দীর্ঘ ২৪ বছর ব্যাট হাতে তিনি শাসন করেছেন বিশ্ব ক্রিকেট। মানুষের কাছে ক্রিকেট ও শচীন শব্দ দু’টি সমার্থক। আজ তাঁর ৫০তম জন্মদিন। হ্যাপি বার্থডে তেন্ডুলকর।
কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে দিদি সবিতা ছোট ভাইয়ের জন্য এনেছিলেন একটা উইলো ব্যাট। কে জানত সেই ব্যাটই একদিন বিশ্ব ক্রিকেটের মহাস্তম্ভ হয়ে উঠবে! সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করবে ঝাঁকড়া চুলের ‘বিস্ময় বালক’কে!
বিস্ময় বালকের দ্যুতি ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব ঘটেছিল শচীন তেন্ডুলকরের। সদ্য ষোলো পেরনো ছেলেটাকে শুরুতেই দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। নির্দেশ ছিল, তোমাকে টিকে থাকতে হবে, বাঁচাতে হবে দলকেও। বিপক্ষ শিবিরে ওয়াসিম আক্রাম, ওয়াকার ইউনিস, ইমরান খানের মতো বাঘা বাঘা পেসার। যাঁদের বিষাক্ত স্যুইং আর বাউন্সের ভয়ে অনেক ব্যাটসম্যানই রাতে ভালোভাবে ঘুমোতে পারতেন না। অন্যদিকে, আবদুল কাদির ও মুস্তাক আহমেদের মতো দুই ঘুঘু লেগ স্পিনার। তা সত্ত্বেও পড়শি দেশে ঢুকে রীতিমতো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হেনেছিলেন শচীন।
সালটা ছিল ১৯৮৯। পাকিস্তান সফরে শচীন দেখিয়েছিলেন, কীভাবে বুক চিতিয়ে লড়তে হয়। সেই দিনগুলি আজও ভোলেননি কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত। ভুলবেনই বা কী করে! তাঁর হাতেই যে ছিল দলের দায়িত্ব। তিনি ক্যাপ্টেন। শচীনের অভিষেক বিদেশ সফর ঘিরে আজও নস্ট্যালজিক ‘চিকা’। সিন্ধুর নাব্যতা কমেছে, কিন্তু শ্রীকান্তের স্মৃতিপটে তেন্ডুলকরের উত্থান কাহিনি আজও একইরকম গভীর। স্মৃতির সরণি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীকান্ত বলছিলেন, ‘দলে তখন ডামাডোল অবস্থা। চুক্তির অর্থ বৃদ্ধি নিয়ে বোর্ডের সঙ্গে সংঘাত জারি ক্রিকেটারদের। অধিনায়ক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল দল ও বোর্ডের মধ্যে সেতুবন্ধন। আসলে সমস্যার বীজটা লুকিয়ে ছিল বেশ গভীরে। আগের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দেশে ফেরার পথে কয়েকজন ক্রিকেটার আমেরিকায় বেসরকারি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল। তা মনঃপুত হয়নি তৎকালীন বোর্ড কর্তাদের। নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়েছিল ক্রিকেটারদের উপর। শেষ পর্যন্ত সমস্যা মেটে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে। কিন্তু রেশ থেকে গিয়েছিল। পাকিস্তান সফরের দল ঘোষণার পর তা আবার মাথাচাড়া দেয়। তবে সেই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আমরা সবাই পাক সফর নিয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলাম। দলের কনিষ্ঠতম সদস্য শচীন। চুপচাপ থাকত। ছোটখাট চেহারা, ঝাঁকড়া চুল। বেশ আকর্ষণীয় এক চরিত্র। মনে পড়ে, ওই সফরে সলিল আঙ্কোলারও অভিষেক হয়েছিল। ওর রুমমেট ছিল শচীন। যাতে ওরা জীবনের নতুন অধ্যায়টা আলাদাভাবে উপভোগ করতে পারে। প্রথম টেস্টের দু’দিন আগে হোটেলের লবিতে শচীনের সঙ্গে দেখা। ও কৌতূহলের বশে কনট্র্যাক্ট বিতর্ক নিয়ে কিছু বলতে চাইছিল। থামিয়ে দিয়ে ওকে বলেছিলাম, বড়দের ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামিও না। খেলায় মন দাও।’
পারফরম্যান্সের নিরিখে শচীনের অভিষেক টেস্ট সিরিজ মোটেও প্রত্যাশা ছুঁতে পারেনি। প্রথম টেস্টে করেছিলেন মাত্র ১৫ রান। দ্বিতীয় টেস্টে ৫৯ ও ৮। তৃতীয় টেস্টে আউট হয়েছিলেন ৪১ রানে। আর শিয়ালকোটে প্রথম ইনিংসে ৩৫ রানে আউট হলেও, দ্বিতীয় ইনিংসে উপহার দিয়েছিলেন লড়াকু অর্ধশতরান, যা ভারতকে ম্যাচ বাঁচাতেও সাহায্য করেছিল। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই মুঠো ফোনের উল্টো দিক থেকে শ্রীকান্ত গড় গড় করে বলে গেলেন, ‘শচীনকে প্রথম টেস্টে খেলানোর কথা ছিল না। ম্যানেজার চাঁদু বোরদে একদিন ডেকে বলল, ছেলেটাকে দেখো, কীরকম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যাট করছে! শচীনকে দেখে সত্যিই ভালো লেগেছিল। তখনই ঠিক করে নিই, ওকে সুযোগ দেওয়া দরকার। অভিষেকে খুব ভালো পারফর্ম করেছিল বলব না। তবে ওর মধ্যে শেখার প্রবল জেদ লক্ষ করেছিলাম। শিয়ালকোটে দ্বিতীয় ইনিংসে ওর চোয়ালচাপা লড়াই কখনও ভুলব না। ৩৮ রানেই পড়ে গিয়েছিল ৪ উইকেট। আমি, রবি, মঞ্জরেকর, আজহার আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়েছি। মনে হচ্ছিল, ম্যাচ ও সিরিজ বাঁচানো সম্ভব নয়। একদিকে সিধু পাজি। অন্যদিকে শচীন। সবে ছেলেটা এক রান করেছে। ওয়াকার ইউনিস সজোরে একটা বাউন্সার ছাড়ল। গিয়ে লাগল ওর হেলমেটে। সবাই হতচকিত। পাশে বসেছিলেন এক নির্বাচক। তাঁকে বললাম, এরকম পিচে ক্রিকেট খেলা যায় না। এত বড় বড় ঘাস। শুনে ওই নির্বাচক বলছিলেন, পাকিস্তান মিডিয়া মজা করে বলছে, কাপ্তান সাহাবের (ইমরানের) নির্দেশ, পিচের ঘাস কাটলে গর্দান কেটে নেবে। শচীনের নাক ফেটে গল গল করে রক্ত পড়ছে। ভিজে গিয়েছে সাদা শার্ট। আমরা ভেবেছিলাম, ওকে তুলে নেব। বাচ্চা ছেলে। এই চাপ নিতে পারবে না। আমাদের দলের ডাক্তার ছিলেন বিশ্বাস রাউত। বললাম, গিয়ে দেখুন কী অবস্থা। ফিরে এসে ডাক্তার বললেন, শচীন খেলবে বলছে। ওর সেই লড়াকু মানসিকতা মুগ্ধ করেছিল আমাকে, গোটা দলকে। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে পরের বলেই ওয়াকারকে ফ্লিকে লেগ সাইডে বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিল। বুঝেছিলাম, এ ছেলের কলজের জোর আছে। তবু চা পানের বিরতিতে শচীনকে ডেকে বললাম, তোমার এভাবে ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হয়নি। ওর সটান জবাব ছিল, ‘আমার কাছে দল বড়। ভয় পেলে চলবে না।’
শচীন তেন্ডুলকরের ক্রিকেট জীবন এমনই সব রোমাঞ্চকর গল্পে মোড়া। পরতে পরতে রয়েছে এমনই বহু উপাদান, যা থেকে চোখ ফেরানোই দুষ্কর। দীর্ঘ ২৪ বছরের ক্রিকেট জীবনে শচীন শুধু খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেননি, পথ দেখিয়েছেন যুবসমাজকে। প্রজন্মকে পড়িয়েছেন শৃঙ্খলার পাঠও। কখনও তিনি পাশের বাড়ির সেই ছেলেটা। কখনও বন্ধুর বেশে ধরা দিয়েছেন টিভির পর্দায়। কখনও আবার অজান্তেই হৃদয়হরণ করেছেন অষ্টাদশী তরুণীর। ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রাচীর গুঁড়িয়ে আপামর ভারতবাসীকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন অমোঘ মায়াজালে। কপিল দেবের নেতৃত্বে ৮৩’র বিশ্বকাপ জয় ভারতীয় ক্রিকেটে নবজাগরণ ঘটিয়েছিল। আর শচীন উন্মুক্ত করেছিলেন বিশ্বায়নের দুয়ার।
শিবাজি পার্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাফল্যের শিখর জয় যে সম্ভব, সেই স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। রূপায়িত করেছিলেন বাস্তবে। ক্রিকেট মাঠে এমন কিছু প্রতিভা আমরা দেখি, যা সত্যিই ঈশ্বর প্রদত্ত। শচীন সব কিছুর ঊর্ধ্বে। প্রতিভার নিরিখে তাঁকে মাপা কঠিন। কীর্তির মূল্যায়নেও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই তো তিনি ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’। জীবন্ত কিংবদন্তি। যাঁর ঝুলিতে রয়েছে ‘সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি’। কথায় বলে, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্য। কিন্তু এই রেকর্ড সত্যিই কি কোনওদিন ভাঙবে? ২০০টি টেস্টে ১৫ হাজার ৯২১ রান। ৪৬৩টি একদিনের ম্যাচে রান সংখ্যা ১৮ হাজার ৪২৮। এখানেই থামেননি তেন্ডুলকর। বল হাতে দুই ফরম্যাট মিলিয়ে তাঁর শিকার সংখ্যা দু’শো। তাই শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁকে বিচার করা ভুল হবে। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিভার তো কখনওই অভাব ছিল না। অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ার কাহিনিও কম নয়। শচীনের সামনেও ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তিনি সেই হার্ডল টপকেছেন সাবলীলভাবে। দেখিয়েছেন সাহসিকতার পরিচয়। ঘটিয়েছেন প্রতিভার বিস্ফোরণ।
শুধু ডিফেন্স নয়, স্টেপ আউটে বাউন্ডারি হাঁকানোর ক্ষেত্রে শচীনের জুড়ি মেলা ভার। তেমন এক কাহিনিও শোনালেন শ্রীকান্ত। ‘টেস্ট সিরিজের পর পাঁচটি ওডিআই খেলার কথা ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। পেশোয়ারে ছিল প্রথম ম্যাচ। খারাপ আবহাওয়ার জন্য খেলা প্রায় ভেস্তে যেতে বসেছিল। দর্শকরাও নাছোড়বান্দা। খেলা না হলে গণ্ডগোল লেগে যেত। অবশেষে ঠিক হয়, দুই দল ২০ ওভারের প্রদর্শনী ম্যাচ খেলবে। পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করে সম্ভবত ১৫৭ তুলেছিল। আমরা রান তাড়া করতে নেমে কিছুটা চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। আস্কিং রেট অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। ক্রিজে তখন আমি আর শচীন। প্রদর্শনী ম্যাচ বলে ঝুঁকি নিচ্ছিলাম না। শচীনকেও বললাম, পরের ম্যাচের জন্য প্র্যাকটিসটা সেরে নাও। ও বাবা, কে কার কথা শোনে। মুস্তাক আহমেদের বলে একের পর এক ছক্কা। তার পরেই দেখলাম ‘জাগলার’ কাদির হাজির। সেই সময় ওর স্পিন খেলা সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু শেষ ওভারে সেই আবদুল কাদিরকে তুলোধনা করেছিল শচীন। তিনটি বিশাল ছক্কা। এখনও চোখের সামনে ভাসছে। প্রথম দু’টো লং অন দিয়ে। পরেরটা লং অফে। তখনই বুঝেছিলাম, এই ছেলে অনেক দূর যাবে। ওটা আমার দেখা শচীনের অন্যতম সেরা ইনিংস। পাকিস্তান ম্যাচটা জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু মন জয় করেছিল শচীন। সফরের শুরু থেকেই পাক সমর্থকরা আমাদের নানাভাবে হেনস্তা করেছিল। কিন্তু ওই ম্যাচে বদলে গিয়েছিল ছবিটা। গ্যালারিতে শুনেছিলাম শচীনের নামে জয়ধ্বনি।’