বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

এভারেস্টের খোঁজে

দেবরাজ দত্ত: ‘নোরগে না হিলারি কে আগে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া বা সামিটে পৌঁছন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে, দলনেতা কর্নেল হান্টের ঘোষণা চিরস্মরণীয়— ‘They reached it together, as a team.’ হ্যাঁ, দলবদ্ধ হয়ে অজানাকে আবিষ্কার ও প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার অদম্য বাসনায় মানুষ বার বার ছুটে গিয়েছে দুর্গম পথে।
পনেরো শতকে ইউরোপ থেকে সারা বিশ্বে সমুদ্রযাত্রার মাধ্যমে নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের জন্য অভিযান শুরু হয়েছিল। তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু জয় করার জন্য প্রথম ব্রিটেন প্রচেষ্টা শুরু করে। কিন্তু দু’টি ক্ষেত্রেই হারতে হয় তাদের। ব্রিটিশদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ‘তৃতীয় মেরু জয় করে’ জাতীয় গর্ব পুনরুদ্ধার করার আশা করেছিলেন— পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণের মাধ্যমে। 
উনিশ শতকের শুরুতেও পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুর অবস্থান মানুষের কাছে অজানা ছিল। কিন্তু ততদিনে মানুষের মনে এই ধারণা জন্মেছে যে, হিমালয় এর কোনও শৃঙ্গের শীর্ষই হচ্ছে পৃথিবীর সেই সর্বোচ্চ বিন্দু। তার অবস্থান এবং পরিচয় শনাক্ত করার লক্ষ্যে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা ‘গ্রেট ত্রিকোণমিতিক সার্ভে’ (Great Trigonometrical Survey) আরম্ভ করে ভারতীয় উপমহাদেশে। 
১৮৪৭ সালে ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত সওয়াজপুর স্টেশন থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন। সে সময় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ২৩০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত আরও উচ্চ একটি শৃঙ্গ লক্ষ করেন। প্রায় একই সময়ে জন আর্মস্ট্রং নামে তাঁর এক কর্মচারীও আরও পশ্চিম থেকে এই চূড়াটি লক্ষ করেন এবং একে ‘Peak-b’ হিসেবে অভিহিত করেন। মাইকেল হেনেসি নামে অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহর একজন সহকর্মী সে সময়ে পর্বতগুলিকে রোমান সংখ্যায় প্রকাশ করা আরম্ভ করেন এবং সেই রীতি অনুযায়ী Peak-b এর নতুন নাম হয় Peak-XV (১৫ নম্বর শৃঙ্গ)।
১৮৫২ সালে দেরাদুন শহরে অবস্থিত সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সদর দপ্তরে বাঙালি গণিতবিদ ও পর্যবেক্ষক রাধানাথ শিকদার, আর একজন কর্মচারী জেমস নিকলসনের মাপ-জোক থেকে ত্রিকোণমিতিক গণনা করে সর্বপ্রথম নির্ণয় করেন যে, এই শৃঙ্গই বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিকলসন ওই সময়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং তাঁর হিসাব-নিকাশ অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নিকলসনের গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে ওয়াহ ও তাঁর অন্যান্য সহকর্মীরা পরবর্তী দুই বছর গণনা কাজ চালিয়ে যান। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি কলকাতার সহকারীকে পত্র মারফত তাঁর সিদ্ধান্ত জানান। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে, এই শৃঙ্গের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৩৯.২ মিটার (২৯ হাজার ফুট) হওয়ায় এটাই সম্ভবত বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। জনসমক্ষে এই শৃঙ্গের উচ্চতা জানানো হয় ৮ হাজার ৮৩৯.৮ মিটার (২৯,০০২ ফুট)। 
কিন্তু, পরে সার্ভে অব ইন্ডিয়া ১৯৫৫ সালে সংশোধিত উচ্চতা ২৯ হাজার ২৯ ফুট এবং ২০২০ সালে ফের নেপাল-চীনের যৌথ সার্ভেয়ার রিপোর্টে এভারেস্টের সংশোধিত উচ্চতা ২৯ হাজার ৩২ ফুট নির্ধারিত হয়।
সার্ভে অব ইন্ডিয়ার শৃঙ্গের নামকরণের নিয়ম নীতি অনুযায়ী পর্বতশৃঙ্গগুলির নাম স্থানীয় নামে রাখার কথা ছিল। কিন্তু ওয়াহ বলেন যে, তিনি ১৫ নং শৃঙ্গের কোন স্থানীয় নাম খুঁজে পাননি। বিদেশিদের জন্যে তিব্বত ও নেপাল উন্মুক্ত না  থাকায় তাঁর স্থানীয় নামের অনুসন্ধান তখন বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু, এই পর্বতের বেশ কয়েকটি স্থানীয় নাম ছিল। যেমন— দার্জিলিঙে দেওধুঙ্গা বা পবিত্র পর্বত, তিব্বতে চোমোলাংমা ইত্যাদি। অনেক পরে ১৯৬০ সালে নেপাল সরকার সাগরমাথা নামে এই পর্বতের একটি নেপালি নাম রাখে। যাইহোক, ওয়াহ এই যুক্তিও উত্থাপন করেন যে, অনেকগুলি স্থানীয় নাম থাকায় যে কোনও একটি নামকে রাখা ঠিক হবে না। সেই কারণে তিনি তার পূর্বসূরি সার্ভেয়র জেনারেল জর্জ এভারেস্টের নামে এই শৃঙ্গের নামকরণের সুপারিশ করেন। 
ব্রিটিশ পর্বতারোহীরা সর্বপ্রথম এই পর্বতশৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা শুরু করেন। নেপালে ওই সময় বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় ব্রিটিশরা তিব্বতের দিক থেকে এই পর্বতের উত্তর শৈলশিরা ধরে বেশ কয়েক বার আরোহণের চেষ্টা করেন। ১৯২১ সালে এভারেস্ট শৃঙ্গ অভিযানে ব্রিটিশরা তিব্বতের দিক থেকে ৭ হাজার মিটার (২২ হাজার ৯৭০ ফুট) উচ্চতা পর্যন্ত ওঠেন। এরপর ১৯২২ সালে অভিযানে তাঁরা এই পথেই ৮ হাজার ৩২০ মিটার (২৭ হাজার ৩০০ ফুট) উচ্চতা পর্যন্ত ওঠেন। এই অভিযানে তুষারধসে সাতজন মালবাহকের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯২৪ সালের অভিযান এভারেস্ট আরোহণের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিযান। জর্জ ম্যালোরি ও অ্যান্ড্রিউ আরউইন শৃঙ্গের দিকে আরোহণের একটি শেষ চেষ্টা করেন। ১৯২৪ সালের ৮ জুন দুপুরের সময় এভারেস্টের প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপে তাঁদের শেষ দেখা যায়। কিন্তু, তাঁরা ফিরে আসতে ব্যর্থ হন। যার ফলে তাঁদের আরোহণই প্রথম সফল আরোহণ কি না সেই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ১৯৯৯ সালে ম্যালরির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছিল।
১৯৫২ সালে এডওয়ার্ড উইস-ডুনান্টের নেতৃত্বাধীন একটি সুইস অভিযাত্রী দল নেপাল দিয়ে এভারেস্টে আরোহণ প্রচেষ্টা করার অনুমতি পায়। দলটি খুম্বু আইসফলের মধ্যে দিয়ে একটি রুট প্রতিষ্ঠা করে এবং দক্ষিণ গিরিখাতের ৭ হাজার ৯৮৬ মিটার আরোহণ করে। রেমন্ড ল্যাম্বার্ট এবং শেরপা তেনজিং নোরগে দক্ষিণ-পূর্ব রিজের ৮ হাজার ৫৯৫ মিটার ওপরে ওঠেন, যা ছিল তৎকালীন উচ্চতা আরোহণের ক্ষেত্রে মানুষের নতুন রেকর্ড। তেনজিংয়ের এই অভিজ্ঞতা তাঁর ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলের সঙ্গে আরোহণ করার সময় সহায়ক হয়। 
 ১৯৫৩ সালের ২৯ মে জন হান্ট এর নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমন্ড হিলারি এবং তাঁর সঙ্গী তেনজিং নোরগে নেপালের দিক থেকে পর্বতশীর্ষে প্রথম পদার্পণ করেন। এরপর থেকে গত প্রায় ৭০ বছরে কয়েক হাজার মানুষ এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে অভিযান চালাতে গিয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩০৪ জন পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়েছে।
১৯৬০ সালের ২৫ মে চীনা পর্বতারোহী ওয়াং ফুঝোউ, গোনপো এবং চু ইয়িনহুয়া উত্তর শৈলশিরা ধরে প্রথম শৃঙ্গজয় করেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ মে প্রথম মহিলা হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করার কৃতিত্ব লাভ করেন জাপানের জুনকো তাবেই। ১৯৭৮ সালের ৮ মে অস্ট্রিয়ার পিটার হেবলার এবং ইতালির রেইনহোল্ড মেসনার প্রথম অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট চূড়ায় সফলভাবে অরোহণ করেন। প্রথম প্রতিবন্ধী হিসেবে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টম হুইটেকার এভারেস্টের চূড়ায় উঠেন। একটি কৃত্রিম পা নিয়েও তিনি এভারেস্ট জয় করে অসম্ভব মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দেন। নেপালের পর্বতারোহী কামি রিটা শেরপা গত ৮ মে ২৬তম বার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে পদার্পণ করে   সবচেয়ে বেশিবার শৃঙ্গ জয়ের ইতিহাস তৈরি করেছেন। নন-শেরপা হিসেবে এই রেকর্ড ব্রিটিশ পর্বতারোহী ও অভিযানের গাইড কেন্টন কুল এর দখলে। মোট ১৬ বার এভারেস্ট জয় করেছেন তিনি।
১৯৯৬ সালের মে মাসে সর্বমোট ১২জন পর্বতারোহী প্রাণ হারান। ২০১৪ সালেও খুম্বু আইসফলে পর্বতারোহীদের জন্য লোড ফেরি করার সময় ১৯ হাজার ফুট উপরে তুষারধসে ১৬ জন শেরপা গাইড মারা যান। এভারেস্টের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল দুপুরে। ভূমিকম্পের ফলে মাউন্ট পুমোরি থেকে নামা একটি বিশাল তুষারধস এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে আঘাত হানে এবং ২২ জন পর্বতারোহী এবং শেরপা গাইড প্রাণ হারান। তবে, এই ট্র্যাজেডিগুলি পর্বতারোহীদের এভারেস্টে চড়ার চেষ্টা থেকে বিরত করতে পারেনি।

29th     May,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা