আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই ভবিষ্যৎ—এমনটাই মত বিজ্ঞানীদের। এতদিন পর্যন্ত তা ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ‘চ্যাটজিপিটি’ বদলে দিল সেই ধারণা। প্রথমবার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সাড়া দিল বিশ্ববাসীর আঙুলের ছোঁয়ায়।
নিউ ইয়র্কের কাছের একটি ছোট শহর মেপল। চরিত্রে আর পাঁচটা ছোট শহরের মতোই। সহজ-সরল রুটিনমাফিক দিন কাটে মেপলবাসীর। আচমকাই ছন্দপতন। শহরের প্রাণভোমরা টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার মুখে। রুজি-রুটি হারানোর আশঙ্কায় দিশাহারা মানুষ। এর মধ্যেই মসিহা হয়ে হাজির একটি সংস্থা—ক্যারো ম্যানুফ্র্যাকচারিং। বন্ধ হতে চলা ফ্যাক্টরি কিনে নতুন করে শুরু হল পথচলা। এসবের আড়ালে ছিল অন্য একটা ছবি। ক্যারোর বিরোধিতা করায় রহস্যজনকভাবে পদচ্যুত হতে হয় শহরের মেয়র, পুলিস প্রধান ও সিটি কাউন্সিলের সদস্য এক চিকিৎসককে। বদলে এলেন যাঁরা, তাঁরা কেউই সেই সমস্ত পদের উপযুক্ত প্রার্থী নন। তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা—সংস্থার নির্দেশের বিরোধিতা না করা। এ পর্যন্ত পড়লে গোটা বিষয়টিকে ক্ষমতালোভী এক অসাধু সংস্থার ষড়যন্ত্র মনে হতে পারে। ভাবনাটি ঠিক। আবার পুরোপুরি ঠিক নয়। কেন? এখানেই লুকিয়ে চমক। আসলে ক্যারো নামক সংস্থাটির পরিচালন ক্ষমতা কোনও মানুষের হাতে নেই। রয়েছে ‘সামারিটান’ নামে এক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের হাতে। কারখানার আড়ালে চলছে নিউরাল ইমপ্ল্যান্ট তৈরি ও পরীক্ষার কাজ। একটি শহরের মানুষ ও তাঁদের আবেগ-অনুভূতির উপর নজর রেখে চলছে তথ্য সংগ্রহ। মানুষ বোঝার সামাজিক পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার প্রয়োজনে বা কোনও বিপদ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে মানুষ খুনেও পিছপা হয় না ‘সামারিটান’। ‘পার্সন অব ইন্টারেস্ট’ ওয়েব সিরিজে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এমনই ভয়ঙ্কর চেহারা তুলে ধরেছেন পরিচালক জোনাথন নোলান।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। ১৯৫৬ সালে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্ট্যানলি ম্যাকার্থি। ডর্টমাউথ কলেজের এক আলোচনা সভায়। তাঁর কথায়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হল ‘দ্য সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অব মেকিং ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস’। সহজ বাংলায়—বুদ্ধিমান যন্ত্র নির্মাণের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। অর্থাৎ যে যন্ত্র নিজের শেখা ‘বুদ্ধি’ দিয়ে চিন্তা করতে পারবে। সেই শুরু। এর পর দীর্ঘদিন আলোচনা-গবেষণার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এই বিষয়টি। একটা সময় কল্পবিজ্ঞানের গল্প, সিনেমাজুড়ে ছিল ‘এআই’-এর দাপট। বাস্তব দুনিয়ায় এর কতটা প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে হিসেবনিকেশ করতেন বিজ্ঞানী, গবেষকরা। ধীরে ধীরে উন্নততর জীবনের খোঁজে ব্যস্ত মানুষের সফরসঙ্গী হয় এআই।
প্রাথমিক ধাপে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে সহজ কিছু কাজ শেখার মধ্যে দিয়ে পথচলা শুরু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের। হাতের লেখা পড়তে শেখা, রোগ নির্ণয়, দোভাষীর কাজ বা দাবা খেলার মতো বিষয় শেখাতে নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে, অনেকটা সেই ধাঁচেই তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্ক। তবে এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে কোনও একটি কাজ নিখুঁতভাবে করা সম্ভব। অন্য কোনও কাজ, আদতে তা ভীষণ সহজ হলেও তা পারবে না। এই বাধা টপকে এআই-কে নতুন মাত্রা দিতে শুরু হয় জেনারেল এআই নিয়ে গবেষণা। যার মাধ্যমে একইসঙ্গে নানা বিষয়ে নানান কাজের শিক্ষা দেওয়া যাবে। শিশুরা যেভাবে শেখে, সেভাবেই শিখবে এআই-ও। তবে অনেক দ্রুত।
সত্যিই দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। কতটা, তার প্রমাণ মিলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক স্টার্টআপ ‘ওপেনএআই’-এর তৈরি প্রোটোটাইপ চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম ‘চ্যাটজিপিটি’তে। আর পাঁচজন বিশেষজ্ঞের মতোই সহজ ভাষায় যে কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে পারে টেক্সট জেনারেটিং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পরিবারের এই সদস্য—জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফর্মার (জিপিটি)। কীভাবে কাজ করে এই চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম? ধরা যাক, আপনাকে কলেজে কোনও বিষয়ে একটি লেখা জমা হবে। কোন বিষয়ে কতটা লিখতে হবে জানিয়ে দিলেই চটজলদি মিলে যাচ্ছে উত্তর। আবার কেউ হয়তো জানতে চাইলেন ২০১৫ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা সফর নিয়ে। প্রশ্ন পড়ে আপনার ভ্রূকুঞ্চন স্বাভাবিক। কিন্তু ‘চ্যাটজিপিটি’র জবাব সদা প্রস্তুত—ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মৃত্যু হয়েছে ১৫০৬ সালে। ফলে ২০১৫ সালে তাঁর পক্ষে আমেরিকায় আসা সম্ভব নয়। প্রশ্নোত্তর পর্ব এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু অধরা রয়ে যেত চমক। আর সেই জন্যই পরের ধাপে ‘চ্যাটজিপিটি’ লিখেছে, ধরা যাক কলম্বাস ২০১৫ সালে আমেরিকায় এলেন। পা রেখেই দেখতেন ১৪৯২ সালের সদ্য চেনা ভূখণ্ডটি কতটা বদলে গিয়েছে। আর কী কী কারণে তিনি চমৎকৃত হতেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে লেখাটিতে। এই মুহূর্তে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের কোড লিখতে বা ভুল শোধরাতেও এই প্ল্যাটফর্মের দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেকে। যা দেখে অনেকের আশঙ্কা, এর ফলে কোপ পড়তে পারে অধ্যাপক, স্ক্রিপ্ট লেখক, প্রোগ্রামার, সাংবাদিকদের রুজিরুটিতে।
আর এখানেই দুশ্চিন্তার সূত্রপাত। এক সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই মানুষকে শাসন করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন স্টিফেন হকিং। খুব ভুল বোধহয় বলেননি তিনি। না হলে ডিপ মাইন্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রকল্পের ‘সাফল্য’ বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ বাড়াবে কেন! বছর পাঁচেক আগের কথা। কে কত বেশি আপেল জমাতে পারে, তা নিয়ে এআই নির্ভর দু’টি এজেন্টের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। ৪ কোটি রাউন্ডের খেলার শুরুতে প্রচুর আপেল থাকায় দুই প্রতিযোগী নিজের মতো করে ফল সংগ্রহ শুরু করে। বিপত্তি ঘটে আপেল কমতেই। জিততে মরিয়া দু’তরফই একে অপরকে লেজার বিম দিয়ে সাময়িক নক আউটের চেষ্টা করে। প্রতিযোগিতায় দু’জন মানুষ মুখোমুখি হলে যেমনটা ঘটবে, এক্ষেত্রেও সেই দৃশ্য দেখে চমকে যান বিজ্ঞানীরা। বোঝা যায়, যত জটিলভাবে এআই তৈরি করা হয়েছে, আক্রমণাত্মক মনোভাব ততই বেড়েছে।
এই সমস্যার সমাধান একটাই। কোথায় দাঁড়ি টানতে হবে, তা জানা। অ্যালফাবেটের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এরিক স্মিডের গলাতেও শোনা গিয়েছে সেই সুর। তাঁর কথায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্র জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। তবে তা মানুষের ধ্বংস ডেকে আনার হাতিয়ারও হতে পারে। তাই প্রয়োজন কিছু নিয়ম মেনে চলা। না হলে একদিন এআই মানুষের জন্য বিপদ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট রাসেল। ‘হিউম্যান কম্প্যাটিবল: এআই অ্যান্ড দ্য প্রবলেম অব কন্ট্রোল’ বইয়ের লেখকের মতে, এআই-এর মধ্যে চেতনাবোধ জন্মাচ্ছে, তা নিয়ে ভয় নেই। কিন্তু নিজের লক্ষ্যপূরণে তা বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেই চিন্তার ব্যাপার।
যদি কখনও এমনটা ঘটে, কী হতে পারে! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড় পরীক্ষা করতে ‘কম্পু’র কাছে সহজ কোনও প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতে পারেন উইঙ্গফিল্ডের মতো কেউ। জবাবে হয়তো তাঁকেও শুনতে হবে, ‘যা জানো, তা জানতে চাওয়াটা মূর্খের কাজ।’ যন্ত্রের চাবুক উত্তর শুনে দূরে দাঁড়িয়ে শুধু মুচকি হাসবেন টাকমাথা, দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক। এমনটাই হবে, জানতেন প্রফেসর শঙ্কু।