কোম্পানি পরিচালনা করতে গিয়ে হেনরি ফোর্ডের তো চক্ষু চড়কগাছ! তাঁর মনে হল, এ কী! ইহুদিদের জায়োনিষ্ট জাল অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরছে গোটা দুনিয়াকে! ইহুদিদের তুলোধনা করা শুরু করলেন আমেরিকার বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।
১৯১৯ সালে প্রকাশ করলেন নিজের পত্রিকা ‘দ্য ডিয়ারবর্ন ইনডিপেনডেন্ট’। মাত্র পাঁচ বছরে সেই পত্রিকার সার্কুলেশন গিয়ে দাঁড়ায় ৯ লক্ষ। পত্রিকায় ৯১ পর্বের কলামে ফোর্ড ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরলেন বিশ্বের ইহুদি নেটওয়ার্ক। লিখলেন, ‘ইহুদিরা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মেশে না কারো সঙ্গে। তারা লোভী, প্রতারক। আবার তাদের হাতেই অর্থ, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা।’ ফোর্ড-এর কলামগুলি নিয়ে রাতারাতি চার খণ্ডের বই বাজারে চলে এল। বইয়ের নাম ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল জিউ।’ আমেরিকা থেকে কয়েকদিনের মধ্যেই সব বই হাওয়া। বিশ্বব্যাপী তুমুল হইচই। প্রতিবাদ শুরু করল ইহুদিরাও। পত্রিকার বিরুদ্ধে উঠল সম্প্রীতি নষ্টের উস্কানির অভিযোগ। ১৯২৭ সালে বন্ধ হয়ে গেল ফোর্ডের পত্রিকা এবং আলোচিত সেই বই। ততদিনে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল জিউ’-র এক কপি পৌঁছে গিয়েছে হিটলারের কাছেও। সেই বই পড়ে হিটলার তো মন্ত্রমুগ্ধ। বইটির ঠাঁই হয় তাঁর বিছানা লাগোয়া টেবিলে। নাৎসিরা ফোর্ডকে দেয় রাষ্ট্রীয় সম্মান— জার্মান ঈগল। যা কোনও অ-জার্মানকে কখনও দেওয়া হয়নি।
কারাবাসের সময় হিটলার যে আত্মজীবনী লিখেছিলেন, তার নাম মাইন কাম্ফ। সময় ও সুযোগ পেলে তিনি কী করতে চান তার নিখুঁত নিশানা দিয়েছিলেন প্রায় ছ’শো পাতার এই কেতাবে। ইতিমধ্যে ইহুদি-বিদ্বেষী ইতিহাসবিদ কার্ল ভন ম্যুলারের ‘মহাযুদ্ধের রাজনৈতিক ইতিহাস’, ‘মধ্যযুগ-পরবর্তী জার্মান ইতিহাস’ ইত্যাদি বক্তৃতায় মুগ্ধ তিনি। আর আছেন অর্থনীতিবিদ গটফ্রিড ফিডার। যিনি ইহুদি কার্ল মার্ক্সকে নস্যাৎ করে তত্ত্ব খাড়া করেন: পুঁজি দু’রকম। উৎপাদনমূলক আর আগ্রাসী। ইহুদি পুঁজি দ্বিতীয় রকম। যেমন ইতিহাস, তেমনই অর্থনীতি। সেই পাঁচন গিলেছেন হিটলার। তাতে মিশেছে ব্যর্থ রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর প্রতিহিংসা। হেনরি ফোর্ডের সুরে তাল মিলিয়ে হিটলার লিখলেন, এক হাজার বছর ধরে এরা ইউরোপে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে এখানে ওখানে বিচরণ করছে। তাদের নিজস্ব কোনও সংস্কৃতি-শিল্প-সভ্যতা কিছুই নেই। এরা বাস করে সর্বত্র। আর ভব্য ইউরোপীয় সভ্যতার শাঁসটুকু শুষে খায়। তাদের নিজের কোনও দেশ নেই। মনে প্রাণে ভালোবাসে না বা আপন মনে করে না কোনও দেশকে। এ দেশে তারা উত্তমরূপে জার্মান ভাষা শিখে জার্মান সাজার চেষ্টা চালিয়েছে। শিক্ষা দীক্ষার সুযোগ নিয়েছে পুরো দস্তুর, যদিও তাদের রক্তে বিন্দুমাত্র জার্মান সংস্কৃতি নেই। সেটা তাদের মুখোশ মাত্র...
ইহুদি জাতিটাকে একেবারে মুছে ফেলার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা অ্যাডলফ হিটলার যে জার্মানির একচ্ছত্র শাসক হওয়ার পরে শুরু করেছিলেন, তা নয়। বরং যখন তাঁর বয়স মেরেকেটে তিরিশ, সেই সময় থেকেই এই গণহত্যার ছক ঘুরছিল তাঁর মাথায়। ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জনৈক গেমলিচকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যুক্তিভিত্তিক বিদ্বেষে ভর করেই ইহুদিদের অধিকার শেষ করার পথে যেতে হবে। অনার্য ইহুদিদের চূড়ান্ত অবলুপ্তি ঘটানোটাই চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত।’ চিঠি বলতে এটুকুই। বাকি ইতিহাস লিখতে তারপর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের অভাব হয়নি।
১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাবনার ভয়ঙ্কর বাস্তবায়ন শুরু করলেন হিটলার। গোটা দুনিয়া দেখল, নাৎসি জার্মানির সেই কুখ্যাত ‘ফাইনাল সলিউশন।’ ইহুদি জাতটাকে একেবারে মুছে দিতে হবে। হলোকস্ট। কেন? কারণ, হিটলার, মনে করেন যে ‘খারাপ’ ইহুদি জাতটা আর্য জার্মানদের দূষিত করছে। সেই সময় হিটলারের মতো অসংখ্য জার্মান নাগরিক মনে করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির আর্থ-রাজনৈতিক সঙ্কটের এক বড় কারণ ইহুদিরা। যদিও হিটলারের তখন অনেক বেশি আতঙ্ক ছিল কমিউনিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নাৎসি বিরোধিতা নিয়ে। এই রাজনৈতিক শত্রুদের খতম করতেই ১৯৩৩ সালের ২২ মার্চ প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল জার্মানির দাচাউতে। দায়িত্বে অ্যাডলফ হিটলারের ডান হাত। হলোকস্টের অন্যতম মস্তিষ্ক। নাৎসি প্রশাসনের দ্বিতীয় শীর্ষ কর্তা— হেনরিখ হিমলার। তাঁকে নাকি হিটলার নিজে এক বড়দিনের পার্টিতে পুতুল আর চকোলেট উপহার দিয়েছিলেন।
১৯৩৫ সালে নুরেমবার্গ জাতি আইন জানিয়ে দিয়েছিল, প্রত্যেক জার্মানকে প্রমাণ করতে হবে তার শিরায় কতটা ইহুদি রক্ত মিশে রয়েছে। বংশের চার প্রজন্মে ইহুদি ছোঁয়া হলেই বিপদ। জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল। সেনাবাহিনীতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। একান্ত অবাঞ্ছিত। নাগরিকত্ব কেন, সাধারণ সামাজিক অধিকারও মিলবে না। যদিও হিটলারের অন্যতম বিশ্বস্ত সহকারী হেরমান গোয়েরিং বলেছিলেন, কে ইহুদি কে নয় সেটা আমি ঠিক করি! প্রয়োজন বুঝে।
দাচাউ বন্দি শিবিরটি ছিল দক্ষিণ জার্মানির বাভারিয়ায় দাচাউয়ের উত্তর-পূর্বে। একটি পরিত্যক্ত অস্ত্র কারখানায়। আসলে দাচাউ ছিল অন্যান্য কনসেনট্রশন ক্যাম্পের মডেল। দাচাউ ক্যাম্পটি থেকেই জার্মানির অন্যান্য ক্যাম্পগুলির প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করা হতো। দাচাউ মানে তখন নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, নজিরবিহীন বর্বরতার আর এক নাম। নাৎসিদের পরীক্ষাগার। রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকাংশই ছিলেন ইহুদি কিংবা ক্যাথলিক পুরোহিত। প্রতিদিন মানুষ খুনের জন্য নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার করত নাৎসিরা। মানুষ মারার জন্য সায়ানাইড-যুক্ত জিকলন-বি ব্যবহার হতো। এই বিশেষ ধরনের কীটনাশক দিয়ে দেওয়া হতো ব্যারাকের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট স্ফটিকের টুকরোর মতো জিনিসগুলি পরিণত হতো ভয়ঙ্কর গ্যাসে। একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য পাগলের মতো করত মানুষগুলি। সেই চিৎকার ছড়িয়ে পড়ত গোটা ক্যাম্পে। যন্ত্রণায় ফেটে পড়ত ফুসফুস। আর পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ত ‘এসএস’ (গেষ্টাপো) গার্ডরা।
ক্যাম্পে প্রতিদিন ‘রোল কল’ হতো ভোর চারটেয়। তারপর টানা বারো ঘণ্টা কাজ করতে হতো বন্দিদের। ক্লান্ত হয়ে কেউ কাজ থামালে তাকে উলঙ্গ করে হাত পিছনে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। কখনও গুলি করে মেরে ফেলা হতো সবার সামনেই। এ ছাড়া বাইরে বরফের মধ্যে গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো, যাতে সারা রাত আস্তে আস্তে শরীরটা ঠান্ডায়় জমে ইটের মতো হয়ে যায়। দিনের পর দিন জানালা বিহীন অন্ধকার ঘরে খাবার না দিয়ে রেখে দেখত যে তিলে তিলে মরতে কত দিন সময় লাগে! একটা সময় গোটা জার্মানিতে একটি জিঙ্গেল ছড়িয়ে পড়েছিল: লিবার হের গট, মাচ মিচ স্টাম, দাস ইচ নিচ নাচ দাচাউ কম। যার অর্থ, প্রিয় প্রভু ঈশ্বর, আমাকে বোবা করে দিন, যাতে আমাকে দাচাউতে না যেতে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষকে কাবু করতে নিত্য নতুন আবিষ্কারের ফন্দি এঁটেছিল হিটলারের জার্মানি। একদিকে রাসায়নিক বোমা বানানোর ফর্মুলা নিয়ে মেতেছিলেন একদল বিজ্ঞানী। সঙ্গে কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণাও। এ জন্য গবেষণাগারও তৈরি করেছিল নাৎসি বাহিনীর সামরিক-শাখা বাফেন-এসএস। সব জায়গা বাদ দিয়ে নাৎসিরা বেছে নিয়েছিল কুখ্যাত দাচাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প চত্বরই। শুধু রাসায়নিক যুদ্ধের গণ্ডিতে বিশ্বযুদ্ধকে বেঁধে না রেখে কীভাবে তাকে জৈব-যুদ্ধে পরিণত করা যায়, তলে তলে সেই চেষ্টাই হচ্ছিল। বোমার বদলে যদি থাকে এক ঝাঁক মশা! গুলি-বোমা-গ্রেনেডের পাল্টা হাতিয়ার পালে পালে মশার কামড়। একবার হুল ফোটালেই নির্ঘাৎ ম্যালেরিয়া। এই সদ্য আবিষ্কৃত জৈব অস্ত্র দাচাউ ক্যাম্পের ইহুদিদের উপর প্রয়োগ করা যেত সহজেই। দায়িত্বে অধ্যাপক শিলিং। যদিও পরে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়েছিল খোদ শিলিংকেই।
ক্রুর্ট ল্যান্ডউয়ার ছিলেন বিখ্যাত বায়ার্ন মিউনিক ফুটবল ক্লাবের একেবারে প্রথম যুগের সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্ট। ১৯১৩ সালে ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দেশের হয়ে লড়াই করতে চলে গিয়েছিলেন। চার বছর পর ফিরে এসে আবার ক্লাবের দায়িত্বে। ১৯৩২ সালে বায়ার্ন যখন প্রথম ফুটবল লিগ জেতে ল্যান্ডউয়ার তখনও ক্লাব প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ইহুদি হওয়ার কারণে, নাৎসিরা এসেই তাঁকে দাচাউ কনসেনট্রশন ক্যাম্পে পাঠায়। অসামান্য সামরিক রেকর্ডের জন্য ৩৩ দিন পরে মুক্তি পান। বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে সুইজারল্যান্ড পালান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম জার্মানি তাঁকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনে। আবার বায়ার্ন প্রেসিডেন্ট হন ল্যান্ডউয়ার। কিন্তু ল্যান্ডউয়ারের মতো সৌভাগ্য ক’জনের হয়! ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫— এই এগারো বছরে ৩২ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল এই মৃত্যুপুরীতেই। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ইহুদি, বাকিরা রাজনৈতিক বন্দি। বন্দিশিবিরে কখনও কখনও টাইফাস, ডায়েরিয়া মড়কের আকার ধারণ করত। ভোররাতে একবার আর ফিরে এসে রাতে একবার টয়লেট ব্যবহার করার অনুমতি মিলত। দু’বারের বেশি টয়লেটের সুযোগ ডায়েরিয়ার রোগীরও নয়। তাই কাপড়ে চোপরেই মাখামাখি হয়ে যেত মলমূত্রে, সেই কাপড়ই পরে থাকতে হতো। রাতের বেলায় বেগ এলে, খাবারের জন্য যে এনামেলের বাটিটা দেওয়া হয়েছিল, সেই বাটিতেই কাজ সারতে হতো। কারণ, রাতের বেলায় ব্যারাকের বাইরে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। পরদিন সকালে পাঁচ মিনিট সময়ের মধ্যে সেই বাটিই পরিষ্কার করে তাতে সকালের খাবার নিতে হতো। কী বলবেন একে? পৃথিবীর সর্বপ্রথম মৃত্যুর শিল্পায়ন— কিলিং ওন ইনডাস্ট্রিয়াল স্কেল! মিত্র বাহিনী এখানে পৌঁছানোর আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন বন্দিদের গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হতো। পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত বহু দূর। কিন্তু এত বড় মাপের গণহত্যা কতদিন চেপে রাখা যায়। বাতাসেরও কান আছে যে!
সেই পোড়া গন্ধের খোঁজে, যেদিন (১৯৪৫-এর ২৯ এপ্রিল) মিত্র বাহিনী দাচাউ ক্যাম্প ঘিরে ফেলে, সেদিন অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছুই ছিল। যেমন দাচাউ বন্দিশিবিরের প্রবেশ গেট। জার্মান ভাষায় বড় বড় করে লেখা: Arbeit Macht Frei। যার অর্থ— ‘কাজ আপনাকে মুক্তি দেবে।’
হিটলারের ‘আচ্ছে দিন’-এর মূলমন্ত্র বলে কথা!