বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

আমেরিকার প্রেতপুরী
মৃণালকান্তি দাস

ভোর পাঁচটা। আকাশ তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানলার শার্সিতে পুরু বরফ। অন্ধকার ভেদ করে তিনটে আলোর রেখা। বন্দিরা যাতে পালাতে না পারে, সে জন্য দু’টো আলো এখানকার টাওয়ারে অনবরত ঘুরপাক খায়। রশ্মিগুলি একে অন্যকে ছেদ করে আলাদা হয়ে যায়। এদিকে ওভারকোটের ওপর কম্বল চাপিয়ে, হাতে গ্লাভস আর পায়ে মোজা পরেও ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে।
বন্দিশালার ওপরের বাঙ্কে শুয়ে, বিভিন্ন শব্দ ভেসে আসে সুকভের কানে। করিডর দিয়ে ২০ গ্যালন মলের পিপে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে অন্য বন্দিদের ইউনিট। এতটুকু চলকে গেলে দুর্গন্ধে টেকা দায় হবে। সুকভদেরও হাড়-কাঁপানো এই ঠান্ডায় উঠতে হবে। রেশনে বরাদ্দ রোজকার দু’টুকরো রুটি। মাংসহীন সুরুয়া খেয়ে রোল-কলের জন্য দাঁড়াতে হবে। ওই খাবারে পেট ভরে না। ইভান দেনিসোভিচ সুকভ তাই আধখানা রুটি লুকিয়ে জ্যাকেটের পকেটে ভরে নেয়।
এভাবেই শুরু হয়েছিল রুশ লেখক আলেকজান্দার সলঝেনিৎসিনয়ের প্রথম উপন্যাস ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান দেনিসোভিচ’। ১৯৬২ সালে সেই বই রুশ ভাষায় ছেপে বেরনোর পরই বিশ্ব জুড়ে হুলস্থুল। স্তালিনের আমলে সোভিয়েত দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই সব বন্দিশিবির বা ‘গুলাগ’-এর কথা তার আগে এভাবে জানা ছিল না। উপন্যাস লেখার অপরাধে রেহাই পাননি সলঝেনিৎসিনও। নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের শেষ দিকেই রুশ গোয়েন্দাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে বন্দি শিবিরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারপর টানা আট বছরের জেল-জীবন...
গোটা দুনিয়া জেনেছিল গুলাগ বন্দিদের যন্ত্রণার কথা। ভলগা নদীর জলে মিশে গিয়েছে বন্দিদের সেই রক্তাক্ত ইতিহাস। একসময় কোলিমা রাজপথের নামই তো হয়ে গিয়েছে ‘দ্য রোড অব বোনস’। অর্থাৎ হাড়ের রাস্তা! কারণ? এই রাস্তা বানাতে এত বন্দির মৃত্যু হয়েছে যে অ্যাসফল্ট মোড়ানো রাজপথের নীচে হাড় খুঁজে পাওয়া মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। মানবসভ্যতা ভেবেছিল স্তালিনের মৃত্যুর পর ‘গুলাগ’-এর সেই ভয়ঙ্কর ইতিহাস হয়তো জাদুঘরে ঠাঁই পাবে।
কিন্তু ৯/১১-র ধাক্কায় বিধ্বস্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ যে সেই ইতিহাসকেই বাঁচিয়ে তুলবেন, তা কে ভেবেছিল? বুশ প্রশাসনের যুক্তি ছিল, বন্দিদের দীর্ঘ জেরা (অত্যাচার) করার অধিকার তাঁদেরও রয়েছে। কারণ, ৯/১১-র কুচক্রীদের খুঁজে বের করতেই হবে। তাই আমেরিকার তটভূমির বাইরে এমন জায়গা খুঁজে নেওয়া হয়েছিল, যেখানে মার্কিন আইন কাজ করবে না, জেনেভা কনভেনশনও নয়। সভ্যতা-অসভ্যতার যুদ্ধের প্রতীক হয়ে উঠবে গুয়ান্তানামো বে!
পোয়ের্তো গ্রান্দে। ১৪৯৪-এর ১৩ এপ্রিল ক্রিস্টোফার কলম্বাস গুয়ান্তানামোতে পা দিয়ে এই নামই দিয়েছিলেন। খেরোর খাতায় লিখে রেখেছিলেন, ‘কালো জলের চওড়া এক উপসাগর।’ তার ৪০০ বছর পর স্পেনীয়-মার্কিন যুদ্ধ চলাকালীন, ১৮৯৮-এর ১০ জুন মার্কিন নৌবাহিনী গুয়ান্তানামোতে নামে। সেই প্রথম। যুদ্ধের ফলাফল ছিল আমেরিকানদের পক্ষে। সেই থেকে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্যারিবীয় সাগরের উপর ‘গিটমো’ মার্কিন নিয়ন্ত্রণে। কিউবার আপত্তিকে পাত্তাই দেননি কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ইরাকে আবু ঘ্রাইবের গল্পটা মনে পড়ে?
মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে অত্যন্ত অস্বস্তিকর এক অধ্যায়। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পরে সাদ্দাম হোসেনের এই বন্দি শিবিরকে মার্কিন সেনারা একটি পুরোদস্তুর সামরিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে। এই আবু ঘ্রাইবেই বন্দি একাধিক ইরাকির উপর মার্কিন সেনারা জেরার নামে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও মানসিক নিপীড়ন চালিয়েছে এবং সগর্বে সেগুলি ক্যামেরাবন্দি করেছে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে আঁতকে ওঠার মতো সব ছবি। ২০০৪ সালে সিবিএস নিউজ চ্যানেলে ফাঁস হয়ে যায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার নিদর্শন। দুনিয়া সেদিন দেখেছিল, বন্দির গলায় বেড়ি পরিয়ে ছাগলের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছেন মার্কিন সেনা লিন্ডি ইংল্যান্ড। নগ্ন বন্দিদের দিয়ে বানানো মানব পিরামিডের সামনে সহাস্যে পোজ দিচ্ছেন স্পেশাল অফিসার চার্লস গ্রেনার ও লিন্ডি। বন্দিকে নগ্ন করে তার সারা শরীরে মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে বিষ্ঠা। স্বাভাবিকভাবেই তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল রেডক্রস ইন্টারন্যাশনাল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রভৃতি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী ধিক্কারের মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় বুশ প্রশাসন। ১১ জন সেনা কোর্টমার্শাল ও কারাবাসের পরে বাহিনী থেকে বিতাড়িত হয়। বুশ প্রশাসন দাবি করে, আবু ঘ্রাইব একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তা কখনওই মার্কিন সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক আচরণ ও নীতিবোধের পরিচয় দেয় না। কিন্তু কয়েক বছর পর কিছু গোপন নথিপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, ইরাক হামলার আগেই নাকি মার্কিন বিচার বিভাগ থেকে সেনাবাহিনীকে কিছু ‘বিশেষ তদন্ত পদ্ধতি’ প্রয়োগ করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে এ-ও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জেনেভা কনভেনশন দ্বারা গৃহীত যাবতীয় নিয়ম এক্ষেত্রে খাটবে না।
প্রশ্ন উঠেছিল, কতটা সভ্য এই সভ্যতা? ইরাকের কারাগারের ছবি কি ভিয়েতনামের মানুষের কাছে নতুন? মেয়েদের শরীর কেটে সেনা ক্যাম্পে টাঙানো হতো না? বেয়নেট দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হতো না মানুষকে? নাপাম দিয়ে উজাড় করে দেওয়া হয়নি গ্রামের পর গ্রাম? এই ছবি কি কম্বোডিয়ায় নতুন? চিলিতে? আফগানিস্তানে? সভ্যতার গল্প তো মারণেই। মানবদেহ এখানে শুধু নিপীড়িত হয়নি, ক্যামেরাবন্দি সেই নিপীড়ন হয়ে উঠেছে বিনোদনের উপাদান। নিপীড়ন নিজেই এখানে হয়ে উঠেছে সযত্নে রেকর্ড করা প্রদর্শনমূলক বিষয়বস্তু। সযত্নে সংরক্ষিত দৃশ্যগুলি সেদিন যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই গোলোকায়িত সমাজের পুরোটাই আজ আমেরিকার নজরবন্দি। সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হলে যে কারও উপরে যখন তখন নেমে আসতে পারে অকথ্য অত্যাচার।
যেমনভাবে মার্কিন দাক্ষিণ্যে গুয়ান্তানামো কারাগার একসময় হয়ে উঠেছিল এক প্রেতপুরী!
২০০২-র জানুয়ারিতে ওই জেল চালু হওয়ার সময় তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেছিলেন, ‘ভয়ঙ্কর অপরাধীদের জন্যই ওই জেল বানানো হয়েছে।’ কার্যত, ‘শত্রু’ দেশগুলি ধরা পড়া বিপক্ষের সেনা জওয়ানদের উপর যেমন নির্মম অত্যাচার চালায়, ওই জেলে অত্যাচার চালানো হতো সেইভাবেই। কেউ কেউ নাৎসিদের ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’র সঙ্গেও তুলনা করেন। মর্তের নরক ‘গুয়ান্তানামো বে’ কারাগার সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, যেখানে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আটক করা বন্দিদের নারকীয় শাস্তির মুখে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। ন্যায্য বিচার তাদের জন্য নয়। যুদ্ধের আইনই বলে শেষকথা। প্রতিবাদ তথ্যরেণু হয়ে ঝরে পড়ে ইতিহাসের অস্থিপঞ্জরের ভিতরে। দাগিয়ে যায় সেই কালো বাস্তবের ক্যালেন্ডারে। যেখানে মৃত্যুর সমার্থক শব্দ ‘নিকেশ’। সোভিয়েত জমানার ‘গুলাগ’-এর সঙ্গে এর অমিল কোথায়? বন্দিদের দিকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া, নগ্ন করে ঝুলিয়ে রাখা, বিদ্যুতের শক দেওয়া— ভয়াবহ এক অত্যাচারের ল্যাবরেটরির জন্ম দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ।
গুয়ান্তানামোর বন্দিদের একটা বড় অংশকে শেষ পর্যন্ত কোনও অপরাধে অভিযুক্ত করা যায়নি। দীর্ঘ সময় তাঁরা কার্যত বিনা বিচারে নির্যাতিত হয়েছিলেন। বছরের পর বছর। আক্ষরিক অর্থেই, নির্বিচারে। হাতকড়া পরা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা। জল খেতে না দেওয়া। তীব্র আলোর ঝলকানি। বরফে শুইয়ে রাখা। মুখে কাপড় বেঁধে অনবরত জল ঢালা। হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলা। জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত বেধড়ক পেটানো। তীক্ষ্ণ উচ্চমাত্রার শব্দ দ্বারা নির্যাতন। আরও কত কী! আর তা যাবতীয় মানবাধিকার লঙ্ঘন করেই। জেলের ভিতর জিজ্ঞাসাবাদের এক ‘আধুনিকতম পদ্ধতি’ প্রয়োগ দেখেছিল একুশ শতকের দুনিয়া। যাকে বলে ‘এনহান্সড ইনটেরোগেশন’। জেরার এই অভিনব পন্থার স্রষ্টা মনোবিদ জেমস মিচেল। নিন্দুকেরা অবশ্য বলতেন, ওই জেরা আসলে ‘থার্ড ডিগ্রিরই’ নামান্তর। আমেরিকা মানতে চায়নি।
মিচেল জানিয়েছেন, শত্রুর হাতে ধরা পড়ার পর কীভাবে তাদের জেরার মুখে সংযম রাখতে হবে, তা নিয়ে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, তার ভিত্তিতেই ওই প্রক্রিয়া সুপারিশ করেছিলেন তিনি। বন্দিদের বার বার কাঠের দেওয়ালে নিয়ে ধাক্কা মারা, কখনও আবার ছোট্ট একটি বাক্সে পোকামাকড়ের সঙ্গে পুরে বন্ধ করে দেওয়া হতো। তবে সব থেকে বেশি অভিনব ছিল ওয়াটারবোর্ডিং। সহজভাবে বললে, জলে ডুবে যাওয়ার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়ে যে রকম অনুভূতি তৈরি হয়, ঠিক সেই রকম অনুভূতি তৈরি করে জেরার নামই ওয়াটারবোর্ডিং। ধরে নেওয়া হয়, এই পরিস্থিতিতে সংযম হারিয়ে জেরার মুখে ভেঙে পড়বেন বন্দি। মিচেলের কথায়, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, এবার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জমি বুঝে নিতে হবে।’
‘শিন্ডলার্স লিস্ট’-এর তিন বছর পর স্টিভেন স্পিলবার্গ টিভির জন্য একটা তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। ‘সারভাইভার্স অব দ্য হলোকস্ট’ নামে সেই তথ্যচিত্রে এক ইহুদি বেহালাবাদকের সাক্ষাৎকার রয়েছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর নাৎসি অফিসাররা তাঁকে বলেছিল, ‘ও, তুমি বেহালা বাজাও বুঝি। ঠিক আছে, কিছু একটা বাজিয়ে শোনাও।’ তড়িঘড়ি একটুকরো বাখ বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন তিনি। অফিসাররা বলল, ‘বাঃ বাঃ, খাসা হাত। আরেকটা বাজাও।’ চারপাশে তখন মৃত্যুর মিছিল চলছে। ঝাড়াই বাছাই চলছে ধরপাকড় করে আনা ইহুদিদের। নারী-পুরুষের মধ্যে যারা একটু শক্তপোক্ত, তাদের মাথা কামিয়ে, হাতে উলকি এঁকে বন্দি সংখ্যা লিখে ঝটপট পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দূরে সার বেঁধে থাকা ব্যারাকে। আর বৃদ্ধ যারা, অসুস্থ, অথবা অশক্ত, তারা একটা আলাদা লাইন করে দাঁড়িয়েছে। ওদের হয়তো অন্য কোথাও পাঠানো হবে। ফলে প্রতি মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে এক একটা পরিবার। স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাচ্ছে, বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। চারদিকে চিৎকার। কান্নার রোল। তার মধ্যে বেহালার সুর ওঠে না। তাও ইহুদি বেহালাবাদক বেঠোফেন বাজালেন কিছুক্ষণ। আবার তারিফ... হাততালি চটাপট। সঙ্গে আবদার আরও কিছু শোনাও। এভাবেই বেহালায় সুর উঠল— হেইডেন, ব্রুকনারের মতো তাবড় জার্মান সুরকারের ছন্দে। হঠাৎ এক নাৎসি অফিসার জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, তুমি গুস্তাভ মাহলার বা মেন্ডেলসোন-এর কোনও সুর জানো?’ আতঙ্কে স্থির বেহালাবাদক। এঁরা তো নাৎসি যুগে নিষিদ্ধ। এতক্ষণ তিনি বুঝতেই পারেননি, বাজনা শোনার নাম করে কীভাবে তাঁকে একটু একটু করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে...
গুয়ান্তানামো কি সেই ভয়ঙ্কর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতোই? গুয়ান্তানামো বে কারাগারের বিস্তারিত বর্ণনা প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন বন্দি মজিদ খান। মার্কিন সামরিক আদালতে মজিদ খান ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাঁর উপর চলা সিআইএ-র নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেই কাহিনি ফলাও করে ছাপিয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস। মজিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত থাকা। ২০০৩ সালে পাকিস্তান থেকে ধরা পড়েন। তাঁকে তুলে দেওয়া হয় সিআইএ-র হাতে। পরে সিআইএ-কে যাবতীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। আশা ছিল মুক্তি মিলবে। কিন্তু যতই সাহায্য করেছেন, ততই বেড়েছে নির্যাতনের মাত্রা।
ছাদের সঙ্গে হাত বেঁধে দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রাখা হতো। টানা দীর্ঘ সময় ঘুমতেও দেওয়া হতো না। জাগিয়ে রাখতে দিনের পর দিন গায়ে ঢালা হতো বরফ জল। জলের মধ্যে মাথা ঠেসে ধরে রাখা হতো। জল থেকে উপরে তোলা মাত্র নাকে-মুখে আবার ঢালা হতো জল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক রুম থেকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় দেওয়াল, সিঁড়ি ও মেঝের আঘাত লাগত মাথায়। কিন্তু কিছুই তো করার ছিল না। ‘মনে হতো আমি মারা যাচ্ছি!’
সিআইএ-র নির্যাতন নিয়ে ২০১৪ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল সেনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি। সেই প্রতিবেদনেও উঠে এসেছিল মজিদ খানের উপর নির্যাতনের বিবরণ। কমিটি সেই সময় জানিয়েছিল, নিজেদের সুবিধা মতো বয়ান আদায় করতে নির্যাতনের পথ বেছে নিতেন সিআইএ-র অফিসাররা। মজিদ খাবার খেতে না চাইলে সিআইএ অফিসাররা তাঁর পায়ুপথ দিয়ে খাবার ঢুকিয়ে দিতেন। নাকে নল ঢুকিয়েও খাবার খাওয়ানো হতো। বন্দি জীবনের ছ’বছর মজিদ কখনও দিনের আলো দেখেননি। একই অভিজ্ঞতা খালিদ শেখ মহম্মদ, ওয়ালিদ বিন আত্তাশ, রামজি বিন আল-শিব, আম্মার আল-বালুচিদের।
আলজাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্কের ফোটোজার্নালিস্ট সামি আলহাজ ছিলেন ‘কয়েদি নং ৩৪৫’। অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমেই একজন সাংবাদিককে স্বাগত জানিয়েছিল ‘মানবতাবাদী’ মার্কিন সেনারা। অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হল। ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল। একে একে জীবন থেকে অন্যায়ভাবে কেড়ে নিল ছয় ছয়টি বসন্ত। অতঃপর বলা হল, ‘আমরা সত্যিই দুঃখিত, তোমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই।’ আমেরিকার সযত্নে লুকিয়ে রাখা এক মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন হয়েছিল সেদিন। প্রশ্ন উঠেছিল, গুয়ান্তানামোতে যা হতো তা কি জেরা, নাকি সে-ও এক সন্ত্রাস!
২০১৬-র ২৩ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘এই একুশ শতকে আমাদের মতো দেশে এই জেল চালু রাখার অর্থই হল, আমরা যে মূল্যবোধকে মর্যাদা দিই, তার অমর্যাদা করা। ওই জেল চালু রাখলে যে, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত হয় না, তা প্রমাণিত হয়েছে। ওই জেল গোটা বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা হেঁটও করে দিয়েছে।’ সেদিন মার্কিন কংগ্রেসে ওই কুখ্যাত জেল বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, বিদায়বেলায় কার্যত একটি ‘গ্লাসনস্ত’ই ঘটিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকার ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কিন্তু তারপর? দীর্ঘ ছ’বছরেও বন্ধ হয়নি সেই প্রেতপুরী।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শুনিয়েছেন, এবার নিশ্চিত ইতিহাসে ঠাঁই পাবে গুয়ান্তানামো কারাগার। কথা দিয়েছেন তিনি।

20th     March,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা