স্বাধীনতার পর থেকে এপর্যন্ত দেশজুড়ে অবলুপ্ত অন্তত শখানেক ভাষা-উপভাষা। সঙ্কটের মুখে আরও ৩০টি। যে কোনও দিন হারিয়ে যেতে পারে তারা। সেগুলির মধ্যে অন্যতম আমার মাতৃভাষা, টোটো। মাত্র হাজার দেড়েক মানুষের কথা বলার মাধ্যম।
মাদারিহাট ব্লক সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে আমাদের গ্রাম। জঙ্গল, চা বাগান, বনবস্তি, নদী ও পাহাড়ি ঝোরা দিয়ে ঘেরা। হাজার দেড়েক বাসিন্দা। প্রত্যেকেই টোটো ভাষায় কথা বলি। কিন্তু পড়াশোনা বা লেখালিখি সবই হয় বাংলায়। আমার বাবা ও মা কেউই পড়াশোনা জানতেন না। কিন্তু পড়াশোনার গুরুত্বটা বুঝতেন। বাবা সর্বদা আমাদের ভাই-বোনদের বলতেন, ‘তোমরা কেউ এক জন অন্তত পড়াশোনা করো’। আমার এক দিদির পড়াশোনা দ্বিতীয় শ্রেণিতেই শেষ হয়ে যায়। তবে আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। প্রাথমিকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। বাংলা বুঝতে খুব একটা পারতাম না। তবু জেদ ছিল, পড়বই। তার জন্য শেষপর্যন্ত টোটোপাড়া ছেড়ে যেতে হয়। কোচবিহারের জোড়াই-রামপুরে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হই। সেখানে আর এক সমস্যা। রাজবংশী ভাষা পড়তে হয়। তখনও বাংলাটাই ভালোভাবে রপ্ত করতে পারিনি। কিন্তু বিরাট অসুবিধা হয়নি। ওখান থেকে মাধ্যমিকও পাশ করি। তবে রবীন্দ্র মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
দিনহাটার জমাদারবসে ২২ জন ছাত্রকে ২৫০ গ্রাম ডাল ভাগাভাগি করে খেতে হত। দিনে চারটে রুটি পাওয়া যেত, সেটাও খুব পাতলা। ২ কেজি সব্জি ২২ জন ছাত্র মিলে খেতাম চাটনির মতো করে। আর ছোটো শালিমার নারকেল তেলের কৌটোর মতো এক কৌটা চালের ভাত। তাতে পেট ভরতো না। মাধ্যমিকের নিয়মতিভাবে পড়াশোনা আর সম্ভব হয়নি। কাজের খোঁজে নামতে হয়। ঠিক সেই সময়ই কবি শামসুর রহমানের লেখা রুনা লায়লার এই একটি গান ওলটপালট করে দেয় আমার গোটা জীবনের গতিপথ। নাহ্, পুরো গানটা নয়। স্রেফ কয়েকটা লাইন...
‘ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে
ধূ ধূ বালুচরে, পাখিদের নীড়ে
তুমি আমি গাই গানের বর্ণমালা।’
ভুটানের তাদিং পাহাড়ের পাদদেশের আর পাঁচটা লোকের মতো আমারও ছোটবেলা থেকে রেডিও শোনার ভীষণ নেশা। কত যে গল্প, গান, শ্রুতিনাটক শুনেছি, ইয়ত্তা নেই। কিন্তু রুনা লায়লার গানের ‘বর্ণমালা’ শব্দটি আমাকে কেমন যেন পাগল করে দিয়েছিল। মনের ভিতরে খচ খচ করতে শুরু করেছিল—সকলের বর্ণমালা রয়েছে, তাহলে আমাদের, টোটোদেরই বা থাকবে না কেন? বারবার মনে হতে শুরু করে, আমাদেরও তো মাতৃভাষা আছে। কিন্তু সেই ভাষার অক্ষর কোথায়? বর্ণমালা ছাড়া আমরা বাঁচব কীভাবে? অন্য ভাষার হরফ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে করতে আমাদের মাতৃভাষাটাই হারিয়ে যাবে না তো? অন্যরা এই সমস্যাটা বুঝত না। কিন্তু আমাকে অস্থির করে তুলেছিল এই ভাবনা। তা থেকেই এক নতুন পথচলার শুরু।
রাজ্য সরকারের অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দপ্তরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলল অসম লড়াই, ভাষাকে প্রতিষ্ঠার। টোটো ভাষার বর্ণমালা তৈরির। পথচলা যে খুব সহজ হবে না, তা জানতাম। তবে শুরু করার পর বুঝলাম, যতটা ভেবেছিলাম, এ কাজ তার চেয়েও কঠিন। কষ্টসাধ্য। কিন্তু পিছু হটার প্রশ্নই নেই। ২০০৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে শুরু করলাম কাজ। প্রথম ছ’মাস বহু কষ্ট করতে হয়েছে। টোটো ভাষার ‘ফোনেটিক সাউন্ড’ ধরেছিলাম। তা দিয়েই আমাদের বর্ণমালা তৈরি প্রস্তুতি একটু একটু করে শুরু হয়।
এই সময়েই টোটোপাড়ায় বেড়াতে আসেন সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুয়েস্টের অস্ট্রেলিয়ান ভাষাবিদ টোবি অ্যান্ডারসন। এখান নৈসর্গিক দৃশ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে যায়। সেই সময়েই অ্যান্ডারসন সাহেবকে জানাই আমাদের মাতৃভাষার বর্ণমালা তৈরির বহু দিনের বাসনার কথা। আসলে ভাষা সংক্রান্ত কোনও প্রশিক্ষণ না থাকায় ধ্বনির সঙ্গে শব্দ মেলাতে এবং সেই অনুযায়ী লিপি তৈরি করতে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেকথাও জানাই প্রখ্যাত সেই ভাষাবিদকে। সব শুনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দু’বার ভাবেননি তিনি। শুরু হল লিপি তৈরির কর্মযজ্ঞ। একটা সময়ের দেশে ফিরে যান টোবি। কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। নিয়মিত ফোনে কথা হতো। বর্ণমালার এডিটিং ও চিত্রগ্রাফির কাজে প্রচুর সাহায্য করেন তিনি। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের পর ২০১৫ সালে তৈরি হল আমাদের মাতৃভাষার বর্ণমালা।
মোট ৩৬টি বর্ণ বা অক্ষর। তার মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তা দিয়ে ইতিমধ্যে তিনশো শব্দ তৈরি করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে এই বর্ণমালা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ২২ মে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে ইতিমধ্যে আইএসও কোড-ও পেয়েছে টোটো লিপি। পরে মাতৃভাষার শব্দ, ধ্বনি ও শব্দের বিবর্তন নিয়েও বেশ কিছু কাজ হয়েছে। শব্দভাণ্ডারের সম্পাদনাও করা হয়েছে।
অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রথাগতভাবে টোটো ভাষা পড়ানো শুরু হয়নি না। অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রথাগতভাবে টোটো ভাষা পড়ানো শুরু হয়নি। কিন্তু আমি আশাবাদী। অনেকেই বলেন, টোটো শিখে কী হবে? কী হবে, সেটা বড় কথা নয়। এখন তো ইংরেজি জেনেও তেমন চাকরি পাচ্ছে না নতুন প্রজন্ম। মাতৃভাষা শিখে টোটোরা চাকরি পাবে কি না, সেটাও আমার জানা নেই। কিন্তু এটা আমাদের বেঁচে থাকার মাধ্যম। নিজেদের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকে যতটুকু পেরেছি, করেছি।
পদ্মশ্রী পাওয়ার খবর যখন পেলাম, বাড়ির উঠোনে বসে শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদেছি। এটা তো টোটো সমাজের জয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সরকারের কাছে আর দু’টো জিনিস চাই—টোটোদের বর্ণমালার স্বীকৃতি আর টোটো জনজাতির উন্নতি! জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পারলে, সেটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বেঁচে থাক আমার মাতৃভাষা। তার অস্তিত্ব যেন কোনওদিন লুপ্ত না হয়।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস