বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

জাগো দুর্গা... জাগো
দশপ্রহরণধারিণী
কলহার মুখোপাধ্যায়

প্রচুর আলো। গঙ্গার জলে রোদ্দুর পড়লে চোখ ঝলসে যায়। তবে তা সত্ত্বেও আর্চের নীচে এ দিকটায় রোদ তেমন আসতে পারে না। একটু ছায়া ছায়া। ঝুপসি অন্ধকার। ‘মালিশ পার্টি’ না থাকলে কালো কাঠের পাটা পেতে এখানেই শুয়ে থাকে লখেশ্বর। চোখে রোদ পড়ে। কখনও শরৎ কাটিয়ে দেওয়া কালো মেঘে রোদ ঢাকে। কখনও আইসক্রিমের মতো অবাধ্য মেঘগুলো আকাশে হাবিজাবি জন্তুজানোয়ার এঁকে দেয়। তাদের কয়েকটি অবশ্য কথা শোনে। লখা চাইলেই তার ধাই মায়ের মুখটা স্পষ্ট করে এঁকে দেয় বাধ্য মেঘগুলি। ঠিক তখনই কান্না পায় লখার। এত বছর বাদেও পায়। জীবন ওলটপালট করে দেওয়া মহালয়ার দিনটায় আরও বেশি করে পায়।  
গঙ্গার ঘাটে ঝুপসি অন্ধকার তৈরি করা আর্চগুলি একজন নির্জন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে লখাকে। এই আর্চ নাকি বহু পুরনো! কোম্পানি আমলের। তার বাবা সুখদেব বা তার বাবারও যখন জন্ম হয়নি, তখন হয়তো তৈরি। এক মালিশ পার্টি বলেছিল, রানি রাসমণি নাকি তৈরি করিয়েছিলেন এই ঘাট। এর পাশের পাশেরটা, যেখানে লখার মতো অনেকে মালিশ করে... সেই ঘাটটির নামও রাসমণি ঘাট। ওখানে থাকে না লখা। একটু দূরে একটু নিভৃতে থাকলেই ভালো। অনেক কথা আজকাল আর ভালো লাগে না। ঘণ্টায় ৪০০ টাকা নেয় মালিশ করতে। দু’-একটা পার্টি এলেই দিব্যি খাওয়া জুটে যায়। মহাজাতি সদনের কাছে ঘর ভাড়া আছে একটা। সেটার ভাড়া উঠে গেলেই ঝাড়া হাত-পা। হিন্দিটা তার পোক্ত। এখানে থাকতে থাকতে বাংলাটাও ঝরঝরে। আর বাপ-পিতেমোর ভাষা উড়িয়াটা তো জন্মসূত্রেই জানা। তবে হিন্দি গানই বেশি শোনে সে। পুরনো গান বাজে সে স্টেশনগুলিতে, সেগুলি সেট করা মোবাইলে। এখন সেই লাইনটা হচ্ছে, ‘উমর সে লম্বি রাস্তোকো মঞ্জিল সে পওছতে দেখা নেহি। জিনে কা বজা কুছ ভি নহি, মরনেকা বাহানা ঢুঁনতা থা হ্যায়, এক আকেলা ইস শহর মে...’। আর একটু পর রেডিওতে মহালয়া শুরু হবে। তারপর তর্পণ করতে হু হু করে আসবে মানুষ। ভিড়ে ছেয়ে যাবে গঙ্গার ঘাট। সেই ভিড়... সেই ঘটনা...। অত ভিড় না হলে তাঁতের শাড়ি পরত বউটা। পুজোর আগে কিনে দেওয়ার বায়না ধরেছিল। দেব, বলেছিল লখা। ‘এক আকেলা ইস শহর মে...’। গানটা শুনলে লখার স্মৃতি এক লহমায় রিওয়াইন্ডে। বাঁধভাঙা নদীর মতো ছুটতে থাকে মন। পিছন পিছন দৌড়েও লখা তার নাগাল পায় না। ঠিক তখনই বাধ্য মেঘগুলি আকাশে ধাই মায়ের ছবি আঁকে। আর শাপভ্রষ্ট শবদেহের মতো আলকাতরা মারা পাটাতনটায় এলিয়ে পড়ে তিরিশ বছরের দেহটা। মাথার উপরের আর্চটা তখন তার সব ছায়া ডেকে নিয়ে আড়াল করে দেয় লখার শরীর। প্রবল তাড়নায় সে ছুটতে থাকে পিছন পানে। স্মৃতি আচ্ছন্ন হয়ে ঘিরে ধরে। চোখে ভাসে বাড়ি... ধাই মা... নতুন বউটার নাকছাবির ঝিলিক...। জন্ম দিতে গিয়ে মা প্রায় মরেই যাচ্ছিল। ধাই মায়ের হাতেই জন্ম। তার কোলেপিঠেই বেড়ে ওঠা। জন্মকালের রক্তরস মাখা হাতে তুলে সেই যে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল লখাকে, তারপর আর বুক থেকে নামায়নি। কোনও এক দূর আত্মীয়তা তাদের সঙ্গে। স্বামী হারানোর পর এই গ্রামে এসে ওঠে। বাড়ির পাশে একটা ঘর তাকে দেওয়া দিয়েছিল। সেখানেই একার সংসার। গ্রামের কেউ পোয়াতি হলে দেখাশোনা করত। তার হাত দিয়ে কম বাচ্চা জন্ম নেয়নি! তবে কীভাবে যেন লখা হয়ে গিয়েছিল নিজের ছেলে। লখার বাপ-ঠাকুরদার পেশা ছিল কলকাতা বাবুঘাটে গিয়ে তেল মালিশ করা। ধাই মা সেই পথে যেতে দেয়নি। তিলতিল করে জমানো টাকা দিয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়িয়েছিল। পরের ছেলে হলেও লখাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল ধাই মা। অফিসের বাবু হয়ে ওঠা অবশ্য হয়নি। সেই মালিশওয়ালা তকমাই জুটল লখার কপালে। সে ভাগ্যতাড়িত বলেই অসম্পূর্ণ এক মানুষ। না হল ছেলে হয়ে ওঠা, না হয়ে ওঠা হল স্বামী। 
আচ্ছা, পিতৃপুরুষ ছাড়া কি তর্পণ হয় না? এই প্রশ্নটা বড্ড তাড়া করে লখাকে। জিজ্ঞেস করেছে সে অনেক পুরুত মশাইকে। অকাজের মুহূর্তগুলো ঘাটের ধারে বসে থাকে সে। সবাই মোটামুটি একই উত্তর দেয়... শাস্ত্রে আছে। কে লিখেছে এই শাস্ত্র? কেন লেখা হয়েছে? বউটাকে পছন্দ করে এনেছিল ধাই মা নিজে। বাড়ির লোক আপত্তি জানায়নি। ধাই মার ব্যক্তিত্বটা অদ্ভুত। গরিব হলেও তার ছাপ চেহারায়, আচরণে পড়ত না। কাচা কাপড়চোপড় পরে পরিপাটি থাকতেন। ঘরটা তার নামে লিখে দিয়েছিল লখার বাপ-কাকারা। সেই ঘর আর চিলতে উঠোনে ছিল গুছনো সংসার। ওই রাজত্বে লখা ছিল রাজা। নাড়ুটা তার জন্য, জামাটাও তার জন্য কেনা। বিধবার ঘরে মাছ... তাও লখার জন্য। সবাই জানত, লখার দুই মা। সেই ধাই মার দূরেরও দূরের এক আত্মীয়ার মেয়ে টুসি। মেয়েটির ভালো নাম মনেও নেই লখার। স্কুল ফাইনাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল মেয়েটি। বাবা কৃষক। ফলে খাওয়া পরার অভাব ছিল না। মা হারা, বাবার আদরের মেয়েটি সংসারধর্মে পটু। খুব আদরের। লখার পছন্দই হয়েছিল টুসিকে। তবে সবথেকে বেশি মন টেনেছিল ওর নাকছাবি। থেকে থেকেই ঝিলিক দিত। ফলে তাকে স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা মনে হতো লখার। বিধবা হওয়ার পর তাড়িয়ে দেওয়ার সময় যতটুকু গয়না ধাই মা আনতে পেরেছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে, তার সবটুকুই দিয়েছিল লখার বউকে। এই দিনটার জন্যই হয়তো বেঁচে ছিল বৃদ্ধা। তাই খেতে না পাওয়ার সময়ে একটা গয়নাও বিক্রি করেনি। নতুন একটা নাকছাবি শুধু কিনেছিল লখা। পাথরটা আরও চকচকে। ঝিলিকও বেশি। নাকছাবি, তার মালিক সেই নাকটা, আর নাকের মালিকের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে লখা বিয়েটা করে ফেলে। ম্যানেজমেন্ট পড়া ততদিনে প্রায় শেষ। এবার একটা চাকরি জুটে গেলেই ধাই মা নিশ্চিন্ত। এত সুখ কপালে সইলে হয়?
আর্চের ঝুপসি ছায়ায় লখার বেজায় শীত করে। শরীরটা আরও একটু গুটিসুটি মেরে যায়। গঙ্গা থেকে গরম ভাপ উঠছে। কিন্তু তাতে ঠান্ডা কাটে না লখার।  ছটপট করতে করতে উঠে পড়ে লখা। এরকমই একটা দুপুর...। কালো একটা মেঘ তখন ধাই মার মেঘ-মুখ ঢেকে অন্ধকার করে দিয়েছে আকাশ। শ্মশানের মতো অন্ধকার হয়ে ওঠা এ দুপুর, অসহ্য।   
একদিন ভোরে প্রবল চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় লখার। টুসি বাইরে থেকে এসে জানাল, ধাই মার সঙ্গে গণ্ডগোল পাশের গ্রামের মহাজনের। ধারের টাকার সুদের কিস্তি দেওয়া নিয়ে। লখা দৌড়য়। মহাজনের লোকজন ততক্ষণে চলে গিয়েছে। ডান হাত কাপড়ে চেপে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ধাই মা। সাদা কাপড়টায় লাল ক্রমে ধরছে। এক্ষুণি রক্ত না আটকালে প্রাণে বাঁচানো অসম্ভব। হাতে ১৪টা সেলাই পড়ল। তিনদিন প্রায় সংজ্ঞাহীন। পরে জানা গেল, পড়াশোনার টাকা জোগাড়ের জন্য চড়া সুদে টাকা ধার নিয়েছিল ধাই মা। কিস্তি ঠিকঠাকই শোধ হচ্ছিল। কিন্তু বিয়ের সময় তাতে ছেদ পড়ায় মহাজন খেপে ওঠে। সেদিন এসেছিল জমি বন্ধক রাখা কাগজ নিয়ে। ধাই মা-র ঘরের দখল নিতে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে পড়ে লখা।
জ্বরটা আর কমেনি। ডান হাতটা সেপটিক হয়ে যায়। সেখান থেকে গ্যাংগ্রিন।  সেবারই মহালয়ার সকালে সবাই মিলে গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়ার কথা ছিল। কলকাতায় আসার দিনও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তার ঠিক সপ্তাহ দেড়েক আগের এক দুপুরে ধাই মাকে কাঁধে তুলে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল লখা। সবাই কাঁদছিল। শুধু কাঠের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল লখা। ধকধক করে জ্বলছিল চোখ দুটো। পুলিস, কেসকাছারি, টাকাপয়সার খেলা বিস্তর হয়েছিল। মহাজনের বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। পড়াশোনা শেষ করেনি লখা। বাবুঘাট এসে মালিশ করা শুরু তখন থেকেই। টুসি থেকে গিয়েছিল গ্রামেই। 
কোনারকের খানিক দূরে তাদের গ্রাম। বউকে বলেছিল, একদিন সূর্যমন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে। ধাই মাও যেতে পারবে। আর যাওয়া হয়নি। কলকাতায় গঙ্গার ধারে বসে নাকছাবির ঝিলিকটা লখার মনে ঘাই দিত। ধাই মা মারা যাওয়ার বছর খানেকের মাথায় পুজোর আগে টুসিকে কলকাতায় নিয়ে আসে লখা। মহালয়ার দিন মালিশ বন্ধ। সেদিন বউটাকে গঙ্গায় স্নান করাবে আগেই বলে রেখেছিল। ততদিনে বাবুঘাটে খানিকটা থিতু হতে পেরেছে। মহাজাতি সদনের কাছে ঘরটাও নিয়েছে। সেই ঘরেই পুজোটা কাটাত টুসি। এমনটাই কথা হয়েছিল ঘরের বাকি ভাড়াটেদের সঙ্গে। তারা ওই ক’দিন থাকত হিন্দ সিনেমার পাশে আর একজনের বাড়িতে। পুজোয় তাঁতের শাড়ি কেনা, গঙ্গায় স্নান, কচুরি খেতে যাওয়া, এসি হলে বসে অন্তত একটা হিন্দি সিনেমা, সারারাত ঠাকুর দেখা— এতগুলো প্ল্যান। মহালয়ার আগের দিন নাকচাবিটায় ঝিলিক তুলে স্টেশনে নামল বউ।
সকাল থেকে ভিড় বলে এদিন মালিশ বন্ধ থাকে। মহালয়ার দিন গঙ্গায় ডুব দিলে পুণ্যি হয়, বলত ধাই মা। এই দিনটাতেই টুসি গঙ্গাস্নান করবে বলে বলেছিল। অন্ধকার কাটছে। মাহেন্দ্রক্ষণ। রেডিও চালিয়েছিল লখা। তার পাশে বসল টুসি। সেই প্রথম শুনল, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির/ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;/প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত/জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা।/আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে ওঠে /রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।/ তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।...’
নাকছাবিতে ঝিলিক তুলে টুসি বলেছিল, ‘গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল গো। এমন গান আগে কখনও শুনিনি।’ পুরোটা শুনে তারপর বেরিয়েছিল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে জগন্নাথ ঘাট। মহালয়ার পুণ্য লগ্নে স্নান। তারপর কচুরি খাওয়ার প্ল্যান। 
সকালে সেবার ভিড়টা একটু বেশিই। জগন্নাথ ঘাটে থিকথিক করছে মানুষ। জলে নামার পর কখন যে টুসির হাতটা ভিড়ের চাপে ছেড়ে গিয়েছিল, টের পায়নি লখা। টুসি সাঁতার জানত না। সবাই বলেছিল, সগ্গে  চলে গিয়েছে। লখা থেকে গিয়েছে বাবুঘাটেই।
বহুদিন লখা বাড়ি যায় না। বাবা সেদিন এসে বলে গিয়েছে, মা একটি মেয়ে দেখেছে। বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে দেশের বাড়ি যেতে হবে একদিন। মহালয়ার দিন মালিশ বন্ধ থাকে। ছুটি। সেদিন গেলে সবদিক রক্ষে থাকে। 
অন্ধকার থাকতেই ঘুমটা ভাঙে লখার। মোবাইলে মহিষাসুরমর্দিনী বাজছে। গঙ্গার হাওয়ায় গা শিরশির করছে লখার। ধাই মায়ের জন্য কি তর্পণ করা যায় না? টুসির জন্য? নিজের জন্য? ‘বিমানে বিমানে...’ শুরু হল। আকাশের রং দেখে মনে হচ্ছে আসল নয়। যেন আঁকা ছবি। তাতে ধাই মার ছবিটা আঁকা হচ্ছে। গঙ্গার ঘোলা জলে হালকা লাল রং ধরছে। মেঘের কোণ ছিঁড়ে ঝিলিক দিচ্ছে নাকছাবিটা। ধাই মার মুখ আর নাকছাবিটা কিছুক্ষণের মধ্যে গঙ্গায় এসে মিশবে। ধাই মার শাড়ির গন্ধ, নাকছাবিটা প্রবলভাবে টানছে। গঙ্গার জলে নেমে চলা শুরু করে লখা। মোবাইলটা ঘাটেই রইল। ‘শান্তি দিলে ভরি/দুঃখ রজনী গেল তিমির হরি’— মহালয়া শেষ হচ্ছে। 
ছবি :  সোমনাথ পাল, অতূণ বন্দ্যোপাধ্যায় 

25th     September,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা