বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

/ ১১

আজ ১১ সেপ্টেম্বর। একুশ বছর আগে এদিনই আক্রান্ত হয়েছিল নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার। যার জেরে শুরু হয়েছিল আফগানিস্তান যুদ্ধ। দীর্ঘ দু’দশকের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ফিরে দেখলেন মৃণালকান্তি দাস।
 
মহীরুহ পতন...
কমফর্ট ইন। রুম নং ২৩২। নিজের আর আবদুল আজিজ ওমারির পাসপোর্ট, টিকিট সব গুছিয়ে রাখছিল মহম্মদ আটা। কাল এখান থেকেই বেরিয়ে সকাল ছ’টায় পোর্টল্যান্ড জেটপোর্ট। ফ্লাইট ধরে বস্টন লোগান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ইলেভেন। বিজনেস ক্লাসের টিকিট।
‘চলো, একটু পিৎজা খেয়ে আসি।’ উৎসাহিত হয়েও একটু থমকে গেল ওমারি। ‘যদি কারও নজরে পড়ে যাই?’
হাসল আটা। ‘কাল গোটা পৃথিবীর নজরে পড়বে তুমি। আজকের দিনটা আমাদের। চলো। একটু ওয়ালমার্টেও যেতে হবে। দু’টো ছুরি কিনব।’
ধর্মের মোহে কখনও-কখনও মানুষ হয়ে ওঠে এমনই বারুদ। তখন তাকে দিয়ে সব করানো যায়। মগজের কোষে তার শয়তানের চাষ। নিজেকে বিসর্জন দিতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমন মানুষ তৈরি হয় কোন ভবের কারখানায়? কারা বানায় ‘এক্সপায়ারি ডেট’ লেখা এমন হোমো স্যাপিয়েন্স? দুনিয়া কাঁপানো মার্কিন গোয়েন্দা সংগঠন সিআইএ কি কিছুই জানত না?
ততক্ষণে বিন লাদেনের প্ল্যান চূড়ান্ত!
দশটা নয়, চারটে প্লেন হাইজ্যাক করা হবে মাঝ-আকাশে। প্রতিটা প্লেনের একটা করে টার্গেট থাকবে। পয়লা টার্গেট হোয়াইট হাউস। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাড়ি। দ্বিতীয় টার্গেট পেন্টাগন। পৃথিবীজুড়ে সামরিক দাদাগিরির খুঁটি। আর তিন নম্বর টার্গেটটা আমেরিকার শিরদাঁড়া ভেঙে দেবে। নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জোড়া টাওয়ার। ওদের বিত্ত-বৈভব আর অর্থনৈতিক খবরদারির বিজয়স্তম্ভ। দু’টি টাওয়ার, তাই দুটি প্লেন। একটা চালাবে মারোয়ান, আর অন্যটা আটা নিজে। মারো এবং মরো। সন্ত্রাসবাদের মন্ত্র। সন্ত্রাসী চরিত্রের যে লক্ষণ সবচেয়ে প্রকট, তা হল মৃত্যুলিপ্সা। কেবল বিষ ছড়িয়ে যাওয়াই তাদের কাজ। অন্তের দিকে এগনোই তার মোহ।
১১ সেপ্টেম্বর ২০০১, সকাল ৮টা ১৪ মিনিট। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ইলেভেন। বস্টনের লোগান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে সকাল ৭টা ৫৯ মিনিটে ছেড়ে লস এঞ্জেলস পৌঁছনোর কথা। কিন্তু পৌঁছায়নি। কারণ, এইমাত্র প্লেনের দখল নিয়ে নিয়েছে আল-কায়েদার পাঁচ জিহাদি। চালকের আসনে মহম্মদ আটা। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে সমানে জানতে চাইছে ফ্লাইট হঠাৎ রাস্তা বদলাচ্ছে কেন। আটা বিরক্ত গলায় বলল, ‘শান্ত থাকুন। কিছু হয়নি। আমরা এয়ারপোর্টে ফিরে আসছি।’ তারপর রেডিওটা বন্ধ। ফালতু কথা বলার সময় নয় এখন। লক্ষ্য সামনে। ওই যে মঙ্গলবার সকালের রোদে ঝকঝক করছে মার্কিন অহংয়ের গজদন্ত মিনার। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জোড়া টাওয়ার। আটার লক্ষ্য নর্থ টাওয়ার। দিনের প্রথম আঘাতটা হানার গৌরব তাকেই দিয়েছেন ওসামা বিন লাদেন। শিরদাঁড়া টান করে সোজা হয়ে বসল মহম্মদ আটা। তাঁর হাত শক্ত করে ধরে পাইলটের জয়স্টিক। মুখে স্মিত হাসি, দৃষ্টি সামনে। নর্থ টাওয়ারের ইস্পাত আর কাচের কাঠামোয় ঝলসে উঠছে রোদ। যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে চোখ, তবু পলক ফেলছে না আটা। টার্গেট থেকে নজর সরানো যাবে না।
সকাল ৮টা ৪৬ মিনিট। প্রথমে একটা আওয়াজ। তীব্র। অশুভ। তারপর নাগরদোলার মতো সেনসেশন। ঝড়ে সমুদ্রতীরের গাছগুলি ঠিক যে রকম দুলতে থাকে অচৈতন্য পাগলের মতো, গোটা বিল্ডিংটা সেভাবে দুলছে। খ্যাপার মতো। লক্ষ লক্ষ কাগজের টুকরো আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন ৬০ তলা উচ্চতায় কেউ এক কনফেটি বৃষ্টি সাজিয়েছে বেখেয়ালে। অফিস ফ্লোরে যা হওয়ার কথা, তাই। চিৎকার, আতঙ্ক, পালানোর রাস্তা খোঁজা। কী হয়েছে পরিষ্কার তখনও বোঝা যাচ্ছে না। ভূমিকম্প? কেউ বলছে প্লেন ভেঙে পড়েছে বিল্ডিংয়ে...
সাউথ টাওয়ারে ততক্ষণে ধাক্কা মেরেছে দ্বিতীয় বিমানটি। মাথার উপরে ঝড়ে পড়ছে আগুন বৃষ্টি। আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে লোকজন। কাঁদছে, চিৎকার করছে। গ্রাস করেছে অজানা ভয়। চারদিকে দমবন্ধ করা ধোঁয়ার গন্ধ। মনে হচ্ছে, এ কি মৃত্যুর গন্ধ! হঠাৎ টিভির পর্দায় পেন্টাগন। জ্বলছে একটা দিক। ধোঁয়া বের হচ্ছে। অ্যাঙ্কার বলছেন, টুইন টাওয়ারের মতো একই কায়দায় বিমান দিয়ে ধাক্কা মারা হয়েছে পেন্টাগনেও। ডিসি থেকে লস এঞ্জেলস-গামী আমেরিকান এয়ারলাইনসের ৭৭ নম্বর বিমানটিকে টেক অফ করার ৩৫ মিনিট পরেই জঙ্গিরা অপহরণ করে। ৬৪ জন যাত্রী-সহ সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে পেন্টাগনের পশ্চিম দিকে ধাক্কা মারে বিমানটি। আর চতুর্থ বিমানটি ভেঙে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার শ্যাঙ্কসভিলের একটি মাঠে। ‘সেদিন ১০২ মিনিটই চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছিল আমাদের জীবন,’ লিখে রেখেছে ৯/১১ মেমোরিয়াল অ্যান্ড মিউজিয়াম।
হাতুড়িতে গোটা পৃথিবীটা গুঁড়িয়ে দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই হঠাৎ এক লহমায় সর্বস্ব যেন এক অলৌকিক চাপে চুরমার। বাকি সব অন্ধকার, একশো দশ তলার টুইন টাওয়ার খেলনার মতো চুরচুর হয়ে স্রেফ ধ্বংসস্তূপ। ওই দুই স্তম্ভকে যারা ক্ষমতার দম্ভ ভাবতেন তাঁরা শুনেছিলেন মহীরুহ পতনের শব্দ। এক লহমায় উধাও তিন হাজার মানুষের প্রাণ। টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ থেকে থ্যাঁতলানো, ঝলসানো মৃতদেহগুলি বের করে এনে রাখা হয়েছিল নিউ জার্সি সিটির লিবার্টি স্টেট পার্কে। এত অসহায় মৃত্যু দেখে নিজেকেও অপরাধী মনে হয়! ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আগুন জ্বলেছিল প্রায় ছ’সপ্তাহ ধরে। ওই ধ্বংসস্তূপ সরাতে সময় লেগেছিল প্রায় ছ’মাস। ক্ষয়ক্ষতি অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার। একে কোল্যাটেরল ড্যামেজ ছাড়া কীই বা বলা যায়?
অতঃপর ‘ওয়ার অন টেররিজম’ শুরু। নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করার প্রস্তুতি। আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দুনিয়ায় পৌঁছনো মাত্রই ইসলাম নামধারী মানুষের শরীরজুড়ে খানাতল্লাশি। দুনিয়াটা ভাগ হয়ে গিয়েছে সাদা-কালোয়। সন্ত্রাসবাদী কে, আর কে নয়?— এই প্রশ্নই একমাত্র জরুরি হয়ে উঠেছে পশ্চিমের দুনিয়ার কাছে।
ইসলামি মৌলবাদের বৃদ্ধি, আল-কায়েদার উত্থান, এবং গোয়েন্দা-ব্যর্থতার মধ্যে কোনটার কতটা প্রভাব তার হিসেব কষতেই আমেরিকা হিমশিম। ৯/১১ কমিশনের রিপোর্ট বলছে, আমেরিকার প্রধান ব্যর্থতা ছিল কল্পনাশক্তির অভাব। তাঁরা ভাবতেই পারেননি এক ডজন সন্ত্রাসবাদী প্লেন চালানো শিখবে, বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক বিমানকে বক্সকাটারের সাহায্যে ছিনতাই করবে এবং সেগুলিকে ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, সন্ত্রাসবাদীরা কীভাবে বিভেদের বীজ বপন করতে পারে, তাও ভাবেননি তাঁরা।
একুশ বছর আগের সেই দিন আক্ষরিক অর্থেই আমেরিকাকে সমূলে পাল্টে দিয়েছে— ভিতরে ও বাহিরে। বিমান ওড়াবার দু’ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছনো, সরকারি কার্যালয়ে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, পথে-ঘাটে কড়া নজরদারি, বহু শ্বেতাঙ্গের মনে অভিবাসী-বিরোধী ঘৃণা— ৯/১১-র এই সব নিয়মই গড় আমেরিকার জীবনে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। আমেরিকা আজ নিজের ছায়া দেখেও যেন আঁতকে ওঠে। অবিশ্বাসের সেই কুয়াশা ক্রমে আচ্ছন্ন করেছে বাকি দুনিয়াকেও। প্রত্যাঘাতেরও চেষ্টা হয়েছে বার বার। দানব-দমনের এই চেষ্টাকে বলা হয়েছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। ৯/১১-র পরেও তো বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা বড় কম ঘটেনি। মুম্বই, লন্ডন, প্যারিস, নিস, ব্রাসেলস, ক্রাইস্টচার্চ বার বার কেঁপে উঠেছে সন্ত্রাসের আঘাতে। সন্ত্রাস থেকে গিয়েছে অধরাই। কিন্তু আদতে অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াইটা হয়ে পড়েছে আরও কঠিন।
তবু ৯ বললেই, ওই ১১ সংখ্যাটি যে কী স্বতঃস্ফূর্ততায় বসে পড়ে তার পাশে, সে কথা জানে গোটা দুনিয়া!

ধ্বংসের প্রতিশোধ...

২১ বছর আগের সেই দিন!
মাত্র ১০২ মিনিট। আল-কায়েদার হামলায় মাটিতে গুড়িয়ে গিয়েছিল নিউ ইয়র্ক সিটির বিখ্যাত টুইন টাওয়ার। সেদিন এয়ার ফোর্স ওয়ানের বিমানে বসে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। যারা এটা করেছে, তাদের খুঁজে বের করবই।’ নিজের প্রেস সেক্রেটারি আরি ফ্লাইশারকে বলেছিলেন বুশ। সরকারি প্যাডে প্রেসিডেন্টের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির কাছে। তারপর?
পয়লা নম্বর শত্রু লাদেনকে নিকেশ করতে আমেরিকার সময় লেগেছে আ রও ১০ বছর।
তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল ২৫ লক্ষ মার্কিন ডলার পুরস্কার। এমনকী, আফগানিস্তানে পুরোদমে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে। যে যুদ্ধ চলেছে দু’দশক ধরে এবং আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধ হিসেবে রেকর্ড গড়েছে। কিন্তু ওসামা বিন লাদেন থেকে গিয়েছেন আমেরিকানদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। জর্জ বুশের শাসনকাল পেরিয়ে গিয়েছে নিষ্ফলভাবে। মার্কিন গোয়েন্দা ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সামরিক কৌশলবিদদের বোকা বানিয়ে লাদেন আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়-পর্বতের গুহা ছেড়ে পাঁচ বছর ধরে বাস করেছেন মার্কিন-মিত্র পাকিস্তানে। রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ৮০ মাইল দূরে অ্যাবটাবাদ শহরের একটি বাড়িতে। ওই বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাকাডেমি।
লাদেনকে খুঁজে বের করার কাজে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কে সাহায্য করেছিলেন পাক চিকিৎসক শাকিল আফ্রিদি। তাঁর কাজ ছিল ভুয়ো প্রতিষেধক কর্মসূচির হয়ে প্রচার চালানো এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা। আর তাতেই কেল্লা ফতে। শাকিলের পাঠানো নমুনা থেকে সিআইএ জানতে পারে, অ্যাবটাবাদের ‘ওয়াজিরিস্তান হাভেলি’ নামে সাদা বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছেন সন্ত্রাসের কারিগর বিন লাদেন। এরপর তো গোটাটাই ইতিহাস।
ইতিহাস মনে রাখবে ২০১১ সালের ২ মে’র সেই নিশুতি রাতের ঘটনা!
রাতের আকাশে সেদিন দেখা মেলেনি চাঁদের। অ্যাবোটাবাদ শহর লোডশেডিংয়ে ডুবে। সর্বাধুনিক সমরপ্রযুক্তিতে সুসজ্জিত মার্কিন কমান্ডো বাহিনী পুরো অভিযান চালিয়েছিল পিচকালো আঁধারে নিমজ্জিত বাড়িটির ভিতরে। অভিযানে অংশগ্রহণকারী মার্কিন নেভি সিলের ২৪ কমান্ডো। অন্ধকার আকাশের কোথাও চিলের মতো চক্কর খেয়েছে ড্রোন। সেখান থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে পুরো অভিযানের ভিডিও চিত্র। ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে অভিযান পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বিদেশসচিব হিলারিসহ পেন্টাগন-সিআইএর কর্তারা। লাদেন খতম— তাঁরা এই নিশ্চিত ঘোষণা শোনার জন্য উদগ্রীব। সেদিন প্রথম প্রহরেই সেই বাড়ির তিনতলার একটি ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়েছিল লাদেনের রক্তাক্ত দেহ। নেভি সিলের একটি গুলিতেই উড়ে গিয়েছিল তাঁর কপালের ডান পাশ থেকে মাথার একটা অংশ। ২০০১-এর ১৬ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার অন টেররিজমে’র কর্মসূচির ঘোষণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশ। তার বারো বছর পর ২০১৩ সালের ২৩ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করেন, ‘ওয়ার অন টেররিজম ইজ ওভার’।
আর সেই  পাক চিকিৎসক শাকিল আফ্রিদি? যাঁর পাওয়ার কথা ছিল পুরস্কার। তার জায়গায় মিলেছে কারাদণ্ড! কেউ কথা রাখেনি। সিআইএকে সাহায্য করার দায়ে পাকিস্তানের বিষ নজরে পড়েন আফ্রিদি। ২০১২ সালের মে মাসে শাকিল আফ্রিদিকে ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় পাক আদালত। জঙ্গি যোগাযোগের তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় চিকিৎসকের গায়ে। তাঁকে পেশোয়ারের কারাগার থেকে অজ্ঞাত জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। গোটাটাই রহস্য। শাকিল আহমেদের মুক্তি চেয়েছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওইটুকুই। পাত্তাই দেয়নি ইসলামাবাদ। ওয়াশিংটনও ভুলে গিয়েছে সেই সাহসী চিকিৎসকের কথা।
আমেরিকা শুধু চায় প্রতিশোধ। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দম্ভ গুড়িয়ে যাওয়ার প্রতিশোধ। রেহাই নেই কারও। ৯/১১ হামলার চক্রীদের খুঁজে খুঁজে শাস্তি দিয়েছে আমেরিকা। কেউ মরেছে গুলিতে। কেউ পচছে জেলে।
টুইন টাওয়ার হামলার অন্যতম চক্রী আল-কায়েদা নেতা খালেদ শেখ মহম্মদ ওরফে কেএসএম। বিমানের মাধ্যমে এমন ভয়াবহ হামলার কথা ভেবেছিলেন কুয়েতের এই নাগরিকই। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সিআইএ। আমেরিকার বুকে ওই ভয়াবহ সন্ত্রাস ঘটানোর নেপথ্যে ছিলেন আম্মর আল বালুচি নামে আল-কায়েদার অন্যতম নেতাও। হামলাকারীদের অর্থ-সহ নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন ওই কুয়েতি নাগরিক। আপাতত গুয়ান্তানামো বে কারাগারে রয়েছেন এরা।
টুইন টাওয়ার হামলার চক্রী সৌদি আরবের বাসিন্দা মুস্তাফা আল হাবসাবি, ইয়েমেনের রামজি বিন আসল শিভ, ওয়ালিদ বিন আত্তাশ কেউ রেহাই পায়নি। যেমন পাননি  ৯/১১ হামলার অন্যতম চক্রী আয়মান আল জাওয়াহিরি। আমেরিকা তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেছিল আড়াই কোটি ডলার। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠন ঘুরে মিশরীয় ওই শল্য চিকিৎসকের সঙ্গে লাদেনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। লাদেনের ব্যক্তিগত চিকিৎসকও ছিলেন তিনি। সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞদের মতে, লাদেন ছিলেন আল-কায়েদার মুখ। সংগঠনের ‘মেরুদণ্ড’ ছিলেন জাওয়াহিরি। লাদেনের মৃত্যুর পর আল-কায়েদার প্রধান হন জাওয়াহিরি। দীর্ঘদিন তাঁকে খুঁজে বেড়িয়েছে আমেরিকার গোয়েন্দাদের শ্যেনচক্ষু। একসময় গোয়েন্দারা জানতে পারেন,  আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের শহরতলিতে লুকিয়ে জাওয়াহিরি। তারপর থেকে সিআইএ-এর নখদর্পণে ছিল জাওয়াহিরির দিনলিপি। এক বছর ধরে চলছিল হত্যার ছক। জানা যায়, সেফ হাউসের বারান্দায় বহুক্ষণ কাটাতেন জাওয়াহিরি। সেই সুযোগ নিয়ে চলতি বছরের ৩১ জুলাই সকালে ড্রোন হামলা চালায় আমেরিকা। ড্রোনে ছিল ‘হেলফায়ার’ নামে এক ধরনের বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র। যার আঘাতে কাবুলের অভিজাত শেরপুর মহল্লার সেফ হাউসের বারান্দায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আল-কায়েদা প্রধানের দেহ।
দুনিয়া জেনেছে, ৯/১১ হামলার একের পর এক চক্রীর রক্ত ঝরিয়েই নাশকতার বদলা নিয়েছে আমেরিকা। জাওয়াহিরি নিহত হতেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গর্বিত টুইট, ‘কত দেরি হল, সেটা বড় কথা নয়, কোথায় লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল, তাতেও ফারাক পড়ে না। আমরা ঠিক খুঁজে বার করবই।’ এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়, জাওয়াহিরির মৃত্যুতে কি ৯/১১-এর বৃত্ত সম্পূর্ণ হল?

শেষ জীবিত...

ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কে-নাইন। যদি জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায় এখনও কাউকে। যত সময় এগচ্ছে, আশা কমছে ততই।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার ওয়ানের ৬৪ তলায় নিউ ইয়র্ক এবং নিউ জার্সির পোর্ট অথরিটির অফিস তখন মাটিতে মিশে গিয়েছে। কেউ তখনও জানে না, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ২৭ ঘণ্টা পরও জীবিত রয়েছে তাদের একমাত্র কর্মী। জেনেল গুজম্যান ম্যাকমিলান। হাই হিল জুতো পরে এবং পায়ে ব্যথা নিয়ে তবুও ১৩ তলা পর্যন্ত নেমে এসেছিলেন জেনেল। আচমকা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল গোটা টাওয়ারই। নিজের ২৭ ঘণ্টা আটকে থাকার স্মৃতি নিয়ে লেখা ‘অ্যাঞ্জেল ইন দ্য রাম্বল’ বইতে জেনেল লিখেছেন, চেতন-অচেতনের দোলাচলে কাটানো ওই ২৭ ঘণ্টায়, তিনি যখন আকুল হয়ে ডাকছিলেন ঈশ্বরকে, একটি জ্যোতির্ময় কণ্ঠ শুনেছিলেন জেনেল, যেন কেউ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘মাই নেম ইজ পল, আই অ্যাম দেয়ার টু সেভ ইউ।’
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বাঁ হাত দিয়ে একটু চাপ দিতেই কংক্রিটের চাঁইয়ের মাঝে অল্প একটু ফাঁক হল। বেঁচে থাকার আর্তিতে চিৎকার। যতটুকু সম্ভব জোরে। হ্যাঁ, শুনেছে ওরা ওর গলার আওয়াজ। উদ্ধারকারীরা চিৎকার করে বলছে, বুঝতে পারছে না জেনেল ঠিক কোথায়। আর একটু চাপ। এবার হাতটা বেরিয়ে এল। উল্টো দিক থেকে কেউ একটা হাত ধরল। সে হাত মানুষের না ঈশ্বরের? এরপরই তাকে হাত ধরে টেনে তোলা হয়।
২৭ ঘণ্টা বন্দি থাকার পর, আরও কয়েক ঘণ্টা সময় লাগল জেনেলকে বের করতে। পায়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেঁথে গিয়েছিল স্টিলের বিম। স্ট্রেচারে চেপে জেনেল যখন আবার নেমে এল মাটিতে, দাঁড়িয়ে থাকা উদ্ধার কর্মীদের মুখে আনন্দের ছোঁয়া। আরও একজনকে বাঁচানো গিয়েছে। স্মৃতি বলছে, জেনেলই শেষ, জেনেলের পরে আর কাউকে জীবিত পাওয়া যায়নি গ্রাউন্ড জিরো থেকে। পরে, নিজের স্বামীকে নিয়ে নিউ ইয়র্কের ফায়ার ফাইটারদের অফিসে ছুটে গিয়েছিলেন সেই জনৈক ঈশ্বরের খোঁজে। কাউকে পাওয়া যায়নি।
রন ডি ফ্রাঞ্চেসকোর কথাই ধরুন। আকাশচুম্বী সাউথ টাওয়ারের ৮৪ তলায় ছিল তাঁর অফিস। চোখের ভিতরেই গলে গিয়েছিল কনট্যাক্ট লেন্স। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আগুন নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন স্টিফেন সিলার। তাঁর ভাই ফ্রাঙ্ক সিলার বলেন, ‘এটা পার্ল হারবারের মতো। আমেরিকা পার্ল হারবারকে ভোলেনি এবং আমেরিকা ৯/১১-কেও ভুলবে না।’
৯/১১-র গল্প তো শুধু মর্মান্তিক স্মৃতি নয়, এ গল্প সাহসেরও!

11th     September,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা