১২৫ বছর আগে এই মে মাসেই পথচলা শুরু হয়েছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের। বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়ির হলঘরে সন্ন্যাসী ও গৃহীভক্তদের উপস্থিতিতে রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেই ঐতিহাসিক ক্ষণটিকে স্মরণ করলেন রামকৃষ্ণ মঠ-বলরাম মন্দিরের অধ্যক্ষ।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ মানব দেহ রাখলেন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু শক্তিস্বরূপ যে রামকৃষ্ণ, সর্বহিতকর, আলোকদানকারী যে রামকৃষ্ণ তিনি রইলেন বেঁচে। প্রয়াণের আগেই শ্রীরামকৃষ্ণ এমন একটি সংগঠনের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, যে সংগঠন মানবসমাজকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে সতত নিযুক্ত থাকবে। তিনি একটি দল, সংগঠন বা এক সঙ্ঘ সূচনা করলেন এবং নরেন্দ্রনাথকে প্রধান করে তাঁর হাতে অর্পণ করলেন। প্রয়াণের পূর্বে তিনি নরেন্দ্রনাথকে কাছে ডেকে এক টুকরো কাগজের উপর লিখে দিলেন— ‘নরেন শিক্ষে দিবে।’ নরেন্দ্রনাথ ইতস্তত করে বললেন, ‘না, আমি পারব না।’ শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন, ‘তোর ঘাড় করবে।’ সেই সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেব নরেন্দ্রনাথকে দিয়ে গেলেন তাঁর বহু তপস্যার ফল আধ্যাত্মিক সম্পদের অমৃতকুম্ভ।
স্বামীজি এক নবীনরূপে সনাতন আদর্শ স্থাপনের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিলেন। এই আদর্শ— শাশ্বত ভারতবর্ষের বেদান্তের বাণী এবং সেই বেদান্তের বাণীর মূর্ত প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন। স্বামীজি অনুভব করলেন শুধু বেদ উপনিষদের কথা মানুষকে বললে চলবে না, তার সঙ্গে একটা জীবন দেখাতে হবে এবং বেদ উপনিষদ অপূর্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে। ফলে একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণীই পুনরায় ফিরিয়ে আনবে ভারতের প্রাচীন গৌরব— অখণ্ডভাব, সংস্কৃতির সম্প্রীতি, জাতি-ধর্মের মিলন, ঐক্য ও জাতীয় সংহতি। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে স্বামীজি অপূর্ব ব্যবহারিক বেদান্তের সমন্বয়ের বাণী শুনেছিলেন— জীবই শিব, প্রতিমায় ঈশ্বরের পূজা হয় আর মানুষে হয় না? শিবজ্ঞানে জীবের সেবা! এই বাণী শুনে স্বামীজি দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘এই অদ্ভুত সত্য সংসারে সর্বত্র প্রচার করব— পণ্ডিত, মূর্খ, ধনী, দরিদ্র, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সকলকে শুনিয়ে মোহিত করব।’
শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর প্রিয়শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে সামনে রেখে সূচনা করেছিলেন নবীনরূপে সনাতন আদর্শের সন্ন্যাসী সঙ্ঘ। কিন্তু এই আদর্শকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা তখন অতীব প্রতিকূল। নবীন সন্ন্যাসী হয়ে আদর্শের প্রতি চিরাচরিত প্রাচীন চিন্তাধারার প্রচণ্ড স্ববিরোধ এবং প্রচণ্ড অর্থের অভাব তখন স্বামীজি ও তাঁর গুরুভাইদের এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিল।
১৮৮৬ থেকে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বামীজি সমগ্র ভারত পরিক্রমা করেন। তিনি যতদূর সম্ভব নিজের অতুল বিদ্যাবুদ্ধি গোপন করে সাধারণ সাধুর মতো ভ্রমণ করতেন। সাধারণ সন্ন্যাসীর মতো ভিক্ষান্নের উপরই তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। অনেক সময় দেহরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আহারও তাঁর জুটত না। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘কারও নিকট ভিক্ষা চাইব না। যখন আপনি জুটবে তখন খাব।’ এর ফলে দিনের পর দিন তাঁকে অনাহারে থাকতে হতো। কতদিন তাঁকে পথের পাশে মন্দিরে, ধর্মশালায়, ঝোপ-জঙ্গলে ও পর্বতগুহায় রাত কাটাতে হয়েছে, কখনও বা তাঁকে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হয়েছে।

স্বামীজি নিজেকে গোপন করতে চাইলেও সূর্য উদয় হলে যেমন কাউকে বলে দিতে হয় না যে, প্রভাত হয়েছে, সূর্যরশ্মির প্রকাশ কোনও ঘোষণাকারীর অপেক্ষা রাখে না, সেই রকম স্বামীজিও যেখানে যেতেন সর্বত্র তাঁর তপস্যাদীপ্ত রূপ ও মুগ্ধদৃষ্টি সকলকে আকর্ষণ করত। সন্ন্যাসী কিন্তু রাজার মতো চালচলন, দীপ্ত বিশাল দু’টি চোখ এবং অপূর্ব মুখমণ্ডলে এক আধ্যাত্মিক-জ্ঞানের জ্যোতি।
উত্তর-পশ্চিম-মধ্য-দক্ষিণ সমগ্র ভারত-পরিক্রমায় স্বামীজি নিজেকে যেন যাচাই করে নিয়েছিলেন, তেমনি গভীরভাবে জেনেছিলেন বর্তমান ভারতবর্ষকে, জেনেছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষকে। পরিক্রমাকালে ভারতের সর্বশ্রেণির মানুষের অন্তরাত্মার পরিচয় পেয়েছিলেন। উপলব্ধি করেছিলেন অখণ্ড ভারতের রূপ। সমগ্র ভারতের ছবি তাঁর অন্তরলোকে ওই সময়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল। ভারত ভ্রমণের ভিতর দিয়ে স্বামীজির অন্তরে ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি একটা সক্রিয় রূপ নিয়েছিল। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির চিন্তা গভীরভাবে করেছিলেন। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেছিলেন—বহু-বিস্তৃত আচার-অনুষ্ঠান সত্ত্বেও ভারতের ধর্ম এখনও সঞ্জীবিত। দোষ ধর্মের নয়, দোষ মানুষের। ধর্মের নামে ধর্ম-ব্যবসায়ী গোঁড়া পণ্ডিত ও পুরোহিতদের আধিপত্যই সমাজজীবনের পঙ্গুত্বের অন্যতম কারণ। ফলে জাতির অখণ্ডতাবোধ জাগাতে হলে প্রয়োজন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। ধর্ম সাধনায় স্বাধীনতা, সমাজিক সুযোগ-সুবিধার অধিকার দিতে হবে সর্বস্তরের মানুষকে। এই জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব এবং নারীশক্তি জাগরণের জন্য জীবন্ত দুর্গা, বগলার অবতার, দেবী সরস্বতী শ্রীমা সারদা দেবীর আবির্ভাব, তাঁকে কেন্দ্র করে নারী স্বাধীনতা ও প্রকৃত নারী গার্গী, মৈত্রেয়ী জন্ম নেবে, একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমা সারদাদেবীর জীবন ও বাণীই পুনরায় ফিরিয়ে আনবে ভারতের প্রাচীন গৌরব— অখণ্ডভাব, সংস্কৃতির সম্প্রীতি, জাতি-ধর্মের মিলন, ঐক্য ও জাতীয় সংহতি। স্বামীজির এই ধারণা দৃঢ় হয়েছিল ভারতের পথে-প্রান্তরে, নগরে-শহরে, গ্রামে-গঞ্জে পরিক্রমা করে। স্বামীজি তাঁর ভারত-পরিক্রমাকালে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতের উচ্চ আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বেদান্ত দর্শন এবং ভারতীয় জনসাধারণের দুঃখ নিবারণের জন্য সেবাধর্মের প্রচলন করতে হবে এবং উভয়ের সামঞ্জস্য করাই হবে শ্রীরামকৃষ্ণের অভীপ্সিত কর্ম। পরিক্রমাকালে স্বামীজি অনুধাবন করেছিলেন, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করাই হবে ভারতের উন্নতির অন্যতম পথ। বৈদেশিক শিক্ষাকে মূর্খের মতো অনুসরণ না করে দেশীয় শিক্ষার আদর্শ ও ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। দেশকে বুঝতে ও জানতে হবে। জাতীয় জীবনের গতি, বৃদ্ধি ও প্রসার কোন দিকে, তার উদ্দেশ্য কোন লক্ষ্যের অভিমুখী তা দেখতে হবে।
পরিক্রমার পূর্বে স্বামীজি উপলব্ধি করতেন অনন্ত কর্মক্ষেত্র হতে যেন এক আহ্বান আসছিল, ‘তুমি এসো— তুমি এসো, তোমার দেশ অধঃপতিত, জগৎ অজ্ঞানান্ধকারে নিমজ্জিত, তুমি সিংহবিক্রমে তোমার নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়।’ এ যেন ভারতমাতার মহামায়ার নীরব অশ্রান্ত আহ্বান তাঁর অন্তরে বেজে তাঁকে চঞ্চল করে তুলেছিল— কী চাই, কোথায় যাই—কী করি—কীসে শান্তি, নিশিদিন এই চিন্তা। মহামায়ার ইচ্ছায় তিনি পরিব্রাজক রূপে ভারতমাতার পরিক্রমা শুরু করলেন। ভারত ও বিবেকানন্দ পৃথক নয়, একই। নতুন, জাগ্রত, উদ্যত ভারতের ঘনীভূত মূর্তিই স্বামী বিবেকানন্দ।
পাশ্চাত্যের উদ্দেশে স্বামীজি রওনা দিলেন। নিয়ে গেলেন সনাতন ভারতের বেদান্তের মুক্তির বাণী যা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন-আলোকে উদ্ভাসিত এক নববেদান্ত–বিশ্বজনীন বাণী, সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশে তিনি আমেরিকায় ধর্মমহাসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে স্বামীজি সমগ্র জগৎকে দেবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন সনাতন ভারতের বিরাট আধ্যাত্মিক সম্পদের অমৃত ভাণ্ডার।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ঈশ্বরের দূত। শুধুমাত্র তাঁর বক্তৃতার মধ্যে তাঁর কর্ম নিহিত ছিল না। সারাজীবন ধরেই তিনি সমগ্র বিশ্বে আধ্যাত্মিক সম্পদ বিতরণ, মানবের চেতনাশক্তির বিকাশ ও বিশ্বের মধ্যে ঐক্য স্থাপন এবং ভারতবর্ষকে এক নতুনরূপে গড়ে তোলার কর্মে তিনি জীবন উত্সর্গ করেছেন। যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের সকলকে এক ঊর্ধ্বভূমিতে উত্তরিত করে দিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাসী অনেকে বলতেন, স্বামী বিবেকানন্দ একজন মুক্তির দূত, তিনি একজন বন্ধনমোচনকারী ঈশ্বরের সন্তান।
স্বামীজির বাণীর মধ্যে এক প্রচণ্ড শক্তি নিহিত ছিল। অগ্নিগর্ভ বেদান্ত বাণী— ‘মানুষ পাপী নয়, মানুষ দেবতা’, ‘প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্নিহিত দেবত্ব রয়েছে ও তাকে প্রকাশ করাই জীবনের লক্ষ্য’, ‘সমস্ত শক্তি তোমার মধ্যেই আছে, তুমি যা চাইবে তাই করতে পারবে’, ‘যে নিজেকে বিশ্বাস করে না সেই নাস্তিক’, ‘ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে থেমো না’, ‘সম্মুখে এগিয়ে যাও’, ‘জগতের ব্যাধির ওষুধ হল শক্তি’, ‘আমি যা চাই তা হল লৌহদৃঢ় পেশী, আর ইস্পাতদৃঢ় স্নায়ু— তার ভিতরে থাকবে বজ্রদৃঢ় এক মন’, ‘সকলের জন্য মুক্তি অর্জন করতে নরকে যেতে হলে তা–ই যাও’, ‘নিঃস্বার্থপরতাই ঈশ্বর’, ‘ভালো হও ও ভালো কর্ম কর’, ‘সকল কর্মই হোক ঈশ্বরের পূজা’— এই বিদ্যুৎ সঞ্চারকারী কথাগুলি শুনলে মানুষের ভিতর শক্তি ও উদ্যমী শক্তি প্রকাশিত হয়ে ওঠে। মানুষকে সৎ হতে, ঈশ্বরকে অনুসন্ধান করতে এবং দেশের মানুষকে কর্মে ও সেবায় উদ্বুদ্ধ করতে এমন শক্তিগর্ভ বাণী আর শুনতে পাওয়া যায় না।
এই পটভূমিকায় স্বামীজি পাশ্চাত্য থেকে ভারতবর্ষে ফিরে শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমা সারদাদেবীর আশীর্বাদে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিলেন। ১ মে ১৮৯৭— পুণ্য দিনটিতে রামকৃষ্ণ মিশন ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় শুরু হল। স্বামীজি শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলছেন, ‘নানা দেশ ঘুরে আমার ধারণা হয়েছে, সঙ্ঘ ব্যতীত কোনও বড় কাজ হতে পারে না।’ ১ মে, ১৮৯৭ স্বামী বিবেকানন্দ ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতার বলরাম মন্দিরে। এই বাড়ির হলঘরে সন্ন্যাসী ও গৃহীভক্তদের উপস্থিতিতে স্বামীজি প্রথম রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়। পরবর্তীকালে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ নামে রেজিস্ট্রি হয়। সঙ্ঘের প্রধান উদ্দেশ্য— আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ। গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয়েই সমাজে কর্ম করবে—নিজের মুক্তি ও জগতের কল্যাণে। স্বামীজি প্রবর্তিত ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ ও সমস্ত কর্মযজ্ঞের উৎসরূপে চিহ্নিত হল এই বাড়ি। এখানেই প্রতি রবিবার মিশনের নানা কর্মের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা সহ মিটিং হতো। সেইমতো মুর্শিদাবাদের মহুলা গ্রামে প্রথম সেবাকর্মের পরিকল্পনা এখানে গৃহীত হয়।
রামকৃষ্ণ মঠ শুরু হয়েছিল পূজা-পাঠ, জপধ্যান, সাধনভজন করে ভগবানলাভের উদ্দেশ্যে। আর রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা হল রামকৃষ্ণের উদার বিশ্বজনীন ধর্মমতের প্রচার, মানুষ-ভগবানের বিভিন্নভাবে পূজা ও দরিদ্র-আর্ত-নারায়ণের সেবার উদ্দেশ্যে। মঠের ভিতরে ভগবানের পূজা এবং মিশনের ভিতরে আর্ত দরিদ্রের সেবাকে এক দৃষ্টিতে দেখেছেন। গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয়কে চালিত করলেন এক ঈশ্বর লাভের উদ্দেশ্যে—‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’। নিজের মুক্তি ও জগতের কল্যাণ কর্ম করে। এই সেবাধর্মই হবে আমাদের কর্মজীবনে বেদান্তের প্রয়োগ। বনের বেদান্তকে ঘরে আনা যায়, সকল কাজে লাগানো যায়। ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’–এর বাস্তব রূপ দেন স্বামীজি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করে। তাই রামকৃষ্ণ মিশন আজ নগরে, পল্লিতে, তীর্থক্ষেত্রে সর্বত্র নিয়ত নর-নারায়ণ-সেবা, আর্ত, পীড়িত, দুঃখদৈন্যগ্রস্ত শত শত জীবের কল্যাণ সাধনে ব্রত নিয়েছে। সন্ন্যাসী ও গৃহী এই জনসেবায় অধিকারী। এরাই প্রকৃত কর্মযোগী।
স্বামীজি সকলের উদ্দেশে বললেন, ‘আমরা যাঁর নামে সন্ন্যাসী হয়েছি, আপনারা যাঁকে জীবনের আদর্শ করে সংসারশ্রমে কার্যক্ষেত্রে রয়েছেন, যাঁর দেহাবসানের দশ বৎসরের মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জগতে তাঁর পুণ্য নাম ও অদ্ভুত জীবনের আশ্চর্য প্রসার হয়েছে, এই সঙ্ঘ তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা প্রভুর দাস। আপনারা এ কার্যে সহায় হোন।’
স্বামীজির এই সভার পর ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ সমিতির অধিবেশন প্রতি রবিবার বলরাম বসু মহাশয়ের বাড়িতে হয়েছিল। মিশনের লক্ষ্য ও আদর্শ যেহেতু কেবল আধ্যাত্মিক ও সেবামূলক, অতএব রাজনীতির সঙ্গে এর কোনও সম্বন্ধ থাকবে না।
আমরা জানি, শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগন্মাতা কালীর দর্শন ও কৃপা লাভ করে শ্রীবিদ্যার উপাসনা শুরু করেন। কিন্তু তিনি কোনও প্রতিমায় শ্রীবিদ্যার উপাসনা করেননি। শ্রীবিদ্যাকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন তাঁর অবতাররূপী মানবী এক স্ত্রী দেবীর মধ্যে। সেই মানবী দেবীই হলেন শ্রীমা সারদাদেবী। তিনিই স্বয়ং শ্রীবিদ্যা। সন্ন্যাসী শ্রীরামকৃষ্ণ সেই সম্রাজ্ঞী দেবীকে আদ্যাশক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশরূপে আরাধনা করেন। তিনি শ্রীমা সারদা দেবীর মধ্যে দিয়ে কাঞ্চিপুরমের পীঠাধিষ্ঠাত্রী দেবী ষোড়শী ও দেবী কামাক্ষীকে দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীরূপে পূজা করেন। সেই দিন থেকেই এইটি নির্দিষ্ট হল যে, আমাদের এই সন্ন্যাসী সঙ্ঘের দেবী শ্রীবিদ্যা মানবদেহী শ্রীমা সারদা দেবীর মধ্য দিয়েই তাঁর আদেশ ও নির্দেশ অনুযায়ী রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ পরিচালিত হবে।
এই ভাবনাটিকে আরও দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেই ঐতিহাসিক পদক্ষেপটিও স্বামীজি নিয়েছিলেন এই বলরাম মন্দিরের হল ঘরে অনুষ্ঠিত সভায়। উপস্থিত ত্যাগী-গুরুভাই ও গৃহী ভক্তদের সম্বোধন করে আবেগময় ভাষায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘শ্রীশ্রীমাকে কি রামকৃষ্ণদেবের সহধর্মিণী বলে আমাদের গুরুপত্নী হিসাবে মনে কর? তিনি শুধু তা নয় ভাই, আমাদের এই যে সঙ্ঘ হতে চলেছে, তিনি তার রক্ষাকর্ত্রী, পালনকারিণী, তিনি আমাদের সঙ্ঘজননী।’ জননীর স্নেহ দিয়েছেন বলেই শ্রীশ্রীমা সঙ্ঘজননী নন। স্বামীজি এক বক্তৃতায় ওই ভয়ঙ্কর দিনগুলির কথা স্মরণ করে বলেছিলেন—‘আমি যেন তখন নরকযন্ত্রণা ভোগ করছিলাম।...অথচ এমন কেউ ছিল না, যে একটু সহানুভূতি জানাবে আমাকে। শুধু একজন ছাড়া। সেই একজনেরই আশীর্বাদ আমরা পেয়েছিলাম। আর তাঁর সহানুভূতিই আমাদের মনে আশা জাগিয়েছিল। তিনি একজন নারী।...একমাত্র তিনিই আমাদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করতেন। যদিও তিনি নিজে ছিলেন অসহায়, আমাদের চেয়েও দরিদ্র।’ এই নারী আর কেউ নন, স্বয়ং সঙ্ঘজননী সারদা দেবী, শ্রীরামকৃষ্ণহীন নিঃসঙ্গ দিনগুলিতে তাঁর সন্তানদের কাছে যিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতীক।
তাই শ্রীশ্রীমা সঙ্ঘকে সুনির্দিষ্ট পথে চালাচ্ছেন বলে তিনি সঙ্ঘজননী, নিজের জীবন দেখিয়ে তিনি সঙ্ঘকে চালাচ্ছেন লক্ষ্য স্থির রেখে–ত্যাগ-বৈরাগ্য, ঈশ্বর-নির্ভরতা, সত্যনিষ্ঠা, আপামর জনসাধারণের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা দেখিয়ে। গৃহীভক্তদের গার্হস্থ্য জীবনের আদর্শ দেখিয়েছেন, ত্যাগী-ভক্তদের সন্ন্যাসের আদর্শ দেখিয়েছেন। সঙ্ঘের আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস তিনি স্বয়ং মহামায়া, মহালক্ষ্মী ও দেবী সরস্বতী–তাই সঙ্ঘজননী।
বলরাম মন্দির ও শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘ
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যলীলার বিকাশ দক্ষিণেশ্বরে, কিন্তু তার বিস্তার উত্তর কলকাতার বাগবাজারে অবস্থিত ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর বাসভবনকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম লীলাক্ষেত্ররূপে অতুলনীয় মর্যাদা লাভ করে ‘বলরাম মন্দির’। এই স্থান দেশ-বিদেশে অগণিত ভক্ত ও অনুরাগীদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি আকর্ষণ করছে। পুরনো কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে ৭ নং গিরিশ অ্যাভেনিউ-এর উপর অবস্থিত বাড়িটির নাম বলরাম মন্দির। বর্তমানে আজ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একটি শাখাকেন্দ্র— রামকৃষ্ণ মঠ, বলরাম মন্দির। বাড়িটি আনুমানিক ১৭৭৪ সালে তৈরি হয় অর্থাৎ প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো। ১৮৮১ সালের ১ জানুয়ারী শ্রীরামকৃষ্ণদেব দক্ষিণেশ্বরে প্রথম দর্শন করেন বলরাম বসু। প্রথম দর্শনে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে দেখে বলেছিলেন ‘ওঁকে চৈতন্যদেবের কীর্তনের দলে দেখেছিলাম।’ সেই থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কলকাতার বলরাম ভবনে আগমন শুরু করেন। প্রায় ১০০-এর বেশি বার তিনি এই ভবনে পদার্পণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পাদস্পর্শে বলরাম ভবন আজ বলরাম মন্দিরে পরিণত হয়েছে। বলরাম মন্দির ছিল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে কলকাতার ভক্তদের মিলনের বৈঠকখানা। শ্রীরামকৃষ্ণ-লীলাপ্রসঙ্গকার স্বামী সারদানন্দজির ভাষায় ‘মা ভবতারিণীর দ্বিতীয় কেল্লা’। অবশ্যই বলরাম মন্দির হল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিত্য ভক্ত-লীলাস্থান বা লীলাতীর্থ অর্থাৎ আজও শ্রীরামকৃষ্ণদেব এখানে ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হন— নাম-গান, কীর্তন, নৃত্য, মুহুর্মুহু সমাধি ও লীলা করেন।
গৃহদেবতা শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব ও রথযাত্রা উৎসব
এই গৃহের আর এক ঐতিহ্য হচ্ছে বাড়ির গৃহদেবতা ছিলেন স্বয়ং শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব। তাঁর নিত্য সেবা হতো ও অন্নভোগ ছিল শুদ্ধ অন্ন। তাই শ্রীরামকৃষ্ণদেব যখন কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজে ও ভক্তগৃহে বহুবার আসতেন বলরাম মন্দিরে তিনি রাত্রিবাস ও অন্নগ্রহণ করতেন। তিনি আর কোথাও রাতে থাকতেন না বা অন্নগ্রহণ করতেন না। শ্রীরামকৃষ্ণদেব রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করে ভক্তসঙ্গে নৃত্য, কীর্তন ও মুহুর্মুহু সমাধিতে ডুবে যাচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্পর্শ-ধন্য সেই রথ এই বাড়িতে রয়েছে এবং সেই রথে আজও শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রা রথযাত্রা ও পুনর্যাত্রার দিন উপবিষ্ট হন ও পূজিত হন।
আত্মারামের কৌটার পূজা
আমরা সকলে জানি, ১৮৮৬ সালে ১৬ আগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মহাসমাধির পর তাঁর পবিত্র পূতাস্থির অর্থাৎ আত্মারামের কৌটা এই বাড়ির ঠাকুর ঘরে অর্থাৎ জগন্নাথদেবের পূজার ঘরে সংরক্ষিত ছিল এবং প্রায় দু’মাস এখানে পূজা করার পর বরাহনগরে মঠে নিয়ে যাওয়া হয়।
শ্রীশ্রীসারদা দেবীর পদার্পণ ও অবস্থান
সর্বপ্রথম শ্রীমা সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বর থেকে ঠাকুরের নির্দেশে বলরামবাবুর স্ত্রী কৃষ্ণভাবিনী দেবী অসুস্থ থাকায় তাঁকে দেখতে আসেন। ঠাকুরের মহাসমাধির পর গভীর শোকাচ্ছন্ন শ্রীশ্রীমাকে বলরামবাবু কাশীপুর থেকে নিয়ে এসে এই বাড়িতে রেখে সেবা করেন এবং শোক দূর করবার উদ্দেশ্যে শ্রীশ্রীমাকে বৃন্দাবন তীর্থে নিয়ে গিয়ে সেখানে তাঁদের বাড়ি কালাবাবুর কুঞ্জে রেখে সেবা করেন।
তাছাড়া শ্রীশ্রীমা এই বাড়িতে ১৮৮৭, ১৮৮৮, ১৮৯০ সালে এবং পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করেছেন। ১৯০৭ সালে দুর্গাপুজোর সময় শ্রীশ্রীমা বলরাম ভবনে অবস্থান করেন এবং গিরিশ ভবনে গমন করেন। বলরাম ভবনে অন্তঃপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘরটিতে তিনি প্রায়ই থাকতেন। তাই এই ঘরটি বর্তমানে ‘মায়ের ঘর’ নামে পরিচিত এবং শ্রীশ্রীমায়ের চিত্র নিত্য সাজানো হয়। শ্রীশ্রীমা এই বাড়ির ছাদে নিত্য ধ্যান করতেন, তবে একবার তিনি গভীর সমাধিতে ডুবে যান এবং পরে যোগীন মাকে জানিয়েছিলেন—ঠাকুরের কাছে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং পুনরায় ওই স্থূল শরীরে প্রবেশ করতে চাইছিলেন না।
সিস্টার নিবেদিতার নারীশিক্ষার পরিকল্পনা
১৮৯৮ সালের ১২ নভেম্বর নিবেদিতার এদেশে নারী শিক্ষার উদ্দেশে বলরাম ভবনে স্বামী বিবেকানন্দের উপস্থিতিতে পাড়ার অভিভাবকদের নিয়ে একটি মিটিং করেন এবং এখানেই ঠিক হয় মেয়েদের নিয়ে একটি স্কুল শুরু করা হবে। বাগবাজারের বিখ্যাত নিবেদিতা স্কুলই তার ফলস্বরূপ। ভগিনী নিবেদিতা এই ভবনে বহুবার এসেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পার্ষদের আগমন
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে তাঁর ত্যাগী সন্ন্যাসী সন্তান ও গৃহীভক্তগণ এখানে প্রায় সকলেই এসেছেন। সন্ন্যাসী পার্ষদরা মঠের বাইরে এই বলরাম মন্দিরকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মঠ বা মন্দির বলেই মনে করতেন। তাঁরা কলকাতায় এলে এই বাড়িতেই উঠতেন ও রাত্রিবাস করতেন।
বলরাম ভবনে নীচের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে লাটু মহারাজ স্বামী অদ্ভুতানন্দজি প্রায় ন’বছর ছিলেন এবং তুরীয়ানন্দজিও এই ঘরে বহুদিন কাটিয়েছেন।
এই ভবনে স্বামী প্রেমানন্দজি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দজিও এই ভবনে মহাসমাধি লাভ করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মহিলা ভক্তদের মধ্যে গৌরী মা, যোগীন মা, লক্ষ্মীদিদি, গোলাপ মা, গোপালের মা—সকলে এসে থাকতেন।
রামকৃষ্ণ মঠ—বলরাম মন্দির
রামকৃষ্ণ মঠ, বলরাম মন্দির—অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বৈঠকখানা বা কেল্লা—নিত্য ঠাকুর সেবা ও ভক্তসেবাই এই মঠের প্রধান সেবাকার্য। রামকৃষ্ণ মঠের নানা বাৎসরিক উৎসবের সঙ্গে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব ও ১ মে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা দিবস এখানকার দু’টি বিশেষ উৎসব। শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে রথটির রজ্জু ধরে টেনেছেন এবং নৃত্য ও সঙ্গীত করেছেন—সেই রথটি ভক্তদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে ঘরে থাকতেন সেটি বর্তমানে তাঁর মন্দির এবং ঐতিহাসিক হলঘর সেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা ও নিবেদিতা স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেই হলঘর নাট মন্দির, যেখানে ভক্তরা নিত্য প্রার্থনা ও ধ্যান করেন। তাই আজও দিব্য পবিত্র এই লীলাস্থান—রামকৃষ্ণ মঠ, বলরাম মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীশ্রীমা তাঁদের অমৃত-প্রেম-সুধাভাণ্ড নিয়ে সকল জগৎবাসীকে আহ্বান করছেন।