বন্ধু, কী খবর বল?
সুদীপ্ত রায়চৌধুরী : ১৯৫৫ সাল। শশব্যস্ত টেকনিশিয়ান স্টুডিও। শ্যুটিং চলছে। আচমকাই সব বন্ধ। সভা ডেকেছেন জহর রায়। শুরু হল বক্তৃতা! জহর বলছেন, ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আজ একটি রেকর্ড করেছে। কমেডি করে গাড়ি কিনেছে। বাংলা সিনেমায় কমেডিয়ানের প্রথম গাড়ি। এ আমাদের সবার অহঙ্কার।’ সেই জমায়েতে উপস্থিত ছিলেন খোদ সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু। জহরকে গাড়ি কেনার কথা জিজ্ঞাসা করা হলেই তাঁর এক জবাব, ‘কেন, ভানু তো কিনেছে!’ বন্ধুর আদেশে ফি শনিবার ভানুর অস্টিন পৌঁছে যেত জহরের কাছে। সেই গাড়িতেই টালিগঞ্জে আসতেন তিনি। ভানুর ভরসা ছিল ট্যাক্সি। বন্ধুত্বই যে তাঁর সাফল্য। আর বন্ধুর সাফল্য আপন করে নেওয়া? সেটা জহর রায়ের গুণ। আসলে কিছু কিছু শব্দ-নামের জন্মই যেন একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকার জন্য। এক ব্র্যাকেটে তাঁদের বাস। তেমনই যে ছিলেন ভানু-জহর। চারের দশকে শুরু। অভিনেতা-পরিচালক সুশীল মজুমদারের বাড়িতে। তারপর ৩০ বছর একই স্রোতে বয়ে গিয়েছে সেই বন্ধুত্ব।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার ঘিরে। কে পাবেন, তা ঠিক করতেন দর্শকরা। ভোটের মাধ্যমে। ১০ বার শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতার পুরস্কার জিতেছিলেন ভানু। একটা রেকর্ড। একবার সেই পুরস্কার জিতে নেন জহর রায়। তা শুনে ভানুর সহাস্য উক্তি, ‘জহর পুরস্কার পাইসে, এ আমার হার নয়। অর পুরস্কার পাওনের অর্থ আমারই পুরস্কার জেতা।’ দু’জনেই ছিলেন পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। সেই বাঁধন ছিন্ন হয় জহর রায়ের মৃত্যুতে। বন্ধুহীন ভানু বলেছিলেন, ‘ব্র্যাকেটটা ভেঙে গেল।’
উৎসবে ব্যসনে চৈব, দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ, যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।।
চাণক্য শ্লোকের দু’টি লাইন। ‘আদর্শ’ বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু শব্দের ব্যাখ্যায় এই সম্পর্ককে বাঁধা যায় না। এর বিস্তৃতি বিশাল। অতল সমুদ্রের মতো। ঠাঁই মেলে না। আবার চরিত্র তো বেঁচে থাকে কিছু শব্দেই! যেমন ‘গুগাবাবা’। এও একটা ব্র্যাকেট। গুপী গাইন, বাঘা বাইন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ নিয়ে সিনেমা করার আবদার জুড়েছিলেন তেরো বছরের সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ। সিদ্ধান্ত নেন সত্যজিৎও। প্রথমে ‘রাজা’র চরিত্রের জন্য ভেবেছিলেন ছবি বিশ্বাসকে। স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী ছবি আঁকার পর দেখেন, রাজা হিসেবে সন্তোষ দত্তই ফিট। বদলে যায় সিদ্ধান্ত। বাঘা কিন্তু রবি ঘোষই। কিন্তু ‘গুপী’ কে হবেন? আঁকা ছবি অনুযায়ী, ‘গুপী’র চেহারা রোগা, লম্বা। মাথায় একটু বড় চুল। কিন্তু কে এই ‘গুপী’! কোথায় পাব তাঁরে! শুরু হল খোঁজ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভেবেছিলেন, তাঁকেই করা হবে গুপী। কিন্তু তা করা হল না। প্রায় সপ্তাহখানেক পর তপেন চট্টোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করেন বিজয়া রায়। লাইট হাউসের সামনে সত্যজিতের সঙ্গে দেখা হয় তপেনের। একদিন হাজির হলেন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। শুনলেন ‘গুপী-বাঘা’র কথা। পাশে বসে রবি ঘোষ। আলাপ। সিনেমার সূত্র ধরে সেই আলাপচারিতা গড়ায় নিবিড় বন্ধুত্বে। ১৯৯৭ সালের বইমেলায় কীভাবে কাদা বাঁচিয়ে রবি ঘোষ হেঁটেছিলেন, তা একাধিকবার দেখিয়েছিলেন তপেন। সেবছর বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যাওয়ার তিনদিন পর ফের শুরু হয় মেলা। ৪ ফেব্রুয়ারি আচমকাই বয়ে আনে রবি ঘোষের মৃত্যুসংবাদ। থেমে যায় বন্ধুত্বের চাকা। সঙ্গী হারিয়ে ‘গুপী’র উক্তি, ‘শনিবার জুটি ছিলাম, রবিবার একা গেলাম।’
মৃত্যু। কত শত সম্পর্কে দাঁড়ি টেনেছে ছোট্ট একটা শব্দ। ভেঙেছে ঘর-বাড়ি-মন। অথচ এই মৃত্যুকে ছুঁয়েই বন্ধুত্বের জয়গাথা শুনিয়েছিলেন ডাঃ ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থুড়ি, অমিতাভ বচ্চন। শুনিয়েছিলেন তাঁর এক রোগীর কথা। ‘আনন্দ’-এর কথা। কর-গোনা জীবন ফুরিয়ে যাবে জেনেও আশপাশের প্রতিটি মানুষকে খুশি আর আনন্দে ভরিয়ে রাখার ব্রত নিয়েছে সে। নামের প্রতি যথার্থ সুবিচার। ‘আনন্দ’রূপী রাজেশ খান্নাকে পেয়ে যেন জীবনের রসদ খুঁজে পান চিকিৎসক ভাস্কর। বুঝতে পারেন, মৃত্যু কবিতার মতো শান্তির শেষ আশ্রয়। সেই হাত ছোঁয়ার আগে বাঁচতে হবে প্রাণভরে। স্বল্পায়ু জীবনকেও বড় করে বাঁচার শিক্ষা বন্ধু আনন্দের থেকেই পেয়েছিলেন ভাস্কর। রিলের গল্প আম আদমিকে কাঁদিয়েছিল। কেঁদেছিলেন রাজেশও। একাকী। রিল লাইফের ‘বাবুমশাই’য়ের উত্থান মানতে পারেননি তিনি। তিক্ত সেসব দিন ভুলে অবশ্য সামনের দিকে এগচ্ছিলেন অমিতাভ। কানে এল রমেশ সিপ্পির কথা। আইকনিক এক সিনেমা তৈরির কথা ভাবছেন নামজাদা এই পরিচালক। ‘শোলে’। কিন্তু কাস্ট প্রায় ঠিক। জয়— শত্রুঘ্ন সিনহা। বীরু—ধর্মেন্দ্র। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার আগে হঠাৎ একদিন ধর্মেন্দ্রর কাছে যান অমিতাভ। কাজের অনুরোধ নিয়ে। ফেরাতে পারেননি। ভাগ্যিস! রমেশ সিপ্পির হাত ধরে তৈরি হল ইতিহাস। ভারত খুঁজে পেল বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। জয়-বীরু। এখনও পর্যন্ত বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় বন্ধু জুটি। যে জুটি সেই কবে গেয়েছিল ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’। মনে মনে ফিসফিস করে এখনও সেই লাইন আউড়ে চলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সিনেমায় জয়-বীরুর পয়লা নম্বর দুশমন হলেও বাস্তবে ‘গব্বর’ আমজাদ খানের সঙ্গেও দু’জনের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। ছবিতে গব্বরের সঙ্গীদের হাতে মৃত্যু হয় জয়ের। তবে পর্দার বাইরে একবার বন্ধু ‘গব্বর’কে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন অমিতাভই। গোয়ায় ‘দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার’ ছবির শ্যুটিং। সেটে আসার সময় পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন আমজাদ খান। শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে হতে প্রায় কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। বন্ধুর এই বিপদের খবর পেয়ে শ্যুটিং ছেড়ে হসপিটালে হাজির হন অমিতাভ। কাগজপত্রে সইসাবুদের পাশাপাশি রক্ত দিতেও দু’বার ভাবেননি তিনি। প্রাণে বাঁচলেও সিনেমাটি অবশ্য করা হয়ে ওঠেনি আমজাদের। তাতে অবশ্য ভাটা পড়েনি সম্পর্কে। এটাই তো বন্ধুত্ব! আর বন্ধুর জন্য ঝুঁকি নিতে পিছপা হয়নি এলিয়ট, মাইকেল, গ্রেটিরাও। ক্যালিফোর্নিয়ার জঙ্গলে পথ হারানো ইটিকে পুলিস-গোয়েন্দাদের হাত থেকে বাঁচাতে দ্বিধাবোধ করেনি এলিয়টরা। হলই বা সেই বন্ধু ভিনগ্রহী। হলই বা কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা। বন্ধুত্বের বাঁধন কিন্তু অটুট।
বন্ধুত্ব রক্তের সম্পর্ক নয়। তার চেয়েও বেশি কিছু। মানুষের নানা ধরন। পছন্দ, অপছন্দ। তা সত্ত্বেও অমোঘ এক মায়াজালে বাধা পড়ে তিনজন। সিড-আকাশ-সমীর। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে এসে হাজির হয় ভালোবাসা। ফাটল ধরে বন্ধুত্বের দেওয়ালে। প্রেমের কারণে আলাদা হয় পথ। আবার প্রেমের কারণেই ফিরে আসে তারা। উপলব্ধি করে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের টান। এটাই ফারহান আখতারের ‘দিল চাহতা হ্যায়’ ছবির নির্যাস। খুব সহজ, সরল। আমাদের জীবনের মতোই। অথচ তাঁর এই সিনেমাই বদলে দিয়েছে বলিউডে বন্ধুত্বের গল্প বলার ধরন। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আত্মপ্রকাশ হল নতুন রূপে। নয়া বন্ধুত্বে। সে বন্ধুত্ব মুন্না ভাই ও সার্কিটের, আবার কখনও রাজু, ফারহান, র্যাঞ্চোর। আমরা দেখলাম, ‘কেমিক্যাল লোচা’ মার্কা এই সম্পর্কের কোনও গণ্ডি নেই। সমাজের সব তলাতেই এর অবাধ আধিপত্য। তাই তো টাপোরি গুন্ডা মুন্নার ডাক্তার হয়ে ওঠার স্বপ্ন ডাঃ আস্থানা সহ অন্যদের কাছে হাস্যকর মনে হলেও পাশে থাকে শুধু সার্কিট। তাঁকে ঘিরেই মুন্নার আসলে মুন্না হয়ে ওঠা। এই অমোঘ টানেই হার্ট অ্যাটাকের অভিনয় করে রানওয়ে থেকে ফিরিয়ে আনা বিমানকে। অন্যের নাম ভাঁড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়া কলেজবেলায়। নেপথ্যে ছিল একটি মাত্র মেসেজ—হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর খোঁজ মিলেছে। তার জন্য চুলোয় যাক গোটা দুনিয়া। নিখাদ ব্রোম্যান্স।
সিনেমা। কয়েক ঘণ্টার রুপোলি মুগ্ধতা। অথচ পর্দার সেই ব্রোম্যান্সে আচ্ছন্ন হয় এক একটা প্রজন্ম। সময় বদলায়। বদলে যায় সংজ্ঞাও। থেকে যায় বন্ধু। মেটাভার্সের মুগ্ধতা কাটিয়ে আমরা খুঁজি এমনই বন্ধুতা। রাতবিরেতে হাক্কা নুডলস খেতে ইচ্ছে করলে বন্ধু গিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলের শেফকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসে। মৃত্যুশয্যায় বন্ধুর কোলে পড়ে থাকা অবস্থাতেও বলে, তোর ছেলেমেয়েদের আমাদের বন্ধুত্বের গল্প নিশ্চয়ই শোনাবি। আবার কখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা বন্ধুকেই আর এক বন্ধু বলে, তোকে বাঁচতে হবে। আবার কলম ধরতে হবে। সুকান্ত-প্রশান্তরা তো অমলিন... চিরকালীন। জীবনযুদ্ধে ভেঙে পড়া মনটাও সজীব হয়ে ওঠে। সময়ের পলি তখন মুছে যায়, থেকে যায় একটি লাইন... ‘বন্ধু, কী খবর বল?’
পুরানো সেই সখার কথা...
কলহার মুখোপাধ্যায়: বাল্যে ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল...। কৈশোরে লাল ফিতে সাদা মোজা...। যৌবনে এই একলা ঘর আমার দেশ...। আর বার্ধক্যে, চিরসখা হে...। এই সব নিয়েই তো সাধারণের জগৎ! তাই না...? আর এই জগতে দুই ব্যক্তি যখন সমানতালে কনট্রিবিউট করে, তখনই তো বন্ধুত্ব। মানুষের নিজস্ব কক্ষপথে যে স্যাটেলাইট ঠিকঠাক ফিট করে যায়, সেই হল বন্ধু। সে বন্ধুত্ব সাধারণের হতে পারে, অসাধারণেরও। বাংলার কয়েকটা উপন্যাসের কালজয়ী চরিত্রগুলোকে খেয়াল করে দেখুন—বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’-এ শঙ্কর-আলভারেজের বন্ধুত্ব, কিংবা ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরা ও বিনয়। আবার ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের নিখিলেশ-সন্দীপ। অদ্ভুত না বন্ধুত্বের রসায়নটা? সুতোটা যেন ছিঁড়েও ছেঁড়ে না। ছেলেবেলার ক্লাস ফ্রেন্ড মোহিত তাই কয়েক যুগ পরেও জয়ের মধ্যে সেই রসায়নটা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। ও সরি, শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। এগুলো দিয়ে চলবে তো?
—কী যে বলেন মশাই! ফেলু মিত্তিরের সাজেশন বলে কথা! চলবে না, দৌড়বে।
এতগুলো কথা বলে ফেলেও সিগারেটে আগুন এখনও দেয়নি ফেলুদা। ফিল্টারের পিছনটা দিয়ে প্যাকেটে বেশ খানিকক্ষণ ধরে ঠুকে চলেছে। নিজের সঙ্গে একটা সমঝোতা আর কী! চ্যালেঞ্জ বললেই বা ভুল কোথায়? সিগারেট হাতে থাকবে, কিন্তু মুখে যাবে না। বয়স হয়েছে। কাগজে তাঁর আর প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে লেখাটা বেরনো ইস্তক ক্লায়েন্টদের আনাগোনা ফের শুরু হয়েছে। স্মার্ট ফোন ব্যবহার করছেন প্রদোষচন্দ্র মিটার। লালমোহনবাবু বলার পর অ্যাপ ক্যাব ভাড়া করে হাজির হয়েছেন গঙ্গার ধারে। জটায়ুর টাক আরও একটু প্রশস্ত। বইয়ের কাটতি এবং রয়্যালটি, কোনওটাই মন্দ নয়। সেকেন্ড হ্যান্ড সবুজ অ্যাম্বাসাডার বদলে নতুন একটি সেডান কিনেছেন। এসেই ঘোষণা করেছেন, চিন্তা করবেন না। আপনাকে বাড়ি নামিয়ে আমি গড়পাড় ফিরব।
এবার বর্ষাটা খাপছাড়া। তবে আজ যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। একটি সংগঠন লালমোহন গাঙ্গুলিকে বক্তৃতা দিতে আহ্বান জানিয়েছে। সাবজেক্ট, বন্ধু দিবস। ফেলুবাবুর কাছে শেষ মুহূর্তে ক্লাস নেওয়ার অভ্যাসটা এখনও ছাড়তে পারেননি। ভাবেন, একবার ছুঁয়ে নিই। যদি আবার উটের পাকস্থলী হয়ে যায়! ফেলুদাই সাজেস্ট করেছে, বাংলা সাহিত্যের অমর সব চরিত্রের বন্ধুত্ব নিয়ে বলুন। আর এই সাবজেক্টে ক্লাস নেওয়ার জন্য গঙ্গার ধারই সেরা ক্লাসরুম।
—গভীরে যাওয়ার আগে... বুঝলেন লালমোহনবাবু, অ্যাডভেঞ্চার দিয়ে শুরু করাটাই ভালো। ওটাই আপনার ইউএসপি। মানুষকেও টানে বেশি। তাই ‘চাঁদের পাহাড়’ দিয়েই শুরু করবেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছর পাঁচেক আগে অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে শঙ্করের চরিত্রায়ন করলেন। সঙ্গে আলভারেজ। দু’-তিনটে বিষয় আমাকে নাড়া দেয় লালমোহনবাবু। ভেবে দেখুন, আলভারেজের অন্তিম পরিণতি আগে, অন্যভাবেও হতে পারত। শঙ্কর তাকে জল-খাবার দিয়ে শুরুতেই বাঁচিয়ে তুলে মানবিকতা দেখিয়েছে। আমরা জানি, হিন্দুধর্মে ছুঁৎমার্গের প্রভাব কেমন। আলভারেজকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে এসবের পরোয়া করেনি শঙ্কর। বন্ধুত্ব কিংবা মানবিকতা যাই বলুন, এ ক্ষেত্রে নিজের ভাবধারাকে অতিক্রম করেছে চরম আস্তিক দেশের একটি যুবক। আর, পর্তুগিজ আলভারেজের সামনে বাঙালি জাতির যাতে মাথা নিচু না হয়, ভারতবর্ষের মানমর্যাদা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, তার জন্য নিজের ক্লান্ত অবসন্ন ভাব সর্বদা লুকিয়ে গিয়েছে শঙ্কর। এটা কিন্তু স্বদেশপ্রেমের বিজ্ঞাপন। ভারতের শিশু থেকে বৃদ্ধ—প্রত্যেকের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের বীজমন্ত্র বুনে দিয়েছেন লেখক। কিছু মনে করবেন না, আপনার প্রখর রুদ্র পড়ার আগে এখনকার বাচ্চাদের অবশ্যই চাঁদের পাহাড় পড়া উচিত। আলভারেজ শুধু বন্ধু নন, দলনেতাও বটে। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। সেই প্রমাণও বারবার দিয়েছে শঙ্কর। তাই বারবার আলভারেজের পরামর্শ মেনে দুর্গম পথ চলায় ভুল করেও করেনি শঙ্কর। শুধরে নিয়েছে নিজেকে। দারুণ বিপদেও অধৈর্য হয় না। মেজাজ হারায় না। স্নায়বিক দুর্বলতা প্রকাশ করে না। আবার বন্ধুর মৃত্যুর পর উপলব্ধিও হয় ‘...হীরার খনিতে তার দরকার নেই। বাংলাদেশের খড়ে ছাওয়া ঘর, ছায়াভরা শান্ত গ্রাম্য পথ, ক্ষুদ্র নদী, পরিচিত পাখিদের কাকলী—সে-সব কত দূরের কোন অবাস্তব স্বপ্ন-রাজ্যের জিনিস, আফ্রিকার কোনো হীরকখনি তাদের চেয়ে মূল্যবান নয়।’
সিগারেট ধরাল ফেলুদা। লাল নোটবই খুলে লিখছেন জটায়ু।
—এবার সত্যজিৎবাবুর গল্প খেয়াল করুন। ‘দুই বন্ধু’ গল্পে লিখছেন, দুই দশকের জার্নি। মহিম আর প্রতুল, দুই কিশোর বন্ধু। স্কুল শেষে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করে, বিশ বছর পর তারা দু’জনেরই চেনা একটা জায়গায় আবার দেখা করবে। মহিমের মনে ছিল। কিন্তু প্রতুলের? সন্দেহ ছিল। এখানে সত্যজিৎবাবু কৈশোরের আবেগের সঙ্গে জীবনের রূঢ় বাস্তবের একটা মিলমিশ ঘটাতে চেয়েছেন। গল্পের শেষটা খবরদার বলবেন না লালমোহনবাবু। অন্তত এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাড়ি ফিরে বাকিটা পড়ে নেওয়ার সুযোগ দেবেন। এবার আসা যাক শরৎ চাটুজ্জের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য—ইন্দ্রনাথের নামে এই একটা কথাই প্রথমে মনে আসে। শ্রীকান্তর সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব অপার রহস্যে ঢাকা। কেনই বা অপরিচিত কিশোরটির জন্য গুন্ডাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামল ইন্দ্রনাথ? কেনই বা কিছু না জেনে গঙ্গা অভিযানে সম্মতি দিয়ে জীবন বাজি রাখে শ্রীকান্ত? দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুই চরিত্রের মধ্যে বন্ধুত্ব। এই রসায়ন চিরকাল ভাবিয়েছে মানব সমাজকে। আপনি লেখক মানুষ। বিলক্ষণ বোঝেন, দুই মেরুই পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সমমেরু নয়। তাই শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব অমর। আর বেশি এগবেন না। দর্শক বোর হবে। সোজা ঢুকে পড়বেন ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে। ‘গোরা’ চূড়ান্ত মাত্রার দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস। সেটা দিয়ে শেষ করবেন।
—বুঝলুম। কিন্তু নিখিলেশ-সন্দীপের বন্ধুত্বের আলাদা কোনও ব্যাখ্যা তো রবি ঠাকুর দেননি!
—আলবাত দিয়েছেন। পরতে পরতে। ছত্রে ছত্রে। আপনাকে খুঁজে নিতে হবে। মনে করুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস লিখছেন ১৯১৬ সালে। সালগুলোর নোট রাখুন মিস্টার জটায়ু। বক্তৃতার সময় এই তথ্যগুলো খুব ইম্পর্ট্যান্ট। উপন্যাসের সময়কাল ইংরেজ আমল। সামন্ত প্রভুদের দৌরাত্ম্য, পাশাপাশি স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার। দানা বাঁধছে নারী আন্দোলনও। এই আবহে একদিন নিখিলেশ চৌধুরীর বাড়িতে হাজির পুরনো বন্ধু সন্দীপ মুখোপাধ্যায়। দুই বন্ধুর চেতনা আলাদা। নিখিলেশ প্রগতিশীল, সন্দীপ প্রতিক্রিয়াশীল। নিখিলেশের বাড়িতে সন্দীপের আসার কারণ— গ্রামে স্বদেশি আন্দোলনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা। সন্দীপের চরিত্রে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। সে আসার পর স্বামী ছাড়া প্রথম কোনও পুরুষের সঙ্গ পেয়েছিলেন নিখিলেশের স্ত্রী বিমলা। সন্দীপের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সন্দীপ সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ছ’হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল আন্দোলনের নামে। মনে করুন, সন্দীপের প্রতি বিমলার দুর্বলতার কথা জেনেও নিখিলেশ কিন্তু ছিলেন শান্ত। বন্ধুত্বের শর্ত মেনে অবিচল। পরে গ্রামে দাঙ্গা বাঁধিয়ে পালিয়ে যায় সন্দীপ। আর তা থামাতে গিয়ে মৃত্যু হয় নিখিলেশের। এটাও কি বন্ধুত্বের সম্পর্কের প্রতি অভিমান নয়?
এবার বর্ষাকে বারবার ড্রিবল করে প্রায় গোলের কাছে পৌছে যাচ্ছে শরৎ। হঠাৎ হঠাৎ আকাশ নীল বর্ণ নিচ্ছে। আচমকা মেঘগুলো চরতে বেরিয়ে পড়ছে। তবে, আজ আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। গঙ্গার ধার বেজায় গুমোট। ফের শুরু করলেন ফেলুদা।
—পরাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শক্তি ও দুর্বলতা—দুটোই অনুভব করেছিলেন। খুঁজেছিলেন সেই সময় স্বদেশি আন্দোলনের ব্যর্থতা, আবার কর্মপন্থাও। সেই খুঁজে ফেরা থেকেই গোরা চরিত্রের সৃষ্টি। একদিকে তার গোঁড়ামি, আর অন্যদিকে বিনয়ের কাছে মুক্তচিন্তা। কোথাও গিয়ে বিনয়ই যেন গোরার অল্টার ইগো-র মতো। সে গোরার অনুসরণকারী, কিন্তু বিরুদ্ধ মত প্রকাশ ও বিকল্প পথ দেখানোয় দু’বার ভাবে না। গোরা ওঁর প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে গোরার দাদার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় বিনয়। পরে আবার তা উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যেতেও তার বাধে না। সমাজ... বুঝলেন লালমোহনবাবু। ওটাই আমাদের ধরে রেখেছে, আবার ওই সমাজই যত গণ্ডগোলের মূল। ধর্ম, জাতপাত, টাকা পয়সা... সব সময় যেন একটা যুদ্ধ চলছে। বন্ধুত্বের সুতোটা কিছুতেই ছিঁড়তে দেওয়া যাবে না লালমোহনবাবু। ওটাই পারে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে। সমাজকে চেনা ছন্দে ফেরাতে। সেই বন্ধুত্ব ক্লাস ফ্রেন্ডের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। হতেও পারে সে ঠাকুমার সঙ্গে নাতনির বন্ধুতা, কিংবা আপনার-আমার।
আচমকা ঝমঝম বৃষ্টি নামল। গঙ্গা কালো হয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা কাছেই রাখা। এটাও সবুজ। দু’জনেই ছুটলেন তার দিকে। কথা শেষ হল না।
আমার কিছু বন্ধু আছে। /ভালো মন্দ পাঁচমিশালী/নানারকম খামখেয়ালী/রোগা মোটা অসীমবলী/আমার কিছু বন্ধু আছে... -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।