বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

ভারত ছাড় 
আন্দোলন ৮০

ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তাব ঘোষণা হয়েছিল ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট বিকেলে। তার পরের দিন সকালেই গ্রেপ্তার করা হল গান্ধীজিকে। জেলবন্দি করা হল সমস্ত কংগ্রেস নেতাকে। এই প্রথম কোনও নেতার নেতৃত্বে নয়, ভারতীয় জনতা নিজেরাই রাস্তায় নেমে এল। জ্বলে উঠল নতুন আগুন— করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ফিরে দেখলেন সমৃদ্ধ দত্ত।
 
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম: গান্ধী
প্রেমজি ভাই মেঘজি ঠক্কর মাছের ব্যবসায় নামার পর তাঁর এবং উত্তরসূরি গোটা বংশের জীবনধারার গতিটাই বদলে গেল। অধুনা গুজরাতের সমুদ্র উপকূল ভেরাভল মৎস্যচাষিদের কেন্দ্র বরাবরই। শুধু মাছ ধরা নয়, বিক্রি, রপ্তানি সবই হয় এখান থেকে। ভাগ্যান্বেষণে এই ব্যবসায় ঢুকেছিলেন তিনি। কিন্তু ঢুন্ডি রাজপুত সম্প্রদায়ের ঠক্কর লোহানা জাতিভুক্ত। এই জাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল কঠোরভাবে নিরামিষাশী। খাওয়া তো দূরঅস্ত। স্পর্শ করলেও প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কিন্তু রোজগার করতে হবে তো! সব জেনেও গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে ভেরাভলে মাছ ধরা আর বিক্রির ব্যবসায় যোগ দিলেন মেঘজি ঠক্কর। কিন্তু ভালো চোখে নেয়নি তাঁর সম্প্রদায়। তিনি দেখলেন এখানে নয়। বরং আরও বেশি ব্যবসার সুযোগ করাচিতে। কিছু  আয় করে সঞ্চয় বাড়িয়ে আবার না হয় ফিরে আসবেন। তাই করলেন বটে। কিন্তু সমস্যা হল, ততদিনে তিনি মাছের ব্যবসা ছেড়ে দিলেও লোহানা সম্প্রদায় তাঁর পরিবারের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে রাজি নয়। কারণ তিনি মাছের ব্যবসা করেছেন। হিন্দু ধর্মের এই সম্প্রদায়ের কাছে পরিত্যাজ্য। কী আর করবেন এরপর প্রেমজি ভাই? তিনি পরিবারসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। পুত্রের নাম পুঞ্জলাল মেঘজি ঠক্কর। তিনি তাঁর পুত্রকন্যাদের নাম ইসলাম ধর্মানুযায়ী রাখলেন। পুঞ্জলালের ডাক নাম ছিল জিন্নো! তিনি পুত্রের ইসলামি নামের মধ্যেই নিজের নামও ঢুকিয়ে দিলেন। একটু অন্যভাবে। ছেলের নাম হল মহম্মদ আলি জিন্না! 
১৯৪০ সালে লাহোরে সম্মেলন করে সেই পুঞ্জলাল মেঘজি ঠক্করের পুত্র মহম্মদ আলি জিন্না যে প্রস্তাবটি মুসলিম লিগের সভায় পাশ করালেন সেই প্রস্তাবকে ইতিহাস বলে থাকে ‘লাহোর রেজল্যুশন’। এই লাহোর প্রস্তাবে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ভারতীয় মুসলিমদের জন্য পৃথক একটি ভূমি চাই। ভারতের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম আসলে দুটি আলাদা নেশন। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনও মিল নেই। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দল কংগ্রেসের হাতে ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেলে ভারতীয় মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই থাকতে হবে। অতএব নতুন একটি দেশ চাই।  যা ১৯৩৩ সালে লন্ডনে পড়াশোনা করতে যাওয়া এক যুবক রহমত আলি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকে ভারতের হাতে স্বশাসন ও অধিক ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, সেই বৈঠকের তীব্র বিরোধিতা করে সেই যুবক লিফলেট বিলি করেন। বক্তৃতা দেন। দাবি করেন, ইন্ডিয়া কখনও মুসলিমদের নয়। তাঁদের চাই নিজের দেশ এবং নিজের থিসিস পেপারে তিনি লেখেন যে, পাঞ্জাবের পি, আফগানের এ, কাশ্মীরের কে, সিন্ধের এস, বালুচিস্তানের স্তান। এই নিয়ে পাকিস্তান চাই। সেই প্রথম শোনা গিয়েছিল একটি নাম, ‘পাকিস্তান’। 
ঠিক এই আবহে ভারতের সঙ্গে দর কষাকষির জন্য ব্রিটিশ সরকার মরিয়া এক চেষ্টা করল। কারণ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর ভারতীয়দের সঙ্গে চাই। ব্রিটেনের ওয়ার ক্যাবিনেট প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে চাপ দিল যে, ইন্ডিয়ার সঙ্গে একটা কোনও মীমাংসায় আসতে হবে। নাহলে যুদ্ধের সময় ঘরে বাইরে সমস্যা। কংগ্রেসের মধ্যেও মতান্তর চরমে। নেহরু ও রাজা গোপালাচারী দোলাচলে। তাঁরা মনে করেন ব্রিটিশ বিরোধিতা এখন চরমে নিয়ে গেলে যদি অক্ষশক্তিকে সমর্থন করা হয়ে যায়! আর জাপানকে সমর্থন করার অর্থ চীন ও রাশিয়ার বৃহৎ বিপদ। বরং নেহরুর ফর্মুলা ছিল ব্রিটিশকে যুদ্ধে সাপোর্ট দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা ব্রিটিশ দেবে এই প্রতিশ্রুতি লিখিতভাবে সরকারিভাবে আদায় করা দর কষাকষির মাধ্যমে। নেহরুর যুক্তি হল, আমরা গোটা বিশ্বে একঘরে হয়ে যাব যদি অক্ষশক্তিকে সমর্থন করি। গান্ধীজি কিন্তু জাপানকে অতটা বেশি শত্রু ভাবছেন না। তিনি বরং যুদ্ধের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ ব্রিটিশের যুদ্ধে ভারত যুক্ত হবে এটা তিনি চান না। টানাপোড়েন চলছিল ব্রিটেনের মধ্যেও। চার্চিল কোনও সেটলমেন্ট চান না। কিন্তু লেবার পার্টির নেতা ওয়ার ক্যাবিনেট সদস্য ক্লিমেন্ট এটলি ও স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস একই মতের অনুসারী। সেটা হল, ভারতকে একটা কোনও প্রতিশ্রুতি এবার দিতেই হবে। 
সেইমতো অনেক চাপানউতোরের পর স্থির হল, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে পাঠানো হবে ভারতে। তিনি বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলবেন। প্রস্তাব দেবেন যে, যুদ্ধের পর ভারতকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দেওয়া হবে। তারপর ভারতের নির্বাচিত সদস্যরাই একটা সংবিধান গঠন করবেন। আর এই সময়সীমায় অভ্যন্তরীণ সামরিক এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ তথা প্রশাসনিক পরিকাঠামো ব্রিটিশ সরকার যথারীতি দেখভাল করবে। ২৩ মার্চ ক্রিপস ভারতে এলেন। ক্রিপসের সঙ্গে প্রধানত আলোচনা হল কংগ্রেস সভাপতি আবুল কালাম আজাদের। একদিন দু’দিন এক ঘণ্টা দু’ঘণ্টা নয়। একটানা বেশ কয়েক সপ্তাহ। মুখোমুখি মিটিং। চিঠি আদানপ্রদান। সবই হল। প্রস্তাব হল একটি এগজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করা হবে। যেখানে সদস্যরা হবেন ভারতীয়। কিন্তু সেটির সাংবিধানিক প্রধান হবেন ভাইসরয়। চার্চিল এবং লিনলিথগো যেহেতু মনে করেন কংগ্রেস আদতে বর্ণহিন্দুর স্বার্থই দেখে সর্বদা। এটা একটা হিন্দুদের পার্টি। তাই সেই কাউন্সিল তথা জাতীয় সরকারে মুসলিম লিগও থাকবে। 
২৯ মার্চ, বিকেল ৩টে, ১৯৪২।
আজাদ: এই কাউন্সিলে ভাইসরয়ের ভূমিকা কী হবে?
ক্রিপস: তিনি পরামর্শদাতা থাকবেন।
আজাদ: কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কার হাতে থাকবে? ভারতীয়দের? নাকি ভা‌ইসরয়ের?
ক্রিপস: কাউন্সিলের হাতে। 
আজাদ: এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের ইন্ডিয়া অফিসের ভূমিকা কী?
ক্রিপস: এখনও এটা নিয়ে আমি কিছু ভাবিনি। 
আজাদ: এটাই তো সবথেকে বড় প্রশ্ন। 
এই হল প্রথম বিভ্রান্তি। পরবর্তী বিভ্রান্তি হল, সামরিক বিভাগের দায়িত্বে কে থাকবে? ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ যুদ্ধের ময়দানে সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। কিন্তু সামরিক সংক্রান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কাউন্সিলই নেবে অর্থাৎ ভারতীয় সদস্যরা। কংগ্রেসের দাবি। যা ব্রিটেনের আপত্তি। তৃতীয় আপত্তি, প্রাদেশিক রাজ্যগুলি নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তারা কী করবে। ভারতে যোগ দেবে কি না! ক্রিপসের উত্তর থেকেই স্পষ্ট বোঝা গেল, আদতে এই সিদ্ধান্তের অর্থ মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলিকে ভারতের বাইরে রাখার প্ল্যান। অর্থাৎ পাকিস্তানের পক্ষে। তখনও ‘পাকিস্তান’ শব্দটি অবশ্য খুব বেশি আসেনি আলোচনার টেবিল অথবা সাধারণ আলাপচারিতায়। কিন্তু জিন্না চাইছেন এই আলোচনাই জোরালো হোক। তিনি প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে, ভারতীয় মুসলিমদের হয়ে কথা বলার অধিকারী একমাত্র তিনি। কংগ্রেস নয়। কংগ্রেস সেকথা মানবে না। কংগ্রেসের সভাপতির নামই তো আবুল কালাম আজাদ। নেহরু সাংবাদিকদের বলেন, কংগ্রেস গোটা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে। জিন্না বলেন,  মুসলিমরা সেকথা মনে করে না। ১৯৪২ সাল থেকে এই দুই নেতার ইগোর লড়াই চরম আকার নিল।  
সব মিলিয়ে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হল। লন্ডনের ক্যাবিনেট রুমে উইনস্টন চার্চিল আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন, শত্রুর সঙ্গে বসে চা পান করে আলোচনার আর কোনও দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে! আর গান্ধীজি ভাবলেন, তিনি এবার একটা শেষ চেষ্টা করবেন। আবার সত্যাগ্রহ। আবার অহিংস আন্দোলন। কোনও আবেদন নিবেদন আর নয়। এবার সরাসরি বলতে হবে ব্রিটিশ ভারত ছাড়। বম্বের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে ৭ আগস্ট কংগ্রেসের সম্মেলন। ভিড় উপচে পড়ছে। প্রচণ্ড গরম। মাঝেমধ্যে অবশ্য বৃষ্টি এসেছে। কিন্তু ভিড় কমেনি। দুপুর ২টো। মহাত্মা গান্ধী বললেন, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম হতে চলেছে। কংগ্রেস এখনই রাস্তায় নামছে না। কিন্তু ভাইসরয় ধরে নিন এটা একটা চিঠি। তিনি অথবা ব্রিটিশ সরকার যদি কংগ্রেসের দাবি মেনে নেন, তাহলে আলোচনার রাস্তা আছে। নচেৎ তারা যেন তৈরি থাকে। পরদিন ৮ আগস্ট সেই বহু প্রতীক্ষিত প্রস্তাব গ্রহণ করল কংগ্রেস। বলা হল, ব্রিটিশকে এখনই ভারত ছাড়তে হবে। স্বাধীন ভারত মিত্রশক্তির সঙ্গেই যোগ দেবে যুদ্ধে। একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। যেখানে একা কংগ্রেস নয়। সব দলকে নিয়েই এক সম্মিলিত ভারতীয় জাতীয় সরকার হবে। ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তাব ঘোষণা হয়েছিল ৮ আগস্ট বিকেলে। আর পরদিন ভোর ৫টায় মহাত্মা গান্ধী যেখানে ছিলেন সেই জি ডি বিড়লার গেস্টহাউসে পুলিস হাজির হল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে। গান্ধীজিকে বলা হল, আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। গান্ধীজি মৃদু হেসে বললেন, অপেক্ষা করুন। একটি গীতা, একটি কোরান এবং একটি চরকা ব্যাগে ভরে গান্ধীজি বললেন, চলুন! এরপর কী হবে সেটা আন্দাজই করতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। সব কংগ্রেস নেতাকে জেলবন্দি করা হয়েছে। সুতরাং আন্দোলন ব্যর্থ হবে! এরকমই ভেবেছিল ব্রিটিশ। ভুল। এই প্রথম কোনও নেতার নেতৃত্বে নয়। ভারতীয় জনতা রাস্তায় নেমে এল। জ্বলে উঠল নতুন আগুন। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! শুরু হল ভারত ছাড় আন্দোলন! 

তাম্রলিপ্ত: আমরাও পারি, বাংলা জানাল ব্রিটিশকে

উইনস্টন চার্চিলকে সবচেয়ে কঠোর জবাব কে দিয়েছিল? মুখে নয়। কাজে? বাংলার মেদিনীপুর জেলা। যতবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে খোদ ব্রিটিশ এমপি আর রাজনৈতিক দলগুলি প্রস্তাব দিয়েছে যে, এখনই সময় এসেছে ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তরের, প্রত্যেকবার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সেই প্রস্তাবকে মাছির মতো উড়িয়ে দিয়ে যা বলতেন, তার মূল কথা হল, ভারতীয়রা আবার প্রশাসন চালাবে কীভাবে? এমনিতেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, হাজার রকম রোগব্যাধি, অশিক্ষা গ্রাস করে রেখেছে ভারতীয়দের। এরা আবার সরকার চালাবে? সরকারের প্রধান কে হবে? ওই বর্ণহিন্দুদের স্বার্থরক্ষা করা কংগ্রেস? আর তাদের আসল নেতা ওই অর্ধনগ্ন ফকির? যখন ক্রমেই ব্রিটিশ মনেপ্রাণে তৈরি হয়েছে যে, আজ নয় কাল ভারতকে স্বাধীনতা দিতেই হবে, তখন সবথেকে বিপরীত মেরুতে বাস করতেন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। ভারতের ভাইসরয় এমন একজন ছিলেন সেই সময়ে, যিনি নিজে ওই চার্চিলের মতোই ভারতীয়দের অপছন্দ করতেন। লর্ড লিনলিথগো। এই জুটিকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছিল বাঙালি। আর এই জুটি তার প্রতিশোধও নিয়েছিল বাংলাকে প্রায় ধ্বংস করে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়ে। 
সম্ভবত মেদিনীপুরের উপর তাঁদের রাগ সবথেকে বেশি। কংগ্রেস ছিল এই আন্দোলনের আহ্বায়ক। নেহরু থেকে প্যাটেল। আজাদ থেকে গোবিন্দবল্লভ পন্থ, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ কিংবা আচার্য কৃপালনী। সকলকে বন্দি করা হল। সর্বোপরি মহাত্মা গান্ধীকে। সুতরাং এরপর এই আন্দোলনের কোমর ভেঙে যাওয়াই স্বাভাবিক। একদিকে যেমন মুসলিম লিগ ভারত ছাড় আন্দোলনের সমর্থক নয়, আবার একই সঙ্গে হিন্দু মহাসভাও গান্ধীজির এই আন্দোলনে সহমত নয়। উল্টে ভারত ছাড় আন্দোলনের বিরুদ্ধে হিন্দু মহাসভার নেতা দামোদর সাভারকর এমন এক বিরুদ্ধ বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, বাংলার হিন্দু মহাসভা নেতা নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত হয়ে ভেবেছিলেন সংগঠনের আর অস্তিত্ব থাকলে হয়! তিনি নাগপুরে থাকা তাঁর দলের এক নেতা বি এস মুঞ্জেকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, (১৪ আগস্ট, ১৯৪২), ‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বাংলার গোটা হিন্দু সমাজই এখন গান্ধীজির সঙ্গে রয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে কেউ যদি এই ভারত ছাড় আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করে তাঁর অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। একঘরে হয়ে যাবে সে। আমাদের নিজেদের অবস্থাকে আরও চরম সঙ্কটে ফেলেছে বীর সাভারকরের দুর্ভাগ্যজনক বিবৃতি। সবথেকে আশ্চর্য লাগল, মিস্টার জিন্না চাইছেন না যে, মুসলমানরা কংগ্রেসের এই আন্দোলনে যোগ দিক। আবার মিস্টার সাভারকর চাইছেন না হিন্দুরা এই আন্দোলন সমর্থন করুক। অথচ এই আন্দোলন এক বিপুল বিক্ষোভ উদ্দীপনা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে।’
নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজে হিন্দু মহাসভার নেতা হয়েও সঠিকভাবে বিষয়টি অনুভব করেছিলেন। কারণ, ভারত ছাড় আন্দোলনের জেরে ব্রিটিশ সরকার সবচেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল পুনরায় একটিমাত্র রাজ্যকে ঘিরে। বাংলাজুড়ে আন্দোলন, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত তো চলছিলই। যেমন শহিদ হয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। তবে, মেদিনীপুর যা করল সেটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আর ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোর মুখে এক চপেটাঘাত ছিল। সেই আতঙ্কের নাম ছিল মেদিনীপুরের ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমবাগানের মধ্যে স্থির হয়েছিল, মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্ন যদি পূরণ করতেই হয় তাহলে সত্যিই করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে স্লোগানকে আত্মস্থ করতে হবে। আর ব্রিটিশদের হাত থেকে একের পর এক এলাকা দখল করে নিতে হবে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে ব্রিটিশশূন্য করে দিতে হবে বিভিন্ন জনপদকে। সেটা তখনই সম্ভব, যদি নিজেদের সরকার গঠন করা যায়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের কাছে সাধারণ মানুষ ঠিক যা যা পরিষেবা এবং সুযোগ সুবিধা প্রত্যাশা করে, ঠিক সেই ব্যবস্থাই গড়ে তুলতে হবে। এই অসীম অসম্ভবকে বাস্তবায়িত করতে ১৭ ডিসেম্বর তৈরি হল সরকার। যার নাম দেওয়া হল মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র। ’৪২-এর ভারত ছাড় আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আখ্যান ছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা স্বাধীন ভারতীয় সরকার। কিন্তু প্রতিটি উদ্যোগকে ছাপিয়ে গেল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সর্বাধিনায়কের নাম সতীশচন্দ্র সামন্ত। অর্থসচিব অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় এবং প্রতিরক্ষা তথা স্বরাষ্ট্রসচিব হলেন সুশীলকুমার ধাড়া। সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম, মহিষাদল ও তমলুক নিয়ে গঠিত হল থানা জাতীয় সরকার। থানা স্তরের এই প্রশাসন পরিচালনা করবেন নন্দীগ্রামে কুঞ্জবিহারী ভক্ত, তমলুকে গুণধর ভৌমিক, সুতাহাটায় জনার্দন হাজরা। এছাড়া পরবর্তীকালে প্রিয়নাথ জানা, অমূল্যচরণ মাইতি, রাসবিহারী জানা, দেবেন্দ্রনাথ কর, প্রফুল্লকুমার বসুরা ছিলেন। এই সরকারের সেনাবাহিনীর নাম দেওয়া হয় বিদ্যুৎ বাহিনী। শুধুই কি একটি সেনাবাহিনী চালু করে দায়িত্ব সম্পূর্ণ হয়? তাই যথারীতি তার মধ্যে নিয়ে আসা হল একঝাঁক দপ্তর। গেরিলা, ভগিনীসেনা, আইনশৃঙ্খলা, চিকিৎসা, গোয়েন্দা ও যুদ্ধ। গ্রামগঞ্জে সাধারণ চুরি ডাকাতি কমে গেল। কেন? কারণ গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছিল সরকারিভাবে। তারা এসে খবর দিত কোথা থেকে কখন কী প্ল্যান হচ্ছে। 
১৯৪৩ সালে যখন বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ হাজির হয়েছে, তখন ব্রিটিশ সরকার যতটা উদাসীন ছিল, ঠিক ততটাই সক্রিয়তা দেখিয়েছে তাম্রলিপ্ত সরকার। অসাধু ব্যবসায়ীদের গুদামে, বাড়িতে, গোলায় গিয়ে ধান চাল বাজেয়াপ্ত করে গ্রামবাসীর কাছে রেশন সিস্টেমে বিলি করা হয়েছিল। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের হয়তো সর্বোত্তম সাফল্য বিচার বিভাগ। যা ছিল ভ্রাম্যমাণ। যাতে গ্রামবাসীকে কোনও সমস্যা সমাধানে অনেক দূরে যেতে না হয়। ১ টাকা জমা দিয়ে  বিচার শুরুর মামলা দায়ের করতে হবে এই ছিল  নিয়ম। যদি থানা স্তরের বিচারে কোনও বিচারপ্রার্থী সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে তার কাছে সুবিধা ছিল উচ্চতর আদালতে আপিল করার। যেমন মহকুমা ও জেলা। বিস্ময়কর তথ্য হল, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থাকা আদালতগুলিতে যে মামলাগুলির নিষ্পত্তি হয়নি সেগুলির বিচার অনেকাংশ, মসৃণভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল জাতীয় সরকারের আদালতে। কারণ একটাই। জাতীয় সরকার প্রথমেই জোর দিয়েছিল আপসে মিটিয়ে নেওয়ার উপর। মধ্যস্থতাকারীর এমনই পক্ষপাতহীন আচরণ ছিল যে, বাদী-বিবাদী দু’পক্ষই খুশি। প্রায় ৩ হাজার মামলার মধ্যে ১৭০০ মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যায়। 
প্রশাসন পরিচালনায় কতটা সাফল্য দেখাতে পেরেছে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার? একটি মাত্র উদাহরণেই স্পষ্ট। জাতীয় সরকার ভেঙে যাওয়ার পর জমি রেজিস্ট্রেশন ও মিউটেশনের ঠিক যে প্রথায় সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার সেই প্রথাই চালু রেখেছিল। বহু গ্রামীণ যুবককে কাজে লাগিয়ে তাম্রলিপ্ত সরকার তাদের অধীনস্থ এলাকার একটি আস্ত জমি ব্যাঙ্ক নির্মাণের কাজ করেছিল। ব্রিটিশ সরকারের নথিতে ভারত ছাড় আন্দোলন ও অশান্তি অরাজকতার পরিবেশ সম্পর্কে পরিসংখ্যান তৈরি করার সময় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাম্রলিপ্ত সরকারের পরিচালন ব্যবস্থা বিস্ময়কর ছিল। 
১৯৪৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ততদিনে ব্রিটিশ বিদায় ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যে মিত্রশক্তি জয়ী হবে, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু উইনস্টন চার্চিল বাংলাকে শায়েস্তা করার সুযোগ ছাড়েননি। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে আর্চিবল্ড ওয়াভেলকে ভারতে পাঠানো হয় ভাইসরয় হিসেবে। ওয়াভেল এসেই দেখলেন বেঙ্গলের অবস্থা সাংঘাতিক। হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ মৃত্যু হচ্ছে অনাহারে। জাপানের ভয়ে ব্রিটিশ সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করেছিল। চাল সাপ্লাই ছিল বন্ধ। ওয়াভেল এসেই চার্চিলকে চিঠি লিখে বললেন, বেঙ্গলের জন্য খাদ্য রিলিফ দিতে হবে আমাদের। এখানে অবস্থা ভয়ঙ্কর। চার্চিল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমাদের কাছে যে স্টক আছে, সেটা ইউরোপের জন্য দেওয়াই ভালো বলে মনে করি। অনাহার থেকে রক্ষা পাওয়া বেশি জরুরি গ্রিস আর সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলির। ইন্ডিয়ার কথা ভাবার সময় এখন নেই।’ স্তব্ধ হয়ে যান ওয়াভেল! 
নিয়তির আশ্চর্য এক খেলা। পরবর্তী নির্বাচনে উইনস্টন চার্চিল নিজের দেশের মানুষের কাছেই প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্তু ততদিনে আমরা এই বাঙালি জাতি চরম সর্বনাশের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস পেলাম যে, আমাদের ক্ষমতা আছে এককভাবে সরকার পরিচালনার। ভারত ছাড় আন্দোলনে তাম্রলিপ্ত সরকার আমাদের সেই আত্মগরিমা উপহার দিয়েছিল। এই সরকারের কর্মসূচির মধ্যেই লেখা ছিল, সুভাষচন্দ্র বসু ফিরে এলে তিনিই হবেন আমাদের সর্বাধিনায়ক। কিন্তু তিনি এলেন না। বরং একটি  নতুন সর্বনাশ এসেছিল স্বাধীনতার হাত ধরে। বাঙালি আবার একটি ধ্বংসের মুখে দাঁড়াতে বাধ্য হল। যা বাঙালি জাতির সর্ববৃহৎ ট্র্যাজেডি। দেশভাগ! 

10th     July,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা