বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

নেতা শচীনের যদি একটা
বুমরাহ থাকত! : মদনলাল 
সৌরাংশু দেবনাথ

 

সোমবার। ৩১ মার্চ, ১৯৯৭। দিনটা শুরু হয়েছিল অনন্ত সম্ভাবনার আশা জাগিয়ে। আর শেষ হয়েছিল ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে। অধিনায়ক শচীন তেন্ডুলকরের কেরিয়ারের সবচেয়ে কালো দিন!
ফ্ল্যাশব্যাকে সেদিনের বার্বাডোজে ফিরলে এখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্তক্ষরণ হয় মাস্টার ব্লাস্টারের মনে। চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য মাত্র ১২০ রান তাড়া করতে নেমে ৮১ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল ভারত। শেষ আট উইকেট পড়েছিল ঝড়ের গতিতে। সেই পরাজয় কিছুতেই মানতে পারেননি তিনি। জয়ের ব্যাপারে শচীন এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, আগের রাতে রেস্তরাঁর ওয়েটারকে বলেছিলেন ফ্রিজে শ্যাম্পেনের বোতল ভরে রাখতে। টেস্ট জিতে তা দিয়েই সেলিব্রেশনের পরিকল্পনা ছিল তাঁর। আর সেই বিজয়োৎসবে যোগ দিতে হবে ওয়েটারটিকেও। কারণ ক্রিকেটপ্রেমী ওই রেস্তরাঁ-কর্মী বাজি ধরেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে। বলেছিলেন, পরের দিন কার্টলি অ্যামব্রোজের সামনে উড়ে যাবেন ভারতীয়রা। শচীন মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সেই পূর্বাভাস উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর যে তা চাননি! বিশপ, অ্যামব্রোজ, রোজদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল টিম ইন্ডিয়া। 
এমন পরাজয়ে চুরমার হয়েছিল শচীনের মন। টানা দু’দিন কথাই বলেননি কারও সঙ্গে। নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার ভাবনাও মাথায় এসেছিল। তখন জাতীয় দলের কোচ ছিলেন মদনলাল। বিষণ্ণ সেই অতীত এখনও চিমটি কাটে তাঁকে। বললেন, ‘ওই যন্ত্রণা সহ্য করা কঠিন ছিল শচীনের কাছে। একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। মুষড়ে পড়েছিল দলের বাকিরাও। শচীন বা আমি কাউকে বকাঝকা করিনি। তবে খুবই আঘাত পেয়েছিলাম। পরের ম্যাচের আগে কীভাবে আত্মবিশ্বাস উদ্ধার করা যায়, সেটাই ভাবছিলাম।’ যদিও বাস্তবে অটুট রাখা যায়নি মনোবল। একের পর এক ধাক্কা খানখান করে দিয়েছিল নেতা শচীনের এগিয়ে চলার স্বপ্ন। 
অথচ, তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার ছিল মণিমাণিক্যখচিত ঝলমলে মুকুটের মতোই। দুই যুগ ব্যাপী ক্রিকেট জীবনে কী পাননি মাস্টার ব্লাস্টার? তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা তো গুনে শেষ করা যাবে না! স্পর্শ করেছেন সাফল্যের উত্তুঙ্গ শিখর। বিস্ময় বালক থেকে ‘গড অব ক্রিকেট’ হয়ে উঠেছেন দেশে-বিদেশে। এমন রূপকথার উত্তরণের মধ্যেও রয়ে গিয়েছে একচিলতে অপূর্ণতা। নেতা হিসেবে যে তিনি চরম ব্যর্থ। দু’দফায় নেতৃত্বের সেই ব্যালান্স শিট শুধুই হতাশার। ২৫ টেস্টে মাত্র চারটিতে জয়ের মুখ দেখেছেন। আর ৭৩টি ওয়ান ডে ম্যাচে হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছেন মাত্র ২৩ বার। ব্যাটসম্যান শচীন এভারেস্ট হলে ক্যাপ্টেন শচীন ছোটখাট টিলা মাত্র। কিন্তু কেন এত বিবর্ণ নেতা শচীন? তিনি নিজে বিরল প্রতিভার অধিকারী। যদিও তা রক্ষাকবচ হয়ে ওঠেনি নেতৃত্বে। অথচ, অধিনায়ক হিসেবে প্রথম চার টেস্টের মধ্যে তিনটিতেই জিতেছিলেন তিনি। তারপর ক্রমশ ভুলভুলাইয়ায় পথ হারানো। নেতৃত্বের দ্বিতীয় ইনিংসে তো শেষ পাঁচ টেস্টেই হারের মুখ দেখতে হয়েছে তাঁকে। সেই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে পাকাপাকিভাবে দাঁড়ি টানেন নেতৃত্বে।
নেতা শচীনের প্রথম দফায় ইন্ডিয়ার কোচ ছিলেন মদনলাল। খুব কাছ থেকে দেখেছেন জিনিয়াসের দুর্দশার সেই পর্ব। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মদনলালের মূল্যায়ন, ‘শচীন ভাবত সবাই ওর মতো খেলবে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। বাকিদের প্রতিভা ও খেলার ধরন আলাদা। সর্বশক্তি উজাড় করে দিয়েও সেই ফারাক মেটানো যায় না।’ সোজা কথায়, বাকিরা যে তাঁর মতো ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভাধর নন, এই কঠোর বাস্তবটাই অনুধাবন করতে পারেননি তিনি। অনেক সময় ব্যর্থতা জন্ম দেয় অদম্য জেদের, যা ঘুরে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে দলকে। মুশকিল হল, শচীনের ভারত কখনওই ঘুরে দাঁড়ায়নি।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে ১৯৯৭-র মে মাসে ঘরের মাঠে বসেছিল ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ। সেই মঞ্চ থেকেও খালি হাতেই ফিরেছিলেন অধিনায়ক শচীন। ফাইনালেই ওঠেনি দল। সেই আক্ষেপ এখনও টাটকা বিশ্বকাপজয়ী অলরাউন্ডারের গলায়। মদনলাল বলছেন, ‘নেতা হিসেবে শচীনের কিছু করার ছিল না। বরং ও তো ব্যাট হাতে রান করছিল। ওই টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরিও ছিল ওর নামের পাশে।’ বোঝা গেল, ব্যাটসম্যান শচীনও বাঁচাতে পারেননি নেতা শচীনের ভরাডুবি। যার নেপথ্যে ছিল বোলারদের ব্যর্থতা। পেসার হিসেবে কাদের পেয়েছিলেন? অনিয়মিতভাবে ছিলেন শ্রীনাথ। বেঙ্কটেশ প্রসাদের নতুন বলের সঙ্গী হতেন কখনও আবে কুরুভিলা, কখনও বা ডোড্ডা গণেশ, ডেভিড জনসন। চোট-আঘাতের জন্য সব সময় অনিল কুম্বলেকেও পাওয়া যায়নি। ফলে রাজেশ চৌহান, আশিস কাপুর, নীলেশ কুলকার্নি, সুনীল যোশিরাই ছিলেন স্পিনের দায়িত্বে। দুর্বল বোলিংয়ের জন্যই কি নেতা শচীন এত ব্যর্থ? মদনলালের স্বীকারোক্তি, ‘একদম ঠিক। এখন একের পর এক ফাস্ট বোলার উঠে আসছে। ভুবনেশ্বর কুমার, উমেশ যাদবের মতো অভিজ্ঞরা যেমন ছন্দে রয়েছে, তেমনই তরুণরাও নজর কাড়ছে। আর যশপ্রীত বুমরাহ, মহম্মদ সামিদের তো জবাব নেই। কখনও কখনও মনে হয়, নেতা শচীনের যদি একটা বুমরাহ থাকত! এমন বোলিং লাইন-আপ পেলে হয়তো এত ম্যাড়মেড়ে দেখাত না ওর নেতৃত্বের রেকর্ড।’ নেতা হিসেবে শচীন ঠিক কেমন ছিলেন? উত্তর এল, ‘গুড ক্যাপ্টেন। ওর মাথায় প্রচুর আইডিয়া ঘুরত। কিন্তু তা সবসময় মেলে ধরা যেত না। কথায় আছে, দল যতটা ভালো, ক্যাপ্টেনও ততটাই। ভালো দল পেলে নিশ্চিতভাবেই সাফল্য ধরা দিত নেতা শচীনের হাতে।’ ক্রিকেট মহলের প্রচলিত ধারণা, নেতৃত্ব চাপ হয়ে উঠেছিল শচীনের কাছে। পরবর্তী কালে তিনি নিজেও ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে ত্যাগ করেছিলেন নেতৃত্বের দায়ভার। যদিও এই মতবাদ ভোট পাচ্ছে না মদনের। তাঁর সওয়াল, ‘শচীন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। সবসময় পারফরম্যান্স করে গিয়েছে। এমন নয় যে, নেতা থাকার সময় রানের খরায় ভুগেছে সে। উল্টে বিশ্বের সর্বত্র রান করেছিল সেই সময়ও।’
একদিনের ক্রিকেটে নেতা শচীনের রয়েছে দু’টি ট্রফি। ১৯৯৬-র টাইটান কাপ ও তার পরের বছর সাহারা কাপ। সেই সাফল্যের রেসিপি কী? তৎকালীন কোচের বিশ্লেষণ, ‘টরন্টোয় সাহারা কাপে দুর্দান্ত খেলেছিল সৌরভ। ফলে অনেক চাপমুক্ত ছিল শচীন। আসলে অনেক ক্ষেত্রেই দরকারের সময় ক্রিকেটাররা জ্বলে উঠতে পারে না। ক্লিক করে না কম্বিনেশন। যার দায় এসে পড়ে নেতার উপর।’
আর সেই নেতার নাম যদি হয় শচীন, তখন চর্চা তো বেশি হবেই! বাইশ গজের ভগবানের ব্যর্থতা কীভাবেই বা বরদাস্ত করেন ভক্তরা!

24th     April,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা