বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

অবকাশের মেঘমল্লার

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় শতবর্ষে পা রাখছেন ভাবলেই আমাদের মনের আকাশে কেমন যেন মায়াবী আলো ফুটে ওঠে। আমাদের বিনোদনের দুনিয়ায় লাবণ্যের এত পূর্ণ প্রকাশ সচরাচর ঘটে না। যদি অন্য সবকিছু ভুলেও থাকি, বাণিজ্যের কোলাহলে, মুদ্রার দাপটের মধ্যেও কিছুতেই স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না মৃত্যুকে হাসিমুখে পার হতে থাকা আনন্দবাবুর সেই অমলিন কণ্ঠ: ‘জিন্দেগি ক্যায়সে হ্যায় পহেলি’! সংলাপকার গুলজারের সঙ্গে একমত হয়ে আমাদেরও মনে হয় ‘মওত তু এক কবিতা হ্যাঁয়’। রবীন্দ্রনাথ থাকলে হয়তো আরও পরিশীলিত লেখনীতে লিখতেন— মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান। আমাদের মনে পড়তে পারে জাপানি চলচ্চিত্রস্রষ্টা আকিরা কুরুসাওয়ার ‘ইকিরু’ (১৯৫৪)। সেখানেও কর্কট রোগাক্রান্ত ওয়াতানাবের স্বপ্নের উদ্যানে খেলা করে শিশুরা। আমাদের মনে পড়তে পারে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনির থেকে তোলা ছবি দেবকী বসুর ‘কবি’, যেখানে বসনের প্রশ্ন মনের দরজায় কড়া নাড়ে: ‘জীবন এত ছোট কেনে?’ অথচ এত দার্শনিকতা ‘আনন্দ’ (১৯৭১)-এর শেষ দৃশ্যে নেই। সেখানে আরব সাগরতটে জীবনের অনন্ত ভোরবেলা রাজেশ খান্নার হাতে উড়তেই থাকে বেলুন হয়ে। তার যে কোনও ছবিতেই শরতের আলোছায়ার মতো এই আলো, এই ছায়া। সমগ্র আখ্যানটি মোড়া থাকে এমন সুগন্ধী তবকে যে, পারিবারিক ছবি বললেই আসমুদ্রহিমাচল সানন্দে হৃষীকেশবাবুর চলচ্চিত্রমালার কথা মনে করে। সে ছবি ‘গুড্ডি’ (১৯৭১) হতে পারে, ‘অভিমান’ (১৯৭৩) হতে পারে, ‘নমক হারাম’ (১৯৭৩), ‘গোলমাল’ (১৯৭৯) বা ‘চুপকে চুপকে’ (১৯৭৫) অথবা ‘বেমিশাল’ও (১৯৮২) হতে পারে। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের কোনও আখ্যানেই মর্ষকাম ও বিকৃতি নেই। এমনকী তা রূপসীর জরোয়া গয়নার মতো ঝলমল করেও ওঠে না। সেসব ছবি ভরা গরমের বিকেলে ছাদের ওপরে শীতলপাটি আর দখিন হাওয়া।
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় কলকাতার ছেলে। আজ থেকে একশো বছর আগে অর্থাৎ ১৯২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। সে যুগটা যেন বাঙালির সিনেমার। পরপর রাজেন তরফদার, সত্যজিৎ রায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক ও বারীন সাহা একশোর চৌকাঠ পার হবেন। হৃষীকেশ ছিলেন রসায়নের ছাত্র। বিএসসি পাশ করার পর কিছুদিন এদিক ওদিক পড়িয়েও ছিলেন। সে সময় এ দলের অনেকেই আড্ডা মারতেন হাজরা রোডে ক্ষীরোদ ঘোষের বাজারের উল্টোদিকে অধুনালুপ্ত প্যারাডাইস রেস্টুরেন্টে। সেদিনগুলোর কিছুটা বিবরণ পাওয়া যায় ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ছবিতে। সেখানে নাট্যকর্মীদের একজনের নামই তো ঋষি।
ইতিহাসের আশীর্বাদ ছিল হৃষীকেশের মাথায়। তিনি সেযুগের সবচেয়ে নামী স্টুডিও নিউ থিয়েটার্সে হাতেকলমে সিনেমার কাজ শিখেছিলেন। গুরু ছিলেন চারের দশকের প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক সুবোধ মিত্র, যাঁকে ইন্ডাস্ট্রি কচি মিত্তির হিসেবেই চিনত। সে শিক্ষা বৃথা যায়নি। সিনেমা যে মূলত দৃশ্য ও শব্দের মধ্য দিয়ে আদি-মধ্য-অন্তযুক্ত কাহিনির নকশা বুনে যাওয়া— সারা দেশকেই তা শিখিয়ে ছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও। তার কর্ণধার স্যার বি এন সরকার বিশ্বাস করতেন বইয়ের মতোই সিনেমাতেও গল্প স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাবে। চলচ্চিত্র সুস্থ জীবনবোধের কথা বলবে ও আপামর মধ্যবিত্তকে টেনে আনবে প্রেক্ষাগৃহে। আর যিনি হৃষীকেশকে মুম্বইতে শক্ত জমির ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করেছিলেন তিনি বিখ্যাত বিমল রায়। বিমল রায় নিজেও নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওরই অবদান। প্রথমেশ বড়ুয়া যখন ‘দেবদাস’ (১৯৩৫) পরিচালনা করেন, তাঁর ক্যামেরাম্যান ছিলেন বিমল রায়। এই বিমল রায় পরে ‘উদয়ের পথে (১৯৪৪) তৈরি করে চিত্রনাট্যে সংলাপের একটি ছাঁচ বানিয়ে দেন সর্বভারতীয় চলচ্চিত্রে।
পাঁচের দশকে বিমলবাবু বম্বে চলে গেলেন সঙ্গে নিলেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরীর মতো কয়েকজনকে। যখন তিনি ভারতীয় ছবিতে নববাস্তবতার অন্য একটি অভিঘাত আনলেন ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩) ছবিতে, সেখানে সহকারী হিসেবে সম্পাদনায় তুলনা বিরহিত প্রতিভার ছাপ রাখলেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী ‘দেবদাস’ (১৯৫৫) ছবিতেও হৃষীকেশ বিমল রায়ের সহকারী থেকে গেলেন। বিমল রায়ের ছবিতে একেবারে দিনের সূর্যের মতো জ্বলে উঠলেন ‘মধুমতী’-র সম্পাদনায়। এ ছবিতে তাঁর সঙ্গে সঙ্গীতে সলিল চৌধুরী আর গল্প রচনায় ঋত্বিক ঘটকও সহযাত্রী। বস্তুত জেনে রাখা ভালো শুধু হিন্দি নয়, এ সময় তিনি বাংলা ছবিরও সম্পাদনা করেছেন। যেমন রাজেন তরফদারের বিখ্যাত ছবি ‘গঙ্গা’ (১৯৬০)।
কিন্তু হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে চলচ্চিত্রের আঙিনায় পা রাখলেন ‘মুসাফির’ (১৯৫৭) ছবিতে। ঋত্বিক ঘটকের কাহিনি নিয়ে এই ছবি তত সফল হয়নি। কিন্তু হৃষীকেশ প্রথম পরিচালক হিসেবে দাগ কাটলেন ‘আনাড়ি’ (১৯৫৯) ছবিতে। রাজ কাপুর, নূতন অভিনীত এই ছবি একাধিক ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ৪২টি ছবি গল্প বলার জয়যাত্রা। তাঁর নির্মাণ হিন্দি সিনেমার জাঁকজমক ও অতিশয়োক্তি পরিহার করেছে কিন্তু শিল্পচর্চার নামে দুর্বোধ্যতা ও আঙ্গিক-প্রীতিকেও প্রশ্রয় দেয়নি। তিনি জানতেন চলচ্চিত্রকে শেষপর্যন্ত দর্শকের বিচারশালায় জয়ী হতে হবেই। ছ’য়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে সাতের দশকে একদিকে মুম্বই সিনেমায় তুমুল মেলোড্রামার ঘূর্ণীবায়ু অথচ হৃষীকেশ কী অনায়াসে লিখে যাচ্ছেন মধ্যবিত্ত জীবনের দুঃখ আর অভিমান, অশ্রু ও উল্লাস নিয়ে অফুরন্ত রূপকথা। রাজেশ খান্না আর অমিতাভ বচ্চনের মতো বিপরীতমুখী অভিনেতা তাঁর ছবিতে কী অপরূপ ছন্দে পরস্পরের সঙ্গত করেন যে! হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন— আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু; বিরহ দহন লাগে তবু মধ্যবিত্তের রোজনামচায় একটি মধুর নিষ্পত্তিও আছে। হাড়-হিম করা সংঘর্ষের তুলনায় হৃষীকেশ পছন্দ করবেন ‘গুড্ডি’ (১৯৭১)-র কিশোরী জয়া ভাদুড়িকে, যে পর্দার তারকা ধর্মেন্দ্রকে নিয়ে দিবাস্বপ্নে আচ্ছন্ন। একটা ছবি যে শুধু গল্পের জন্যই লক্ষ্মীর প্রসাদ পেতে পারে তা সারাজীবন প্রমাণ করে এসেছেন মুম্বইয়ের এই নিখাদ বাঙালি হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় রুচিতে ও রক্তে।
সারাজীবন নানা মালায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড পান ১৯৯৯ সালে। তাঁর দু’বছর পরেই তাঁকে সম্মানিত করা হয় ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধিতে। সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনেরও কিছুকাল সভাপতি ছিলেন। ভেঙে পড়া মানুষের মিছিল, পাপ ও পতন হৃষীকেশকে বিচলিত করেনি কোনওদিন। তিনি এক সুরভিত অবকাশ। আর সেজন্যই স্মরণীয়।

3rd     July,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা