বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

বাঙালির বাণিজ্যে 
লক্ষ্মীলাভ
শান্তনু বসু

বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী—  একথা কোনও যুগেই গোটা বাঙালি জাতির মনোজগৎকে তেমন ভাবে আকৃষ্ট করেনি। ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য-অভিযানের চেয়ে ভূমি-আশ্রিত কৃষিভিত্তিক জীবনকেই নিরাপদ বলে মনে করেছে বাঙালি। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘... ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব প্রচলন থাকিলেও কৃষিই ছিল জনসাধারণের উপজীব্য। প্রাচীন একখানা পুঁথিতে আছে যে, আত্মমর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন লোকের পক্ষে কৃষিই প্রশস্ত। কারণ বাণিজ্য করিতে অনেক মূলধনের প্রয়োজন এবং অনেক জাল-প্রতারণা করিতে হয়।’  বোঝাই যাচ্ছে অতীত কাল থেকে সমাজের চোখে এদেশে ব্যবসার তুলনায় কৃষিই ছিল গৌরবজনক বৃত্তি।           
তবুও বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভের আশায় বরাবরই অগ্রগামী হয়েছে একশ্রেণির বাঙালি। বাণিজ্য তাঁদের ছিল কৌলিকবৃত্তি। প্রাচীনযুগ থেকে প্রায় মধ্যযুগ পর্যন্ত বাঙালির ইতিহাসে এঁরাই বাণিজ্যিক কৃতিত্বের অধিকারী। আমাদের অনেক মঙ্গলকাব্যের নায়ক একজন সওদাগর।  যেমন— চাঁদ সদাগর, ধনপতি, শ্রীমন্ত। পর্তুগিজ পর্যটক বারবোসার বিবরণে দেখা যায় বাঙালি বণিকেরা জাহাজে করে বাণিজ্যদ্রব্য ভিন দেশে পাঠাচ্ছে। ১৫৬৩ সালে সিজার ফ্রেডরিক সপ্তগ্রামকে খুব সমৃদ্ধশালী বন্দর বলে বর্ণনা করেছিলেন। সপ্তগ্রামে ছিল অনেক বিত্তবান বাঙালি বণিকদের বসবাস। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’র কবি লিখছেন— 
‘হিরণ্য-গোবর্ধন নামে দুই সহোদর।
সপ্তগ্রামে বার লক্ষ মুদ্রার ঈশ্বর ।।’
পলাশির যুদ্ধের পর ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল আড়ত দিল্লি-আগ্রা থেকে সরতে সরতে কলকাতায় এসে থানা গাড়ল। শিকড় নামাল হুগলি নদীর তীরে। বণিক-জাতি হিসেবে সারা ভারত জুড়ে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ এসে হাজির হল বাঙালির দুয়ারে। একদল সাহসী মানুষ মেতে উঠলেন লক্ষ্মীর সাধনায়। 
পলাশি-উত্তর যুগে প্রবেশের আগে প্রাক-পলাশি যুগে বাঙালির ব্যবসার চিত্রটা কেমন ছিল একটু ফিরে দেখা যাক। ইংরেজরা যখন কলকাতায় এসে ঘাঁটি গাড়ল, তখন তাদের মালপত্র বাজারে বিক্রির জন্য স্থানীয় বেনিয়ানদের প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই কাজে যোগ দিয়ে বেশ কয়েকজন ভাগ্যান্বেষী বাঙালি রাতারাতি বিত্তবান হয়ে উঠলেন। এই বিত্তের কিছুটা তাঁরা বিনিয়োগ করলেন ব্যক্তিগত ব্যবসায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়াতে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন— নন্দরাম সেন, দীপচাঁদ, জনার্দন শেঠ প্রমুখ।      
জনার্দন শেঠের বড় ছেলে বৈষ্ণবচরণ সাধু ব্যবসায়ী হিসেবে নাম কিনেছিলেন। গঙ্গাজল বেচে বিত্তবান হয়েছিলেন তিনি। চমকে ওঠার মতো কথা বটে। আসলে সে সময় দক্ষিণ দেশে নিত্যপুজোর কাজে গঙ্গাজলের দারুণ চাহিদা। পাত্রে গঙ্গাজল ভরে দক্ষিণে পাঠাতেন বৈষ্ণবচরণ। পাত্রের গায়ে থাকত বৈষ্ণবচরণের শিলমোহর।   
গোবিন্দপুরের বাসিন্দা ছিলেন পঞ্চানন কুশারী। কোম্পানির জাহাজের মালপত্র ওঠানো-নামানো, জাহাজিদের খাদ্য, পানীয় সরবরাহের কাজ করতেন তিনি।  তাঁর অধীনে কাজ করত শয়ে-শয়ে কুলিমজুর। কুশারীরা পিরালি ব্রাহ্মণ। তাই সাধারণ লোকে পঞ্চাননকে ঠাকুরমশায় বলে ডাকত। সেই ঠাকুর থেকে কোম্পানির কাগজপত্রে তাঁর পদবি হয়ে দাঁড়াল ‘TAGORE’ (টেগোর)। পঞ্চানন ঠাকুরের বংশ থেকেই জোড়াসাঁকো ও পাথুরেঘাটার ঠাকুর পরিবারের উৎপত্তি।    
প্রাক-পলাশি যুগে বাঙালি ব্যবসায়ী বলতে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে হয়। এঁরা হলেন— লক্ষ্মী ধর, শোভারাম বসাক, নয়নচাঁদ মল্লিক, শুকদেব মল্লিক প্রমুখ।   
লক্ষ্মী ধর অধিক পরিচিত ছিলেন ‘নকু ধর’ নামে।  লোকে বলত ধনকুবের। নকু ধরের কড়ির জোর ছিল প্রবাদের মতো। দালালি ও সুদের কারবারই ছিল তার অর্থের মূল উৎস। মারাঠা-যুদ্ধের সময় তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কয়েক কোটি টাকা ধার দিয়েছিলেন। ইংরেজ বণিকদের কাপড় জোগান দিয়ে প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন শোভারাম বসাক।    
পলাশি-উত্তর যুগে কোম্পানির কর্মচারী রূপে অন্য একদল বিত্তবান লোকের উত্থান দেখল বাংলা। এঁদের মধ্যে মুখ্য চরিত্র হলেন— ক্লাইভের স্নেহধন্য রামচাঁদ রায় ও নবকৃষ্ণ দেব এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের স্নেহধন্য কৃষ্ণকান্ত নন্দী ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। পলাশির যুদ্ধের সময় ফোর্ট উইলিয়ামের দেওয়ান ছিলেন রামচাঁদ। মাইনে ষাট টাকা। মৃত্যুর সময়ে তার সম্পত্তির মূল্য ছিল এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা। নবকৃষ্ণও ছিলেন ষাট টাকা মাইনের মুনশি। পলাশির যুদ্ধের কিছু পরে মায়ের শ্রাদ্ধে খরচ করেছিলেন ন’লক্ষ টাকা। হেস্টিংসের আশীর্বাদ মাথার উপরে থাকায় খুব অল্প সময়ে কৃষ্ণকান্ত নন্দী ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের চমকপ্রদ উত্থান হয়েছিল। অর্জিত সম্পদ এঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন জমিতে, সুদের কারবারে ও পণ্য কেনাবেচায়।   
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ভূসম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানার সৃষ্টি করেছিল।  ব্যবসা-বাণিজ্য ঝুঁকির কাজ। তার যথার্থ দেখভাল করার জন্য মেলা পরিশ্রম, হুড়োহুড়ি, দৌড়োদৌড়ি প্রয়োজন। জমিদারি তুলনায় অনেক নির্ঝঞ্ঝাটের কাজ। উনিশ শতকের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে অধিকাংশ বিত্তবান বাঙালি বাণিজ্যের পরিবর্তে জমিদারিতে টাকা লগ্নিকে নিরাপদ বলে মনে করলেন। উদ্যোগপতি না হয়ে বাঙালি জমিদারে পরিণত হল। বাঙালির দুয়ার থেকে ফিরে গেলেন ব্যবসা-লক্ষ্মী।            
অবশ্য চলতি স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কেটে উনিশ শতকে বেশ কয়েকজন বাঙালি লক্ষ্মীর সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। রামদুলাল দে, দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, রামগোপাল ঘোষ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়সহ আরও অনেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হল, এঁদের পরিশ্রম ও সাফল্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এই উদ্যোগপতিদের উত্তরপুরুষেরা অনেকেই ব্যবসা বিমুখ হয়ে জমিদারির দিকেই ঝুঁকলেন।  ব্যবসা চালাতে গিয়ে কেউ ডুবলেন অনভিজ্ঞতা ও অপেশাদারিত্বের জন্য। কেউ বা বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে পূর্বপুরুষের সঞ্চিত পুঁজিকে তামাকের ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দিলেন। এই সময়েই লক্ষ্মীর খোঁজে কলকাতায় আগমন হয়েছে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের। বংশ পরম্পরায় আজও তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালি পারেনি। ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ জীবনকে বেছে নিয়েছে। সে যুগে জমিদারি, এ যুগে চাকরি।   
প্রবল দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে উঠে এসেছিলেন রামদুলাল দে। চাকরি জুটেছিল ধনী ব্যবসায়ী মদনমোহন দত্তের গদিতে। মাইনে মাসে পাঁচ টাকা। কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান রামদুলালের উন্নতি হল অচিরেই। একদিন মনিবের হয়ে নিলামে অংশ নিয়ে ১৪ হাজার টাকায় রামদুলাল একটা ডুবন্ত জাহাজ কিনে নিলেন। নিলাম সবে তখন শেষ হয়েছে। কাগজপত্রে সইসাবুদ হয়ে গিয়েছে, এমন সময় ছুটে এলেন এক ইংরেজ। রামদুলালের কাছ থেকে জাহাজটি চড়া দামে কিনতে চাইলেন। অনেক দরাদরির পর রফা হল এক লক্ষ টাকায়। মাত্র কয়েক মিনিটে লাভ হয়েছে ৮৬ হাজার টাকা। সৎ কর্মচারী রামদুলাল ফিরে এসে মনিবের হাতে তুলে দিলেন পুরো টাকা। মদনমোহন দত্ত খুশি হয়ে পুরো টাকাটা রামদুলালকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে কয়েক বছরের মধ্যেই রামদুলাল কোটিপতি হয়ে উঠলেন।  
বাংলার সঙ্গে আমেরিকার প্রথম বহির্বাণিজ্যের যোগাযোগ ঘটে রামদুলালের মাধ্যমে। আমেরিকার ব্যবসায়ীরা রামদুলালকে এমন শ্রদ্ধা করতেন যে, তাঁর নামে তারা তাদের একটি জাহাজের নামকরণ করেছিলেন। মৃত্যুকালে রামদুলাল প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর দুই পুত্র— আশুতোষ দেব (ছাতুবাবু) ও প্রমথনাথ দেব (লাটুবাবু) একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানকে বৃহত্তর করতে পারেননি। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত মূলধনকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা অনায়াসে বড় বড় কলকারখানার মালিক হতে পারতেন। কিন্তু ছাতুবাবু ও লাটুবাবুর আমলে ব্যবসার বাড়বৃদ্ধি হয়নি।      
দ্বারকানাথ ঠাকুর ভাড়া করা জাহাজে বিদেশে প্রথম পণ্য পাঠান ১৮২১ সালে। গন্তব্য বুয়েনোস এয়ারেস। প্রথম বাণিজ্য প্রয়াসের পরই পরই দ্বারকানাথ গড়ে তোলেন ওরিয়েন্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স সোসাইটি। এছাড়াও দ্বারকানাথ সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে আরও অনেকগুলি বিমা কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন।     
বিনয় ঘোষ লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের বাঙালীদের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো স্বাধীন শিল্প-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহ ও অনুরাগ দ্বিতীয় আর কারও ছিল কি না সন্দেহ।’ প্রথম জীবনে চাকরি করেছিলেন দ্বারকানাথ। প্রথমে সেরেস্তাদার, তারপরে দেওয়ান। দেওয়ানের চাকরি করতে করতেই তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত বণিক হয়ে উঠলেন। প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে ১৮২৯ সালে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয়। প্রায় ১২ লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে কাজ শুরু করেছিল ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। এই মূলধনে দ্বারকানাথের অংশ ছিল অনেকটা।    
সরকারি চাকরি ছেড়ে স্বাধীন শিল্পবাণিজ্যের জন্য ১৮৩৫ সালে ‘কার টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ স্থাপন করলেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ। তাঁর সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন উইলিয়াম কার ও উইলিয়াম প্রিন্সেপ। বাঙালি ও ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে যৌথ সংস্থা স্থাপনের এই প্রথম নিদর্শন। এই কোম্পানি আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে চিনাকুড়ি কয়লা খনি নিলামে কিনে নেয়। ১৮৩৬ সালের ৯ জানুয়ারি সমাচার দর্পণ লেখে, ‘...আলেকজান্দর কোম্পানির ইস্টেট সম্পর্কীয় রাণীগঞ্জের কয়লার আকর গত শনিবারে নীলাম হওয়াতে বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর ৭০০০০ টাকাতে তাহা ক্রয়  করিয়াছেন।’  
কার টেগর অ্যান্ড কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকা সব কয়লাখনি নিয়ে ১৮৪৩ সালে গড়ে ওঠে ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’। এইসব উদ্যোগের পাশাপাশি রেশম ব্যবসা, নীল চাষ, আফিম চাষেও দ্বারকানাথ অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন।     
পণ্য পরিবহণের জন্য দ্বারকানাথ বিপুল বিনিয়োগ করে একাধিক কোম্পানি গড়ে তোলেন। যেমন ক্যালকাটা ‘স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন’, ‘স্টিম ফেরিব্রিজ কোম্পানি’ ও ‘ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন’ কোম্পানি। ম্যাকিনটোস কোম্পানির ‘ফোর্বস’ নামে একটি জাহাজ কিনে নেন তিনি। একসময় ‘কার টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’র অধীনে ১১টি জাহাজ চলত। এর মধ্যে ছ’টি জাহাজের মালিক ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮৪৬ সালের পয়লা আগস্ট ইংল্যান্ডে তাঁর মৃত্যু হয়। এর পরে মাত্র দেড় বছরের মধ্যে দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলি দেউলিয়া হয়ে যায়। শুধু ভূসম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা মূলধনটুকুই অক্ষত ছিল। দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ব্যবসামুখী না হয়ে জমিদারিকেই অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন।      
ফোর্ট উইলিয়ামের সাহেবদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন মতিলাল শীল। পরে শিশি-বোতল ও ছিপির কারবার শুরু করেন। জলবাণিজ্যে বিদেশিদের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে নিজের বণিকসত্তা সদর্পে ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বাঙালিদের মধ্যে মতিলালই প্রথম পণ্য পরিবহণে বাষ্পীয় জলযান ব্যবহার করেন।     
ইংরেজদের সঙ্গে যুগ্ম মালিকানায় আর যাঁরা ব্যবসা পত্তন করেছিলেন তাদের মধ্যে সেকালের বিখ্যাত বাগ্মী রামগোপাল ঘোষের কথা উল্লেখ করতে হয়। কেলসল নামে এক সাহেবের সঙ্গে যোগ দিয়ে রামগোপাল গড়ে তোলেন ‘কেলসল ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি’। পরে কেলসলের সঙ্গে বিবাদ ঘটলে ‘আর জি ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে নিজস্ব কোম্পানি খুলে প্রভূত উন্নতি করেছিলেন।    
উনিশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতায় স্থাপিত হয়েছিল প্রাণকৃষ্ণ লাহার সওদাগরি অফিস। ইনিও খুব সামান্য অবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবসাক্ষেত্রে চমকপ্রদ সাফল্য লাভ করেছিলেন। প্রথম জীবনে প্রাণকৃষ্ণ কোম্পানির কাগজ কেনাবেচা, আফিম ও লবণের ব্যবসা থেকে প্রচুর টাকা উপার্জন করেন। এই সময় মতিলাল শীলের আনুকূল্যে তিনি কয়েকটি সওদাগরি অফিসের মুৎসুদ্দি হন। পরে নিজস্ব সওদাগরি অফিস স্থাপন করেন।   
মশলার ব্যবসা দিয়ে কারবার শুরু করেছিলেন বটকৃষ্ণ পাল। তিনি মশলার দোকানে কিছু কিছু বিলিতি ওষুধ রাখতেন। পরে কলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ওষুধ ব্যবসায়ী হয়ে দাঁড়ান। তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘বি কে পাল অ্যান্ড কোম্পানি’ দেশীয় ফরমুলায় ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করত। বটকৃষ্ণের প্রচেষ্টা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল’ কোম্পানি স্থাপনে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। বেঙ্গল কেমিক্যাল দেশের প্রথম রাসায়নিক দ্রব্য ও ওষুধ প্রস্তুতের কারখানা। 
উনিশ শতকের শেষের দিকে স্থাপিত হয় এইচ বোস অ্যান্ড কোম্পানির পারফিউমারি ওয়ার্কস। এইচ বোসের পুরো নাম ছিল হেমেন্দ্রমোহন বসু। ইনি ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভগ্নীপতি। এইচ বোস অ্যান্ড কোম্পানির কুন্তলীন হেয়ার অয়েল এক সময়ে বাংলা দেশে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। 
রাধানাথ বসু মল্লিক ১৮৩৮ সালে উইলিয়াম ওয়ালেস নামে এক বাষ্পীয় জাহাজ কিনে জাহাজের ব্যবসা শুরু করেন। পরে এক লক্ষ টাকা ব্যয়ে সালকিয়ায় হুগলি ডক ইয়ার্ড স্থাপন করেন তিনি। বাষ্পযানের প্রচলন পূর্ববঙ্গ ও অসম থেকে পাট পরিবহণের সহায়ক হয়েছিল। এই সময় হুগলি নদীর দুই তীরে দ্রুত পাটকল গড়ে ওঠে। ১৮৫৫ সালে জর্জ অকল্যান্ডের সহায়তায় প্রথম পাটকল স্থাপন করেন বিশ্বম্ভর সেন। ১৮৬৭ সালে কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় ‘শিবপুর আয়রন ওয়ার্কসে’র প্রতিষ্ঠা করেন।   
স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকে বাংলায় বয়ন শিল্পের প্রচলন হয়েছিল। কয়েকজন মুসলমান জমিদার ও ব্যবসায়ী যেমন বগুড়ার নবাব আবদুস সোব্বান, এ গজনভি ও আহমেদ মুশাজি সালাজি বেঙ্গল হোশিয়ারি কোম্পানি শুরু করেন। 
সতীশ মুখোপাধ্যায়ের ডন সোসাইটি (১৯০২-১৯০৭) বাণিজ্য সম্প্রসারণে বহুলাংশে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। তাঁর স্থাপিত স্বদেশি দোকান ছিল স্বল্প মূলধন ব্যবসায়ীদের পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের বাজার। 
১৯০৬ সালে ১২ লক্ষ টাকা মূলধনে স্থাপিত হয় বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল। এর প্রথম পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, রাজা সীতানাথ রায়, স্যার আর এন মুখার্জি, কৃষ্ণচন্দ্র দে ও উপেন্দ্রনাথ সেন। ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়ায় শুরু হয় মোহিনী মিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মোহিনীমোহন চক্রবর্তী।    
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এক বিরাট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হন স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি স্থাপন করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’, ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন কোম্পানি’, ‘বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি’। কর্মজীবনের শুরুতে রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি ছিলেন সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদার। পরে মার্টিন কোম্পানির অংশীদার হয়ে পলতা ওয়াটার ওয়ার্কস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল প্রভৃতি নির্মাণ করেন। ভারতে মার্টিন রেলপথ সমূহ স্থাপনের কৃতিত্ব তাঁর।    
কোনও সন্দেহ নেই উনিশ শতকের নবজাগরণ, পাশ্চাত্যের খোলা হাওয়া এবং সাহেব সংসর্গ এক দল সাহসী বাঙালিকে লক্ষ্মীর সাধনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। কৌলিকবৃত্তিকে অগ্রাহ্য করে তাঁরা বাণিজ্যে ব্রতী হয়েছিলেন। এ বিষয়ে অগ্রপথিক ছিলেন রামদুলাল দে ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, এঁরা সকলেই ছিলেন ব্যতিক্রমী। বাণিজ্যিক ভারতের মুখ্য কেন্দ্রবিন্দু কলকাতায় অবস্থানকারী বিত্তবান বাঙালির সে সময় প্রধান  আগ্রহ ছিল জমিদারি, সরকারি কাজ ও পেশাদারি কাজে। বাঙালিদের বাণিজ্যে অনীহা যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল, তা ভরাট করে দিল পশ্চিম ভারত থেকে আসা বণিকেরা। বংশ পরম্পরায় এখনও তাঁরা কলকাতায় বসে সাফল্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছে।  
ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঙালি পথিকৃৎদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। বাঙালি উদ্যোগপতি আজ দুর্লভ। ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য অভিযানের পরিবর্তে বাধা মাইনের চাকরি বাঙালির কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। অন্নদামঙ্গলের কবি লিখেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। সেই দুধ ও  ভাতের সংস্থান করতে গিয়ে ‘জনঅরণ্যে’র সোমনাথের মতোই অজস্র বাঙালি যুবক আজও সামান্য একটা চাকরির খোঁজে জুতোর শুকতলা খুইয়ে ফেলছে। তবুও ব্যবসা করে স্বনির্ভর হওয়ার কথা তারা ভাবতেই পারে না।      
এপ্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় শংকরের রচিত উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে সোমনাথ ও বিশুদার কয়েকটা সংলাপ— সোমনাথ শুধোয়, ‘আপনি আমাকে চানাচুর বেচতে বলছেন?’  জবাবে বিশুদা বলেন, ‘না না। তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান। তোমাকে তা বলতে পারি? তুমি ব্রাহ্মণ-সন্তান তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে পার কিন্তু সওদা করবে কী করে?’  
‘বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী’— কবে একথায় বাঙালির প্রত্যয় হবে জানা নেই। বাণিজ্য-লক্ষ্মী কবে বাঙালির ঘরে থিতু হবেন, তাও বলা দুষ্কর। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী?
ছবি : তাপস কঁাড়ার

9th     October,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা