বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

সাদাকালোর ম্যাজিকেই আন্তর্জাতিক তিনি

কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘পথের পাঁচালি’ সম্মানিত হওয়ার পরপরই সারা পৃথিবীতে সত্যজিতের নাম ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যন্ত ১২টি পুরস্কার পেয়েছে ছবিটি। নিউ ইয়র্ক, বার্লিন, ডেনমার্ক, ম্যানিলা, ভ্যানকুভার, এডিনবার্গসহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে আসে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘পথের পাঁচালি’-কে সম্মানিত করা হয় ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ (শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল) হিসেবে। এই ছবির ৫০ বছর পূর্তিতে ‘দুর্গা’ উমা দাশগুপ্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তখন আমরা কলকাতায়। কাগজে পড়ছি সেই নিশ্চিন্দিপুরের সোনাডাঙার মাঠ নিউ ইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউতে দেখানো হচ্ছে। ছবিটি দেখার জন্য ছাত্রছাত্রীদের ডিসকাউন্টে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। কারণ সকল মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পথের পাঁচালি সকল মানুষের জীবনদর্শনে শিকড়ের সন্ধান দিয়েছে। তাই তো এই ছবির আবেদন সর্বজনীন।’ আর ওই বয়সে প্রিমিয়ার শোতে ‘পথের পাঁচালি’ দেখতে বসে সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুভূতি হয়েছিল অন্যরকম। ‘দিদির মৃত্যুদৃশ্য দেখে হলের মধ্যেই কেঁদে ফেলেছিলাম,’ বলছিলেন তিনি। 
সারা জীবনে ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেছেন সত্যজিৎ। তা ছাড়া তথ্যচিত্র বা দূরদর্শন চিত্র তো আছেই। যুবক বয়সেই সাদাকালোর ম্যাজিক দেখিয়েই আন্তর্জাতিক হয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই এক-একটা মাইলস্টোন। বাঙালির হলেও তিনি সর্বজনীন। ছবি তৈরিতে মহারাজা। যে কাহিনি পছন্দের সেটি নিয়ে তৈরি করেছেন সিনেমা, যে শিল্পী উপযোগী তাঁকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। বিচিত্র বিষয়, বিচিত্র আঙ্গিকে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাসে তিনি একটি চিহ্নিত অধ্যায়।
বার্গম্যান যেখানে শুধুই আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা শোনাতে ব্যস্ত, কুরোসাওয়া যেখানে স্থির— মধ্যযুগের সামুরাই জাপানে, সেখানে সত্যজিতের ছবি বিষয়বস্তুর শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত। ক্যামেরার সঠিক কোণের নির্বাচন, শিল্পীদের অভিব্যক্তি, কম্পোজিশনের নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে সেলুলয়েডে সাহিত্য লিখেছেন। শুধু বিভূতিভূষণ, পরশুরাম বা তারাশঙ্করের কাহিনিই নয়, রবীন্দ্রকাহিনিকেও নতুন করে গড়েছেন তিনি। রামমোহন, মধুসূদন, বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও ছিলেন নবজাগরণের দূত। পৃথিবীর কোন দেশ জয় করেননি তিনি! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে আজও তাঁর জয়জয়কার।
সত্যজিৎ যেন পরশপাথর। ছবির জগতে আগন্তুক হয়েও বিশ্ব-সিনেমায় অপরাজিত। জীবনকৃতির সম্মাননা হিসাবে পেয়েছেন অস্কার। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘লিজিয়ঁ অব নর’, ‘ভারতরত্ন’ ছাড়াও পেয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য স্বীকৃতি। সত্যজিৎ-ই প্রথম ভারতীয় পরিচালক যিনি অস্কার পেয়েছিলেন (ভারতীয় হিসেবে প্রথম অস্কার পান ভানু আথাইয়া। ‘গান্ধী’ ছবির ড্রেস ডিজাইনার হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন এই পুরস্কার)। চার্লি চ্যাপলিনের পরে সিনেমার জন্যে অক্সফোর্ড থেকে সত্যজিৎ পেয়েছিলেন ডক্টরেট ডিগ্রি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশে আজও তিনি অম্লান। কলকাতা তো সেই কবে থেকেই সত্যজিৎময়। সিনেমাপ্রেমী মানুষের কাছে সত্যজিৎ একটি আবেগের নাম। তাঁর নামে ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিশফ লেফ্রয় রোড সংলগ্ন রাস্তাটির নামকরণ করেছেন ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’।  ‘পথের পাঁচালি’ মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই ওপার বাংলায় তাঁদের পূর্বপুরুষের বাড়িটি বিখ্যাত হতে থাকে। সত্যজিৎ এখানে না জন্মালেও, কখনও না এলেও বাড়িটি সত্যজিৎময় হয়ে ওঠে। ওখানকার মানুষজন মসুয়ার বাড়িটিকে বলে থাকেন ‘পূর্ববঙ্গের জোড়াসাঁকো’। আর তাঁর নামে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে একাধিক ক্লাব ও সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ। ফ্রান্সে তাঁকে নিয়ে চর্চা অবিরত। ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘অপু ট্রিলজি’, ‘নায়ক’, ‘মহানগর’ ইত্যাদি ছবি আজও সেখানে জনপ্রিয়। সত্যজিৎ রায় স্বয়ং বলেছিলেন, ‘ফ্রান্স আমার সবচেয়ে বড় মার্কেট।’ প্যারিসের ফিল্ম স্কুলে একটি ক্লাসের নাম ‘সত্যজিৎ রায়’। 
সত্যজিৎ কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পরিচিতি পেলেও যথার্থ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে বার্লিন। এখান থেকে তাঁর যে ছবিগুলি পুরস্কার পায়— ‘চারুলতা’, ‘মহানগর’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ও ‘অশনি সংকেত’। এর মধ্যে ‘অশনি সংকেত’ স্বর্ণ ভল্লুক পুরস্কার পেয়ে শ্রেষ্ঠ ছবির তকমা পেয়েছে। সত্যজিতের সমস্ত ছবির রেট্রোস্পেক্টিভ হয়নি, না হলেও বার্লিন ক্ল্যাসিকালে গত আট বছরে তিনিই সেরার তালিকায় রয়েছেন। ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব মেলবোর্ন ২০২১-এ সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে। উৎসব শুরু হয়েছিল ‘মহানগর’ ছবি দিয়ে। ২০১২ সালে মেলবোর্ন শহরে অস্ট্রেলিয়া ইন্ডিয়া ইনিস্টিটিউটে সত্যজিৎ রায়ের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যজিৎ  রায়ের উপর একটি বিশ্বমানের আর্কাইভ এবং অধ্যয়ন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কাজ করেছেন অধ্যাপক দিলীপ বসু। লস এঞ্জেলসের অ্যাকাডেমি থেকে অনুদান পেয়ে তিনি সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র ও অধ্যয়ন সংগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে আর্ট মিউজিয়াম, প্যাসিফিক ফিল্ম আর্কাইভ, আমেরিকান সিনেমাথেক, স্ট্যানফোর্ড থিয়েটারসহ আমেরিকা জুড়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর চলচ্চিত্র গবেষণার বিষয়।  এইভাবেই সত্যজিতের কাজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

21st     August,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা