বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

বিদায়...
বিদায় বর্ষ। বিদায় ফুটবল সম্রাট।
রাতুল ঘোষ

মরুদেশ কাতারে বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞ শেষ হয়েছে ঠিক ১০ দিন আগে। তারপরই বর্ষশেষে ফুটবল দুনিয়ায় ইন্দ্রপতন। বিশ্ব ফুটবলের প্রথম ‘গ্লোবাল সুপারস্টার’, আন্তর্জাতিক ওলিম্পিক কমিটি দ্বারা স্বীকৃত বিংশ শতাব্দীর ‘সেরা অ্যাথলিট’ এডসন আরান্তেস ডো নাসিমেন্টো ওরফে পেলে পাড়ি দিলেন জীবনের ওপারে। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় কোলন ক্যান্সারে ভুগে। গত ৬০ বছরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, একাধিক পোপ ও হলিউডের ‘সুপারস্টার’রা তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে, শুভেচ্ছা বিনিময় করে কৃতার্থ হয়েছেন। দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় তাঁর ম্যাজিকে আচ্ছন্ন ছিল গোটা ফুটবল দুনিয়া। অথচ পেলে কখনও ইউরোপে ক্লাব ফুটবল খেলতে যাননি। রিয়াল মাদ্রিদকে টানা পাঁচবার ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন করা আলফ্রেডো ডি’স্তেফানো এবং ফেরেঙ্ক পুসকাস তাঁদের খ্যাতির মধ্যগগনেও পেলের মতো জনপ্রিয়তা পাননি। তাই নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালে যিনি যতই চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলে থাকুন না কেন, আসল ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ (গোট) হলেন পেলে। তারপর বাকিরা। আমি পুসকাস, ডি’স্তেফানো, জর্জ বেস্ট, জোহান ক্রুয়েফ, মারাদোনা, মেসি এবং সি আর সেভেনের কথা মাথায় রেখেই একথা লিখতে বাধ্য হচ্ছি।
ছোটবেলায় পেলে ছিলেন আমাদের কল্পলোকের নায়ক। একটা ফিল্মে বিপক্ষের তিন ফুটবলারের মাথার উপর দিয়ে বল তুলে প্রায় ৬০ গজ জমি অতিক্রম করে তাঁকে গোল করতে দেখেছিলাম। তাতে আমাদের ধারণা হয়েছিল, তিনি বোধহয় বল তুলে নিয়ে আকাশ পথে বিচরণ করেন। দুরন্ত ড্রিবলিং, ডজ, দু’পায়ে শট, হেড এবং প্রতিপক্ষের পায়ের তলা দিয়ে বল গলিয়ে বা টোকা মেরে এগিয়ে যাওয়ার অনায়াস নৈপুণ্য দেখা গিয়েছিল ‘দ্য জায়েন্টস অব ব্রাজিল’ নামের সেই ফিল্মে। মোহিত হয়েছিল গোটা ফুটবল দুনিয়া। 
ব্রাজিলের জাতীয় দলের প্রাক্তন ম্যানেজার হোয়াও সালধানা একবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘যদি আমার কাছে বিশ্বের সেরা উইং ব্যাক, মিডফিল্ডার বা ফরোয়ার্ডের নাম জানতে চান, তবে এর সব ক’টির উত্তরেই আমি একটাই নাম বলব— পেলে। দ্য মোস্ট কমপ্লিট ফুটবলার।’
তবে ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ববি মুরই সম্ভবত পেলে সম্পর্কে সেরা মন্তব্যটি করেছিলেন। সেবার ইংল্যান্ড-ব্রাজিল ম্যাচে গোলরক্ষক গর্ডন ব্যাঙ্কসের শতাব্দীর সেরা ‘সেভ’ করেছিলেন। তা নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে পেলে সম্পর্কে ববি মুর বলেছিলেন, ‘ওকে ট্যাকল্‌ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হতো, বলটা পেয়ে গিয়েছি। তারপর এগতে গিয়ে দেখি, পাঁকাল মাছের মতো পিছলে আমাকে সাত হাত পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে পেলে। কখনও আমার পায়ে বলটা টোকা দিয়ে মেরে, ফিরতি বলটা পায়ের তলা দিয়ে গলিয়ে পেলে গোলের দিকে এগচ্ছে। এইভাবে বার বার ঠকেছি। প্রথমে ভাবলাম, এটা নিছকই দুর্ঘটনা। কিন্তু সাতবার ঠকার পর বুঝলাম, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি—এভাবে আমাকে টপকে বারবার বেরিয়ে যাওয়া একমাত্র পেলের পক্ষেই সম্ভব।’ একইভাবে পেলে আবার তাঁর দেখা বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডারের তকমা দিয়েছিলেন এই ববি মুরকেই।
পেলেকে প্রথম চাক্ষুষ করি ১৯৭৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, প্রায় মধ্যরাতে। মধ্য কলকাতার রাজপথে সেদিন ওই গভীর রাতেও ছিল বাঁধ ভাঙা ভিড়। ক্লাবের সুসময় ফেরাতে মোহন বাগানের প্রয়াত কর্ণধার ধীরেন দে সেবার ফুটবল সম্রাট পেলে সহ গোটা নিউ ইয়র্ক কসমস দলকে কলকাতায় উড়িয়ে এনেছিলেন। তাঁর তিনটি শ্রেষ্ঠ কীর্তি —১৯৬৪ সালে ক্যালকাটা গ্রাউন্ডের দখল নিয়ে একমাস ব্যাপী ক্লাবের প্ল্যাটিনাম জুবিলি উৎসব আয়োজন, ময়দানে প্রথম কংক্রিট সদস্য গ্যালারি ও ফ্লাডলাইটের উদ্বোধন এবং ১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইডেনে ফুটবল সম্রাট পেলে সহ নিউ ইয়র্ক কসমস দলকে এনে মোহন বাগানের বিরুদ্ধে খেলানো। পেলের পাদস্পর্শে সেবার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছিল মোহন বাগানের। ১৯৭৭ সালে সুব্রত ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এককভাবে ভারতীয় ফুটবলের ত্রিমুকুট প্রথম জিতেছিল মোহন বাগানই।
পেলে কিন্তু শুরুতে কলকাতায় আসতেই চাননি। সুইডিশ সচিবের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ভারতীয় মুদ্রায় চার কোটি টাকা লাগবে। সেই সময় মোহন বাগানের ফুটবল বাজেট ছিল আট থেকে দশ লাখ টাকার মধ্যে। অত টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে? ধীরেন দে তখন নিউ ইয়র্কে গিয়ে পেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে বলেন, ‘তুমি তো ছোটবেলায় শুনেছি খালি পায়ে ফুটবল খেলতে। নিশ্চয়ই ব্রাজিলেও প্রচুর গরিব মানুষ দেখেছ। ভারতেও কোটি কোটি গরিব মানুষ। তোমাকে কলকাতায় খেলতে দেখলে ওরা দারিদ্রের কথা ভুলে যাবে।’ শুনে পেলের মন গলে যায়। তাঁর সুইডিশ সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলেন ধীরেনবাবুকে।
শেষ পর্যন্ত পেলের আগ্রহেই সেবার এশিয়া মহাদেশে মোট তিনটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিল নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাব। অনেকটাই কম অর্থ নিয়েছিলেন তিনি। টোকিও এবং বেজিংয়ে প্রথম দু’টি ম্যাচ হয়। তারপর সিঙ্গাপুর থেকে কলকাতায় আসার আগে জার্মানি ফিরে যান বেকেনবাওয়ার। এদিকে, কলকাতায় পেলে ম্যাচের টিকিটের জন্য তখন হাহাকার। সর্বনিম্ন টিকিট ছিল ৫০ টাকা (তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মাসিক বেকার ভাতার সমান) এবং সর্বাধিক ৬০০ টাকা (কেরানিকুলের এক মাসের মাইনে)। একটা সাদা-কালো টিভির (তখন দাম ৩ হাজার টাকা) বিনিময়ে তখন ৬০০ টাকার একটা টিকিট ব্ল্যাক হয়েছিল।
সেই রাতেও কলকাতার রাজপথে পেলেকে সম্রাটের মতো সংবর্ধনা দিয়েছিল অগণিত ফুটবলপ্রেমী। ভিআইপি রোডের দু’ধারে থিকথিকে ভিড়। ঠিক ছিল, মানিকতলা হয়ে যাবে পেলের কনভয়। কিন্তু ভিড় দেখে প্রমাদ গুনল ট্রাফিক পুলিস। কনভয় ঘুরিয়ে দেওয়া হল উল্টোডাঙা-গ্রে স্ট্রিট হয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে। গন্তব্য গ্র্যান্ড হোটেল। পেলের রুম নম্বর ছিল ৩১৭। কসমসের জন্য গ্র্যান্ডে মোট ২৬টি ঘর বুক করেছিলেন ধীরেন দে। কলকাতার দুই প্রধান বাংলা দৈনিকও পেলের গতিবিধির দিকে নজর রাখতে ওই হোটেলে ঘর বুক করেছিল। 
পরদিন পেলের হাতে একটি হীরের আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন ‘মোহন বাগান রত্ন’ চুনী গোস্বামী। সেই মুহূর্তের ছবি তোলার জন্য আলোকচিত্রীদের মধ্যে এমন হুড়োহুড়ি শুর হয় যে, বেশ কয়েকজন গ্র্যান্ডের সুইমিং পুলের জলে পড়ে যান। সেদিন রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি নামে কলকাতায়। ২৪ সেপ্টেম্বর সকালেও থামেনি অবিশ্রান্ত বর্ষণ। যতই মাঠে বালি ফেলা হোক, ইডেনের এঁটেল মাটি তখন কর্দমাক্ত খাটালে পরিণত। পেলের ইনস্যুরেন্স এজেন্ট সাফ বলে দেন, এই মাঠ ফুটবল সম্রাটের খেলার পক্ষে অনুপযুক্ত। অতঃপর রাজ্যের তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী তাঁকে বোঝালেন, ‘ইডেনে পেলে না খেললে শহরে দাঙ্গা বেধে যাবে। তোমরা মাঠ থেকে বেরতে পারবে না।’ এটা শোনার পর অবশেষে ইডেনে নামতে রাজি হন পেলে। ততক্ষণে খেলা হবে না ভেবে কালোবাজারিদের মাথায় হাত পড়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল ক্যাপ্টেন কার্লোস অ্যালবার্তো, জিওর্জিও কিনালিয়া, ওয়ার্নার রথ, টনি ফিল্ড সহ এক ঝাঁক তারকা মাঠ মাতিয়ে দেন। সেদিন পেলের ব্লাইন্ড পাস থেকে কার্লোস অ্যালবার্তো লক্ষ্যভেদ করে ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের মতোই ‘প্রেসিডেন্টস গোল’ উপহার দিয়েছিলেন আমাদের। মনে পড়ে ১০ নম্বর জার্সির মহম্মদ হাবিবের সেই বিখ্যাত উক্তি— ‘পেলে ভি দশ নম্বর হ্যায়, ম্যায় ভি দশ নম্বরী। ছোড়েগা নেহি।’ মোহন বাগানের হয়ে সেদিন দু’টি গোল করেছিলেন শ্যাম থাপা ও হাবিব। তবে ম্যাচের ৭০ মিনিটে বক্সের মধ্যে সুধীর কর্মকারের স্লাইডিং ট্যাকলে ফাউল দেন রেফারি লক্ষ্মী নারায়ণ ঘোষ। পেনাল্টি থেকে গোল। ম্যাচ ২-২ ড্র করে কসমস।
এরপর ইতালিয়া-৯০ বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে পেলের সান্নিধ্যে এসেছিলাম। সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডেই মুখোমুখি হয়েছিল দুই লাতিন আমেরিকান জায়ান্ট ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনা। দিনটা ছিল ১৯৯০’এর ২৪ জুন। প্রেস বক্সে ‘ও গ্লোবো’কে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে ম্যাচ শুরুর আগেই পেলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘ব্রাজিলের কোচ সেবাস্তিও লাজারোনি ইউরোপিয়ান স্টাইলে খেলিয়ে আর্জেন্তিনাকে হারাতে পারবে না। ওর কপালে দুঃখ আছে।’ অব্যর্থ ছিল সেই ভবিষ্যদ্বাণী। ব্রাজিলের স্ট্রাইকার ক্যারেকা গণ্ডাখানেক সহজ সুযোগ নষ্ট করেন। আর মারাদোনার ডিফেন্স চেরা একটা থ্রু পাস ক্যানিজিয়ার সামনে একমাত্র গোলের পথ খুলে দেয়। সেদিন তুরিনের দেল আলপি স্টেডিয়ামে সাম্বা ফুটবলপ্রেমীদের অঝোর ধারায় কাঁদতে দেখলেও পেলের চোখে কোনও জল দেখিনি। তারপর আরও চারটি বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে দেখেছি মাস্টার কার্ডের প্রেস কনফারেন্সে পেলের উপস্থিতি। প্রশ্নোত্তর পর্বেও তিনি থাকতেন সপ্রতিভ। 
ভাটিকান সিটি দেখতে গিয়ে পেলে একবার পোপকে বলেছিলেন, ‘সঙ্গীতে যেমন বেঠোফেন, আঁকায় মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, ফুটবলে তেমনই আমি।’ বছর দুয়েক আগে দিয়েগো মারাদোনার প্রয়াণের পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পেলে বলেছিলেন, ‘মাই ফ্রেন্ড, তুমি ভালো থেকো। আমিও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ওখানে যাব। তখন স্বর্গে দু’জনে চুটিয়ে ফুটবল খেলব।’
এবার কি স্বর্গের মাঠেই সাক্ষাৎ হবে বিশ্ব ফুটবলের সম্রাট ও যুবরাজের?

1st     January,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা