বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

বড্ড  গরম!
মৃন্ময় চন্দ

পথিক: নাঃ—একটু জল না পেলে আর চলছে না। সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখনও প্রায় এক ঘণ্টার পথ বাকি! তেষ্টায় মগজের ঘিলু শুকিয়ে উঠল। কিন্তু জল চাই কার কাছে?... মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা: জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ তো জলপাইয়ের সময় নয়।...জল চাচ্ছেন তো ‘জল’ বললেই হয়। ‘জলপাই’ বলবার দরকার কী? জল আর জলপাই কি এক হল? আলু আর আলুবোখরা কি সমান? মাছও যা আর মাছরাঙাও তাই। বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে গেলে কি চালতার খোঁজ করেন?
সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’-এর ঘোর নিদাঘের গলদঘর্ম পথিক নয়, এমত অবস্থায় যে কেউ বলবেন ‘ঘাট হয়েছে মশাই’। অসহ্য গরম, ট্রেনে বাসে ঘাম জ্যাবজ্যাবে তিতিবিরক্ত মানুষের খিটিরমিটির লেগেই আছে। টিভির পর্দায় রাজনীতির খেউরকে পিছে ফেলে শুধু থার্মোমিটারের পারদের ওঠানামা। পাড়ার সবজান্তা সিধুজ্যাঠা থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আইপিসিসি সমস্বরে চেঁচাচ্ছে, এত গরম কস্মিনকালে নাকি পড়েইনি। প্রখ্যাত বিদেশি মিডিয়া দাড়ি চুলকে বলছে ২০২২-এর এপ্রিলের মতো বিকট গরমে ভাজাপোড়া নাকি গত ১২০ বছরে আর কখনও ভারত হয়নি!
সত্যিই কি ২০২২-এ গরমের নতুন রেকর্ড গড়ল ভারত? তাপমাত্রার পারা সহনশীল মাত্রার একটু উপরে চড়লেই কেন শুরু হয় দোষারোপের পালা? বিজ্ঞানীরা বলেন গ্রিনহাউস এফেক্ট। বছর কুড়ি আগেও সাধারণ মানুষ মাথা চুলকে বলত, গরমের সঙ্গে সবুজ বাড়ির কী সম্পর্ক? পরে অবশ্য বহু প্রচার শেষে জানা গেল, গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি হল— কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। মানে কার্বনের আধিক্য। এরা বাতাসে বাড়তে থাকা মানেই দূষণ চরমে পৌঁছয়। তার এফেক্ট পড়ে জলবায়ুর উপর। অর্থাৎ বড্ড গরম, বা ভীষণ ঠান্ডা। কিন্তু জমির উত্তাপ বেড়ে যাওয়া? তার জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস বা কার্বন-ডাই-অক্সাইড আদৌ কি দায়ী? নাকি ভূ-উষ্ণায়ন নামক গল্পের পুরোটাই রাজনৈতিক ধান্ধাবাজি? কার্বন ট্যাক্স বা কার্বন ক্রেডিটের ফাঁদে ফেলে ধনী মাতব্বর দেশগুলোর ভারতের মাথায় কাঁঠাল ভাঙার ফন্দি?

ভূ-উষ্ণায়নের আজব গল্প
আবহাওয়া/জলবায়ুর ঠিকা নেওয়া গণৎকাররা বলছেন, ১৭০০ সালের তুলনায় বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নাকি বেড়েছে ৩০ শতাংশ। কয়লা-পেট্রল-ডিজেল পুড়েছে যথেচ্ছ, মানুষ বন কেটে বসত বানিয়েছে। বিশ্বের ফুসফুস আমাজনের চিরহরিৎ বনাঞ্চল, ব্রাজিলের স্থানীয় জমি মাফিয়ারা বেচে দিচ্ছে। যে ধনকুবেররা আমাজনের জঙ্গল কিনে গোখাদ্য বা সয়া চাষের লাভজনক ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন, তাঁদেরই দেশের নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রী বা পরিবেশবিদরা কার্বন-গ্রিনহাউস গ্যাস বা ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। মহাজ্ঞানী-মহাজনেরা বলছেন, কার্বন বা গ্রিনহাউস গ্যাসই নাকি গত ১০০ বছরে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ০.৬-১.৫ ডিগ্রি বাড়ানোর মূল কারিগর। তাঁদের যুক্তি, এই কারণেই গলছে হিমবাহ, আল্পস নাকি সিরিঙ্গে হয়ে আয়তনে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। হিমবাহের বরফ গলা জলে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা নাকি ১০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। আগামী দিনে তা বেড়ে ৩ ফুটও নাকি হতে পারে। ১৯৭০-এর পর থেকে সুমেরু মহাসাগরে বরফ নাকি কেবলই গলছে। ভরা শীতেই নাকি উত্তরমেরুর তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়বে। প্রশান্ত মহাসাগরে বাড়বে এল নিনোর দাপট। তার ফলেই বাড়বে অস্ট্রেলিয়ার খরা-অজন্মা, ক্যালিফোর্নিয়ার বন্যা। বর্তমানে শুখা ক্যালিফোর্নিয়া খরা আর দাবানলের সৌজন্যেই খবরের শিরোনামে। এখনই লাগাম না টানতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে আট গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি বছর ৩ হাজার ৬০০ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নাকি পরিমণ্ডলে মিশবে। তার ফলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২১০০ সালের মধ্যেই বাড়বে ২ থেকে ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট। 
ভূ-উষ্ণায়নে বৃষ্টিপাতের ধরনও নাকি বদলাবে। বৃষ্টির খামখেয়ালিপনায় বাড়বে বন্যা-খরার প্রকোপ। তাপমাত্রা বাড়লে মশা-মাছি বা অন্যান্য বাহক-বাহিত রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর, ডেঙ্গি বা লাইম ডিজিসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার দাবিও করা হয়েছে। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলবর্তী মানুষের জীবন ও সম্পত্তি-হানির আশঙ্কা উত্তরোত্তর বাড়বে। আগামীতে ১০ কোটি বিপন্ন উপকূলীয় মানুষ হবেন উদ্বাস্তু। এলেবেলে কেউ নয়, কথাগুলো বলছেন হোয়াইট হাউস অফিস অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ভূতপূর্ব অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর ফর এনভায়রনমেন্ট রবার্ট টি ওয়াটসন এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের’ ভূ-উষ্ণায়নজনিত রিপোর্টের জনক মাইকেল ডি লেমোনিক। কথাগুলো তাঁরা বলেছিলেন ১৯৯৫-তে।

মূল চক্রী
আসলে ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’ অত্যন্ত সাধারণ এক প্রাকৃতিক ঘটনা। মানুষ  ধরাধামে অবতীর্ণ হওয়ার বহু আগে থেকেই গ্রিনহাউস গ্যাস স্ব-মহিমায় বিরাজমান। গ্রিনহাউস গ্যাসের নামে যে ভ্রান্তিবিলাস, আসলে তা জলীয় বাষ্প। সূর্যের তাপকে ধরে রাখে জলীয় বাষ্প। আর সেই তাপ ভূ-মণ্ডলের একেবারে নীচের স্তর বা ট্রপোস্ফিয়ারেই বিচরণ করে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন বা অন্য কিছু গ্রিনহাউস গ্যাসও খাপ পেতে তাপকে ধরে। কিন্তু ভূ-পরিমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ানোর মূল চক্রী জলীয় বাষ্প। কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্প বা গ্রিনহাউস গ্যাস মিলে ধরিত্রীর তাপমাত্রা সুমধুর ৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের আশপাশে  বেঁধে রেখেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস বা জলীয় বাষ্প না থাকলে পৃথিবীর তাপমান শূন্যের ১০ ডিগ্রি নীচে বিরাজ করত এবং পৃথিবী পরিণত হতো মঙ্গলের মতোই ঊষর, পরিত্যক্ত, প্রাণহীন এক গ্রহে। 
অ্যানথ্রোপোজেনিক বা মনুষ্যকৃত কারণে, পেট্রল-ডিজেল-কয়লার লাগামছাড়া দহনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউসের গ্যাসের বাড়বৃদ্ধিই যদি ভূ-উষ্ণায়নের একমাত্র কারণ হয় তবে ১৯৪০-’৭০— এই তিরিশ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বাড়ার কথা। কারণ গোটা বিশ্বে শিল্পায়নের বান ডেকেছিল ওই তিরিশ বছরেই। শিল্পায়নের প্রাকশর্তে সবচেয়ে বেশি কয়লা পুড়েছিল। রাশি রাশি উৎপাদিত পণ্য পরিবহণে পেট্রল-ডিজেলের দহনও হয়েছিল সর্বাধিক। কিন্তু এই সময় বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বদলে কেবলই কমেছে। বিজ্ঞানী বা জলবায়ু বিশারদদের মধ্যে তখন আলোচ্য বিষয় ছিল একটাই, পৃথিবী কি আবার হিমশীতল ‘তুষার যুগের’ দিকে ধাবমান? গত ১০০ বছরের আপাত উষ্ণতার ইতিহাসে বিরল ব্যতিক্রম ছিল ১৯৪০-’৭০, এই তিরিশ বছরের শীতলতা। 
আইপিসিসি বা পরিবেশ নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করা পণ্ডিতরা গত শতকের যে এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে হল্লা পাকাচ্ছেন, সেই এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়েছিল ১৯৪০-এর আগে, প্রাক শিল্পায়ন যুগে। যখন মনুষ্যকৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের টিকিটিও নেই। ভূ-উষ্ণায়নে মনুষ্যকৃত গ্রিনহাউস গ্যাসই যদি দায়ী হয়, তা তখনও দিনের আলোই দেখেনি।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস সবসময়ই ভীষণ জটিল এক গাণিতিক প্রক্রিয়া। ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ ১২ ঘণ্টা আগের পূর্বাভাসকেই ভুল প্রমাণিত করে পশ্চিমবঙ্গকে লেজের ঝাপটা মেরে বাংলাদেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির যুগে একদিন আগেও যদি সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব না হয়, আইপিসিসি তবে ১০০ বছরের আবহাওয়ার পূর্বাভাস, তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধির খুঁটিনাটি বাতলাচ্ছে কীভাবে? তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অবিসংবাদী ভূমিকা রয়েছে মেঘের। গ্রীষ্মকালে মেঘলা দিনে সেই কারণে বড্ড বেশি গরম লাগে। উষ্ণায়নের হিসেব কষতে গেলে সবার আগে তাই মেঘের ঠিকুজি-কুষ্ঠি জরুরি। আইপিসিসি যে কম্পিউটার-কৃত ‘জেনারেল সার্কুলেশন মডেল’ বা জিসিএম মারফত জলবায়ু সংক্রান্ত যাবতীয় হিসেবনিকেশ কষে (বর্তমানে কাপলড মডেল ইন্টারকমপ্যারিসন প্রজেক্ট ফেজ সিক্স) নিদান হাঁকে তাতে মেঘের ছলাকলা ধরতে পারা অসম্ভব। ভূপৃষ্ঠ, সমুদ্র এবং নভোমণ্ডলের স্থূল কিছু গাণিতিক পরিসংখ্যানের নাড়াঘাঁটায় আইপিসিসি-র ‘জিসিএম’ বিজ্ঞের মতো বলছে গত ১০০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা নাকি ১.৫ ডিগ্রি বেড়েছে। ১৯৮০ সালেই নাকি তাপমাত্রা বেড়েছে আধ ডিগ্রি। নিখুঁত নির্ভরযোগ্য তাপমাত্রা পরিমাপে সক্ষম কেবল পৃথিবী প্রদক্ষিণরত কৃত্রিম উপগ্রহ। বিশ্বের প্রতিটা আনাচে-কানাচের ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার’ চষে প্রতিনিয়ত গভীর অভিনিবেশে তাপমাত্রা মেপে রেকর্ড করে চলেছে উপগ্রহ। ১৯৮০-তে তাপমাত্রার উল্লেখযোগ্য কোনও বৃদ্ধির চিত্র উপগ্রহে ধরাই পড়েনি। ১৯৮০-তে, ১ ডিগ্রির ১০ ভাগের এক ভাগ মাত্র তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছিল, তুচ্ছ সে ঘটনা নিয়েই আইপিসিসি-র মরাকান্নার শেষ নেই। কোনও অসৎ অশুভ উদ্দেশ্য ছাড়া এক-দশমাংশ তাপমাত্রা বৃদ্ধি আইপিসিসি-র বয়ানে একলাফে কীভাবে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়? গ্রিনহাউস গ্যাস সৃষ্ট ভূ-উষ্ণায়নের বিশেষ কিছু চরিত্রলক্ষণের কথা আইপিসিসি-র ‘জিসিএম’ ফলাও করে বলছে। বলছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং গ্রিনহাউস গ্যাস-কৃত ভূ-উষ্ণায়নে উত্তর গোলার্ধ, দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় বেশি উত্তপ্ত হবে। উচ্চ অক্ষাংশের তাপমাত্রা নিম্ন অক্ষাংশের তুলনায় বেশি বাড়বে এবং সুমেরু বা উত্তরমেরুর তাপমাত্রাও পাল্লা দিয়ে চড়বে। জিসিএম-র গণনায় এগুলো স্পষ্টতই ‘গ্রিনহাউস সিগন্যাল’। অথচ দুই গোলার্ধ, উচ্চ বা নিম্ন অক্ষাংশ মায় উত্তরমেরুতেও তাপমাত্রার কোনও বৃদ্ধিই এযাবৎকালে পরিলক্ষিত হয়নি। সুতরাং মনুষ্যকৃত গ্রিনহাউস গ্যাস বা কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা মিথেনকে কোনওভাবেই ভূ-উষ্ণায়নের জন্য দায়ী করা চলে না। বিরল মেধায়, জিসিএম গণনা করে দেখেছে, ভূ-উষ্ণায়নের ফলে স্কটল্যান্ডের থেকে সাহারা মরুভূমিতে বেশি বৃষ্টি হবে। শুনে শুধু ঘোড়া নয়, হাসছে গোটা পৃথিবীই। আইপিসিসি-র আহাম্মকি বা আবোলতাবোল অবৈজ্ঞানিক অতিকথনে তিতিবিরক্ত এমআইটির, স্লোয়ান প্রফেসর অব মেটিরিওলজি রিচার্ড লিন্ডজেন প্রকাশ্যে বললেন, ‘আইপিসিসি-র অবিমৃষ্যকারিতায় আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল উচ্চমার্গের স্পর্শকাতর একটি বিষয়ও বিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে রাজনীতির তুরুপের তাস হয়ে উঠল!’ 
কূটতর্ক থাক। ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে ৩ ফুট উঁচু হয়ে নাকি ভাসিয়ে দেবে আতলান্তিকের দু’পাড়ের অগণন আমেরিকান সৈকত-শহর। চীনের বেশ কিছুটা অংশ, মালদ্বীপ, সেসেলিস, কুক এবং মার্শাল দ্বীপ মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যাবে। অসংখ্য নদী ব-দ্বীপ, মায় সুন্দরবনও নাকি রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর সুন্দরী-গরান-গেও গাছ কোলে সমুদ্রের নীচে চিরনিদ্রায় শয়ান হবে। ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস’-এ গত ৮ মার্চ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। প্রকাশ-মাত্রই সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে তুমুল হইচই। ২০১৫-’২০ মুম্বইসহ ৯৮টি উপকূলবর্তী শহরের ওপর চালানো হয় নিবিড় এক গবেষণা। দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি নয়, সেচ ও গৃহকর্মে ব্যাপকহারে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের ফলেই উপকূলীয় অঞ্চলের শহরগুলো প্রতি বছর ২ মিটার বা ৬.৬ ফুট পর্যন্ত মাটির নীচে বসে যাচ্ছে। চাষ বা ঘরের কাজে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ জল তোলা এখনই বন্ধ না হলে মুম্বই-সুন্দরবনসহ ৯৯টি উপকূলবর্তী শহর/অঞ্চল হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতো আত্মঘাতী নিশির ডাকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে আত্মাহুতি দেবে অচিরেই। 

উষ্ণায়ন ও সান স্পট
তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের কারণে সূর্যের মুখে কালো দাগ বা ব্রণ সৃষ্টি হয়। ব্রণ-র হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা হ্রাসের এক অম্লমধুর সম্পর্ক রয়েছে। সূর্যের ব্রণের আগমন-বিসর্জন চক্রাকারে ‘সান-স্পট সাইকেলে’র দিনক্ষণ অনুযায়ী আবর্তিত হয়। গত ১০০ বছরে ‘সান-স্পট সাইকেলের’ আয়ু ১১.৭ থেকে কমে ৯.৭ বছর হয়েছে। ব্রণ সারানোর কোনও ক্রিম/মলম সূর্যদেবের ঝোলায় না থাকায় ব্রণ সারতে ৯.৭ থেকে ১১.৭ বছর লেগে যাচ্ছে। কম সময়ে ব্রণ সারলে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে, তখনই প্রাণান্তকর গরমে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ধীর গতিতে ব্রণ সারলে ধরিত্রী হচ্ছে সুশীতল। ডেনমার্কের বিজ্ঞানী ইজিল ফ্রিস ক্রাইসটেনসেন ও নাড লেসেন ‘সান-স্পট সাইকেল’ সূত্রের প্রবক্তা।

ভূ-উষ্ণায়নের অকল্পনীয় সুফল
তাপমাত্রার সামান্য হেরফেরেই মানব ইতিহাস সাক্ষী থেকেছে অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বা দাঙ্গার। বহু সাম্রাজ্যের দেশ বেড়াজাল ভেসে দলে দলে মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সব অঘটনের জন্যই দায়ী মাত্র ১ ডিগ্রি বা তারও কম তাপমাত্রা হ্রাস। বৃদ্ধি নয় মোটেই। সামান্য ঠান্ডা বাড়াতেই ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানরা রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল। মাত্র আধ ডিগ্রি তাপমাত্রার অবনমনে ভাইকিংরা গোরু-ছাগল নিয়ে সদলবলে পাড়ি জমিয়েছিল আমেরিকায়। ১২০০ সালে আবার সামান্য ঠান্ডা বাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে নেদারল্যান্ডসের তিন লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছিল। এক ডিগ্রি মাত্র তাপমাত্রা কমায় গোটা ইউরোপে নেমে এসেছিল অন্ধকারের বিভীষিকা— গ্রীষ্মে ভয়ঙ্কর বৃষ্টি আর শীতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা— দুইয়ে মিলে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। যত অনিষ্ট-অনাচার-অঘটন, সব তাপমাত্রা কমার সঙ্গে জড়িত। গবেষণা দেখাচ্ছে, আল্পস বা মেরু অঞ্চলে বরফের চাঁদোয়া বিগত বছরগুলোতে অপসৃত না হয়ে আরও বিস্তৃত হয়েছে। সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে। উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বাষ্পায়ন বেড়েছে, স্বভাবতই অবনমিত হচ্ছে সমুদ্রের জলতল। ১ হাজার ৭টি গবেষণাপত্রে প্রমাণিত বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ায় উদ্ভিদের বৃদ্ধি বিকাশ ত্বরান্বিত হয়ে ফলন বেড়েছে বহুগুণ। গরম বাড়লে পৃথিবীর চাষযোগ্য জমির পরিমাণ তিনগুণ বাড়বে। উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে জলীয় বাষ্পের কিছুটা তঞ্চিত হবে ভূপৃষ্ঠে। মরুভূমি তাতে মরূদ্যান হতেই পারে! এমনই অভিমত হুভার ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো টমাস গেল মুরের। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন ভূ-উষ্ণায়নে বাড়ছে বাতাসে ভাসমান জলীয় বাষ্প অর্থাৎ এরোসলের কারণে। দিনের বেলা মেঘাচ্ছন্ন থাকছে পৃথিবী। দিনের তাপমাত্রার খুব একটা নড়নচড়ন না হলেও রাতের তাপমাত্রা বিশেষত হেমন্ত এবং শীতে বাড়ছে। রাতের তাপমাত্রা বাড়ায় বিভিন্ন শস্যের ফলন বাড়ছে অনেকটাই। বাড়ছে বনাঞ্চল। সুমেরু মহাসাগর সন্নিহিত উত্তর সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা ঘন সবুজ বনচ্ছায়ায় আচ্ছাদিত আজ। ৩ মিটার লম্বা উইলো গাছের জঙ্গলের আড়ালে বল্গাহরিণরা গা ঢাকা দিচ্ছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড নামক সারে বিশ্বের বনাঞ্চলের বায়োমাস বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ শতাংশ। আবিশ্ব বনাঞ্চল বেড়েছে ১৫ শতাংশ। জঙ্গলের আয়তন বাড়লেও ‘অ্যালবেডো এফেক্টে’র কারণে বাড়ছে উষ্ণায়নও (‘সায়েন্স’, ১৯ মে, ২০২২)।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও ভূ-উষ্ণায়নের যুগলবন্দিতে কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-জাপান-উত্তর রাশিয়া-ফিনল্যান্ড-আইসল্যান্ডে ফলন বেড়েছে ১৭ গুণ। আমেরিকার কৃষি-দপ্তরের ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ: ইকনমিক ইমপ্লিকেশনস ফর ওয়ার্ল্ড এগ্রিকালচার’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে ভূ-উষ্ণায়নে ফলন বাড়ায় চাষি যেমন কিঞ্চিৎ স্বস্তির মুখ দেখছে তেমনই ‘কমোডিটি প্রাইস’ বা পণ্যের মূল্যও কমায় সাধারণ মানুষও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। উষ্ণপ্রধান আবহাওয়ায় পরিবহণ খরচ কমে, বরফ ভেঙে এগতে হয় না বলে জ্বালানির সাশ্রয় হয়। ট্রাক-চালকদের দুঃস্বপ্নের রাত ফুরোয়। গত ৪০ বছরে দিনরাতের তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির খেলাকে আইপিসিসি-র ‘জিসিএম’ ধরতে না পারাতেই গোল বেধেছে। ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে আইপিসিসি তাই বলছে গ্রিনহাউস গ্যাস ও তজ্জনিত ভূ-উষ্ণায়নে শেষের সে দিন সমাগত। 
আইপিসিসি-র তালে তাল মেলাচ্ছেন স্বার্থান্ধ কিছু ধনী দেশ ও তাদের রাষ্ট্রনায়কেরা। কার্বন ক্রেডিট বা কার্বন ট্যাক্সের জাঁতাকলে ফেলে তারা রপ্তানি বাণিজ্যের গলা টিপে ভাতে মারতে চাইছে আমাদের মতো নুন আনতে পান্তা ফুরনো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। সামরিক আধিপত্যবাদের জুজু দেখিয়ে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ভারতকে বশ মানানো যাবে না বুঝেই নতুন ফন্দি ভূ-উষ্ণায়নের দোহাই পেড়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা গ্রিনহাউস গ্যাস দমনের নামে ভারতের ঘাড়ে সুচতুরভাবে কার্বন ট্যাক্সের বিরাট বোঝা চাপানো হচ্ছে। আর ভারত সরকারকে ছলে-বলে-কৌশলে ভর্তুকি তুলে নিতে বাধ্য করা, যাতে পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাস কিনতে নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ মানুষের। পেট্রপণ্যে উন্নত ধনী দেশগুলো ভর্তুকি বাড়িয়েই চলেছে, আর ভারত সরকার পেট্রপণ্যে ভর্তুকি ছেঁটেই চলেছে। গত ১২ মে ‘নেচার’ পত্রিকার ৬০৫ নম্বর ভলিউমের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে একজন মার্কিন নাগরিকের নিত্যদিনের কাজে ১৩.৭ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশছে। আর সেখানে একজন ভারতীয়ের দৈনন্দিন কাজকর্মে সারা বছরে ১.৭ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিমণ্ডলে মেশে। তাসত্ত্বেও ভারত সরকার মুখ বুজে উন্নত ধনী দেশগুলোর ফরমানে কার্বন ট্যাক্সের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ডেকে আনছে নিজেরই সর্বনাশ।

17th     July,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা