হালখাতা, মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার। ত্রিবেণী সঙ্গমে হাঁটি হাঁটি পা পা নববর্ষের। চাহিদা তুঙ্গে সদ্য ছাপা পঞ্জিকারও। কিন্তু কী প্রয়োজন? ফাঁস করলেন কলহার মুখোপাধ্যায়
আজ পুঁইশাক খাওয়া যাবে না। কাল বেগুন খাওয়া নিষেধ। হাবিজাবি কোনও নিষেধাজ্ঞা ভেবে কিন্তু উড়িয়ে দিলে হবে না। নিষেধ আছে শাস্ত্রে। হেসে গড়িয়ে পড়লেই তো হল না, আজকালকার ছেলেমেয়েদের এই দোষ... সবকিছু নিয়ে শুধু ঠাট্টা! সন্দেহ থাকলে পাঁজি খুলে দেখে নিন। শুনে চোখ ছানাবড়া? কিচ্ছুটি করার নেই। হ্যাঁ, পঞ্জিকা বা পাঁজির কথাই হচ্ছে। বাংলার বাজারে ২০০ বছর ধরে যে বই বেস্ট সেলার, সেই পাঁজি! ফি বছরের মতো এবারও কোন কোন দিন কী কী খেতে নেই, ঠিক করা হয়ে গিয়েছে। এ বছরের পাঁজি ছাপা শেষ। ছেয়ে গিয়েছে দোকানে দোকানে। একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই আপনি সবজান্তা!
খাওয়া, না খাওয়া শুধু নয়। সর্বদা ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ঠাট্টা করা স্বভাব যাঁদের, তাঁদের তো আবার চাকরির পরীক্ষায় জেনারেল নলেজটা লাগে। তা বলুন দেখি, জাতীয় অধ্যাপক বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রয়াণ দিবস কবে? মনে নেই! পাঁজিতে গোটা গোটা করে লেখা আছে দিনটা। শুধু সত্যেন্দ্রনাথ নয়, বাংলার প্রাতঃস্মরণীয় সব মনীষীর জন্মমৃত্যুর খতিয়ান মিলবে পাঁজি খুললেই। আচ্ছা বদ্রীনাথ ধাম বা জগন্নাথ ধাম কলকাতা থেকে কত দূরে? কোন কোন ট্রেন সেখানে যায়? তাও আছে পাঁজিতে। ওষুধ না খেয়ে শুধুমাত্র ধ্যান করে ব্রেন স্ট্রোক সারানোর উপায়ও রয়েছে। এসব কিছু আবার দেখেন না হাল ফ্যাশনের বাবুরা। তবে বাড়িতে পাঁজি ঢোকা মাত্রই হামলে পড়ে ব্যক্তিগত লগ্নফলটা কিন্তু পারলে গিলে খেয়ে নেয়। ভাগ্য জানার আগাম ফিকিরও কম নয়। বার্ষিক নক্ষত্রফল মুখস্থ করে তবে ছাড়ে। এদিকে কোনওদিন মাংস খেতে বারণ পড়লে হেসে গড়ায়। আদিখ্যেতা যত্তসব!
এরপর যদি জানাতে চাই, ‘বৈদিক যুগে বছরকে বারো ভাগে ভাগ করেছিলেন ঋষিরা—তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, ঊর্জ, সহস্ ও সহস্য। তপঃ থেকে শুচি পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং নভস্ থেকে সহস্য পর্যন্ত দক্ষিণায়ণ। তিথির প্রচলন হয় অনেক পরে। কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে গণনা করে ২৭-২৮টি নক্ষত্রে বিভক্ত করা হতো। এটাই পঞ্জিকা গণনার আদিরূপ...’ এসব শোনাতে থাকলে তেড়ে মারতে আসবে সবাই। ‘এসব শুনতে চেয়েছি কি আমরা? খালি বাজে বকা। কাজ নেই কোনও।’ এসব বলে দু-চার ঘা কষিয়ে দিলেই বিপদ। চুপ করে যাওয়াই ভালো। তবে এটাও ঠিক, এককালে পঞ্জিকার যে একটা রসসিক্ত ব্যাপার ছিল, তা হাল আমলে খুঁজে পাওয়া ভার।
যেমন, বশীকরণ থেকে রতিকান্ত বটিকা সহ সচিত্র বিলাতি গুপ্তকথা। পরম কল্যাণকর রতিবর্ধক বটিকা ও শ্রীগোপাল তৈল। এসবের হাত ধরে এল গনোরিয়ার ওষুধ। মহিলাদের আকর্ষণীয় দেখাতে গোলাপকুসুম, গন্ধতেল, কুন্তলবাহার, কেতককুসুম তেল। স্নো-পাউডার। কেমিক্যাল গহনা থেকে শিশুদের ওষুধ। চাষের বীজ-সার, চশমা, বন্দুক, বাঁশি, কবিরাজি সালসা। মায় বাংলা উপন্যাস। সবকিছুর সচিত্র বিজ্ঞাপন ছিল পাঁজির আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মিলত ইলেকট্রিক সলিউশন সেবনে স্বাস্থ্য উদ্ধারের উপায়ও। তবে তিথি-নক্ষত্র-বার-ক্ষণ জানতে পাঁজি ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। সেই নির্ভরতা অবশ্য এখনও প্রায় একইরকম।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার কর্ণধার সুপর্ণ লাহিড়ী বলেন, ‘বিয়ের তিথি জানতে এখনও একমাত্র ভরসা পাঁজি। চাহিদার কারণে এখনও বছরে একাধিকবার রি-প্রিন্ট করাতে হয়।’ গুপ্ত প্রেসের কর্ণধার অরিজিৎ রায়চৌধুরীর কথায় , ‘ডিজিটাল ফরম্যাটে আসার পর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশেও পাঁজির চাহিদা বাড়ছে।’ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সম্প্রতি পঞ্জিকার পকেট সংস্করণ বের করেছে গুপ্ত প্রেস। বর্তমানে বিশুদ্ধ ও গুপ্ত প্রেস ছাড়াও পিএম বাগচি, বেণীমাধব, পূর্ণচন্দ্র শীল, মদন গুপ্তের পঞ্জিতার চাহিদাও প্রবল। বাংলায় পাঁজির ইতিহাস মোটামুটি দুশো বছরের পুরনো। ১৮১৮ সালে প্রথম মুদ্রিত হয় পঞ্জিকা। ১৮০৭ সালে তুলট কাগজে হাতে লেখা পঞ্জিকার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। তারও ৮০ বছর আগে তালপাতায় লেখা পাঁজির সন্ধানও মেলে।
তাহলে সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল?
কবে একাদশী? দুর্গাপুজোর নির্ঘণ্ট কী? কালীপুজো কবে? সরস্বতী, লক্ষ্মী, মনসা, শীতলাপুজো ক’টায় পড়ছে? অশোকষষ্ঠী কোনদিন? বাড়ির ভিতপুজো হবে, তিথি অনুযায়ী শুভক্ষণ কখন? অন্নপ্রাশন বা উপনয়ন কোনদিন করলে শুভ? সব উত্তর পেটে নিয়ে বসে আছে বাঙালির পঞ্জিকা। হাতে পাঁজি থাকলে আর কোনও মঙ্গলবারের অপেক্ষা নয়। সব উত্তর থাকে ঠোঁটের গোড়ায়। হরেক প্রশ্নের এক তুড়িতে সমাধান বলেই প্রায় ২০০ বছর ধরে বঙ্গজীবনের আস্থা ও ভরসার অপর নাম একটাই—পঞ্জিকা। বাঙালির ‘অ্যালেক্সা’।