দিশিকৃষ্ণ আর ঋষি কৃষ্ণের এ এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। পৌষের কনকনে সকালে কুয়াশা ছিঁড়ে উড়ে আসে কীর্তনের সুর। হরিনামের ধুয়ো কানে না এলেও সুরে দুলে ওঠে মন। কিন্তু কান পাতলেই যে অন্য এক আধ্যাত্মিক সন্ধান। খোল, করতাল, হারমোনিয়ামের সঙ্গতে এ কীর্তন যে অন্য—‘হেদে এ মূর্তভুবনে নাহি কোন জন, নিষ্পাপীয় কলেবর, ও মন জগতের ত্রাণকর্তা সেই জন, যিশু নাম তাহার গো।’ গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই জনপদকে চেনা যায় না। শুধু বয়ে চলে কুয়াশার সঙ্গে হরিনামের মতোই ‘জয় যিশু’ ভজনা। এক অদ্ভুত মাদকতায়।
খ্রিস্টীয় কীর্তনের সুর ও গান
পরিবর্তনের ঢেউয়ের মধ্যেও দশকের পর দশক ধরে খ্রিস্টীয় কীর্তনের এই ধারা স্বমহিমায় বিরাজমান। মূলত সীমান্ত জেলা নদীয়ায় এই ধারা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বেশভূষা, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারেও বৈষ্ণব কীর্তনের সঙ্গে খ্রিস্টীয় কীর্তনের অনেক মিল। হরিনাম কীর্তনের থেকে আলাদা হলেও আপাতভাবে শুনে তফাৎ বোঝা সহজ নয়। শান্ত মনে, ভালো করে শুনলে বোঝা যায় এর মাহাত্ম্য। গানের কথায়, সুরে রয়েছে যিশুর উপস্থিতি—‘এস সবে জয় রবে যিশু গুণ করি গান, মহীয়ান যিশু অমর প্রধান।’ খ্রিস্টীয় কীর্তনের আসরে ভক্তদের ভিড়ে মুছে যায় সমস্ত ধর্মীয় ভেদাভেদ।
বছরভর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে খ্রিস্টীয় কীর্তনিয়াদের। কিন্তু এই ছবিটাই বদলে যায় ডিসেম্বর মাস এলে। কীর্তনিয়াদের তখন বাড়িতে পাওয়াই ভার। গ্রাম-গঞ্জে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের ভৈরবী, দরবারি, আশাবরী, শিবরঞ্জন, পূরবী, ভাটিয়ালি, ঠুংরি সহ নানা সুরের সুতোয় বাঁধা পড়েন ভক্তরা। কোথাও ঠুংরির সুরে শোনা যায়, ‘হেদে ঈশ্বর আপনি জন্মিল অবণী, উদ্ধারিতে পাপী জন, ও মন যেই পাপী হয় ভজয়ে তাঁহায়, সেই পাবে পরিত্রাণ গো।’ কোথাও আবার শোনা যায়, ‘জয় যিশু জয় যিশু বলে আনন্দেতে মেতেছে, আজো মধ্যরাতে গোয়ালঘরে আঁধার সূর্য উঠেছে।’ খ্রিস্টীয় কীর্তনে বাদ যায়নি সমকালীন সামাজিক অবস্থাও। যেমন উনিশ শতকের শেষদিকে লেখা হয়—‘বাংলাদেশ পাপগুণে জ্বলতেছে, যিশু তোমা বই আর নিবায় কে, পাপের আগুন উঠিয়া ধূম আকাশ পানে ধেয়েছে, চৌদিকে লাগিয়া আগুন ছারে খারে যেতেছে।’
খ্রিস্টীয় কীর্তনের ইতিহাস
অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার মাটিতে প্রায় দেড়শো বছর ধরে রয়েছে খ্রিস্টীয় কীর্তনের শিকড়। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, ১৮৩০ সাল নাগাদ নদীয়া জেলায় খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার শুরু হয়। শারীরিক সুস্থতার জন্য মিশনারি রেভারেণ্ড জেমস ডিয়ার পূর্ব বর্ধমানের কালনা থেকে এসেছিলেন নবদ্বীপে। ওপারেই কৃষ্ণনগর। সেখানে তখন প্রচুর সংখ্যক ইউরোপীয়ান। কৃষ্ণনগরে খ্রিস্টধর্মের প্রচারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন জেমস ডিয়ার। কয়েক বছরের মধ্যেই নদীয়া জেলার দীপচন্দ্রপুর গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দাকে ধর্মান্তরিত করেন তিনি। বর্তমানে অবশ্য সেই গ্রামের উপস্থিতি রয়েছে শুধু দলিলেই। পাশের ধুবুলিয়া গ্রামেও শুরু হয় ধর্মান্তকরণ। ধীরে ধীরে নদীয়া জেলার বিভিন্ন অংশে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটাতে শুরু করে। কৃষ্ণনগর, চাপড়া সহ সাত জায়গায় তৈরি হয় মিশনারি কেন্দ্র। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় ধর্ম চর্চা নিয়ে সমস্যা দেখা যায়। কারণ, ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের ধাঁচে ইংরেজি মাধ্যমে ধর্মচর্চা করা গ্রামের মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অগত্যা উপায়! বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণেই গানে, সুরে যিশুকে প্রতিষ্ঠিত করতে মনোনিবেশ করেন তাঁরা। তখন থেকেই খ্রিস্টীয় পদাবলীর সূচনা। ১৮৭৬ সাল নাগাদ প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে রেভারেন্ড হেনরি উইলিয়াম এই কীর্তন শেখেন। তাঁর একটা দলও ছিল। ধীরে ধীরে এই কীর্তন খ্রিস্টধর্মের উপাসনার মাধ্যম হয়ে ওঠে। ততদিনে অবশ্য নদীয়া জেলায় খ্রিস্টধর্মের ‘নবজাগরণ’ শুরু হয়েছে। ১৯২০-২৩ সালের মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের মতিলাল মল্লিক ও সিমন অমরনাথ বিশ্বাস নবদ্বীপে গিয়ে ব্যাকরণগতভাবে কীর্তন শেখেন। এরপর তাঁরাই বাইবেলের বিভিন্ন গল্প ও চরিত্রকে নিয়ে পালা লিখে কীর্তনের সুর দেন। বিশিষ্ট গবেষক জনসন সন্দীপ বলেন, ‘একুশ শতকে শুধু নদীয়া নয়, দুই বাংলাতেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খ্রিস্টীয় কীর্তন। এর কারণ অবশ্যই শব্দ ও ভাষার সারল্য।’
খ্রিস্টীয় সঙ্গীত চর্চার সূচনা
সঙ্গীতের মাধ্যমে ঈশ্বর লাভ অনেক সহজ। ঈশ্বরের উপলব্ধি করা যায় নিমেষেই। কথা-সুর-তালের মিশ্রণে আধ্যাত্মিক শক্তি পৌঁছে দেয় ঈশ্বরের কাছে। ধর্মের প্রচারে তাই বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে এই সঙ্গীতচর্চা। যা খ্রিস্টীয় কীর্তন বলেই প্রসিদ্ধ। ধীরে ধীরে খ্রিস্টীয় সঙ্গীত সামাজিক অনুষঙ্গে পরিণত হয়। এই সুতোয় বাঁধা পড়ে যিশুবন্দনা-ধর্মপালন। খ্রিস্টীয় সঙ্গীত ও খ্রিস্টীয় কীর্তনের পার্থক্যও খুব সূক্ষ্ম। কারণ খ্রিস্টীয় সঙ্গীতের আঞ্চলিক রূপ হল খ্রিস্টীয় কীর্তন। এই কীর্তন মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে আবদ্ধ। আর তার সবটাই যিশুকে ঘিরে। আমাদের গ্রাম বাংলায় খ্রিষ্ট ধর্মের বয়স মোটামুটি চারশো বছর হলেও খ্রিস্টীয় গীতির বয়স প্রায় তিনশো বছর। যার মধ্যে প্রথম দু’শো বছর বিদেশিদের হাতেই লালিত হয়েছে এই কীর্তন।
উনিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে অবিভক্ত বাংলায় খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। বহু মানুষ এই ধর্মের দীক্ষা নিতে শুরু করেন। তখন থেকেই মানুষের সামাজিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এই কীর্তন। মূলত, বাইবেলের নীতি, দর্শনের প্রতি অখ্রিষ্ট সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করতে ও শহর থেকে গ্রাম বাংলার প্রতিটা স্তরের মানুষের কাছে যিশুর মাহাত্ম্যকে তুলে ধরতে এই গীতিচর্চা শুরু হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় সেই প্রচারের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘কোথাও পাদ্রী সাহেব ঝুড়ি ঝুড়ি বাইবেল বিলুচ্চেন-কাচে ক্যাটিকৃষ্ট ভায়া সু্র্ব্বন চৌকিদারের মতো পোশাক-পেনটুলেন, ট্যাংট্যাঙে চাপাকান মাথায় কালো রঙ্গের চোঙগাকাটা টুপি। আদালতি সুরে হাত মুখ নেড়ে খ্রিষ্টধর্মের মাহাত্ম্য ব্যক্ত কচ্চেন।’
ডিসেম্বরে খ্রিস্টীয় মেলা
ডিসেম্বর মানেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে উৎসবের মাস। কারণ এই মাসেই আবির্ভূত হন যীশু। আর তাই উৎসবের আমেজ দেখা যায় নদীয়া জেলার চাপড়া সহ আশেপাশের এলাকায়। রঙিন আলো, রকমারি খাবার ও নানান থিমের বাহারে সেজে ওঠে বিভিন্ন পাড়া। খাদ্য তালিকায় থাকে পিঠে পুলি, রকমারি কেক। ২৬ ডিসেম্বর চাপড়ায় শুরু হয় বড়দিনের মেলা। শেষ হয় ১ জানুয়ারি। পাড়ার মোড়ে আলোয় ঢাকা পড়ে দেবদারু গাছ। সঙ্গে থাকে কীর্তন। চাপড়ার প্রবীণ বাসিন্দা বললেন, আপনাদের যেমন দুর্গাপুজো। আমাদেরও তেমনি বড়দিন। সারাবছর অপেক্ষা করি এই সময়টাই জন্য। জানা যায়, চাপড়া থেকে বারো মাইল দূরে বল্লভপুরে খ্রিস্টীয় মেলার সূচনা হয়েছিল। এই বল্লভপুর এখন বাংলাদেশে। চাপড়ার মেলার পত্তন হয়েছে বল্লভপুরের পরে। এবার মেলায়, খেলা, কবি সম্মেলন, প্রর্দশনী, সহ নানা আয়োজন করা হয়।
খ্রিস্টীয় কীর্তনের বিবর্তন
কালের নিয়মে বিবর্তন এসেছে খ্রিস্টীয় কীর্তনে। গানের সুরে কথায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কীর্তনের ভাব ভঙ্গিমায় যুক্ত হয়েছে খ্যামটা। এমনটাই মনে করছেন প্রবীণ শিল্পীরা। যে কারণে খ্রিস্টীয় কীর্তনের আদি সুর এখন অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই অদূর ভবিষ্যতে গূঢ় খ্রিস্টীয় কীর্তনের সংকটময় অবস্থা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই। যেমন, ‘পূর্ব গগনে দেখবে চহিয়া নব তারা উদয় হলো.....।’ এই গানটার সুর হলো একতালা। এছাড়াও শিবরঞ্জন সুরে রয়েছে— ‘ফিরে এসো এসো ফিরে/ফিরে এসো সুপথে/মরণজ্বালা নাইরে সেথায়/যাবি যদি আলোকরথে...।’ কিন্তু বর্তমানে আধুনিক সুরে লেগেছে কীর্তনে। বাউল ও লোকসংগীত ধরনে গাওয়া হচ্ছে কীর্তন।
বিশিষ্ট শিল্পী বাসুদেব মণ্ডল বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরেই গানের কথায় সুরে নানা পরিবর্তন এসেছে। আগে যে সুরে গান হতো এখন সুরগুলো অনেক আধুনিক হয়েছে। বিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কীর্তনে। শ্রোতাদের গানের স্বাদ বদলেছে।
গবেষক জনসন সন্দীপ বলেন, সুর হলো নদীর মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে আধুনিক হবে। তেমনি আবার কালজয়ী সুর থেকে যাবে। কীর্তনে নতুন নতুন সুর সংযোজন হচ্ছে। সুর, কথা বদলালেও গানের দর্শনে পরিবর্তন হয়নি। তবে শিক্ষিত কীর্তনিয়ার অভাব ঘটছে। কীর্তনের আসল ঘরানা অনেকটা অবলুপ্তির পথে। এরা এখন খ্রিস্টীয় কীর্তনে লোকসংগীত ও বাউলের সুর ঢুকিয়ে দিয়েছে। অপসংস্কৃতি ছুঁয়েছে আমাদের খ্রিস্টীয় কীর্তনকে।