বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

শ্যামাসঙ্গীতের পূজারি
সোমনাথ বসু

১৯৩০ সাল। মে মাসের ৭ তারিখ, বুধবার। প্রচণ্ড গরম। সকাল থেকেই গাছের পাতা স্তব্ধ। কলকাতার আকাশে-বাতাস কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। এন্টালির ৮/১ পালবাগান লেনের বাড়িতে আনচান করছেন কবি। বসন্ত রোগে আক্রান্ত ছেলে বুলবুলের শরীরটা বেশ খারাপ। ডাক্তার, কবিরাজ, বদ্যি—কোনও কিছুই বাদ রাখেননি তিনি। কিন্তু ক্রমশই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে বছর আটেকের বুলবুল। বিকেলের দিকে একজন বললেন, ‘দমদমের কাছে এক সাধু থাকেন। বসন্তে আক্রান্ত রোগীদের তিনি সুস্থ করে তুলছেন।’ দেরি না করেই কবি সেখানে পাঠালেন দুই সঙ্গী মইনুদ্দিন ও শান্তিপদ সিংহকে। কাতর কণ্ঠে আবেদন তাঁর, ‘যে করেই হোক একবার তাঁকে নিয়ে আসুন।’ তিনি এলেন, তবে তখন রাত অনেক হয়েছে। শান্তিপদর ডাক শুনে দৌড়ে এলেন কবি। দরজা খুলেই মইনুদ্দিনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে অশ্রুসজল চোখে নজরুল বলে উঠলেন, ‘ওরে, তোর সাধু কি মরদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে?’ একবার নয়, দু’বার নয়। বারবার একই কথা বলে চলেছেন কবি। বাকিরা বিহ্বল। সাধু আসার মিনিট দশেক আগেই বুলবুলের মৃত্যু হয়। স্বাভাবিকভাবেই এরপর ভেঙে পড়েন নজরুল। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, পুত্রশোক কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এর ঠিক মাস তিনেক পরে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মুর্শিদাবাদের লালগোলা বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদারের সঙ্গে। তিনি তন্ত্রসাধক, কালীভক্তও বটে। এই পর্বেই ক্রমশ মা কালীর ভক্ত হয়ে পড়েন নজরুল। অসুস্থ স্ত্রী প্রমীলা কাজির জন্য কলকাতার একাধিক মন্দির থেকে তিনি প্রসাদী ফুল সংগ্রহ করেছেন। জানা যায়, সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নজরুলের আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকত কালী সাধনা।
তিনের দশকের প্রথম দিকে নজরুলের ভালোবাসার বৃত্তে ঢুকে পড়ে রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত। আপন খেয়ালে তিনি কণ্ঠে তুলে নেন ‘অপার সংসার, নাহি পারাবার’ এবং ‘মন রে, কৃষিকাজ জানো না’। বরদাচরণই কবিকে এই সময় রামপ্রসাদের একটি বই উপহার দেন। তা পড়ে কালী সাধনার প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরও বাড়ে। লিখতে শুরু করেন শ্যামাসঙ্গীত। 
শোনা যায়, ভোররাতের স্বপ্নে মা কালীকে কন্যারূপে দেখেন নজরুল। তারপরই ভেঙে যায় ঘুম। ধড়পড় করে উঠে বসেন কবি। কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর মিলেমিশে একাকার কালি, কলম, মন। গানটি কী জানেন? ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’। খুব ভালো করে গানটি পড়লে বা শুনলে বুঝবেন, আবেগের সঙ্গে কবির ভক্তির ভারসাম্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একইরকম। এই গানেই তিনি লিখেছেন, ‘পাগলী মেয়ে এলোকেশী নিশীথিনীর দুলিয়ে কেশ, নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার রে তার নাইকো শেষ/সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক ঠিকরে পড়ে রূপের মানিক, বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না, মা আমার তাই দিগ্‌-বসন’। অর্থাৎ, মায়ের কন্যা এবং মাতৃরূপকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অনবদ্য শব্দবন্ধে। দর্শন এবং তত্ত্বের বেড়া ভেঙে মা কালী প্রতিভাত হয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর চেতনায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রধানত তিন ধরনের। প্রথম পর্বে কন্যা এবং মাতৃরূপে মা কালীকে তিনি শব্দ ও সুরের সংমিশ্রণে পুজো করেছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবির মনে হয়েছে, মা অশুভনাশিনীও বটে। হালিশহরের সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের পর নজরুলই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ২৪৭টি শ্যামাসঙ্গীত লিখেছিলেন। আর তাঁর গানের ইউএসপি? ভাব ও ভাষায় সহজ থাকা। তাই তো তাঁর কলম দিয়েই বেরিয়েছে, ‘মোর লেখাপড়া হ’ল না মা, আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা, আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে নাচি দিয়ে করতালি।’
নজরুল ইসলামের জীবনের দরজায় বারবার কড়া নেড়েছে দুঃখ-যন্ত্রণা। তবে ভেঙে পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছেন কবি। বিভিন্ন সমালোচনা গায়ে না মেখে স্বতন্ত্র পথে এগনোই ছিল তাঁর দর্শন। খ্যাতির দৌড়ে নিজেকে রাখতে চাননি কখনও। সাধের বাংলাদেশের বেতারেও একসময় তাঁর শ্যামাসঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়েছিল। একবুক অভিমান নিয়ে ঘনিষ্ঠদের বলতেন, ‘জানি, আমার শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারি না। পয়সাওয়ালাদের তাঁবেদারি করা স্বভাবে নেই। রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে নিয়েই জীবন আমার। অসাধারণ হওয়ার জন্য সাধারণকে ভোলা অসম্ভব।’
জীবনের মাঝপথে প্রায়শই ভক্তিভাবে টলমল করতেন কবি। পদস্খলনের আশঙ্কা ভুলিয়ে তাঁকে সহযোগিতার দু’হাত বাড়িয়ে দেয় কালী সাধনা। এমনই এক সন্ধ্যায় ‘মা, মা’ বলতে বলতে অক্লেশে লিখে ফেলেন, ‘ভক্তি, আমার ধূমের মত, ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত/শিব-লোকের দেব-দেউলে মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।’
পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য নজরুল কলম ধরেছিলেন। এই পর্বেও মা কালী তাঁর সৃষ্টিতে বারবার এসেছেন। মহাশক্তির কাছে কবি ‘দীনতা ভীরুতা লাজ গ্লানি’ ঘোচানোর মন্ত্র চেয়েছেন। এই সময় তাঁর একাধিক শ্যামাসঙ্গীতে সমকালীন নিপীড়িত ভারতের ছবিও ফুটে উঠেছে। অসুর বিনাশিনী দিগবসনা মা কালীর কাছে শক্তি ভিক্ষা করে তিনি দেশবাসীকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হতে বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে নজরুলের মন্তব্য, ‘এক মায়ের কাছে আরেক মায়ের স্বাধীনতা ভিক্ষার মধ্যে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। এটা তো জীবনের তাগিদ। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের চেতনাও মুক্ত হবে। কতদিন আর কারাগারের শিকলে মাকে বন্দিদশায় দেখব?’
জীবনের গোধূলি পর্যন্ত আদরের বুলবুলকে ভুলতে পারেননি কবি। কখনও মনে হয়েছে, মা কালীই হয়তো ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দেবেন। এরকম ভাবনা থেকেই  তিনি একদিন লিখে ফেললেন, ‘এই শ্মশানে ঘুমিয়ে আছে/ যে ছিল মোর বুকের কাছে,/ সে হয়ত আবার উঠবে জেগে মা ভবানীর নাম-গানে।’

28th     May,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা