সেকালের কলকাতায় চড়ক শুরু হতো কালীঘাটে। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গাজন সন্ন্যাসী বা ভক্তারা ভোরবেলায় কালীঘাটে চলে আসতেন। তাঁদের সঙ্গে থাকত নানা দেশজ বাদ্যযন্ত্র, সঙের দল। কালীঘাটে ‘বাণ-ফোঁড়া’ হয়ে যাওয়ার পর গাজনের দল বেরিয়ে পড়ত পথে পথে। কীরকম ছিল সেই সময়ের গাজনের দলের এই পথ পরিক্রমা? সে বর্ণনা মূর্ত হয়েছে হুতোমের (কালীপ্রসন্ন সিংহ) বর্ণনায়। তিনি লিখেছেন, ‘ক্রমে গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গ্যাল। সহরে কানপাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধো, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সুতোশোন, সাপ, ছিপ ও বাঁশ ফুঁড়ে একেবারে মরিয়া হয়ে নাচতে নাচতে কালীঘাট থেকে আসচে...।’
আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগের কথা। ভারতভ্রমণ কালে ১৮২২ সালে কলকাতায় এসেছেলেন ব্রিটিশ পর্যটক ফ্যানি পার্কস। ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে প্রসিদ্ধ গবেষক বিনয় ঘোষ ফ্যানির বর্ণনায় কলকাতার গাজনের নানা রং ফুটিয়ে তুলেছেন। ফ্যানি লিখেছেন, ‘দেখলাম, হাজার হাজার লোক রাস্তায় ভিড় করে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কীসের ভিড়? শুনলাম, চড়কপূজার উৎসব হচ্ছে। দীর্ঘ একটি কাষ্ঠদণ্ডের মাথায় হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়কপূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কত রকমের লোক যে কত বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে, তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচক্ষে দেখলাম এ দেশের বৈরাগী সাধুদের। সর্বাঙ্গে তাদের ভস্মমাখা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে এক টুকরো কাপড় জড়ানো...।’ তাঁর বর্ণনায় আরও পাই, ‘নীচ জাতের হিন্দুরা শুনেছি চড়ক পূজার অত্যন্ত ভক্ত। পূজা উৎসবের যোগদানকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ...ধনী লোকেরা টাকাপয়সা দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের চড়ককাঠে চরকিপাক খাওয়ান পুণ্যার্জনের জন্য। এইভাবে প্রক্সি দিয়েও নাকি পুণ্যলাভ করা যায়।’
কালীঘাট থেকে গাজন শুরু হলেও সেই সময়ে কলকাতায় চড়কের আসর বসত অন্যান্য জায়গায়। যেমন এন্টালি অঞ্চলে দু’টি চড়কের মেলা হতো। তখন এন্টালিকে ইন্টালি বলার চল ছিল। কালীঘাট-হাজরা থেকে চিৎপুর, বড়বাজার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যেসব চড়কের মেলা বসত, তার উপর ১৮৩৯ সালে আঘাত আসে। কলকাতা পুলিস ওই রাস্তায় গাজনের শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে দেয়। কারণ গাজনকে কেন্দ্র করে ভক্তারা যেসব নৃশংস রীতিনীতি পালন করত, তা নিয়ে সাহেবদের তো বটেই, এখানকার অনেকেরই আপত্তি ছিল। তাই ১৮৩৯ সালের ৩০ মার্চ প্রশাসন নির্দেশিকা দিয়ে বলে, ‘চড়কের সন্ন্যাসীরা কালীঘাট হইতে কলুটোলা ও মেছোবাজারের রাজবর্ত্ম দিয়া আগমনকরণের যে প্রথা আছে, তাহার পরিবর্তে সারকিউলার রোড অর্থাৎ নূতন রাস্তা দিয়া আগমন করিবেক।’ সে সময়ের ‘সমাচার দর্পণ’ কাগজে এ ঘোষণা ফলাও করে প্রচারিত হয়। এরপর ১৮৬৩ সালে সরকার আইন করে শরীরে বাণ ফোঁড়া বন্ধ করে দেয়। সেই কারণে তখন থেকে চালু হয়েছিল পিঠে গামছা বেঁধে ঝুলে চড়ক কাঠে ঘোরার প্রথা। সেকালের কলকাতায় সবচেয়ে বড় অর্থাৎ ১৬ চরকির চড়কগাছ হতো বাগবাজারে। বাগবাজার স্ট্রিটের এখন যেখানে বাবু নন্দলাল বসুর বাড়ি, তার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এই চড়ক বসত। এটি রামধন ঘোষের চড়ক নামেও পরিচিত ছিল। ১৮৫৫ সাল নাগাদ এই চড়ক বন্ধ হয়ে যায়। বুড়াবাজারের (বুড়া শিব বা ধর্মঠাকুরের নামে বড়বাজারের আগের নাম ছিল বুড়াবাজার) বুড়া শিবতলা থেকে গাজনের মেলা পরে চিৎপুর বিডন উদ্যানে চলে আসে। পরে আবারও এই গাজনের ঠাঁইবদল হয়। চলে আসে ছাতুবাবুর বাজারের মাঠে। এখনও এই চড়ক মেলা বসে ছাতুবাবুর বাজারের সামনের রাস্তায়।
উনিশ শতকের কলকাতায় চড়কের শোভাযাত্রার একটি অসাধারণ বর্ণনা হুতোম দিয়েছেন এভাবে—‘চিৎপুরের বড় রাস্তা, মেঘ কল্লে কাদা হয়—ধুলোয় ধুলো। তারমধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েচে। প্রথমে দু’টো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশে বেঁদে কাঁদে করেচে, কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ি বাজাতে বাজাতে চলেচে। তার পেছনে এল মেলো নিশেনের শ্রেণি। মধ্যে হাড়িরা দল বেঁদে ঢোলে সঙ্গতে ভোলা বোম, ভোলা বড় রঙ্গিলা, লেংটা ত্রিপুরারী শিরে জটাধারী ভোলার গলে দোলে হাড়ের মালা ভজন গাইতে গাইতে চলেচে। তার পেচনে বাবুর অবস্থামত তকমাওয়ালা দারোয়ান, হরকরা, সেপাই। মধ্যে সর্বাঙ্গে ছাই ও খড়ি মাখা টিনের সাপের ফণার টুপি মাথায় শিব ও পার্বতী সাজা সঙ। তার পেচনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকী বাণ ফুঁড়ে ধুনো পোড়াতে পোড়াতে নাচতে নাচতে চলেচে।’ হুতোমের কথাতেই শেষ করা যাক। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘কলকেতা শহরের আমোদ শীগগির ফুরায় না, বারোয়ারি পূজার প্রতিমা পূজা শেষ হলেও বারো দিন ফেলা হয় না। চড়কও বাসি, পচা, গলা ও ধসা হয়ে থাকে—সেসব বলতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায় ও ক্রমে তেতো হয়ে পড়ে। সুতরাং টাটকা চড়ক টাটকা-টাটকাই শেষ করা গেল।’
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়