বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

স্মৃতির পর্দায় দূরদর্শন
জগন্নাথ বসু

বিগত শতাব্দীর অন্যতম বিস্ময়! সেই অক্টাগন থেকে আজকের স্মার্ট, ওএলইডি—টেলিভিশনের বিবর্তন বন্ধ হয়নি এই ফাইভজি যুগেও। আর একসপ্তাহ পরেই ২১ নভেম্বর। ১৯৯৬ সালের এই দিনেই রাষ্ট্রসঙ্ঘে আয়োজিত হয়েছিল প্রথম বিশ্ব টেলিভিশন ফোরাম। সেই থেকে তারিখটি বিশ্ব টেলিভিশন দিবস হিসেবে পরিচিত। তার আগে এই মাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির পথে হাঁটল ‘বর্তমান’

তখন দূরদর্শনের দু’দল কর্মীদের মধ্যে প্রচণ্ড গণ্ডগোল। স্টুডিও অফিসটা ঘিরে রেখেছে আমাদের বিপক্ষের কয়েকজন। তাদের টপকে স্টুডিওতে ঢোকার কোনও উপায় নেই। এদিকে খবর পড়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম দূরদর্শন ভবনের মধ্যে থাকা এক গোপন সুড়ঙ্গের কথা। সেটির লুকনো দরজা খোলা হল। সেই প্রায়ান্ধকার সুড়ঙ্গপথে হোঁচট খেতে খেতে কোনওরকমে ট্রান্সমিশন রুম। ক্যামেরা রেডি। লাইভ খবর পড়তে হবে তক্ষুনি। স্ক্রিপ্ট পড়ার সময়  পর্যন্ত হাতে নেই। কপাল থেকে একফোঁটা ঘাম টপ করে জামার কলারে পড়ল, বুঝতে পারলাম। ঠিক তখনই মনিটরে দেখতে পেলাম নিজের মুখ। এয়ার করে দেওয়া হয়েছে আমাকে। প্রায় এক্সটেম্পোতে পড়লাম পুরো খবর। জগন্নাথ বসুকে উপস্থাপক হিসেবে সেই প্রথম দেখল মানুষ। এই কথাটা অনেকেরই কিন্তু জানা নেই। বেশ গা ছমছমে একটা বিষয়, তাই না...
এই ঘটনাটা ঘটছে দূরদর্শনে। কিন্তু আমার কর্মজীবন শুরু রেডিওতে। তখন বেতার তরঙ্গের নিত্য আনাগোনার মধ্যে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে অ্যান্টেনা। বদল আসছে, মালুম হচ্ছিল। কোনও অজানা পথে পা বাড়ানোর একটা চাপা উত্তেজনা থাকে। সেই অনুভূতি নিয়েই এলাম টেলিভিশনের ময়দানে। দীর্ঘদিনের চেনা পরিবেশ ছেড়ে আসাটা খুব সহজ ছিল না। স্বয়ং তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আপনার থেকে রেডিও  পেয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি।’ জবাবে বলেছিলাম, ‘আমায় শূন্য থেকে শুরু করতে দিন।’ রেডিওর কর্তাব্যক্তিরাও ছাড়তে চাননি। তবু বুক ঠুকে চলে এলাম। হাজার হোক, পরিবর্তনই তো জীবনের নিয়ম। রেডিও জগতের অনেকেরই ধারণা ছিল, টিভিতে আমার কেরিয়ার বোধহয় দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ফিরে আসব রেডিওতেই। আমার মনে অবশ্য কোনও সংশয় ছিল না। জানতাম, রেডিওতে আমি যত দক্ষই হই না কেন, এই জগৎ আমার কাছে অচেনা, নতুন। এখানে আমি শুধুই এক ছাত্র। নতুন মাধ্যম চেনা-জানার অসম্ভব খিদে নিয়ে শুরু হল পথচলা।
সালটা ১৯৯২। আমার দুনিয়া বদলাল। বদলাচ্ছিল দূরদর্শনও। সেই সময়ে সাহিত্য মনস্কতা, সৃজনশীলতার পথ ছেড়ে ধীরে ধীরে বাণিজ্যমুখী হয়ে উঠছিল দেশের একমাত্র টেলিভিশন সংস্থা। এর মধ্যেই একদিন জরুরি মিটিং ডাকলেন তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল রতিকান্ত বসু। বুঝিয়ে দিলেন, সময় বদলাচ্ছে। অনুষ্ঠানের জন্য আর মানুষ এসে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে না। বরং কোন অনুষ্ঠানের কেমন জনপ্রিয়তা, তার রেটিং, টিআরপি সহ হরেক হিসেবের সঙ্গেই বানাতে হবে চমকদার প্রোমো। সেটি নিয়ে যেতে হবে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের কাছে। তাঁদের আকৃষ্ট করতে হবে বিজ্ঞাপনের জন্য। বুঝতে পারলাম, বিনোদনের বাণিজ্যিকীকরণের সূচনা হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য চালু হল নতুন এক দপ্তর। প্রধান পদে বসানো হল আমাকেই। একটু গোড়ার কথায় ফিরে আসি। দেশে দূরদর্শনের সূচনাকাল অবশ্য ছিল একদমই অন্যরকম। ১৯৩৬ সালে বিশ্বে প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে বিবিসি। তার প্রায় দু’দশক পরে ১৯৫৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে পথ চলা শুরু দূরদর্শনের। ছোট একটি ট্রান্সমিটার নিয়ে অস্থায়ী এক স্টুডিও থেকে প্রথমবার পরীক্ষামূলক সম্প্রচার করা হয়। সহযোগিতা করেছিল ইউনেস্কো। সেই শুরু। সপ্তাহে দু’দিন এক ঘণ্টা করে দূরদর্শনে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো। ১৯৬৫ সাল থেকে চালু হয় দিনভর সম্প্রচার। অল ইন্ডিয়া রেডিও’র অংশ হিসেবে। সে বছরই প্রথম পাঁচ মিনিট দীর্ঘ খবরের বুলেটিনের সূচনা। পাঠ করতেন প্রতিমা পুরী। দূরদর্শনের প্রথম সংবাদ উপস্থাপিকা। হাতে গোনা দর্শক। তাও প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর আসেন সালমা সুলতান।
একটা সময় পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিও ও দূরদর্শন ছিল একই ছাতার তলায়। ১৯৭৬ সালের ১ এপ্রিল দু’টি সংস্থা আলাদা হয়ে যায়। দূরদর্শনের লোগো কী হবে? তা তৈরি করার দায়িত্ব পড়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের উপর। সেখানকার পড়ুয়াদের মোট ১৪টি নকশার মধ্যে থেকে বঙ্গসন্তান দেবাশিস ভট্টাচার্যের আঁকা লোগোটি পছন্দ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর অনুরোধেই দূরদর্শনের ‘সিগনেচার টিউন’ তৈরি করেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’-র প্রথম লাইনের সুরের আদলে। কলকাতায় অবশ্য দূরদর্শন আসে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট। শুরু হল দু’ঘণ্টার সম্প্রচার। পর্দায় কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম উপস্থাপিকা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তের মুখ। বললেন, ‘নমস্কার, কলকাতা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শুরু হল ব্যান্ড এক, চ্যানেল চারে।’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, রাজ্যের তথ্য দপ্তরের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। টালিগঞ্জের রাধা ফিল্ম স্টুডিওর একফালি অফিস ছিল তখন টেলিভিশন সেন্টার। সারা দিন ধরে চলত রেকর্ডিং। সন্ধ্যায় ট্রান্সমিশন, ঘোষণা, সংবাদ পাঠ। ১৯৮৬ সালের ১ জুলাই নিজস্ব অফিস পায় কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্র, গল্ফ গ্রিনে। উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী।
ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে দূরদর্শনের। শুধু কলকাতায় নয়, দেশজুড়েই। ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে এশিয়ান গেমসের আয়োজন করে ভারত। সেই সময় থেকেই শুরু হয় রঙিন ছবির সম্প্রচার। তখন সপ্তাহজুড়ে চলত ‘চিত্রমালা’, ‘সাপ্তাহিকী’, ‘চিত্রহার’, ‘রঙ্গোলি’র মতো নানান অনুষ্ঠান। সঙ্গে ছিল ‘হামলোগ’,‘বুনিয়াদ’-এর মতো সিরিয়াল। যদিও জনপ্রিয়তার নিরিখে নতুন নজির গড়ে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’। সারা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় জমাতো টিভি স্ক্রিনের সামনে। দেখানো হতো নানান তথ্যচিত্র। বিভিন্ন বিষয়ের উপর। 
কলকাতা দূরদর্শনে শুরু থেকেই দর্শকদের অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হতো। সেই কারণে সূচনা হয় ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠানের। দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের ভার এল পঙ্কজ সাহার কাঁধে। এই অনুষ্ঠানের হাত ধরেই আমজনতার কাছে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। পরবর্তীতে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ভার আসে আমার হাতে। আমি অনুষ্ঠানটিতে কিছুটা বদল আনি। সরাসরি চলে যাই দর্শকদের মাঝে। ঘুরে বেড়াই হরেক জেলায়। এমনই একবার অনুষ্ঠান ছিল বর্ধমানে। অনুষ্ঠানের মধ্যেই দেখা এক গ্রাম্য মানুষের সঙ্গে। পরনে ফতুয়া, ধুতি। কোলে বাচ্চা। জিজ্ঞাসা করলাম, টিভি দেখেন? কোন অনুষ্ঠানটি সবচেয়ে ভালো লাগে? শহুরে কায়দার সেই প্রশ্নের সটান জবাব দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘যাত্রা দেখতে ভালো লাগে। দেখান না ক্যানে?’ টের পেয়েছিলাম, শহুরে ভাবনার বাইরেও একটা দুনিয়া রয়েছে। কলকাতায় বসে তা টের পাওয়া যায় না।
দূরদর্শনের অন্দরের রেষারেষিতে কী হতে পারে, শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম। বিষয়টি একটু বিস্তারিত বলি। একটা সময়ে রেডিও-টিভির টানাপোড়েন চরম আকার নিয়েছিল। খবরের বিভাগকে বিপাকে ফেলার মরিয়া চেষ্টাও চালিয়েছিল কয়েকজন। একদিনের ঘটনা এখনও স্মৃতিতে তাজা। খবরের বিভাগের সবাই হাত তুলে নিয়েছে। এর মধ্যেই আমাকে ডেকে পাঠালেন অধিকর্তা। তাঁর সাফ নির্দেশ, খবরের বিভাগ বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আজ আপনাকেই খবর পড়তে হবে। উনি জানতেন, কার্যক্ষেত্রে অফিসার পদে থাকলেও আমি একজন বাচিক শিল্পীও বটে। সেদিন শরীর বিশেষ ভালো ছিল না। তথাপি কর্তার নির্দেশ। উপায় কী! স্টুডিওতে যাব কীভাবে? চার দিক বন্ধ করে রেখেছে বিক্ষুব্ধরা। শেষে এক সুড়ঙ্গ পথের মধ্যে দিয়ে ট্রান্সমিশন রুমে নিয়ে গেলেন স্টেশন ইঞ্জিনিয়ার। আপৎকালীন পরিস্থিতি বলে কথা। অস্থায়ীভাবে সেখান থেকেই হবে সরাসরি সম্প্রচার। পৌঁছনো তো গেল, কিন্তু খবর কোথায়! কী দেখে পড়ব! এদিকে প্রায় সাতটা বাজে। মনে হচ্ছিল, আজ আর বোধহয় খবর পড়া হবে না। এর মধ্যেই হাজির এক চা বিক্রেতা। চা দেওয়ার মধ্যেই লুঙ্গির ভাঁজ থেকে বার করে দিলেন ‘খবর’। মক-শো করার সময় নেই। সরাসরি অন-এয়ার। কাজে লাগল রেডিওর অভ্যাস। নির্ভুলভাবে খবর পড়লাম। সম্প্রচার শেষ হতেই ফোন করলেন তৎকালীন অধিকর্তা। সাধুবাদ দেওয়ার সঙ্গে খবর পরিবেশনের ভারটিও দিলেন তৎকালীন অধিকর্তা। আমার পরে কয়েকটি বুলেটিন পড়েন সহকর্মী অজিত মুখোপাধ্যায়। মজার কথা, তিনিও দূরদর্শনে এসেছিলেন রেডিও থেকেই।
আরও কয়েকজনের কথা না বললে এই ফিরে দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁদের মধ্যে একজন অভিজিৎ দাশগুপ্ত। সেই সময়ে দূরদর্শন মাধ্যমটি বুঝে সেই অনুযায়ী কাজ করা খুব সহজসাধ্য ছিল না। অথচ সেই কাজটি খুব সহজেই করতেন অভিজিৎ। তাঁর প্রযোজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে সেই দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। অন্যদিকে, নিজেদের দক্ষতায় উপস্থাপিকা হিসেবে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন শাশ্বতী গুহঠাকুরতা, চৈতালি দাশগুপ্তরা। কলকাতা দূরদর্শন মানেই একঝাঁক স্মৃতির মন্তাজ। ধীরে ধীরে সময়ের চাদরে ঢেকে গিয়েছে অতীতের দিনগুলি। কেবল টিভির যুগে যাঁদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, তাঁদের দূরদর্শন নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা হয়তো নেই। কিন্তু আমাদের সময়টা ছিল অন্যরকম। আবেগ, ভালোবাসার আর এক নাম ছিল দূরদর্শন, যা আজ শুধুই নস্টালজিয়া। টিআরপির লড়াইয়ে সবাই এখন ছুটছে। দূরদর্শনের সামনে একের পর এক দাপুটে বেসরকারি চ্যানেল। এ চ্যালেঞ্জ কঠিন। তার পরেও দূরদর্শন ফের ঘুরে দাঁড়াবেই। সেই বিশ্বাস লালন করে চলেছি আজও।

13th     November,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা