বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

ইতিহাস বদলের নেশা ভয়ঙ্কর
 

আকবর সিংহাসনে বসেছিলেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ঠিক ৩০০ বছর পর তাঁর বংশধরদের ভাগ্যে কী ঘটল? আকবরের মৃত্যুর তিন বছর পর, ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ আগস্ট ‘হেক্টর’ নামক একটি জাহাজে চেপে ভারতের সুরাত বন্দরে পা রেখেছিলেন উইলিয়ম হকিন্স নামক এক নাবিক ও একটি সংস্থার কমান্ডার। সেই প্রথম ভারতে আসা ওই কোম্পানির, যাদের প্রবল ইচ্ছা এই দেশে ব্যবসা করার। অনুমতি পেতে সম্রাট জাহাঙ্গিরকে খুশি করতে হবে। হকিন্স যেখানে চাকরি করতেন আর যাদের জাহাজে তিনি এসেছিলেন, সেই সংস্থার নাম— ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি! বাবরের স্বপ্নের সাম্রাজ্য ধ্বংসের প্রধান কারিগর! 
মে, ১৮৫৭। হঠাৎ কমবেশি ৩০০ সিপাহি দিল্লিতে ঢুকে পড়েছে। মিরাট থেকে রাজধানীতে এসেছে তারা। বিদ্রোহ করেছে ইংরেজের বিরুদ্ধে। সামনে কোনও বিদেশিকে পেলেই হত্যা করছে এই সিপাহিরা। আর অগ্রসর হচ্ছে লালকেল্লার দিকে। আপাতত লালকেল্লাই মুঘল সাম্রাজ্য। তার বাইরে আর সবই ইংরেজের দখলে। সিপাহিরা এসে ঘোষণা করে দিল তাদের নেতা, সেনাপতি হলেন সম্রাট স্বয়ং। অর্থাৎ বাহাদুর শাহ জাফর। গালিব আর জৌকের শের শায়েরি শোনা ছাড়া যাঁর আর কিছু করার অধিকারও নেই। সিপাহিদের এই ঘোষণায় সবথেকে হতচকিত তি঩নিই। সিপাহিরা দখল করে রাখল দিল্লি। ইংরেজরা যথেষ্ট আতঙ্কিত। কিন্তু কতদিন? এদের কাছে না আছে পর্যাপ্ত টাকা। না আছে অস্ত্র। অতএব সরঞ্জাম ও রসদ দুই-ই ফুরিয়ে গেল দ্রুত। 
১৪ সেপ্টেম্বর। শিখ আর পাঠান বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজ সেনা একজোট হয়ে ঢুকে পড়ল দিল্লিতে। রাজধানীর বুকে নতুন করে ধ্বংসলীলা শুরু। কাচ্চা চালান নামক শুধু একটি মহল্লায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। শ্মশান হয়ে যায় দিল্লি। বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরকে শুধু যে বন্দি করা হয়, তা-ই নয়। তাঁকে জন্তুর মতো বন্দিশালায় সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। মানুষ এসে এসে যাতে দেখতে পায় তাদের সম্রাটের অবস্থা। মুঘল সম্রাটের সন্তানদের নগ্ন করে হাঁটায় ইংরেজরা। প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে অথবা গুলি করে হত্যা করা হয় একের পর এক শিশু, কিশোর, যুবককে।
এককালের মহাশক্তিধর মুঘল সাম্রাজ্যের শেষতম বংশধরদের অন্যতম বাহাদুর শাহ জাফরের দুই সন্তান মির্জা আবদুল্লা এবং মির্জা কোয়ায়েশকে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল হুমায়ুন টুম্বে। এক শিখ প্রহরী এই দুই ভাইকে দেখে জানতে চাইল, ‘তোমরা এখানে কী করছ?’ 
তারা কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘সাহেব আমাদের এখানে থাকতে বলেছে।’
 শিখ প্রহরী বলল, ‘মাথা খারাপ নাকি! সাহেব ফিরে এসে তোমাদের মেরে ফেলবে। যেখানে পারো পালাও। এখনই যাও। কোথাও দাঁড়াবে না।’ 
জেনারেল হডসন এসে ওই শিখ প্রহরীকে দেখে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার ওরা কোথায় গেল?’ প্রহরী বলল, ‘আমি জানি না তো! কারা?’ হডসন পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করেও পেল না। কোথায় গেল দু’জনে?
 মির্জা কোয়ায়েশ সব চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে, সাদা চাদর পরে ফকির সেজে পৌঁছেছিলেন উদয়পুরে। এক হিজরার দয়ায় মহারাজার কাছে দৈনিক এক টাকা ভাতা আদায়েও সমর্থ হন তিনি। আর এভাবেই ফকির সেজে রয়ে যান পরবর্তী ৩২ বছর। আর তার অন্য ভাই মির্জা আবদুল্লা রাজস্থানেরই টঙ্ক শহরে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেছিলেন। ওই ভাবেই মৃত্যু হয় দু’জনের, যাঁদের পূর্বপুরুষের নাম ছিল বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব...। ইতিহাস এরকমই নির্মম। সে ভালো কিংবা খারাপ হয় না। সে হয় নিরাসক্ত এক ধারাবিবরণীকার। 
কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাক্রম থেকে এই তাবৎ ইতিহাস মুছে দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের কেন্দ্রীয় সিলেবাসে আর থাকবে না মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাহলে কী ঘটেছিল ভারতে? দিল্লিতে? আগ্রায়? রাজস্থানে? বাংলায়? বিহারে? লখনউয়ে? এই চরিত্রগুলি কি আদৌ ছিল কেউ? নাকি এই ৩৩১ বছর ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে ভারত চলে গিয়েছিল এক গভীর নিদ্রায়? স্যর টমাস রো তাহলে সুরাতে কারখানা করার একটা লাইসেন্স আদায় করে নিয়েছিলেন কার কাছ থেকে? সেই লাইসেন্সই তো একদিন রাজদণ্ডরূপে দেখা দেবে! তবে কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বলেও কিছু ছিল না? ভারতের ইতিহাসহীন, গৌরবহীন, সাফল্যহীন, ব্যর্থতাহীন, নিষ্ঠুরতাহীন, ধর্মহীন এই শূন্যকালের নিদ্রা তাহলে কবে ভাঙল? ২০১৪ সালে? 
কেন এই সিদ্ধান্ত? কারণ, বিজেপির আদর্শ গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) শিক্ষায়। যাঁদের নীতি ও আদর্শের আর প্রধান চালিকাশক্তি একটি বিশেষ গ্রন্থ। ‘হিন্দুত্ব’। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত। লেখক দামোদর বিনায়ক সাভারকর। ঠিক দু’বছর পর কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার গঠন করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ‘হিন্দুত্ব’ নামক গ্রন্থের সারকথা কী? হিন্দুত্ব কোনও ধর্ম নয়। এটি একটি জাতি। ভারতে বসবাসকারী প্রত্যেকের রক্তে হিন্দুত্বের জিন। আরএসএসের তাই প্রধান লক্ষ্য হল হিন্দুরাষ্ট্র গঠন। এই লক্ষ্য নিয়ে কোনও আপস নেই আরএসএসের। আর তাই মুঘল অথবা ব্রিটিশ, যে কোনও বিদেশি সংস্কৃতিই হল হিন্দুত্বের পরিপন্থী। আরএসএস মনে করে হিন্দুত্বের নিছক একটি শাখা হিন্দু ধর্ম। প্রত্যেক ভারতবাসী হিন্দুত্ববাদী এবং হিন্দু জাতির। সে যে ধর্মই পালন করুক না কেন! হিন্দুত্বকে স্বীকার করতেই হবে। আর তাই স্বাভাবিকভাবে হিন্দুত্ব যাদের রক্ত ও শিরায়, তারাই প্রকৃত ভারতবাসী। এই হল ফরমুলা। আর তাই ইতিহাস বদলে দেওয়ার ফরম্যাট। শুধুই কেন মুঘল অথবা মুসলিম সভ্যতা পড়ানো হবে? ভারতের নিজস্ব সভ্যতার ইতিহাসই পড়তে হবে। এটাই দাবি তাদের। আর তাই ইতিহাস বদলের শুভারম্ভ। 
ঠিক এখানেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। মুঘলদের পাশাপাশি নাথুরাম গডসের গান্ধীহত্যা কিংবা আরএসএসকে যে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলই নিষিদ্ধ করেছিলেন, সেই অধ্যায়গুলিও বাদ দেওয়া হয়েছে নয়া সিলেবাসে। অথচ নাথুরাম গডসে নিজে ছিলেন চরম আরএসএস বিরোধী। একটা সময় সঙ্ঘের সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু তারপর একদিন হঠাৎ রেগে সদস্যপদ ছেড়েও দেন। এমনকী আরএসএসকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, ওরা হিন্দুদের নপুংসক হিসেবে তৈরি করছে। কেন? কারণ, সংস্কৃতি ও চরিত্র গঠনে আরএসএস যে ভূমিকা ও ব্রত নিয়েছিল, নাথুরাম মনে করতেন তা আদতে দুর্বলতা। ১৯৩৯ সাল থেকে অগ্রণী পত্রিকায় নাথুরাম লাগাতার লিখে এসেছেন যে, আরএসএস হিন্দুদের মধ্যে থেকে আগ্রাসী, যোদ্ধা মনোভাবকে ধ্বংস করে দিয়েছে। 
সেই নাথুরাম যখন মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে, তখন আরএসএসের অন্যতম প্রধানত চিন্তাবিদ এম এস গোলওয়ালকর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এরকম জঘন্য মনোবৃত্তির এক ব্যক্তি যে আমাদের দেশেরই নাগরিক, এটা আমাদের কাছে আরও বড় এক যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে। মহাত্মা গান্ধীর মতো এক মহাপ্রাণ মানবিকতার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদিত করেছিলেন। তাঁকে হত্যা করা শুধু তাঁর প্রতি নয়, গোটা দেশের প্রতি এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা।’
আরএসএসের প্রথম যুগের সরসঙ্ঘচালক যাঁকে চরম বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়েছেন, সেই নাথুরাম গডসের গান্ধীহত্যাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার কারণ কী?
 ইতিহাস বদলের নেশায় এটাই হয়। একসময় নিজের অজান্তে, নিজেদের ইতিহাসও বদলে দেওয়া হয়! 
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
 সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়

9th     April,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা