, মুন্সি নবকৃষ্ণ, রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর, রায়দুর্লভরাও সেই দলে। চক্রান্তকারীদের চিনতে ভুল করেননি নবাব। তাই ঘসেটি বেগমকে মোতিঝিলের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে চলে আসেন নিজের প্রাসাদে। এমনকী সিরাজের দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, ইংরেজরাও নাকি এই চক্রান্তের অংশীদার।
ঘসেটি বেগমের বিশ্বস্ত প্রিয়পাত্র দেওয়ান রাজবল্লভকে আগে থেকেই সহ্য করতে পারতেন না নবাব। তাই মসনদে বসার পরেই তাঁর কোষাগার দখলে ঢাকায় লোক পাঠালেন। কিন্তু অতিশয় চালাক রাজবল্লভ আগেভাগে ছেলে কৃষ্ণদাসকে টাকাকড়ি-ধনরত্ন নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির সর্দার উইলিয়ম ওয়াটসের বদান্যতায় কলকাতার গভর্নর রজার ড্রেকের কাছে আশ্রয় নেন কৃষ্ণদাস। সিরাজও ছাড়ার পাত্র নন। একে ইংরেজদের উপর তিনি খাপ্পা। কারণ, তাঁর মসনদে বসার সময় নবাবি নজরানা দেয়নি ওরা। তার উপর তাঁর অনুমতি না নিয়েই শুরু হয়েছিল কেল্লার সংস্কার। সব মিলিয়ে ক্ষিপ্ত নবাব তখন দূতের মাধ্যমে গভর্নর ড্রেককে বার্তা পাঠালেন— দুর্গ সংস্কার বন্ধ কর। আর, রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণদাসকে পত্রপাঠ মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠাও। কিন্তু কর্ণপাত করলেন না ড্রেক। জবাব এল— কোনওটাই সম্ভব নয়। সিরাজ তখন পূর্ণিয়ার পথে। শওকত জঙ্গকে শায়েস্তা করতে যাচ্ছেন। সেই সময়ই এসে পৌঁছল ড্রেকের জবাব। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সিরাজ। পূর্ণিয়া অভিযান স্থগিত রইল। সসৈন্যে রওনা হলেন কলকাতার উদ্দেশে। প্রথমে কাশিমবাজার কুঠি দখল করে নবাব বন্দি বানালেন ইংরেজ কর্মচারীদের। সেই বন্দিদের মধ্যে অন্যতম ওয়ারেন হেস্টিংস। দিনটা ২৪ মে, ১৭৫৬। সিরাজ যদি এখানে থেমে যেতেন তাহলে বাংলার ভাগ্য হয়তো অন্যরকম হতো। কিন্তু নবাব তো সেই পাত্র নন।
৫ জুন। ত্রিশ হাজার সৈন্যসামন্ত নিয়ে তিনি চললেন কলকাতা দখলে। কোম্পানির মালখানায় কিন্তু তখন বেশি কিছু টাকাকড়ি ছিল না। ডালহৌসি স্কোয়ারে পুরনো কেল্লা— ফোর্ট উইলিয়ামের অবস্থাও তথৈবচ। দেওয়াল নড়বড়ে। বুরুজে জংধরা কতগুলো কামান। নামমাত্র গোলা-বারুদ। আর সৈন্যসংখ্যা? মাত্র ২৭৫ জন। তার মধ্যেও ৭০ জন অসুস্থ, ২৫ জন বাইরে। বাকি ১৮০-র মধ্যে আবার মাত্র চারজন গোরা সাহেব। বাকিরা মেটে-ফিরিঙ্গি। সেনাপতি ক্যাপ্টেন জর্জ জীবনে যুদ্ধ করেননি। দৌত্যের শেষ চেষ্টা করলেন ড্রেক। কিন্তু সিরাজ ততক্ষণে কালনার পথ ধরে হুগলির কাছে। বাহিনী জোগাড়ে নামল নিরুপায় ইংরেজরা। তবে মিলল জনাকতক জাহাজি-গোরা, ফিরিঙ্গি, আরমানি। সব মিলিয়ে ৫১৫ জন, যারা জীবনেও বন্দুক ধরেনি।
ততদিনে কলকাতাজুড়ে রব উঠেছে... সিরাজ আসছে, মহাসব্বনাশ দুয়ারে। শহর ছেড়ে পালানোর ধুম পড়েছে। গোবিন্দ মিত্তিরই শুধু রয়ে গেলেন। ইংরেজরা গোটাকতক কামান নিয়ে গড় বানাল বাগবাজারে পেরিন-সাহেবের বাগানের উত্তর সীমানায়, চিৎপুর ব্রিজের গায়ে। ২৫ জন সৈন্য নিয়ে এডওয়ার্ড পিকার্ড সেখানকার চার্জে রইলেন। তৈরি হল আরও তিনটি ব্যাটারি বা তোপমঞ্চ। একটি লালদিঘির উত্তর-পূর্বে, এখন যেখানে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ। একটি রানি মুদিনীর গলির কাছে, আজকের গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনে। এবং একটি পুরনো কেল্লার উত্তরে, তৎকালীন সেন্ট অ্যান গির্জার কাছে। সেই গির্জা অবশ্য আর নেই।
ততদিনে উমিচাঁদ এবং কৃষ্ণদাসকে কেল্লার গারদে ঠুসে দেওয়া হয়েছে। শোনা গেল, আশপাশের জমিদারদের উপর নবাব কড়া হুকুম, কেউ যেন ইংরেজদের রসদ দিয়ে সাহায্য না করে।
১৫ জুন। হুগলির কাছে গঙ্গা পেরিয়ে এপারে পৌঁছে গেলেন নবাব। যুদ্ধ আসন্ন তা বোঝাই যাচ্ছিল। মাদ্রাজ-কাউন্সিলকে সৈন্য পাঠানোর জন্য চিঠি লেখা হল। কেল্লায় মাসদুয়েকের খাবার জড়ো করল ইংরেজরা। আশ্রয় নিলেন মেমসাহেবরাও। পরদিনই মীরজাফরের নেতৃত্বে চিৎপুরে খালের ধারে পৌঁছে গেল সিরাজের একদল সৈন্য। কিন্তু সেখানেই থামতে হল তাদের। কারণ, পিকার্ড মহাবিক্রমে লড়লেন। পিছু হটলেন মীরজাফর। ফিরে গেলেন দমদমে, নবাবের ছাউনিতে।
প্রথম রাউন্ডে জয় তাতিয়ে দিল ইংরেজদের। নবাবের চিন্তা ততক্ষণে বাড়িয়েছে মারাঠা ডিচ। এমন সময় দেবদূতের মতো এসে উপস্থিত হলেন উমিচাঁদ ঘনিষ্ঠ জগন্নাথ সিং। শহরে ঢোকার দু-দু’টি পথ বাতলে দিলেন তিনিই। তার মধ্যে একটি বর্তমানে টালার কাছে একটি ছোট সাঁকো। অন্যটি শিয়ালদহের কাছে মারাঠা ডিচের উপরকার নিচু সেতু। ব্যস, হাতি-ঘোড়া, ভারী কামান নিয়ে কলকাতায় ঢুকে পড়লেন সিরাজ। ঘাঁটি গাড়লেন হালসিবাগানে উমিচাঁদের বাগানবাড়িতে। ততক্ষণে অবশ্য বউবাজার, বড়বাজারের দিশিপাড়ায় লুটপাট, আগুন লাগাতে শুরু করেছে নবাবি সৈন্যরা।
১৮ জুন, শুক্রবার। ইসলামি মতে শুভ দিন। শুরু হল লালদিঘির যুদ্ধ। খোলা তোপমঞ্চে অধস্তন জেফনায়া হলওয়েলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন ডেভিড ক্লেটন। দেখতে দেখতে শুরু জোরদার লড়াই। ফাঁকা বাড়িগুলির আড়াল থেকে নবাবের সৈন্যের গোলাগুলিতে পিছু হটল ইংরেজরা। ক্যাপ্টেন ক্লেটন তখন কেল্লায় পাঠালেন হলওয়েলকে। বললেন, ‘তুমি গভর্নরকে খবর দাও।’ তিনি ঘুরে আসতে আসতে অবশ্য লালদিঘির যুদ্ধ খতম। নবাবের সেনা এসে কামানগুলি দখল করে সেগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধেই কাজে লাগাল। শিশুদের নিয়ে নৌকায় উঠে পালাতে শুরু করলেন মেমসাহেবরা। পালালেন প্রধান সেনাপতিও।
১৯ জুন। আলো ফুটতে না ফুটতে শুরু হয়ে গেল কেল্লা লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ। ইংরেজ সৈন্যদের আশ্রয়স্থান তখন সেন্ট অ্যান গির্জা। গোলাবারুদ প্রায় শেষ। যে মেমরা তখনও পালাননি, তাদের তুলে দেওয়া হল নৌকায়। সেদলে ভিড়লেন গভর্নর ড্রেক স্বয়ং। তাঁর পরিবর্তে কেল্লার বাকি সাহেবরা মনোনীত করলেন হলওয়েলকে। তিনি অবশ্য ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, এখন লড়াই নয়, সন্ধির সময়।
২০ জুন। রবিবার। ইংরেজদের আর যুদ্ধ করার ইচ্ছে নেই। নবাবের সেনারা তিন দিক থেকে ঘিরে ধরল কেল্লা। হলওয়েল বন্দি উমিচাঁদকে ধরে মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ হল না। কেল্লার ভিতর থেকে গঙ্গায় যাওয়ার ফটক ভেঙে পালায় এক ওলন্দাজ পল্টন। সেই পথ ধরেই ঢুকে পড়ে নবাবি সৈন্য। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন হলওয়েল। যুদ্ধ শেষ। দোলায় চড়ে হাজির সিরাজ। হলওয়েলকে বললেন, ‘এমন সুন্দর শহরটাকে নষ্ট করতে বাধ্য করল তোমাদের ড্রেক। সত্যিই দুঃখ হচ্ছে!’
ততদিনে রাজবল্লভের সঙ্গে নবাবের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। উমিচাঁদ আর কৃষ্ণদাস দু’জনকেই মুক্তি পেলেন। ৫০-৬০ জন সাহেবকে নিয়ে হলওয়েল রয়ে গেলেন কেল্লাতেই। রাতটা অবশ্য সুখে কাটল না। তর্কাতর্কির জেরে কেল্লার গারদখানার মধ্যেই তাঁদের পুরে দিল পাহারাদাররা। অসহ্য গরমে সেই খুপরিতেই প্রায় ৩০ জন দমবন্ধ হয়ে মারা যান। ২১ জুন। হলওয়েল সেই অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে নবাবকে সব জানালেন। পাত্তা দিলেন না সিরাজ। ২৪ জুন। মাত্র ৫০ হাজার টাকা হাতে এসেছে। নবাব তো রেগে আগুন! বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিলেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না! রাগ করে শেষপর্যন্ত কলকাতার আদ্যিকালের নামটা পর্যন্ত তুলে দিলেন তিনি। আলিবর্দীর নামে নতুন পরিচয় দিতে চাইলেন শহরটাকে।
২ জুলাই। মুর্শিদাবাদের পথ ধরলেন সিরাজ। তার আগে নবাবি সিলমোহর পড়ল শহরের নতুন নামে। কলকাতা বদলে গেল আলিনগরে। নতুন শাসক মানিকচাঁদ। বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হল হলওয়েলকে।
হলওয়েল পরে গারদে মৃত্যুর সংখ্যাটাকে শতাধিক বলে দাবি করেন। বাংলার ইতিহাসে সেই ঘটনাই অন্ধকূপ হত্যা নামে কুখ্যাত। সেই গল্পটাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৭৬০ সালে হলওয়েল বানান এক স্মৃতিস্তম্ভ, ব্ল্যাকহোল মনুমেন্ট। পরে অবশ্য তা সরিয়ে দেয় ইংরেজরাই। ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন বড়লাট হয়ে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনেন সেই স্মৃতিস্তম্ভটি। নাম দেন হলওয়েল মনুমেন্ট। গ্রেপ্তার হলেও সেটিকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে ছেড়েছিলেন সুভাষচন্দ্র।
আলিনগরের ইতিহাসের শেষটা অবশ্য করুণ। নামকরণের ঠিক একবছরের মাথায় পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্লাইভ বাহিনীর কাছে পরাজিত হন সিরাজ। ৩০ জুন, ১৭৫৭। দুপুরবেলা রাজমহলের কাছে ধরাও পড়েন। তাঁকে নিয়ে আসা হয় মুর্শিদাবাদে, ক্লাইভের কাছে। সেই রাতে মীরনের নির্দেশে মহম্মদী বেগ নৃশংসভাবে হত্যা করেন বাংলার শেষ নবাবকে। ঘটনাচক্রে সেদিনটাও ছিল ২ জুলাই।
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে