বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

আইএসএল
কতটা প্রস্তুত কলকাতার দুই প্রধান?

প্রশান্ত ব্যানার্জি: আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। তারপরই ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ঢাকে কাঠি পড়বে। প্রথম কয়েকটি বছর এই প্রতিযোগিতাটিকে নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। একাধিক তারকা ফুটবলার থেকে শুরু করে জিকোর মতো কিংবদন্তি ফুটবল ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি আইএসএলকে অন্য পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লিগের মানও পড়তে শুরু করে। ভারতীয় ফুটবল দলের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। যাই হোক, দেশের এক নম্বর লিগ নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে। ব্যতিক্রম নই আমিও। এবারও প্রতিটি ম্যাচ দেখার চেষ্টা করব। ইস্ট বেঙ্গল ও মোহন বাগানের খেলা তো কোনওমতেই মিস করা চলবে না। 
গত মরশুমে শেষ মুহূর্তে আইএসএলে নাম লিখিয়েছিল এসসি ইস্ট বেঙ্গল। স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তুতির তেমন সুযোগ পায়নি। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। প্রাক-মরশুম শিবিরের বিকল্প কিছুই হতে পারে না। যা লাল-হলুদ ফুটবলারদের পারফরম্যান্সে ফের প্রমাণিত। সেই তুলনায় এবার দল গুছিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাচ্ছেন নতুন কোচ ম্যানুয়েল ডিয়াজ। পক্ষান্তরে, আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের কোচিংয়ে প্রায় একই দল ধরে রেখেছে এটিকে মোহন বাগান। রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামস, মনবীর সিংদের পাশাপাশি এ বছর হুগো বোমাস, জনি কাউকো, অমরিন্দর সিংকে দলে নিয়েছে তারা। আইএসএলে বাকি দলগুলির তুলনায় সবুজ-মেরুনের প্রস্তুতি আগেই শুরু হয়েছে। 
আইএসএলের সফলতম দল এটিকে মোহন বাগান। সাতবারের মধ্যে তিনবার খেতাব জিতেছে তারা। যার মধ্যে দু’বার দলকে সাফল্য এনে দিয়েছেন কোচ হাবাস। গত বছরও তিনি সবুজ-মেরুন ব্রিগেডকে ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু মুম্বই সিটি এফসি’র কাছে হার মানতে হয় রয় কৃষ্ণাদের। গত বছর তিনবারের সাক্ষাতে প্রতিবারই মুম্বইয়ের কাছে বশ মেনেছিল হাবাস-ব্রিগেড। এবার নিশ্চয়ই সেই পরিসংখ্যান মাথায় থাকবে সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের। 
এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে লড়াকু ফুটবল খেলেও নক-আউট পর্বে মুখ থুবড়ে পড়ে মোহন বাগান। উজবেকিস্তানের আল নাসাফের কাছে হাফ ডজন গোলে হারের লজ্জা বেশ ধাক্কা দিয়েছিল আমাকে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রতিপক্ষের শক্তি না বুঝেই অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হওয়ার খেসারত গুনতে হয়েছিল কোচ হাবাসকে। কারণ, মানের নিরিখে আইএসএলের যে কোনও দলের থেকে অনেকটাই এগিয়ে উজবেকিস্তানের ক্লাবটি। কিন্তু হাবাস তা বুঝতে পারেননি। একইসঙ্গে রক্ষণে তিরি ও সন্দেশের অনুপস্থিতির প্রভাবও পড়ে মোহন বাগানের পারফরম্যান্সে। ভুললে চলবে না, গত বছর এটিকে মোহন বাগানের আইএসএলের ফাইনালে পৌঁছনোর নেপথ্যে এই দুই ডিফেন্ডারের কৃতিত্ব অনেকটাই। আপফ্রন্টে রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসরা নিয়মিত গোল করলেও রক্ষণে ভরসা জুগিয়েছিল এই জুটি। তবে এএফসি কাপের আসরে তিরিদের অভাব ঢাকতে ব্যর্থ প্রীতম-শুভাশিসরা। তাই আইএসএলের আসরে তিরির দলে ফেরাটা অবশ্যই স্বস্তি জোগাবে সবুজ-মেরুন কোচকে। তবে সন্দেশ ঝিঙ্গানের অভাব ভোগাতে পারে। বর্তমানে দেশের এক নম্বর ডিফেন্ডার ও-ই। প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকাররা বেশ সমঝে চলে সন্দেশকে। এখন দেখার, ওর অভাব কীভাবে ঢাকেন কোচ হাবাস। রক্ষণ সংগঠিত করতে পারলে মোহন বাগান এবারও বহুদূর যাবে। 
গত বছর আইএসএলের তিনটি সাক্ষাতেই মোহন বাগানকে টেক্কা দিয়েছিল মুম্বই। এই পারফরম্যান্সের প্রধান কারণ মাঝমাঠের দখল রাখা। আমার মনে হয়, মিডফিল্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার লোকের অভাব ছিল হাবাসের দলে। মনে পড়ে, দু’টি ভূমিকা একসঙ্গে পালন করতে হতো আমায়। আক্রমণের সময় সতীর্থকে দিয়ে গোল করানো ছিল আমার কর্তব্য। ঠিক তেমনই প্রতিপক্ষ আক্রমণে উঠলে ডিফেন্ডারদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হতো। এবার হয়তো মোহন বাগানের মাঝমাঠে সেই অভাব ঘোচাবে হুগো বোমাস। ওর মধ্যে প্রকৃত লিডারের গুণ রয়েছে। পাশাপাশি সদ্য ইউরো কাপ খেলে আসা জনি কাউকোর উপরও নজর রাখতে হবে।  
এই এটিকে মোহন বাগানের প্রধান শক্তি আপফ্রন্ট। রয় কৃষ্ণা, ডেভিড উইলিয়ামসের পাশাপাশি মনবীর সিং, লিস্টন কোলাসোর মতো ভারতীয় ফুটবলাররা রয়েছে। হাফ চান্সকে গোলে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা ফিজির স্ট্রাইকারটির রয়েছে। প্রতিপক্ষ বক্সে ওর থেকে ভয়ঙ্কর স্ট্রাইকার এই মুহূর্তে আইএসএলে আর নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই মোহন বাগান সমর্থকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছে সে। 
ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে শুরুতেই বলতে হবে, এই দলটা নিয়ে আগাম কোনও মন্তব্য করাটা ঠিক নয়। কারণ, পুরোপুরি নতুন রূপে এ বছর ইস্ট বেঙ্গলকে আমরা দেখতে চলেছি। গতবার কোচ রবি ফাউলারের অধীনে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিল লাল-হলুদ ব্রিগেড। আসলে, তারকা ফুটবলার সবসময়েই ভালো কোচ হতে পারেন না। তাহলে ডিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাও কোচ হিসেবে যথেষ্ট সফল হতেন। গত মরশুমে ইস্ট বেঙ্গলের কোনও কিছুই ঠিক হয়নি। একে শেষ মুহূর্তে আইএসএলে নাম লেখানো। তারপর কোনওক্রমে দল গঠন। শুধুমাত্র কোচকে বিশ্বাস করে বিদেশি ফুটবলারদের সই করানো হয়েছিল। আর অবশ্যই ছিল পরিকল্পিত প্রস্তুতি অভাব। টুর্নামেন্ট শুরুর পর দলের সহকারী কোচ বলেছিলেন, ফুটবলারদের চিনতেই নাকি তাঁদের দুই-তিনটি ম্যাচ লেগেছিল। সেই দলের ফল কী হতে পরে, তা আপনারা সবাই জানেন। এবার প্রস্তুতির জন্য কোচ ম্যানুয়েল ডিয়াজ যথেষ্ট সময় পেয়েছেন। 
এ বছর ইস্ট বেঙ্গল দলে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। যার মধ্যে অবশ্যই গোলরক্ষক হিসেবে অরিন্দম ভট্টাচার্যকে সই করানো। গত মরশুমে এটিকে মোহন বাগান জার্সিতে ধারাবাহিকভাবে ভালো পারফর্ম করেছিল ও। তারপরও কেন অরিন্দমকে রাখা হল না, তা আমার ভাবনার বাইরে। হয়তো অমরিন্দরকে গুরুত্ব দিতে গিয়েই ওকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সবুজ-মেরুন টিম ম্যানেজমেন্ট। সেই সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে এসসি ইস্ট বেঙ্গল। গোলরক্ষককে বলা হয় লাস্ট লাইন অব ডিফেন্স। ফলে দুর্গপ্রহরী ভালো হলে বাকি দলেরও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। কারণ, এই ইস্ট বেঙ্গল দলের রক্ষণে নির্ভরতা দেওয়ার লোক তেমন নেই। আদিল খান, রাজু গায়কোয়াড়কে নিলেও এরা প্রত্যেকেই সেরা সময় কাটিয়ে এসেছে। বিদেশি ফুটবলাররা কতটা ভরসা জোগাতে পারে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। টমিস্লাভ মার্সেলা ও ফ্রাঞ্জো প্রেসের বায়ো-ডেটা বেশ চমকপ্রদ। তবে ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে তারা কতটা মানিয়ে নিতে সক্ষম হবে, তা সময়ই বলবে। মাঝমাঠ হল একটা দলের হৃদপিণ্ড। ফলে আইএসএলে ইস্ট বেঙ্গলের সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেকটাই মিডফিল্ডারদের উপর নির্ভরশীল। গত বছরের তুলনায় এবার একাধিক দক্ষ মিডিও দলে নিয়েছে ইস্ট বেঙ্গল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা অমরজিৎ সিং। এছাড়া রয়েছে জ্যাকিচাঁদ সিং ও রোমিও ফার্নান্ডেজ। 
লাল-হলুদের আপফ্রন্ট প্রসঙ্গে বর্তমানে একটা নাম খুব কানে আসছে। চিমা। এই নামটা কলকাতা ময়দান তথা ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আট ও নয়ের দশকে লাল-হলুদ জার্সিতে ময়দানে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল চিমা ওকেরি। এবার কি অন্য চিমাকে একইরূপে দেখা যাবে? আমার মতো এই আশায় রয়েছে ক্লাবঅন্ত প্রাণ লাল-হলুদ সমর্থকরা। চিমা ওকেরির মতো ড্যানিয়েল চিমাও নাইজেরিয়ার। দু’জনের পজিশনও এক। আরও একটা দিক মাথায় রাখতে হবে। টুর্নামেন্টের শেষ দিকে গোয়ায় গরম বাড়বে। আইএসএলে এবার স্প্যানিশ ও ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের প্রাধান্য। সেই তুলনায় ইস্ট বেঙ্গল দলে স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড় আছে। ফলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে তাদের। এছাড়া ভারতীয় ফুটবলারদের অনভিজ্ঞতা কীভাবে ঢাকতে পারেন কোচ ম্যানুয়েল ডিয়াজ, তা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। 
লিগের দ্বিতীয় ম্যাচেই এবার কলকাতা ডার্বি। ফলে এই ম্যাচের ফলের উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। গত বছর জোড়া ডার্বিতেই হারতে হয়েছিল এসসি ইস্ট বেঙ্গলকে। যার প্রভাব পুরো লিগে তাদের তাড়া করেছিল। এবছরও তেমনটা ঘটলে বিপদ আছে। তবে নতুন মরশুম। নতুন ডার্বি। ফলে অতীতের ফল ভুলে শুরু করতে হবে দুই দলকেই। একইসঙ্গে একটা কথা বলতেই হবে। বর্তমানে ডার্বি ঘিরে ফুটবলারদের মধ্যে সেই অবেগটা আর চোখে পড়ে না। আমাদের সময় দু’দলেই বাঙালি ফুটবলারদের উপস্থিতির হার ছিল অনেক বেশি। ফলে, বড় ম্যাচে জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে পারতাম। জিতলে নায়কের মর্যাদা আর হারলে বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়ত। সেই চাপ এখনকার ফুটবলারদের মধ্যে নেই। তার উপর, করোনার জন্য গত বছরের মতো এবারও গোয়ার দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলা হবে। তাই বাইরে উন্মাদনার লহর থাকলেও মাঠের ভিতর তা দেখতে পাওয়া যাবে না। হাবাস জানেন, ডার্বিতে হারলেও তাঁর চাকরি যাবে না। কিংবা রয় কৃষ্ণা গোল না করলে দল থেকে বাদ পড়বে না।  এসসি ইস্ট বেঙ্গলের কাছে এই ম্যাচের তাৎপর্য একটু হলেও বেশি। জিতলে মিলবে মোটিভেশন। আর হারলে? আত্মবিশ্বাস ঠেকবে তলানিতে। ফলে এবার কীভাবে লাল-হলুদ ফুটবলাররা এই ম্যাচে খেলতে নামে, তা দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছি।
একজন বাঙালি হিসেবে অবশ্যই চাইব, এবার ট্রফি আসুক কলকাতায়। সেক্ষেত্রে আমার বাজি অবশ্যই এটিকে মোহন বাগান। তাদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যাবতীয় রসদ রয়েছে। তবে একইসঙ্গে এসসি ইস্ট বেঙ্গল ভালো খেললে আমি খুশিই হব। নতুন দল। নতুন লড়াই। শুরুটা ভালো হলে ম্যানুয়েল ডিয়াজের দল চমক দিতেই পারে। একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে মুম্বই সিটি এফসি, এফসি গোয়ার উপরেও। গত বছর তারা ধারাবাহিকভাবে ভালো ফুটবল খেলেছিল। সেই তুলনায় হতাশ করেছে বেঙ্গালুরু এফসি। ভারতীয় ফুটবলে আত্মপ্রকাশের লগ্ন থেকেই বাগিচা শহরের দলটি সাফল্যের মুখ দেখেছে। তবে গত বছরটা তাদের ছিল না। বিশেষ করে সুনীল ছেত্রীর ফর্ম আমাকে বেশ উদ্বেগে রেখেছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর রিফ্লেক্সও অনেকটাই কমেছে। সতীর্থদের কাছ থেকে তেমন সহযোগিতাও ও পায়নি। যার খেসারত দলকে দিতে হয়েছে। 
অনুলিখন: সঞ্জয় সরকার
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
 সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস

7th     November,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা